#হৃদয়ের_একূল_ওকুল
#পর্ব_১৩
সারা রাত লুৎফার কান্নায় ঘুমানো যায় না। কাশেইম্যার বদ দোষের মধ্যে আরেকটা যোগ হইছে, মদ খাওয়া। লুৎফা মানা করলে কাশেইম্যা তারে ঠেংগায়। যে সে ঠেংগানী না, গাটে গাটে বিষ বিষ ঠেংগানী। মনটায় চায় কাশেইম্যারে আবার ‘বন চটকানা ‘ দেই, দিতে পারি না। স্বামী স্ত্রীর দরজা ধাক্কায়া হুদাই জামাইরে ‘ বন চটকানা’ দেয়া যায় না। আরো কাহিনী আছে। লুৎফারে আমি সাধে সাধে ছিনালী ডাকি না। বৈতালনী সাত সকালে উইঠা কাশেইম্যার জন্য চা নাস্তা বানায়। দুইটা দিন ইন্দুর মারার বিষের প্যাকেট পাকের ঘরে লবনদানীর পাশে ঠ্যাশ দিয়া রাখছি। আরেক দিন প্যাকেট কাইটা চামুচে মাপ দিয়া রাখছি। বৈতালনীর ঘরের সাড়ে ছিনালনী যদি ছুঁইতো চামুচটা। ছুটির দিনে দুপুর বেলা ছিনেমায় অত্যাচারী স্বামীর শাস্তি দেয়া দেখাইতে ছিল। লুৎফারে শোনায় পুরা সিন মুখে মুখে বলছি, যদি কানটা দিয়া শুনত। কাশেইম্যা আমার সামনে পরে না। চটকানা খাওনের পর সে এইটা বুঝছে, আমি তারে পিষ্যা মারার তালে আছি। আমার মাথা যে হালকা কিসিমের আউলা, এইটা এখন এই বাড়ির সব ফেলাটের মানুষ জানে। পানির লাইনে আগে খাড়াই। রতনের দোকানে গিয়া চা নাস্তা খাই। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট চায়ের দোকান গুলাতে গিয়া মন চায় একটা আকিজ বিড়ি নিয়া কান চুলকাইতে চুলকাইতে একটা টান দেই। বেটা মানুষের মতো ফু ফু কইরা গোল গোল ধুমা উড়াইতে পারলে, মনের কষ্ট গুলারে পুড়ান যাইতো। কয়েক দিন ঐ টং গুলাতে আইসি গেছি। কলেজের কাছের থেকা এক প্যাকেট বিড়ি ও আইনা রাখছি। অখন খালি পেরাকটিসের অভাবে বিড়িটা টানতে পারতেসি না। রতনরে ‘বিড়ি খাস’ কিনা জিজ্ঞাসা করছিলাম। সে আমাকে ‘খায়া ফালাইমু’ লুক দিসে। লুক মানে চাহনি। এখন আমি কয়েক খান সোন্দর সোন্দর ইংরাজি জানি। এগুলা হইলো কলেজ গিয়া শিক্ষিত হওয়ার ফলাফল।
আবদুল্লাহ মিয়া অফিসে থাকে। কাজের নাকি অনেক চাপ। আমি যখন কলেজ থাকি সে বাড়ি আসে। আমি টের পাই। আনাজ কবে শ্যাষ হয়, মশলাপাতি, চাল-ডাল সব সে হিসাব মতো কিনা দিয়া যায়। সেদিনের পর থেকা তার সাথে আমার আর দেখা হয় নাই। মাঝে দুইটা মাস গুজরায় গেছে। সুমনার বাচ্চা হওয়া বাবদ আমি শ্বশুড় আব্বার সাথে গিয়ে ওই বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। শাশুড়ী আম্মা আমার হাত চেপে সংসারে।মন দিতে বলছেন। আম্মা জৈন্তাপিরী বাবার তাবিজ নিজের হাতে আমার কোমড়ে বাইধা দিসে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিল মোহাব্বত বাড়াইতে বাবার ফুঁ খুবই উপকারী। আম্মারে আমি বলতে পারি নাই, ‘যার লাইগা বানলা তাবিজ, সে এখন থাকে আপিস।’ আবদুল্লাহ মিয়া না আসলে কি হবে। সব জায়গায় তার খবরদারী ঠিক আছে। খাসী কবিকে আমার কলেজ আসা যাওয়ার সঙ্গী বানায় দিসে। যে লোক নজমুলরে সহ্য করতে পারে না। সে খাসীর মতো দামড়া বেটাকে আমার পাহারাদার বানাইলো ক্যান এইটা নিয়া আমার মনে বিশাল প্রশ্ন ছিলো। খাসী কবি অবশ্য কখনো আমাকে অসম্মান করে নাই। আমি নিজের থেকা খাসীকে কিছু বলি ও নাই। খাসী আসতে যাইতে আমারে বিরহের কবিতা শোনায়। তার একজন প্রেমিকা ছিলো। প্রেম শুরু হওয়ার আগেই তারে তার পিতা বিবাহ দিয়া দিসে। মাঝ দিয়া খাসীকে ‘আকাইম্মা, বুড়া গাধা ‘বইলা গালাগাল দিসে। তাই মনের দুঃখে খাসী এখানে থাকে। খাসী খাইতে ব্যপক পছন্দ করে। আমি একলা মানুষ। আগে আবদুল্লাহ মিয়ার জন্য রানতাম। এখন চিড়া মুড়ি বুস্কুট দিয়া চালায় দেই। মাঝে মাঝে ভাত তরকারী রান্না করি। খাসীর রান্নাবাড়ায় সমস্যা। তারে কয়টা রাইধা দিলে সে প্যাট পুরে ভাত খায়। কাউরে খাইতে দেখলে আমার মনে জান্নাত পাওয়ার শান্তি লাগে। নানী বুড়ি বিছানায় পরা। আবদুল্লাহ মিয়া তারে দেখে যায়। উপরে আসে না। বুড়ি চালাকী করে আমারে ডেকে পাঠায়। নিচে নামতে নামতে দেখি আবদুল্লাহ মিয়া সিড়ি দিয়া নাইমা যাচ্ছে। আমি তো কোন খারাপ কাজ করি নাই। আবদুল্লাহ মিয়া একবার আমার কথাটা বলার সুযেগ দিলো না। কিছু জানলো না, মনকলা খায়া গাল ফুলাইলো। বেটা একটা ফাজিলের ঘরের লম্বা শয়তান।
কলেজ যাওয়ার পথে এখন মালের কুরিয়ার আমিই করি। মাঝেসাঝে খাসী করে। কাঁথার ব্যবসায় মোটামুটি লাভ আসা শুরু করছে। মাঝ দিয়ে আচার আর শুকনা মোয়া চালু করছি। এই দুটা জিনিষ হইছে কেটরিনা। হট ক্যাকের মতো এগুলার চালান দিতে হয়। কেটরিনারে আমি চিনতাম না। কলেজের মাইয়ারা চিনাইছে। তার একখান গান আমার বড়ই পছন্দ হইছে, তেরী উর, তেরী উর। আচারে পাক দিতে দিতে আমি এইটা গাই। কাশেইম্যার আওয়াজ পাইলেই, গান বদলায়া, ‘হারামজাদা মর, তুই মর’ কইতে থাকি। বিরাট গামলায় আচার জ্বাল দেই। তার দিলে ডর থাকলে সে বদমায়েশী করবে না। আঁশ বটি দিয়া তারে টুকরা টুকরা কইরা আচারের তেলে ভাইজা, গুড় দিয়া পাকায় ফেলতে পারি, সে জানে। কয়েকটা আচারের ডিব্বা সুমনারে দিয়া আসছি। সুমনার একটা ফুটফুইটা কন্যা হয়েছে। তার নাম রাখা হয়েছে,’ মনোয়ারা’। মনোয়ারার জন্য কয়েকটা কাঁথা নিয়া গেসিলাম। এখন জামা বানাইতেসি। ছোট্ট ছোট্ট পুতুল জামা বানাইতে গিয়া অবাক হইয়া থাকি। এত ছোট্ট মানুষের হাত পাও হয়! আমার হাত ঠ্যাং গুলাও তো এমন ছিলো। আল্লাহর পরে আব্বা আম্মা খাওয়ায় পড়ায় বড় বানাইছে। তাদের দিকে খালি দুঃখ দিয়া গেলাম। বড় মানুষ হইতে গেলে লেখাপড়া করতে হয়। তাতেও ফেল্টুস মারলাম। জীবনটা ত্যাজপাতা হয়া গেছে। হালার আবদুল্লাহ, তুই মৌজে আসস। চাকরী করস, খাস দাস, ঘুম যাস। আমি একলা একলা এলায় পইরা থাকি। না আছে একটা কথা কওয়ার লোক, না আছে একটা ঝগড়া করার মানুষ। কপলাডাই ভুইত্তা মাইরা গেলো এই পিছার সংসারে আইসা।
কলেজে ও শান্তি নাই। বিয়াইত্তা মাইয়া শুনলে বাকি পোলাপাইনের ভিতর হাহা হিহি পইরা যায়। বিয়া জানি কত মজা, খালি সুখ আর সুখ। কয়েকটা বিষ কাটানী আছে, তারা কিছুদিন পরপর আইসা প্রশ্ন করবপ, ‘ কি গো মিসেস আপা, মিষ্টি খাওয়াইতা না? তোমার পোলাপাইন হয় না ক্যান। দুলাভাইয়ে মোহাব্বত করো না?’ এডিরে মন চায় ফিক্কা মাইরা টাট্টিখানায় নিয়া ফালাই। ফালাইতাম পারি না। কলেজ থেকা বাইর কইরা দেবে। তাই হাসি হাসি মুখ কইরা শুনি। একদিন কইছি, আমার সুখবর হইলে তো চোক্ষে দেখবা, তোমরা এত খুশী ক্যান। চিন্তায় মনে হয় তোমাগো রাইতে ঘুম আহে না ‘। বিহায়া গুলা তাও থামে না। মাথায় গু থাকলে আর কি করমু। নিজেরে সামলায় রাখি। আম্মা খুব কইরা কয়া দিসে, ‘সুযোগ জীবনে বারবার আসে না মায়মুনা। তর আম্মার পড়ার খুব শখ আসিলো। তোর নানীয়ে পড়তে দেয় নাই। মইরা যাইস, তাও পড়াডা ছাইড়া দিস না। ‘ আমার দুই আম্মার জন্য হইলেও আমারে পাশ করতে হবে। ফেল করা সাবজেক্টটা রিবিশন দেয়া শ্যাষ। পুরা বই মুখস্ত কইরা ফেলসি, ট্যানশন নাই। কলেজের পরীক্ষার পড়া পড়ি আর কাঁথা সেলাই। কাঁথার ফোঁড়ে পুতুল তুলি। পুতুলে পুতুলে নিজের জীবন লিখা দেই। এ এক বড়ই আশ্চর্য। আমার জীবন কথা চইলা যাইবো কই না কই। আমি জানমু ও না। যার ঘরে থাকবো, সে ও কি বুঝবো, এই সুই সুতার ফোঁড়ে ফোঁড়ে এক নারীর জীবন কথা লেখা আছে?
মাস খালি ক্যালেন্ডারের পাতা থেকা সইরা যায়। আবদুল্লাহ মিয়া আসে না। লুৎফারে শরমের মাথা খায়া জিজ্ঞাস করছি, আবদুল্লাহ মিয়া বাড়ি আসে না ক্যান। লুৎফা উত্তর দিসে, ‘পাখিরে বানতে পারো নাই ভাবী। ভালো পাখিরে খাঁচায় বান্দা লাগে না ভাবী। তারে সোহাগ কইরা দুইটা দানা খাইতে দিলেই সে খুশী। ‘ আবদুল্লাহ মিয়ারে আমি কোন বটিকা খাওয়াবো এটা ও কয় নাই। কলেজ যাওয়ার পথে মন চায় গাড়ি ঘুরায়া ভুইত্তারে ভালো মন্দ খাইতে দিয়া আসি। কবি খাসী রাজী হয় না। তার ভাইয়ের নিষেধ আছে। পরীক্ষার বেশী বাকি নাই, একদিন বিকাল গড়ায়া সন্ধ্যা নামছে। কয়েক বাড়ি পর কয়টা বকুল কাঁথা দিতে গেসিলাম। আইসা দেখি, আবদুল্লাহ মিয়া জামা কাপড় সুটকেসে বানতেসে। তারে দেইখা চোক্ষে হুদাই পানি আইসে।
–বাড়িত যান? আমিও যাবো, কয়টা কাপড় নিয়া আসছি।
–তোমার যায়া কাজ নাই। সংসারে যে মেয়ের মন আইঢাই করে, তার এত দরদ সাজে না। নিজেরে সামলায় রাইখো। খাদেম তোমারে অপমান করবে না। তয় চলাফিরা সাবধানে করবা। আমার জন্য পারলে দোয়া কইরো।
–আমারো না নিলে আপনেরে যাইতে দিমু না। দরজায় খাড়ায় বিষ খামু্। পাড়ার লোকরে ডাইকা আপনের নামে বিচার দিমু।
— অত সাহস তোমার নাই মায়মুনা। খাইলে বিয়ার দিন খাইতা। বিয়াটা হইতো না। ঘরের বউ হয়ে লেখাপড়া, কাজ কর্মে আমার থেকা তোমার দিকে কোন মানা নাই। তুমি আগাইলে আমি আগাবো। কিন্তু ভর মজলিশে চড় থাপ্পড় মাইরা ইয়ার্কি করবা এইটা তো মানা যায় না।
–তাজ্জুবের কথা, এই জন্য রাগ করছেন? আমি ভাবছি নজমুলরে নিয়া খেপসেন।
— পরের ছেলের সাথে নাচানাচি করলে বাইর ঘরে নিজের মাথা উঁচা কইরা চলতে পারবা? তোমার মাথায় এত কথা, এইটা বোঝ না তুমি। নজমুল তোমার কে? যাক, এসব কথা বলে লাভের চেয়ে লস বেশী।
–আপনেরা সবাই মিলা আমারে পুতলা বানায় দিসেন। যে যেমনে পারেন কথা শুনান। থাকতাম না এহানে, আব্বার বাড়ির বাাে উঠায় দেন।
–নজমুলরে নিয়া তোমার বাড়ির লোকে ভালা কয়? তোমার আব্বার বাড়ি জায়গা হইব ভাবসো? হইলে তোমারে বিয়া দিত না। আমার ঝামেলাটা মিটতে দাও। তোমারে লেখাপড়া করে আজাদ কইরা দিবো। তোমার ও শান্তি, আমারো শান্তি।
আবদুল্লাহ মিয়া চইলা গেছে। রাত বাড়ছে, জনম জনমের কালো বিশ্রি রাত। সকল ঘরে বাতি জ্বলে। আমার ঘরে বাতি জ্বালাই নাই। বারান্দায় কাপড় গুলা পতপত কইরা উড়তেছে। খুব বাতাস জুড়ছে, বৃষ্টি আসব এমন। মাঘের বান জার নামায় বহুত। আমার ভিতর পুইড়া খাক খাক হয়া গেলো। একটা মানুষ টের পাইলো না। আব্বায় আমারে তাইলে এক পয়সার বিশ্বাস করে না। আম্মায় আব্বার হাতের লাঠি। আব্বায় যেমনে ঘুরাইবো, তেমনে ঘুরবো। চোখের পানিতে বুক ভাইসা যায়, মনের আগুন নিভে না। কতক্ষণ বইসা ছিলাম মনে নাই। কোকিল ডাকছে জোরে জোরে। খাসী হাত ভর্তি সদাই নিয়া খাড়ায় আছে। আবদুল্লাহ তারে পয়সা দিয়া গেছে। আমারে কানতে দেখে সে ব্যস্ত হয়া পরছে।
–ভাবী, বইন গো। কান্দেন ক্যান, ভাইয়ে কই। আমারে নিয়া হের বাইত যাওনের কথা। তার শরীর ভর্তি জ্বর। বহুত ঝামেলার মদ্যে আছে ভাই।
— খাদেম ভাই, আপনে আমার ধর্মের ভাই লাগেন। এহান থেকা আমরার বাড়ি যায় একটা ভ্যান লয়া দিবেন? হে গেসে গা আমারে থুয়া। আমি বাড়িত যামু।
— আবদুল্লাহ ভাই’র বড় কঠিন সময় গো ভাবী। হের বিপদ, চারদিকে বিপদ। তার কে আছে কন, আপনে ছাড়া। মা -বাপ মউতের দরজায় খাড়াইন্না। আপনে জানেন? তার জেল হইতে পারে?
(চলবে)