হৃদয়ের একূল ওকুল #পর্ব_৩,পর্ব:০৪

0
848

#হৃদয়ের একূল ওকুল
#পর্ব_০৩,০৪
সুরভি হাসনিন
পর্ব-০৩

সন্ধ্যার পর নফ্রালীর গায়ে জীন ভর করেছে। তার কুদাকুদীতে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে মন চাইছে। এক হাতে বালতি অন্য হাতে ঝাড়ু নিয়ে একেক ঘরে ঢুকে বাড়ির চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। যেদিকে তাকাই সেখানেই চকচক করে। আমার ধারনা, কিছুক্ষণ পরে নফ্রালীর গায়ের থেকে চকচক্কা আলো বের হয়ে আমাদের ভেতর এলিয়েনের মতো ঢুকতে থাকবে। আমরা একে একে ভবিষ্যতের মানুষে রুপান্তরিত হবো। ঘটনা হলো, ভুইত্তামারা আসতেছে। আসর নামাজ শেষে মুনাজাত তুলেছি, আমার চৌদ্দ গুষ্টির নাম মনে করায়ে, বুক কাঁপায়ে মোবাইল ফোনটা বেঁজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার, ধরি কি ধরি না করতে ধরেই ফেলেছি। ওমা! আবদুল্লাহ মিয়া, আমাকে না জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছি, কোন সমস্যা নাই তো? সরাসরি বলে দিলো, আগামীকাল আসবে। বাড়ি ঘর যেনো পরিষ্কার থাকে। তারপর থেকে এই নফ্রালীর নাচনকুদন শুরি হয়েছে। এক ফাল দিয়ে একঘরে গিয়ে আরেক ফালে অন্য ঘরে যচ্ছে। বিষয় খানা দেখে গা রাগে কিরিকিরি কিটকিট করছে।

— এমন ভাব, জানি সৌদি বাদশাহ, ‘শেখ ভুইত্তামা তেলের টিন ‘আসতেছে।
— এইডা কে ভাবী? এই বাড়িতে তেলের কুনু অভাব পরছেনি। আল্লার দয়ায় মিয়া ভাই আসতাছে। আল্লাহ দান, বংশের শান।
–দূর হও বিয়াক্কল আলী। আবদুল্লাহ মিয়ারে দরজায় অভ্যর্থনা দিবা না? এক কাজ করো, একটু হলুদ বাইটা বাটিতে রাখো। হে আসলেই গান বাজাইবা, ‘হলুদ বাটো মেন্দী বাটো’। এ গানের সাথে আবদুল্লাহ মিয়ার এন্ট্রি হবে। গালে তখন লাগায় দিবা কাঁচা হলুদ। একটা কালা চশমা জোগাড় করতে পারবা? আমি তখন ‘ড্যান্স ‘দিলাম। তুমিও লুঙ্গী ড্যান্স দিবা। কুদাকুদী যেমনে শুরু করছো, বাড়ি ঘরে ভুমিকম্প হইতে আছে।

নফ্রালী গোলগোল চোখ করে ভুত দেখার মত তাকিয়ে আছে। সুমনা ওর তেঁতুল গোলা থেকে আমাকে একটু দিয়ে গেলো। মহানন্দে চেটে চেটে তেঁতুল গোলা খাচ্ছি। শশুড় আব্বা আমাকে দেখে দুই গাল বিস্তৃত এক হাসি দিলেন। একটু পর আম্মার ঘরে গেলাম। বুড়ির ঔষধ ফুরিয়ে ছিলো। গিয়ে দেখি ‘মানু বিবির’ পালঙ্কে বুড়ি গহনাগাটি ছিটিয়ে রেখেছে। শশুড় আব্বা পালঙ্কের পাশে আরাম কেদারায় দোল খাচ্ছেন। ঘরের ভেতর সুখী সুখী পরিবেশ। হায়, আমার জীবনটা ত্যানা ত্যানা হয়ে গেলো।

–আমি খুবই খুশী হইছি। সু-সংবাদ এত জলদি জলদি পাবো ভাবি নাই। লও বউ, এই বালা খান তোমারে দিলাম।
–কিসের সু-সংবাদ। ও আপনের ছেলে আসতেছে। আসুক।
–আমার পুলা তোমার স্বামী। তুমি খুশী হও নাই?
–ব্যপক খুশী হইছি আম্মা। খুশীতে দুই রাকাত নফল নামাজ পইরা নিসি। উনি আসলেই কদম বুসি কইরা হাত পাও সোনা রূপার পানি দিয়া মুছায় দিবো।

বালা হাতে দিলাম, ঢলঢল করে। বালা হাতের বদলে বাজুবন্দ হয়ে যাচ্ছে। বুড়ি দেখি বুড়োর সাথে মিটিমিটিয়ে হাসে। বুড়ো শশুড় বুড়িকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমি বেরিয়ে এলাম। বাহ, ভুইত্তাটা আসা উপলক্ষে প্রতি বার এমন গহনা গাটি পেলে আমি মালামাল হয়ে যাবো। লাভের উপর ডাবল লাভ। এইখানে কোন ঝামেলা নাই। উল্টো বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।

আবদুল্লাহ মিয়া হাত ভর্তি করে বাজার নিয়ে ফিরেছে। আসার পথে আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে তাদের সালাম জানিয়েছে। আমরা আর নাইওর যাচ্ছি না। আবদুল্লাহ মায়ের পায়ে বিদেশী লোশন লাগিয়ে খুব করে ডলে দিলো। শশুড় আব্বাকে পুকুর পাড়ে বসিয়ে দাঁড়ি চুল ছাটাই করে গোসল করালো। দুটো শান্ত সরল শিশু যেন আদরে মহা আনন্দিত। আব্বা দু’হাত তুলে আবদুল্লাহ’র জন্য জোরে জোরে দোয়া করলেন। শাশুড়ী আম্মা কাঁদুনী বেগম, আরো কেঁদে কেটে বালিশ তোষক ভিজিয়ে ফেলেছে। পাকের ঘরে আজকে আমার উপর দায়িত্ব ‘মাষকলাই ডালে মাছের মাথার চিকন বাগাড়’। তবু ভালো কিছু রান্না শিখে নিয়েছি। এখন ভর দুপুরে রান্নাঘরের কালি ঝুলির মধ্যে যেতে হবে। কড়াইয়ের মধ্যে তেল ঢালতে আবদুল্লাহ মিয়া হাজির।

— হাঁটু সমান তেল দিয়ে কি গজার মাছ ভাজবা? এক চামুচ সরিষার তেলে কয়েকটা কালিজিরা আর কাঁচা মরিচ দিয়ে মাষের ডাল দাও। হালকা ভাজা হলে গরম পানি ঢালবা। মাছের মাথা লবন হলুদ মাখায় ভাজো। এক দুইটা এলাচ দানা দিবা। তেল মশলায় মাথা কষায় রাখো। ডাল সিদ্ধ হলে, মাথা ঢেলে দিবা। জিরার ফাঁকি দেও, বাসনা পাতা কুচি দিয়া নামাবা। এক ডাল তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়া শেষ। সরিষা শাকে বেশী করে রসুন কুঁচি দিবা। আব্বা পছন্দ করে।

–আপনে রান্না পারেন? আপনেই রান্দেন। আমি কেনদিন রান্না ঘরে ঢুকি নাই।
–বউ থাকতে আমি কেন রাঁধতে যাবো। যদি দরকার লাগে তখন রাঁধলাম।
–আপনের এই বাংলা ইংরাজি মিলানো কথা কওয়া বন করেন। গায়ে বিছলা পাতা লাগে।
— বাংলা ইংরাজি মিলায় কথা বলছি কখন। বিছলা পাতা কি জিনিষ মুনা?
–আবার বলে মুনা। আপনারে বাইট্টা নামে ডাকতে না করছিলাম। বিছলা পাতা হইলো বিছুটি পাতা। লাগাইবেন?
বাংলা ইংরাজী কথা মানে, শহইরা আর গ্রামের কথা মিলাইন্না কথা।
— দেখো, আমি গ্রামের ছেলে। চাকরী করতে ঐ ভাষাটাও বলতে হয়। পোষাকী ভাষা বাড়িতে বলতে ভালো লাগে না।

হাই তুলতে তুলতে আবদুল্লাহ মিয়া উল্টা দিকে হাঁটা দিয়েছে। বজ্জাত লোকটা ইচ্ছা করে আমাকে বিপদে ফেললো। চামে চামে কথা শুনিয়ে দিছে। একবার সুযোগ পাই, আমিও তারে দিয়া যদি লাল মরিচ না বাটাইছি, তো আমার নাম ও মায়মুনা না।

(চলবে)

#হৃদয়ের_একূল_ওকুল

#পর্ব_৪

নতুন বউয়ের বাপ – মা এমন ঘণ ঘণ শশুড়ঘরে আসলে বউয়ের বাড়ির সম্মান নষ্ট হয়।মর্জিনা ফুফু সবসময় বলতো, ‘মাইয়ার শশুড় ঘর, যাইবা মরনের পর’। মেয়ে মরো মরো হলে নাকি বাবা মায়ের শশুড়বাড়ি যেতে হয়। এখানে উল্টো নিয়ম। আবদুল্লাহ মিয়া তার শশুড়ঘর দাওয়াত দিয়েছে। শশুড় আব্বা বন্ধুর সাথে দাবা খেলতে শুরু করেছেন। আম্মা পাক ঘরের কোনায় সঙ্গে করে আনা ছয় বাটির টিফিন বাক্স খুলে খাবার বের করছে। আম্মার আনা খাবার দেখে মনে হচ্ছে, দুনিয়াতে যদি বারো বাটির টিফির ক্যারিয়ার থাকতো, আম্মা তাতে খাবার ঢুকিয়ে আনতো।

— এই গুলা আনতে গেলা ক্যান আম্মা। আমি কত কিছু রান্না করলাম। আগে জানাইতা। আমার কষ্ট কম হইতো।
–তুই রান্না করবি তোর সংসারের জন্য। আমি আনছি আমার আরেক মেয়ের জন্য। সুমনা কই ওরে ডাক।

সুমনাকে ডাকা লাগলো না। সে পাকের ঘরের দরজায় উপস্থিত। আম্মাকে কদমবুসি করে আম্মার হাত পা মসেহ করে দিলো। আম্মা সুমনাকে কপালে চুমু দিয়ে অন্য আরেকটা টিফিন বাটি ওর হাতে দিলেন। ওটা নাকি শুধু সুমনার। আমার কথা আম্মার মনে ছিলো না। সুমনার জন্য আলাদা বাটি তরকারী হয়। আমার বেলায় ঘন্টা। আম্মা মনের ভাব বুঝল কিনা, টিফিন বাটি থেকে ভুড়ি ভাজা বের করলো। আম্মার হাতের ভুড়ি ভাজার স্বাদ যে একবার খেয়েছে, সে বাকি জীবন মনে রাখবে। যদিও এই বিদঘুটে।জিনিষটা পরিষ্কার করতে গিয়ে আম্মার হাত ফালাফালা হয়ে যায়। তবু মেয়ের পছন্দের জিনিষ বলে কথা। লাল লাল ভুড়ি ভাজি কড়াই টেলে গরম করে কাঁচের পিরিচে আলাদা ঢেকে রাখলাম। কাঁচা পেয়াজের এক কামড়ের সাথে বড় লোকমার ভুড়ি ভাজা ভাত খেলে সব দুঃখ উড়াল দেবে।

সারা দুপুর রান্না করে গরমে তেজপাতা হয়ে গেছি। কলের পানিতে মাথা ঠান্ডা হবে না। সাথে ভুইত্তামারার জ্ঞানী আলোচনা শুনেও চান্দি বেজায় গরম। পুকুরে একটা ডুবানী না দিলে চলে না। বাড়ির পুকুরটা খুব সুন্দর। লাল ইটের বাঁধানো ঘাটে দশ সিড়িতে ঘাটলা। এক পাশে অন্দর মহলের কথা ভেবে ট্যাপের পানির সাথে পোষাক পাল্টানোর পাকা জায়গা করা আছে। বাড়ির চৌহদ্দীর ভেতর পুকুরে এ পাশে কেউ আসে না। পাকা ঘরে কাপড় রেখে পুকুরে নেমে গুনে বারোটা ডুব দিলাম। এ মাথা থেকে ও মাথা সাঁতরে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বাজি ধরব কার সাথে। শাহিনা থাকলে শাহিনার সাথে বাজি ধরা যেত। বাজিতে জিতে চার ডজন কাঁচের চুড়ি কিনতাম। শাহানাকে দুই ডজন দিয়ে আমি দুই ডজন হাতে পরে পাড়া বেড়াতে যেতাম। নজমুল ভটভটি নিয়ে আমাদের পেছন পেছন ঘুরত। কই গেলো শাহিনা, কোথায় আসলাম আমি, আর কোন মরায় নজমুল হালার পো মরেছে, কে জানে? হাবি জাবি ভাবতে ভাবতে দেখি পুকুরের পানি থেকে কে জানি মাথা তুললো ওমা! এতো দেখি আবদুল্লাহ মিয়া। এ লোক কোন মতলবে পানির মধ্যে হান্দায় ছিলো।

–আপনে এই খানে কি করেন। মহিলা মানুষ পুকুরে নামছে চোখে দেখেন না। কানা বেডা।
–বাড়ি আসলে আমি পুকুরে গোসল করি। গায়ে ধুলা বালি, সবুজ পাতা, নরম পুকুরের পানি না লাগালে মানুষের মন পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়।
–খাইসে রে, থামেন। এখন উইঠা যান। ডুব দিতে পারতেছি না। বেগানা বেডা পুকুরে থাকলে ডুবান যায়?
–তুমি ডুব দেও। আমি উল্টা হয়ে দাঁড়ায় থাকলাম। তুমি কি আমারে ডরাও মুনা?
— হুর, আপনে হইলেন ভুইত্তা, থুক্কু জ্ঞানী আবদুল্লাহ মিয়া। আপনেরে ডরানের কিছু আছে?
–তুমি নাকি সাঁতার নিয়ে বাজি ধরো। দেখি কয় দমে ঐ পাড়ে পৌছাতে পারবা।
–আমি বাজি ধরি এই কথা আপনি কেমন করে জানলেন?
— শাহিনা আর ওর জামাইয়ের সাথে বাজারে দেখা। শাহিনা শুনলাম ওর স্বামীর সাথে ঢাকা চলে যাচ্ছে। তুমি চাইলে সন্ধ্যাকালে বাইক টেনে একবার ঘুরান দিয়া আসবো।
–শাহিনার সাথে দেখা করার অত দরকার নাই। আপনি বাজি লাগবেন? একশ টাকার বাজি। বাজিতে জিতলে কচকচা একশত টাকার নোট দিবেন।
–আর যদি হারো, তাইলে কি হবে? তুমি আমাকে কয়শত টাকা দিবা।
— টাকা পয়সা দিতে পারব না। আমার আয় নাই, ব্যয় ও নাই।
–তাইলে যা চাই তাই দিবা? কিরা কাটো।
–কিরা মিরা কাটা লাগত না, দিলাম। বাজি শুরু।

ডুব সাতারে ও পাড় পৌছে দেখি, বত্রিশ পাটির তেত্রিশ দাঁত বাহির করে ভুইত্তামারা কেলাচ্ছে। ভুল করে একটা মিসটেক হয়ে গেছে। এই পুকুরটার কোনা কোনা ভুইত্তামারার চেনা। কোন দিকে কেমন পানি, সবটা সে জানে। আর আজকেই এই পুকুরে আমার প্রথম দিন। সে হিসাবে আজকে রেস ধরা ঠিক হয় নাই। আবদুল্লাহ পানি কেটে আস্তে আস্তে আগায় আসতেছে। এই মুহূর্তে খুবই শরম করছে। অথচ আমার রাগ করার কথা। আবার একটা ডুব দিয়ে সাঁতরে পাকায় উঠে দৌড়ে কাপড় বদলানোর ঘরটায় ঢুকলাম। কয়েক মুহূর্তের বিরতিতে দরজায় হালকা ধাক্কা। আবদুল্লাহ দরজা খুলতে বলছে। লোকটা এত জোর খাটাতে চাইছে কেনো। নিজের দেয়া কথা ভুলে গেছে। সংসার হলো তাঁতের মতো। চারদিক থেকে নানান রঙের সুতা এনে পাটি পাটি করে বুনন করতে হয়। কোন বুনন হয় ঘণ, কোনটা খুব পাতলা। ঐ একেক রকম বুননের মধ্যে একেক পরতে সুখ আর নোনাজল লুকিয়ে থাকে। শুধু শরীরের খেলা দিয়ে ঐ বুনন শক্ত হয় না। ভালোবাসার সাত রঙ মিলিয়ে দিতে পারলে ঐ তাঁত বাকি জীবন রঙিন হয়ে থাকে, সংসারে শত ভুল ফুল হয়ে ফোঁটে।

–কাপড় গুলা নাও মুনা। ঘাটে থুয়ে গেছো।
–বাইরে ফালায় থোন। আপনে যান তো। একদম বাড়ির ভেতর যাবেন। চেহারা যানি না দেখি আপনের, কুফা।

আবদুল্লাহর আওয়াজ শোনা গেলো না। ইচ্ছে করে ওকে ‘কুফা’ বলেছি। কাপড় ছাড়তে ছাড়তে মনে হলো, আজকে অমন করে এগিয়ে আসা আবদুল্লাহকে আমি কতদিন কি ভাবে ঠেকিয়ে রাখবো। বুকের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছি। এ লোককে আমি ভালোবাসি না। বিয়েটা আমার ইচ্ছায় হয় নাই। আব্বা আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে ‘কবুল’ বলেছি। এ বাড়িতে আছি, শশুড় শাশুড়ী মানুষ দুটা বয়োবৃদ্ধ। তারা আমার সাথে আমার মতন করে মেশে। তাছাড়া, এখান থেকে পালিয়ে আমি কোথায় যাবো। কার কাছে যাবো? কে আছে আমার? চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলাম, আপন মানুষ কে আছে। কি আশ্চর্য! এক নিকশ কালো আঁধার চোখের পাতা ভর করেছে। পৃথিবীতে একটা মানুষ আমার আপন নেই?

মুতালী বুড়িকে আজ খাবার টেবিলে নামিয়ে আনা হয়েছে। আবদুল্লাহ মিয়া নিজের হাতে তার মাকে মাছের লেজ বেছে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। এমন দৃশ্য এর আগে কোনদিন আমি দেখি নাই। বুড়ির চোখ দিতে গড়ায় গড়ায় পানি পরছে। হাত দুটো মুনাজাতের ভঙ্গিতে বুকের কাছে ধরা। আবদুল্লাহ অন্য হাতের তালু দিয়ে তার আম্মার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে। খেতে খেতে বুড়ির কাশি উঠে গেলো। আমি দৌড়ে পানি আনব, আবদুল্লাহ বুড়ির মুখের ভেতর থেকে আধ খাওয়া ভাতের দলা টেনে বের করলো। গা গুলোতে গিয়েও থমকে গেলাম। এত ভালোবাসা মায়ের প্রতি সন্তানের হয়? কেমন করে হয়! বুড়ি তার ছেলেকে কত আদর দিয়ে পেলেছে; আমার আম্মার চেয়েও বেশী আদরের ছিলো সে প্রক্রিয়া? মাথার ভেতর ভোঁতা ভোঁতা লাগছে। হাতের ভাত ঠেলে উঠব, আব্বা ডেকে বসিয়ে দিলো। শশুড় আব্বার দিকে তাকিয়ে আব্বা হাসছে। অত্যন্ত সুখী পরিবেশ। কোথাও কেন বিষাদ নেই, দুঃখ নেই, তবু আমার কেনো বুক ফেটে, চোখ ঢেলে এমন কান্না পাচ্ছে কেনো।

ভাতঘুম এড়িয়ে এলো চুলে বাড়ির ছাদে উঠলাম। আব্বা আম্মা কখন চলে যেতে চেয়েছিলো। দাবার এক দানে আব্বা আগায় আছে। তাই শশুড় আব্বা আরেক দান না খেলে তাকে ছাড়বেন না। আম্মা শাশুড়ী আম্মার সাথে কুটুরকুটুর গল্প করতে করতে পান খাচ্ছে। আমিও এক খিলি মুখে দিয়েছি। ও মাগো মা, জর্দা ভরা পান খেয়ে মাথা ঘুরানি দিচ্ছে। কয়েকটা ওয়াক ওয়াক তুলে শেষমেশ ছাদে এসে রক্ষা। খোলামেলা বাতাসে শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। বিকেলের এ সময়টা কেমন করা। কিসের জন্য এলোমেলো লাগে মন নিজে ও জানে না। আহারে জীবন, পানির মতন। কই ছিলাম উনিশটা বছর। আজকে এই বাড়ির বউ হয়ে আটকে আছি। চিরকালের চেনা আব্বা আম্মাকে দেখতে যেতে পারি না। আমার ঘর, গাছপালা, শীমের মাচান, লাউফুল, কুমড়ো বড়ির পাশে আম্মার দেয়া চালতার আচার। কিছুই কি আমার ছিলো না? এখন এই নতুন বাড়ির ইট কাঠ পাথরে নত হয়ে, মানিয়ে নিয়ে আমার করে তুলতে হবে। এ কেমন নিয়মরে তোমার উপরওয়ালা। কই আবদুল্লাহ মিয়ারে কি সব ছেড়ে আমাদোর বাড়ি গিয়ে উঠতে হয়েছে। তার জীবনের একটা দিন, নিয়মের আধাখানা ও তো বদলে যায় নাই। তবে, নারী জাতির জীবন এমন জলে ভাসা পদ্ম কেনো? সব আত্মীয়তার সম্পর্ক বিসর্জন দিয়ে ক্লান্ত লাগে কেনো এই মেট্রিক ফেল আমি, মায়মুনা নামের বোকা মেয়েটার।

–ভূতের সাথে কথা বলো মুনা? নীচে চলো, আম্মা ভাপা পিঠা বানাইছে। তোমাকে প্রথম পিঠা খাওয়াবে।
–প্রথম পিঠা আমার আব্বার সাথে আমি ভাগ করে খাই। ও এইটা তো আপনের বাড়ি। তাইলে আগে খাবে আপনার আব্বা। এরপর আপনে, তারপর আপনের আম্মা, এরপর আমার আব্বা, আম্মা, সবশেষে আমি।
— জিদ করো না সব বিষয়ে। আম্মা মানে তোমার আম্মা।
এ বাড়ির কেউ কখনো তোমাকে বলছে, এটা তোমার বাড়ি না? আমার বাড়ির মানুষ গুলা খারাপ না মুনা।
— কেউ বলে নাই। আপনের বাড়ির মানুষ গুলা খারাপ হইলে, এতদিনে আমি হাপুড় দিয়া নদী পার হয়ে শহরে চলে যাইতাম। তারা খুবই ভালো। অতিরিক্ত ভালো। তাই যেতে।পারতেছি না।
–কোথায় যাবা মুনা?

আবদুল্লাহ মিয়া হালকা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরে আসছে। তাকে দেখতে লাগছে কোর্ট পাড়ার ছোট উকিলের মতো। বুকের কাছের তিনটা বোতাম খোলা। এই পুরুষের সাথে লোক সমাজে আমার বাসর রাত হয়ে গেছে। আরো এক রাত কাটিয়ে দিয়েছি। আজকে ও বন্ধ দরজার পাশে আরেকটা রাত কেটে যাবে। কিন্তু আমরা কেউ কাউকে চিনি না। আবদুল্লাহ মিয়া আমাকে চেনার প্রচুর চেষ্টা করছে। আমিই ধরা দিচ্ছি না। এরকম বিবাহে ধরা দিয়ে জীবন নষ্ট করার কোন মানে নাই। আব্বা আম্মা আমার ভালো চাইতে গিয়ে বেশী খারাপ করে ফেলেছে। তাদের ভুলের মাশুল দিতে বাকি জীবন এই মধ্য বয়সী দাদু বুড়োর সাথে সংসার করার কোন মানেই নাই। একটা বিবাহ দিয়া জীবন চলে না। জীবন চলবে জীবনের গতিতে, আমার ইচ্ছায়। আজকে ষোল বছরের টুনটুনি হইলে এসব কথা চিন্তায় আসার কথা ছিলো না। কিন্তু উনিশ বছর বয়সের একটা মেয়ে এসব ভাবতেই পারে। কারো স্বপ্ন চারিনী না হয়েই স্ত্রী হয়ে সে আছি। বড়ই আজুবা।

পিঠার মধ্যে আম্মা তাল পাটালী দিয়েছে। কোড়া নারকেলের মিঠায়, তালপাটালীর সুবাসে পেটের সাথে বুক মোঁচড় দিচ্ছে। শীতের সকালে চুলার পাড়ে কাঁপতে কাঁপতে হাহু করে পিঠা গিলতাম। চালের গুড়ি গলায় আটকে গেলে, আব্বা মাথায় হাত বুলিয়ে মিঠা ডাবের পানি খেতে দিতো। তাদোর ছেড়ে কত দূরে চলে আসছি। পিঠার স্বাদ নোনতা লাগে। আম্মা কোনো মিঠাইর বদলে খাবলা নুন দিলো কিনা, দেখতে গিয়ে টের পেলাম, শশুড় আব্বা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এবার আর কান্না থামাতে পারলাম না। চোখের পানিতে ভেজা পিঠাটা কামড়ে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আব্বা ও চুপিচুপি চোখ মুছছে। আবদুল্লাহ মিয়া বেরিয়ে গিয়ে ফিরে এলো।

— ওরে একটু গঞ্জের থেকে ঘুরায় নিয়া আসি আব্বা। মন খারাপ হইছে মন লয়।
— আমি কোথাও যাইতাম না। আমি আব্বা আম্মার সাথে বাড়ি যাবো।
–আইজ যাইতা পারতা না আম্মা। তোমার মর্জিনা ফুফুর ছেলের বিবাহ লাগছে, আমরা আইজ সেখানে মেয়ে দেখতে যাবো। তুমি জামাই সহ তোমার শশুড় শাশুড়ী লয়া আসবা। আয়োজন করা লাগব তো নাকি।

আম্মার জোরাজুড়িতে তৈরী হতেই হলো। সবার মনে সন্দেহের বীজ তৈরী করে লাভ নেই। সহজ থাকায় লাভ আছে, জটিলতা কম হয়। সুমনার জন্য কিছু দরকারী জিনিষের লিস্ট তৈরী করে নেয়া হয়েছে। নফ্রালী আবদুল্লাহ মিয়ার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে কিছু একটা বললো। আবদুল্লাহ চমকে উঠে সামলে নিয়েছে। বিদায় নিয়ে বাইকের পেছনে উঠলাম। শাড়ি পরে বাইকের পেছনে চড়ার মতো ঝামেলা দায়ক কাজ আর নাই। নিচে দিয়ে খালি বাতাস আসে আর যায়। আঁচল সামলালে চুল খুলে পশ্চিম দিকে উড়াল দেয়। চুল ঠিক করলে, আঁচল উড়ে পুব দিকে পাখনা মেলে। সব গোছগাছ করে বসতে বাতে আবদুল্লাহ মিয়া বাইক ধরে দিলো এক টান। বেটার মনে হয় তাড়া আছে। নয়ত ঐ রকম তুফান মেল ট্রেন কেউ বাইকে ছোটায়? উড়ে গিয়ে পরলাম তার পিঠের ওপর। ইচ্ছে করে আমাকে আছাড় খাওয়ালো ভুইত্তাটা। লোকটা একটা বড় বেহায়া, সাক্ষাৎ শয়তানের চ্যালা। পুরো রাস্তা বরফ পানির বরফ হওয়া পুতলা হয়ে বসে থাকলাম। পাশ দিয়ে হাত ঠ্যাং চ্যাগানো কয়টা মেয়ে গেলো। কয়েকটা আবার নিজে নিজে বাইক চালায়। ‘বিহায়া মেয়েছেলের দল’ সব। বাগে পাইলে এগুলারে কঞি দিয়া বাইড়াইতাম। হাটের মধ্যে ঘুরাঘুরি করতে ভালো লাগছিলো না। আবদুল্লাহ মিয়া আমাকে একটা মনোহরি দোকানে বসিয়ে রেখে গিয়েছে। হাতে সবুজ আইসক্রিম নিয়ে চেটে চেটে খেতে খারাপ লাগছে না। শৈশব ছাড়ায় আসছি মেলা দিন আগে। তবুও আমার বুকের মধ্যে কোথা জানি ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে লুকায় বসে আছে। ফেরার পথে বাইকের আয়নায় নিজের জিহ্বাটা দেখে নিলাম টকটকা সবুজ রঙের জিহ্বা দেখতে হাসি পাচ্ছে। বাইকের আয়না থেকে চোখ সরাবো, পিছনের মানুষটারে দেখে থমকে গেলাম। নজমুল আমার পেছনে ঠিক কখন থেকে আসছে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here