#হৃদয়ের_একূল_ওকুল
#পর্ব১২
কলেজের প্রথম দিন এত এত পোলাপাইনের ভিতরে নিজেরে কেমন বেখাপ্পা লাগছে। আজকে জীবনের বড় একটা সময়ে আব্বা আম্মা সাথে নাই। একা একা লাইনে দাঁড়ায়ে টাকা পয়সা দিলাম। রিসিট নিয়া অফিসঘরে জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়াইছি, ইয়া লম্বা অজগরের সমান লাইন। লাইনের শেষ আছে, মাথা নাই। তার মধ্যে হাভাইত্তা আমি খাড়ায় খাড়ায় কলমের ক্যাপ দিয়া কান চুলকাইতেছি। আতিক্কা, কান্ধের উপর বিশাল চোপাড় খাইলাম,
–বান্ধবী, তুই কলেজ ভর্তি হইছস? দুলাভাই কই। কি সোন্দর মানুষটা তোর কপালে জুটছে রে। আমার জামাই প্রথম প্রথম কত সোহাগ, অখন হুগনা ভাতের ভিত্রে শুটকী মাছের পাইন্যা ছালুন।
— ভুইত্তামারা বেডা একটা জুটসে আমার কপালে। বেডা এমন রাম ছাগল, মুখে ও কইতে পারে না, সে আমারে মোহাব্বত করে। ঘুষ দিয়া চিঠি মারে, আমি কি কচি কৈতর, যে চিঠি পায়া উইড়া গিয়া তার বুকে পতপত কইরা ঝাপ দিমু। শাহিনা, তুই আর মানুষ পাস না।
— তোর কপালের লগে আমার কপালডা ঘইষ্যা দে মায়মুনা।তগো দুলাভাই যদি সারাডা দিনে আমারে একটা ফুন দিতো।
–হালার বেডারে কাইচ্যা কনি মারস না ক্যারে। তুই ও, আরে আমার সোহাগের পিরিতিরে। জামাই তো না, যেন তুলার পোটলা। আয়লো তুলা, বয়লো তুলা।
— বিয়ার পর কি তুই পাগল ছাগল হয়া গেসস মায়মুনা! জামাইরে কেউ কনি মারে? যাহ্, তোর লগে থাকলে আমার সংসার করন লাগতো না।
বিয়াক্কলের ঘরের বিয়াক্কল শাহিনা হাইটা চইলা গেলো। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, পাশের টেবিলে হেলান দিয়া নজমুইল্লা আমাদের সব কথা শুনছে।
–কি প্যাটটা ভরসে নি তোমার নজমুল। আইজ বাইত গিয়া চাচীর কাছে আর ভাত মাত চাইবা না। এতডি কথা খাইলা, প্যাটে গুড়গুড়ি দিতাসে না? যাও গিয়া ইনু খায়া লাও।
— তোমার লগে জামাই মিয়ার মিল মোহাব্বত নাই। যাক, নিশ্চিন্ত হইলাম। এত বড় একখান জিনিষ লুকায় রাখসো। হেদিক দিয়া তোমার আম্মা সারা গেরামে কইয়া বেড়ায়, জামাই -সংসার নিয়া তোমার বলে দম ফেলানির ফুরসত নাই। জামাইয়ের লগে মিল না থাকলে আর কামডা কি সংসারে।
— তোমার টুনির আন্ডা বেরেনে যদি এই তা বুজতা, তয় তো আর ফেল মারতা না, পাডা। অক্ষণ, চোক্ষের সামনে থেকা যাও। নয়ত, এমুন জোরে চিক্কুর পাইড়াম, সবতে মিল্লা শশা ছোলানি দিব।
নজমুল কলার ঠিক করতে করতে, সানগেলাস উপ্রে ছুইড়া চোখে পরতে গিয়া উল্টায় ডাবল উষ্টা খাইলো। সারা লাইন জুইড়া হাসাহাসির ধুম পরছে। এই ফাঁকে আমি সামনে গিয়া কাজ সাইরা নিসি। আবদুল্লাহ মিয়ারে কইছিলাম চইলা যাইতে। বাহির হইয়া দেখি, সে কটকটা রোদে দাঁড়ায় দরদর ঘামতেসে। তার হাতে দুইটা আইসকিরিম। দৌড়ায় আইসকিরিম গুলা হাতে নিলাম। ছাগলা বেডা আইসকিরিম গুলা পরে কিনলেও হইতো। কলেজের ক্যান্টিনে আইসকিরিম গুলা জমা রাখছি। ফিরা আইসা দেখি, ভুইত্তা বেডা ডাবল ভুইত্তা হয়া আছে।
— তুমি অমন দৌড় দিলা কেন মুনা। এত গুলা লোকের সামনে মহিলা মানুষ দৌড়াইতেছে, দেখতে কেমন লাগে।
— ও মাইয়ো মা। আপনেই না আমার মেডেল দেইখা খুশি হইছিলেন। আমার দৌড় পাইরা অভ্যাস আছে। আর শুনেন, কেডায় কি ভাবলো, হেয় নিয়া মায়মুনা বেগমের ভাইবা কাম নাই। টেকা দিয়া কিনসিলেন না জিনিষটি, গইল্লা গেলে কোন হমুন্দী আয়া আবার কিন্যা দিব আপনেরে।
— তোমারে কত দিন বলছি, মুখের কথাটা লুৎফার কাছে ঠিক করে নাও। এমন কথা কলেজে বললে, বার করে দিবে তোমারে। বুঝা গেছে, মায়মুনা বেগম?
মুখ ভেংচায়া আইসকিরিম আনতে আবার দৌড় দিলাম। আইজ আমার ২৬ শে মার্চ। মানে স্বাধীনতা দিবস। ফেল করা জীবনে কোন দিন চিন্তাও করি নাই, আমি একদিন কলেজ যামু। সব সম্ভব হইলো আবদুল্লাহ মিয়ার জন্য। লোকটা গল্পের বইয়ে পড়া পীর সাবের লাহান। এর পড়া পানি খাইলে বৃদ্ধা যুবতী হয়া যাবে, হারানো জিনিষ ফিরা আসবে, মরা মুরগী কক্কক কইরা ডাক পারবে। এই জিনিষরে আব্বা আমার গলায় ঝুলাইছে রে। ইয়া মওলা, তোর কাছে হাজার শুকরিয়া, তবুও জিনিষের দয়ায় জীবনের ঘাটে নৌকা পাইলাম। আবদুল্লাহ মিয়ার বাইকে উইঠা বাড়ির দিকে পথ দিসি। নজমুল আইসা আবদুল্লাহ সাথে যাইচা কথা শুরু করোলো। হাত মসেহ, বুকে বুক মিলায়া সুন্নতী কায়দায় সব রকমের আদর সোহাগ শেষে যখন থামছে, আমি আর নিজেরে ধইরা রাখতে পারলাম না,
— আহা আহা জোড়া সুখ পক্কিডি,কত দিন পর তোমরার দেখা হইছে গো। চুমাডি বাদ রাখলা কেন। হেই কামডাও সাইরা লও। বেডায় বেডায় এত আঞ্জাআঞ্জি কিয়ের কাম? নজমুল, বাইত যা। চাচীরে সালাম দিস। তোরে দেখতে আর মন চায় না।
— মায়মুনা ও কাশেম ভাইয়ের আত্মীয়। খুব ভালো ছেলে। কতদিন ওর আম্মার বানানো হাঁস নিয়া আসছে। লুৎফা চাউলের রুটি বানায় খাওয়াইছে।
–আইজ রাজহাঁস ধইরা জবে দিয়া এমনে রাইন্দা খাওয়ামু, মনে কইবেন, হাঁসডা তখনি পক্ষি হয়া আপনারে লয়া উড়াল দিবো। ছোঁচা বেডা, লন বাড়ি যায়া ভাত খামু। আপনের লক্ষী পক্ষীর লগে আলবিদা করেন।
নজমুল একটু মন খারাপ করসে বুঝি। কিন্তু তার চেয়ে বেশী মন খারাপ যে আবদুল্লাহ মিয়া করছে, এটা বাসায় গিয়া বুজসি। হাজার হইলেও স্বামী মানুষ, তার উপর তাজা তাজা পত্র দিয়া মায়মুনাকে বশ করতে যে চায় সে কুনু কমসম ঝানু পাবলিক না। ভাত খাইতে বইসা আবদুল্লাহ মিয়া দেখি ভাত নাড়ে চাড়ে,
— নজমুল তোমার ছুডু কালের দোস্ত মুনা? তুই -তুমি ডাকো। আমার এমন কোন দোস্ত নাই মুনা জানো? অফিসেও কথা কম বলা মানুষ আমি। পান বিড়ির অভ্যাস নাই, তাই সবার সাথে মিলে না।
— আপনের মিলতো ও না। কাপড়ডি কি পরেন। ঝুইল্লা পরে এমুন। খইস্যা খইস্যা হাডেন। টাইট ফিট হয়া থাকতে পারেন না? বেডা যাইত এমন ল্যাদব্যাদোর হইলে কিরুম লাগে দেখতে জানেন, ছ্যাদরাইন্না লাউ।
— তোমার জন্য হইলেও আমারে পাল্টায় ফেলব মুনা। মুখে মুখে কত কথা বলি, কিছু মনে নিও না। তোমারে…
কথা বলতে বলতে আবদুল্লাহ মিয়া খুব কাছে আসছে। আমি টের পাই তার দ্রুত উঠানামার নিঃশ্বাস। পুরুষ পুরুষ গন্ধ নাকে লাগে, শিকারী বাঘেরর ঘাড়ের লোম ফোলা এক অন্য আবদুল্লাহ মিয়া তার পৌরষ নিয়া জাগছে। ঝট কইরাউইঠা খাড়াইলাম,
–নজমুল আমার লাইগা বিয়ার দিন অপেক্ষায় আছিলো। আমি ইয়েস নো কইলেই আমারে নিয়া পলাইতো। আব্বার ডরে পলাই নাই। তয় আপনে ডরায়েন না, আমি আর পলাইতাম না।
আবদুল্লাহ মিয়ারে পিছ দিয়া ঘরে ঢুইকা দরজা আটকায় দিলাম। এ মানুষরে আমি কত দিন ফিরায় দিব। কেমনে ফিরাবো। আজকে না হয় নজমুলরে দিয়া ঘা দিসি। তারপর? দিন দিন সে কি দিয়া মানব। স্ত্রীর প্রতি দায় দায়িত্বে একশতে তারে চোখ বুইজা দুইশ দিতে পারি। নিজের চেয়েও যানি কবে থেকা তারে বিশ্বাস করা শুরু করছি। মন নরম হয়ে আসলে মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালা শুরু করসি। এ লোক ডেঞ্জার লাইনে খাড়ায় আছে। তারেই বোঝাইতে হবে। দুয়ার খুইলা দেখি আবদুল্লাহ মিয়া একটা হালকা নীল রঙের সোয়েটার ঝাড়তেছে। এইটা আব্বার।
–আব্বারে একটা সাফারী বানায় দিবা মুনা। তোমার রোজগার থেকা দিও। বাপ মায়ের আশা হিয়ার দরকার নাই, ভরসা হবা। তারা যেন চোখ বন্ধ করে তোমারে বিশ্বাস করতে পারে।
–আপনের আম্মা আব্বারে শাল বুইনা দিবো। উল আইনা দিয়েন।
— আমারেও দিও। তোমার ভালোবাসা না পাই, হাতের ছোঁয়াটাতো পাইলাম।
লোকটা হাসতে হাসতে বাহির হইছে। এই ইলিয়াস কাঞ্চন লোকটারে নিয়া আমি বিপদে পরছি। সে তার দিলদার রূপে ফিরা গেলে আমি বাঁইচা যাই। তার সাথে অঞ্জু ঘোষ মার্কা কথা বলতে মন চায় না। আইচ্ছা, খাড়াও চান্দু। অঞ্জু ঘোষের লাহান পেত্নী সাইজা তোমারে দেখামু। না বাবা, থাক। সে যদি সত্য সত্য প্রেম পিরিতি ভাইবা জড়ায় ধরে! আউযুবিল্লাহ হিমিনাশ শয়তানির রাজিম। ঐ আমার ভিত্রের শয়তান, তুফানী বুদ্ধিডি কম দে। শ্যাষে নিজের জালে নিজেই বাইন্দা যামু।
নানী বুড়ির পুতিনের গায়ে হলুদের দাওয়াত পাইছি একখান। হলুদ শাড়ির সাথে গেন্দা ফুলের মালা দিয়া সাজাগুজা করতে হবে। আবদুল্লাহ মিয়ার জন্য একটা হালকা কমলা রঙের মধ্যে সবুজ কাপড়ের জোড়া দেয়া পাঞ্জাবী কিনছি। মরিচ বাত্তি দিয়া বাড়ি সাজাইছে। খাসী কবি খুব দৌড়াদৌড়ি করতেছে। রান্দা বাড়ার জায়গা থেকা ফাল পাইড়া ছাদে যাইতেছে, আরেক দৌড় দিয়া নানীর কাছে টেকা আইনা সদাই কিনতে দিতেছে। আবদুল্লাহ মিয়া আজকাল অফিস নিয়া খুব ব্যস্ত। সাত সকালে যায়, ফিরে রাইতের বেলা। খায় কি খায় না, হিসাবপত্র নিয়া টেবিলে বইসা যায়। আমার সাথেও আগের মতো রঙের আলাপ নাই। শুধু ক্যালকুলেটর চাইপা হিসাব করে। লুৎফা খানমরে একদিন জিগাইসি, ‘আবদুল্লাহ মিয়ার কিসের এত কামকাজ জমছে, বাইত নিয়া আসে’। লুৎফা ছিনালী হাত পা উল্টায়া আমারে মাত্র বলতে যাবে,কাশেইম্যা চোরা আইসা উপস্থিত। আমার কিছু শোনা হয় নাই। কাশেইম্যা রোজ সকাল সকাল আবদুল্লাহ বাইর হওয়ার পর আমার ঘরের দরজায় আইসা খাড়ায়। আমি টের পাই। আওয়াজ করি না। আবদুল্লাহ মিয়ার ঝামেলায় না তারে কিছু বলতে পারি, আবার বাড়িটা ছাড়তে দিলে দেয় না। খাসী আমারে ডাকতে আসছে,
— আপা, নিচে লন, নাচ শুরু হইব। ভাই কই। আবদুল্লাহ ভাই আপনে মিলা লুঙ্গি ডান্স দিবেন।
— লুঙ্গি খুইলা ডান্স দিওন লাগবো? না পইরা ডান্স দিবেন। এইডা আবার কিরুম ডান্স। আমার বাপের জন্মে এই ডান্সের নাম শুনি নাই। আপনে দিয়া দেখান তো।
খাসীর সাথে বুড়ির বাড়িতে গেছি, আল্লাহ গো আল্লাহ, দুনিয়ার সব ঢঙ্গের কলসী গলায় বাইন্দা মাইয়া পোলা হাজির হইছে। ঠ্যাংয়ের সমান বাইচ্চা মাইয়াডির সাজ দেখা ভয় পাইছি। কথার কি ছিরি অগো। বোরো মোরো ডাইক্কা একটা আরেকটার লগে কথা কয়। আবার ডাকে গপ, বপ। মাইগো মা, কি আজিব রঙ্গিন দুনিয়া আছেরে।
পোলাপাইনডি এমন কুইজ্যা কুইজ্যা হাঁটতাছ। ওমা! ওড়না দেহি মাডিত গড়ায়। তর আম্মায় এডিরে দেখলে পিছা দিয়া পিডায়া নালায় লাইতো রে মায়মুনা। আব্বা পোলাডির লম্বা চুলের মুঠি চাইপ্পা খিচা মারতো। কি রঙ্গ রে বাপ! ঘরের এক কোনায় দুইটা আখাম্বা বাক্স বসাইছে। কি জোরে জোরে গান বাজতাছে ওগুলার থেকা। খাসী ভাই কইলো এডি বলো ইস্পিকার। মাইয়া পোলার লগে বুড়ি বুড়ি নানীরা নাচতে লাগছে। কাশেইম্যারে দেখলাম চিকনা একটা পায়জামার লগে হইলদা জংলি ছাপের একটা শার্ট গাত দিয়া ঘুরতেছে। তারে দেইখা আমার ঘিলুতে কারেন্টের শক খাইছি। দুই হাত দুই দিকে ছড়ায়া ঘুইরা ঘুইরা নাচা শুরু করলাম। নাচতে নাচতে কাশেইম্যার কাছে গিয়া তার গালে ঠাস ঠাস ‘বন চটকানা ‘ মারতে আছি। চটকানা খায়া কাশেইম্যা দুই গাল চাইপ্যা দৌড় দিসে। আমিও নাচ নিয়া তার পিছে দৌড়ামু, নজমুল আইসা আমার হাত ধইরা টান দিলো। টাল সামলাইতে না পাইরা আরেক হাত দিয়া তার ধরছি কেবল, দেখি আবদুল্লাহ মিয়া আমার দিকে চায়া আছে। নজমুল তারে দেইখা আমারে ছেড়ে দিসে। আবদুল্লাহ মিয়া ঝড়ের বাহির হয়া গেলো। পুরো রাতে সে আর ফিরে নাই।একলা ঘরে সেই প্রথম আমার আবদুল্লাহ মিয়ার জন্য বুকের মধ্যে কোথাও ব্যাথা লাগলো, কিন্তু তার খবরটা আমি তারে জানাতে পারলাম না।
(চলবে)