হৃদয়ের_একূল_ওকুল #পর্ব_১৪(শেষপর্ব)

0
1881

#হৃদয়ের_একূল_ওকুল
#পর্ব_১৪(শেষপর্ব)

ভ্যানে চড়ে স্বামীর বাড়ি যাওয়া হলো না। তার আগে নানী বুড়ি আমার হাতের উপর মারা গেলো। খাদেম ভাই সহ বাড়ি যাবার জন্য রওয়ানা দিসিলাম। সিড়ি দিয়া নামতে গিয়া নানীর ঘর থেকা ডাক আসলো। শেষ অবস্থায় মানুষের চেহারা কেমন হয় আমার জানা ছিলো না। নানীরে যখন বল্লাম, নানী, বড় কইরা শ্বাস নেও, আইলসামী কইরো না। নানী ঝট কইরা আমার দিকে তাকাইলো। মনে হইলো অখনি পিডাইবো। আমার কানটা তার মুখের কাছে নামাইতে কইলো, ‘ হগলেরে মাইন্যা চলিস, আমি গেলাম গা… আমার বাড়ি ঘর সব তোরারে দিয়া গেলাম। এরপরের কথা জড়ায়া গেছে। বুঝতে পারি নাই। নানী মরার পর চোক্ষু দুইটা বন্ধ কইরা দিলাম। নানীর শইলটা বরফের মতো ঠান্ডা। হুজুরে কইতো, ‘ সৎ মানুষ মরলে পরে তার শইল হয় পাখির পালকের মতন হালকা পাতলা’। নানী যেন উড়াল পঙ্খী, উইড়া গেলো ফুড়ুৎ। জান ছাড়া নির্ভার শইল পইরা রইলো। নানী মরনের পর তার ওয়ারিশানরা আসা শুরু করছে। আস্তে আস্তে সইরা আইলাম। নানী বুড়ি মরনের আগে কি কইছে তা কারো জাননের কাম নাই। আমি একটা মানুষ! যার কথা লোকে বিশ্বাস করবো? যে মইরা গেছে, তার কওয়া কথা তার লগে গেছে । খাদেম ভাই হাপুস হুপুস কইরা কানতাছে।

— নানী নাই, আমি এই বাইত কেমনে থাকতাম। নিজের ঘরে জায়গা হইলো না। আমার বইন জামাই আমারে কয় হাফ লেডিস। হয় আমি হাফ লেডিস। মায়েরে বাপে লাথি গুতা দিত। মায়ে সইয়া রইয়া তাও রাখছিলো। আমার লাইগা বইনের সংসার ভাঙ্গে। পলায়া আইলাম। মা টেকা পয়সা যা লাগে দেয়। আমিও সন্তান। বাপের পয়সায় আমার হক আছে। বাঁইচা থাকতে মন লয় না। শেষে আবদুল্লাহ ভাইয়ে কয়, লেহাপড়া যাই শিখছো পোলাপাইন পড়াও। রাস্তা ঘাটের পোলাপাইন ও আপন হয় বইন, নিজের বাপে আপন হয় না। নানী মেলা আদর দিসে। নিজের ঘর মনে কইরা থাকছি। ফেলাটের কেউ আমারে দেখতে পারে না। আড়ালে হাসে, অথচ টেকা ধার নেওনের বেলায়,এই খাদেমের কথা মনে পরে।

খাদেম ভাইয়ের কথার কোন জবাব আমার কাছে নাই। আমিও এই লোকরে গালাগাল দিসি। হাইসা মজা উড়াইছি। নিজের কাছে নিজে ছোট হইয়া গেলাম। বাড়িত যাওয়া হইলো না। ঘরে ফিরা শ্বশুড় আব্বারে ফোন দিলাম। দুই বার বাজতে ফোনটা উনি কাইটা দিলেন। এইবার সুমনারে ফোন দিসি। সে টেলিফোন ধইরাই এক নাগাড়ে বলে গেলো। তারে আমরা ভুইলা গেছি, খবর নেই না। বাচ্চাটারে মায়া করি না। চুপ কইরা শুনলাম সুমনার কথা। আবদুল্লাহ মিয়ার কথা জিজ্ঞাস করতেই সে চুপ মাইরা গেলো।

–কও না ক্যান সুমনা। তোমার মাইয়ার কসম। আমারে মিছা কথা কইবা না।

–ভাবী, ভাইয়ে আইছিলো। আব্বার লগে বিশাল ঝড়গা কইরা গেসে গিয়া। পরে গয়নাডি দিতে চাইলো ভাইয়েরে। ভাইয়ে মাটিত ফিক্কা ফালায় গেছে। হেয় কি আরেক খান বিয়া করছে? এই হানে থাকলো না। কয় হোটেলে থাকবো, কে জানি লগে আছে।

— এত পয়সার কি কাম লাগছে, হেডা কয় নাই। আব্বায় কই, ফুন ধরে না। কথা কয় না। আমার কেমন লাগে বোঝ সুমনা? আমার বাপ মায়ে বিয়া দিয়া কাম সারছে। হাত পা ঝাড়া দিয়া ফালায় দিসে আমারে। অখন জীবন ও আমার, মরন ও আমার।

— মনে কিছু লয়েন না ভাবী। আপনেরে লইয়াই ঝড়গা হইছে।

সুমনার সাথে কথা আগাইলো না, শ্বশুড় আব্বা ফোন দিসেন। তার সাথে কথা বলে বুঝলাম, বাড়ির জমি বিক্রি করে পয়সা চাইছে আবদুল্লাহ মিয়া। জমি বন্দকী দিয়া আম্মার চিকিৎসা করানো হইছে। তাই, আব্বা টাকা দিতে পারবে না। ভুইত্তামারার টাকা পয়সা কেন লাগবো, জানি না। ফোন ছাড়ার আগ দিয়া আব্বায় খালি গলায় দুইটা কথা বললো, ‘তুমি এই বাড়ির বউ। তোমার আব্বা সজ্জন মানুষ। আচার আচরণ যাই করো, চিন্তা ভাবনা কইরা কইও, কইরো। মহিলা মানুষ অপমান অসম্মান সইজ্য করবা না। কিন্তু যার তার সাথে যেমন খুশী মেলামেশা করবা, এইটা ঠিক না। আবদুল্লাহর সাথে তোমার যদি মন না বসে, ময় মুরুব্বীরে কইও। সংসারে মন বসানের চেষ্টা করো। তার বিপদের সময় পাশে থাকো। ছেলে আমার খারাপ হইলে তারে আমি শাস্তি দিব। তোমারে আমি নিজের মেয়ে জানি। নিজের বদনামে বাপ মায়ের মুখটা কালা কইরো না মা জননী। ‘ এত দুঃখের মধ্যে আব্বার মুখে মা জননী শুইনা আমার বুকের পাথর নাইমা গেলো। আবদুল্লাহ মিয়ার কষ্টের শেষ দেইখা তারে না হয় ছাড়লাম। এমনেও যাইতাম, অমনেও যাইতাম। আল্লাহ যদি চায় এখনি যাই, যামু।

খাদেম ভাই সেই যে দুই কথা কইলো, মুখে এরপর থেকা তালা মাইরা দিসে। যতই জিগাই, কিছু কয় না। রাইতে ভাত গলা দিয়া নামে না। পরের দিন লুৎফারে আঞ্জায় ধরলাম। হাজার তাল বাহানা কইরা লুৎফা কইলো, আবদুল্লাহ মিয়ার উপরে অফিসের টাকা সরানোর অভিযোগ আসছে। রশীদ হাওয়া। মালের পরিমান ও কম। মাস কয়েকের সময় দিসে। টেকা জোগাড় করলে চাকরী না টিকলেও জেল হইতো না। রশীদ পাইলে টেকাও লাগত না, চাকরীও থাকবো। মাল গুলান যারে দিয়া কিনাইছে, হেই পোলায় চাকরী ছাইড়া গেছে গা। তার কোন খোঁজ নাই। টেকার পরিমান শুইনা তাজ্জব হইছি। এক লক্ষ সত্তর হাজার টেকা তুই কনে পাবি মায়মুনা? লুৎফারে সাহস নিয়া কাশেমের বৈতালীর কথা কইতে সে কাঁইদা দিলো। কাশেম তারে বেলাকমেল করে। স্বামী স্ত্রীর গোপন সময়ে ভিডিও বাজারে ছেড়ে দেবার ভয় দেখায়। মানুষ এত খারাপ হইতে পারে?

টাকার ভীষণ দরকার। খাদেম ভাইরে খবর দিয়ে তার আম্মারে জানাইলাম। সবাই মিলা ঝুইলা দিয়াও হাজার পঞ্চাশ হইতো না। খাদেম ভাইয়ের আম্মা একটা আশার আলো দেখাইলো। আমার কাঁথা গুলান বড় দোকানে গিয়া বেচলে দাম পাওয়া যাবে। খাদেম ভাইয়ের বোন পাটের জিনিষ বানায়। তার হাতে বিদেশী কাস্টমার আছে। খালাম্মা আমার কাঁথা গুলা তাদেরে দেখাবে। চোখ মুখ ধুয়া এক থাল ভাত খায়ে নিলাম। কাজে নামার আগে গতরে শক্তি দরকার। যে বিষয়ে ফেল করছিলাম তার পরীক্ষা সামনে। লগে কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দেওন লাগবো। রতনরে ডাইকা নিসি। ওর হোটেলের চাকরী ছাড়ায় দিলাম। আমি আচার বানায় দিমু, সে স্কুলের সামনে বিক্রি করব, গোলা আচার, ডিব্বা আচার। দোকানে দোকানে ঘুরনের কাজটা খাদেম ভাই আর রতনে করব। খাদেম ভাইয়ের সাইকেল আছে। যাতায়াত খরচ নাই। দুই বেলা খাওয়া আমার। লাভের টাকা ভাগ করমু শুইনা খাদেম ভাই খেইপা গেলো।

— দুনিয়াত সব মানুষ লাভ লোকসান দেহে না। আপনে বিসমিল্লা কইরা শুরু করেন। বাকিডা আল্লাহর হাতে। রতনরে আমি ইস্কুলে দেয়াম। আপনে যা পারেন দিয়েন। আমার তো পোলাপাইন নাই। আপনেরা যদি পরিবারে ঠাঁই দেন তয় জীবনে বাঁইচলাম।

এই মানুষ গুলার কথা ফেলতে পারি না। লুৎফা মাঝে মধ্যে খবরা খবর আইনা দেয়। আবদুল্লাহ মিয়া বাসা বাড়িত আসা বন্ধ কইরা দিসে। খাদেম ভাইয়ের কাছ থেকা নিয়ম কইরা খবর নেয় বুঝি। লুৎফারা ঘর ছাইড়া দিব। কাশেম মিয়ারে আজকাল কম আসা যাওয়া করতে দেখি। অল্প অল্প কইরা বাড়ির জিনিষপত্র সরায় নতুন বাসায় তোলে।

নজমুলের সাথে বইসা ফেল বিষয়ের পড়া পড়ি। মাঝে মাঝে নজমুল হোন্ডায় কইরা বাসায় নামায় দিয়া যায়। খাদেম ভাই এতে একটু কষ্ট পায়। একদিন নজমুলের সাথে আসা যাওয়া নিয়া কিছু বলতে আসছিলো,’ এক গ্রামের পোলা’ বলে থামায় দিসি। নজমুলের সাথে ঘুরতে ভালোই লাগে। অন্য ছেলের সাথে আসা যাওয়া করি, বাড়ির লোক চোখের কোনা দিয়া দেখে। গায়ে টিপা হাসাহাসি করে। একদিন কলেজ থেকা ফিরছি, নজমুলই নামায় দিসে। রতন উইড়া আইসা খবর দিলো, আবদুল্লাহ মিয়া একজন মেয়েছেলে সহ রিক্সা কইরা আসতেছে। যেমনে উইড়া আসছিলো, তেমনে উইড়া গেলো। মাঝ দিয়া আমি বেক্কল হইয়া গেলাম। আবদুল্লাহ মিয়া যখন বাসায় ঢুকলো, তার দিকে ফিরা তাকানোর এক ফোঁটা ইচ্ছা আমার নাই। সে যদি আইজ আমারে বাপের ঘরে দিয়ে আসে, চলে যাবো। যে নয়া জীবনের স্বপ্ন দেখায়া পড়ায় ফিরাইছে সেই স্বপ্ন নিজে পারলে পূরণ করলাম। তার কাছে দাবী দাওয়া ছিলো না, রাখলাম না।

— পিছন দেখায়া দাঁড়ায় থাকবা না। খাবার দাও। এই বাড়িতে দিন ফুরাইছে। কলেজের কাছে হোস্টেলে থেকে পড়বা। তোমার জিনিষপত্র গুছায় রাখবা। আগামী সপ্তায় তোমারে ওখানে দিয়া আসা হবে। ঘরের জিনিষপত্র নিয়ে ভাবনা চিন্তা আমার। পরীক্ষা শেষ হইলে তোমারে বাপের বাড়ি নিয়া যাবো।

–ও! আমারে বিদায় দিয়া যে বেটিয়ে নিয়া আসছেন তারে এইখানে তুলবেন। তো আইজ আনছেন কেন। আমি তো অখন যাবো না। আপনের চুরি ধারির খবর শুনছি। সত্য মিথ্যা জাইনা যাই।

কথা শেষ করতে পারি নাই, গালের উপরে বিরাশি সিক্কার চোপাড় খায়া চোক্ষে সরিষা ফুল ফুটতেছে। দেখতে দেখতে বোরখার মুখ খুইলা যে মহিলা চেহারা দেখাইলো, সে আমার উনিশ বছরের চেনা আম্মা। আম্মার হাতে চড় খাওয়ার ব্যাথা ভুইলা আম্মারে আঞ্জায় ধরছি। আম্মা দুই হাতে আমারে ঠেইলা দূরে সরায় দিলো। আম্মা আবদুল্লাহ মিয়ারে খবর দিসে, আমারে দেখতে চায়। আম্মারে কত দিন পর দেখলাম। বুকের মধ্যে তুফান ডেকে কান্না আসতেসে। আম্মা সহ আবদুল্লাহ মিয়ারে খেতে দিসি। একা মানুষ, আয়োজন করে কিছু রান্না করি না। ভাতের মধ্যে আলু দিয়ে ভর্তা করলাম, সাথে মাছের ঝোল। ভর্তায় পেয়াজের সাথে শুকনা মরিচ কচলায় একগাদা ধনেপাতা দিসি। আম্মার খুব পছন্দ। আবদুল্লাহ মিয়া আম্মার জন্য লাল লাল ডিমভাজা করে আনলো। আম্মা একবার আমার দিকে তাকয়, আরেক বার আবদুল্লাহ মিয়ার দিকে তাকায়। আমরা দুই জন দুই মেরুদেশ হইয়া অবস্থান করতেছি। কেউ কারো চেহারা দেখি না। আম্মা ভাত খায়া পান মুখে দিলো। চা বসাইলাম, চায়ের পাতা শ্যাষ। আবদুল্লাহ মিয়াকে বলবো, ঘরের দুয়ারে আওয়াজ পাইলাম। নজমুল চা পাতা, লেবু আর দুধের প্যাকেট নিয়া আসছে। মনে পরলো, আজ দুপুরে বাজার দিয়া আসার সময় বলছিলাম, এই জিনিষ গুলা ফুরায় গেছে। শালার বেটা আইজ এখনি তোর আসতে হবে? বেহুরমত, তুই কাল আসলে কি হইতো।

আম্মা নজমুলকে দেখে বেসম্ভব খেপে গেছে। সে বোরখা ফেলে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে উঠে দাঁড়াইছে। তারে লাগতেছে, পেট মোটা পানক সাপ। অজগরও হইতে পারে, তবে অজগর এত বাইট্টা না, এই যা পার্থক্য। নজমুল আবদুল্লাহকে দেখে রসগোল্লা মার্কা হাসলো। আম্মাকে দেখে তার মুখ শুকায়া পোতাইন্যা মুড়ি। আম্মা পায়ের থেকে হাওয়াই চপ্পল নিয়া নজমুলরে শাসানি দিলো।

–চেয়ারম্যানের পোলা, তোরে আমি চাইরশ বিশ টেকা তোলা বানায় ছাই দিয়া ধইরা রাম দা দিয়া কাটমু। হুয়রের ছাও, বাইম মাছের মতন আমার মাইয়ের পিছে পিছ লাগছত ক্যান। অই, কথা ক, হমুন্দীর নাতি। আবদুল্লাহ এই বিটলা বদমাইশটারে বান্দো। আমি ওরে নাইলনের রশি দিয়া বাইন্দা আম গাছের ডালে ঝুলায়া জাম গাছোত টানা দিমু।

–কাকী, আমার কি দোষ। মায়মুনা কয়, সে চা পানি খাইতে পারে না। তাই নিয়া আসলাম। ওরে দোষ দিয়েন না। আমি নিজের ভুল স্বীকার করলাম। তয় মায়মুনা কিন্তু আমারে লাইক করে কাকী। এই বুইড়া মইচ্চের লগে হের কোন পিরিত নাই।

আবদুল্লাহ মিয়া মাথা নিচু কইরা আছে। আম্মার হাত থেকা জুতা খসে গেসে। আমি বেয়াক্কল হয়ে নজমুলরে দেখতেছি,

–তোর লগে এক হুন্ডায় আই যাই, এর মানে আমি তোর? কুত্তার নাতি, তোর মনে এত পাপ ক্যান। এই কথা তোরে কইসি কোনদিন? বেশরম, বদমাইশ।

–মাগনা মাগনা খাস ঘুরস, তহন সমস্যা নাই। আমি কিছু চাইলেই দোষ। তোর বিয়ার দিন তুই শাহিনারে দিয়া আমারে খবর দেস নাই? তুই পলায় যাবি?

–আমি পলায় স্টেশন গিয়া বইসা থাকতাম। বরযাত্রী গেলে গা বাড়ি ফিরতাম আম্মা। তার সাথে পলাইতে চাই নাই। আবদুল্লাহ মিয়ারে আমার পছন্দ ছিলো না। এই ভুইত্তমারা বেডা, আপনের বউরে অপবাদ দেয়, আপনে তামশা চান, হেরে মাইর দেন।

আবদুল্লাহ মিয়া মাটির দিকে তাকায় নজমুলের হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলো। ফিরল অনেকক্ষণ পর। নজমুলরে কি দিয়া বুঝ দিসে জানতে চাইলাম। সে আমার কথার উত্তর না দিয়া আম্মারে উঠতে কইলো। টাকার সন্ধানে কার কাছে যাবে। নানী মারা গেছে আমি একা থাকি, লুৎফারা নাই। আবদুল্লাহ মিয়া একবারো আমার দিকে তাকালো না। লোকটার চোখ দিয়ে পানি পরছে। যে দিকে চায়, সে জায়গার মাটি ভিজে যায়। আম্মা আমারে যা মনে আসে তাই দিয়ে গাল পারলো। শেষে বললো, ‘এর চেয়ে নজমুলের সাথে ভাইগা যাইতি। মনে করতাম তুই মইরা গেছস। ‘ তারা বাহির হয়া গেলে ঘরে একলা বসে রইলাম। বাসার দরজা যেমন খোলা, আজ আমার মনের দরজাও খোলা। বাতাসে দরজায় বাড়ি খায়, মনের দরজা ভাইঙা কালবৈশাখী উঠে। আমারে দুনিয়ায় একটা মানুষ বুঝলো না। সবাই দুইষা গেলো, বিনা দোষে।

খাদেম ভাই রাতে মন পছন্দ তেহারী নিয়া আসছে। আবদুল্লাহ মিয়া কিছু টাকার জোগাড় করতে পারছে। রতনরে নিয়া খাদেম ভাই সহ খাইতে বসলাম। খাওয়া খালি নাড়িচাড়ি মুখে তোলা হয় না। আবদুল্লাহ মিয়া আমার জন্যে সত্যি ভাবে? আমি একটা বেয়াদব মেয়েছেলে। বেক্কলি করে।যারে যা খুশী তাই ঠাস মাস বলে দেই। আজ তার সামনে বলছি, তারে আমি পছন্দ করি না। নজমুলের সাথে ঘুরতে ভালো লাগে, একটা বন্ধুর সাথে মানুষের ঘুরতে যেমন ভালো লাগে। এই সমাজে মেয়ের সাথে ছেলের বন্ধুত্ব কেউ মানতে পারে না। সব কিছুতে প্রেম পিরিতি না ঢুকাইলে মন ভরে না। নজমুলর বিবাহের আগে আমার জন্য পাগল ছিলো। বিষয়টা নিয়া রঙ্গ রসিকতা করতে মজা লাগতো। নিজেরে দামী দামী মনে হইছে। সেও ভাবলো আমি তারে নিয়া স্বপ্ন দেখা শুরু করছি! হায়রে মাইয়ালোকের জীবন। তোর পছন্দের না দাম আছে, না তোরে কেউ বোঝে। আবদুল্লাহ মিয়ার উপকারে আসবো। যেমনে পারি তারে বিপদ থেকা উদ্ধার করবো।

কত কথা ভাবছি, সারা রাত মনে নাই। মাঝের ঘরে ঘুমায় গেসিলাম। গালের মধ্যে ঠান্ডা ঠান্ডা দুইটা হাতের পরশ টের পাইলাম। আবদুল্লাহ মিয়া হয়ত ফিরা আসছে। হাত বাড়ায় ধরতে চাইলাম,পারলাম না। ঘুম ভেঙে দেখি লুৎফার ঘরের দরজা খোলা। খুটুর খাটুর শব্দ হয়। আজ মেলা কাজ আছে। কাস্টমার কাঁথার টাকা দিবে। আচার এর অর্ডার আসছে বিয়া বাড়ির। শুকনা পিঠা বানায় গায়ে হলুদের জাগায় দিতে হবে। বড় বড় অর্ডারে তেমন বড় টাকা। সাত পাঁচ না ভাইবা ঘরে যাবো কাশেইম্যা তার ঘরের দরজা বন্ধ করলো,

— আহা ঠান্ডার ভিতর শুয়া ঘুমায় আছো। শীত করে না গতরে? তোমার ঠান্ডা গাল দুইটা গরম করতে চাইলাম, দেখি হাত দুইখান বাড়ায় দিসো। ইশ, তোমার চোপাড়ের কথা ভুলি নাই। তাই আর ঘাটাইলাম না। আবদুল্লাহর উপর বহুত মায়া জন্মাইছে না? আবদুল্লাহ এক নম্বরের খবিস। না নিজে খায়, না কাউরে খাইতে দেয়। বহু জ্বালাইছে। এইবারের চোটে খায়া দিসি। শুন বেত্তমিজ মাইয়া, পিরিতের স্বামীরে চাইলে এক রাইত আমারে ভালোবাসা দিবি। তোরে বিশ্বাস নাই। হাত পাও বাইন্দা সোহাগ দিমু। কাশেমের লগে পাঙ্গা নিছস। হিসাব বরাবর কইরা পার পাবি। আবদুল্লাহর টাকা লাগব না, চাকরীটা ছাইড়া যাইব গা। গ্রামে গিয়া খেতি করব, তোর খেতা গাত দিয়া হুইয়া থাকব। শালা, হারামজাদার ঘরের হারামজাদা।

কাশেমের দিকে ঠান্ডা চোখে চায়া থাকলাম। এরে এখন ঘাটানোর দরকার নাই। বুড়া শিয়াল আর শকুন দুইটাই খারাপ হয়। আরো খচ্চর হয় বুড়া অজগর। পেঁচায় ধরে গিল্লা ফালায়। কাশেমরে আমি প্যাঁচ দিয়ে ধরতে পারি, তাতে আবদুল্লাহ মিয়ারে বাঁচানো যাবে না। সকাল হইতে দেরী নাই। কাশেমের দিকে তাকায়া এই প্রথম আমি হাসলাম। কাশেম দেখি হা কইরা দেখতেছে।

–এত কষ্ট করা লাগত না বেয়াই। বেয়াই মানে বুজেন তো, ঠাট্টা মশকরার রিলেশন। আমারে কলেজে ভর্তি করায়া আবদুল্লাহ মিয়া কামের কাম করসে। কথার ভিতরে রস দিয়া খিলি পান বানায় কথা কইতে পারি এখন। আপনে আইজ রাইতে দুই খান কোকাকোলা নিয়া আসবেন। নাচ হবে, গান হবে এরপরেই না ফুর্তি। লুৎফা খানমরে কিতা করবেন?

–সে থাকবে ঐ বাড়িতে। তার এখানে কাজ কি। তারে নিয়া টেনশন নাই। আমার হুকুম ছাড়া সে নড়লে তার কোমড়ের বাকি হাড্ডি গুলা ফালায় দিবো। বান্দিরে সামলাইতে পারি নাই। শিক্ষিত মাইয়া বিয়াটা করতেই হইলো। কাশেম হারব মাইয়ালোকের কাছে? থুহ! গেলাম, মায়মুনা রানী রাইতে আসবো।

–আমার ঘরে বসতে পারবেন না কয়া দিলাম। আপনের ঘর খুইলা দেন। আবদুল্লাহ মিয়া আজ আসবে না। আপনের ঘরে আপনের জন্য অপেক্ষা করলাম। আপনে হলেন কাশেম বস। বস আসবেন, বসের মতো।

কাশেমের দেখলাম কথাটা বিশাল পছন্দ হইছে। সে খুশীতে ক্যালক্যাল করে ঘর খুলে দিয়ে চলে গেলো। দুয়ার দিয়ে ঠান্ডা মাথায় ঘটনা গুলা ভাবলাম। আবদুল্লাহ মিয়ার জিনিষ আছে, রশীদ নাই। জিনিষ কম মানে হইলো জিনিষ কিনে নাই টাকা সরাইছে আবদুল্লাহ মিয়া। আর যে তারে ফাঁসাইছে সে রশীদ সরাইছে, সাথে মাল। কাশেমের কাম পুরাটা। লুৎফা যেমন চালাক চতুর, তারে লুকায় মাল আনা সম্ভব না। কিছুতে ভইরা লুকাইছে। ঐ বাসায় রাখে নাই, লুৎফা টের পাবে। মানে মাল এখন এই ঘরের কোথাও আছে। কই আছে, ভাব ছাগী ভাব। তোর হাতে আইজ দিনের সময়। এরপর জীবনে আবদুল্লাহর সামনে দাঁড়াইতে পারবি না। কাশেমরে খুন কইরা জেল খাটবি। মাথার মধ্যে পিড়া বেলনী দিয়া বাড়ি দিতে মন চাইতেছে। সারা ঘর আতি পাতি দিয়া খুজলাম। চালের ড্রামে কাচের কৌটায় পাইলাম এক জোড়া সোনার দুল, পাতলা হার, সোনার আংটি। আরো নিচে পাইলাম লুৎফার সার্টিফিকেট, বিয়ার কাবিন নামা। দেনমোহর মাত্র তিরিশ হাজার টাকা। কুত্তার পয়দা কাশেইম্যা, তোরে যদি ছিড়া ছিড়া কাউয়া দিয়া না খাওয়াইসি তো আমার নাম মায়মুনা না। পাকের ঘরে আর কিছু নাই। জুতার বাক্স, খাটের নিচ, আলমারিরার চিপা, গোসলখানার তাক সব ফানাফানা কইরা খুজসি। ক্লান্ত হইয়া খাটের উপর শুইয়া পরসি। তড়াক করে লাফায় উঠলাম। খাটটা বাক্সের মতো। জাজিম উঠাইতে জান বাহির হয়া গেলো। ইয়া আল্লাহ, খবিসের বাচ্চাটা জাজিমের নিচে মালামাল হান্দায় রাখছে। দুপুর হইয়া গেলো, খাদেম ভাই রতন আইসা পরছে। নাওয়া খাওয়া রেখে তাদের নিয়া আবার আল্লার নামে খোজা শুরু করছি। টিভির নিচে লোহার ট্রাঙ্ক রাখা। তালা খুলবো চাবি নাই। রতন কোথা থেকা একটা চিকনা তার দিয়া তালা খুইলা ফেললো। ইউরেকা, পায়া গেছিরে কাশেইম্যা তোর ফাঁসির দড়ি পাইয়া গেছি। খাদেম ভাই রতনরে পাহারায় রাখছি। একখান মোবাইল পাওয়া গেছে। তার মধ্যে লুৎফার বাজে ছবি। খাদেম ভাই পুলিশরে নিয়া দেখাইব। রতনরে বলছি আইক্কা অলা বাঁশ আনতে। ফিরা এসে কাশেইম্যারে বেহেশত দেখায় দিবো। কাগজ গুলা হাতের মুঠায় শক্ত কইরা ধরে শ্বশুড় আব্বার কাছে রওনা দিলাম। মায়মুনা বেগমের কলিজায় এখন ভয় নাই, কাউরে দরকার নাই। আবদুল্লাহ ভুইত্তামারারে আমি মায়মুনা বেগম ভালোবাইসা ফেলসি। আর ভালোবাসলে ভয় ডরের বালাই লাগে না।

পরিশিষ্ট :
বিবাহের শাড়িটা গায়ে দিয়ে বসে আছি প্রায় এক ঘন্টা। সারা গা কুটকুট করে চুলকাইতেসে। মাথার উপর পার্লারের বেটিরা সাপের ফনা বাইধা দিসে। আরো ঘন্টা খানেক পর দরজা দিয়া শাহেনশাহ, আকবরে তাজ আবদুল্লাহ ভুইত্তা দি গেরেট আসলেন। তার গলায় গোলাপ মালা, হাতে মিষ্টির থাল। মন চাইতেছে, ফিক্কা দিয়া মিষ্টির থাল ফালায় তারে।দিয়া বোম্বাস্টিং খেলি। হালার বেটা ঘরে ঢুইকা আমারে না দেইখা আমার দৌড়ের মেডেল দেখা লাগছে। দরজার বাইরে শাহিনা আর মর্জিনা ফুফুর গুজুর গাজুর শুনতে পাইতেছি। গলা উঁচায়া যারে যার ঘরে যেতে বলেছি। আবদুল্লাহটা ছ্যাবড়া খেয়েছে। এত লজ্জাবতী লাজুক লতা বেটা ছউল হলে তো সমস্যা। খাট থেকে উঠে তারে হাত ধরে বিছানায় বসালাম। সে তব্দা খাওয়া মোরগা হয়ে আছে। এরপর ঠাস করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বাতিটা যাওয়ার আর সময় পাইলো না। আবদুল্লাহ মিয়ারে জড়ায় ধরসি। সে যেমনে ছ্যাবড়া খাইসিলো, তা দেখতে পারলাম না। সে ফিট খাইলে খাক, না খাইলে না খাক। আমার কি! আমি মায়মুনা বেগম, ভালোবাসতে গেলে পায় না শরম। ভুইত্তা মিয়া আজ তোর অভিমানের খ্যাতা পুড়ি। কথায় কথায় সারা জীবন হইবে ইটিশ পিটিশ, মামলা ডিসমিশ। ভালোবাসা দিয়া ভালোবাসা নিব। বহুত দিন আগে রবি কাকুর একটা গল্পে পড়ছিলাম, একটা অসমাপ্ত চুম্বন সমাপ্ত হইলো। আমিও এখন আবদুল্লাহ মিয়াকে চুম্বন করিব। তারপর বাকি আল্লাহ জানে, হিহি, দি এন্ড।

#সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here