যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে #পর্ব_১৩,১৪

0
943

#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_১৩,১৪
Afsana Asha
পর্ব_১৩

একটা আবাসিক এলাকার বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট। এখানেই রাজন মানিকের স্টুডিও কাম বাসা। ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে রাজন মানিক পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। নামকরা একটা ফিল্ম ম্যাগাজিনে কাজ করছে। তার তোলা ছবিতে সেই ম্যাগাজিনের কাভার হতে পারা মানে ফিল্ম বা টিভি ইন্ড্রাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার সেট হয়ে যাওয়া।

রাজনের ক্রিয়েটিভিটি প্রশংসনীয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাকগ্রাউন্ড নির্বাচন, লাইট ফোকাসে সর্বোচ্চ নান্দনিকতায় ওর একেকটা ক্লিক একেকটা শিল্প হয়ে যায়। উঠতি তারকারা তো বটেই টপ স্টাররাও ওর ফটোগ্রাফি সাবজেক্ট হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। স্টিল ফটোগ্রাফিতে রাজন মানিক নামটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

জার্সি শর্টস আর টিশার্ট পরে, কফির মগ হাতে রাজন মানিক যখন অনিকে দেখা দিলেন পেছনের দেওয়াল ঘড়িটা তখন ঘন্টার কাঁটায় বারোটা নির্দেশ করছে। ঘুম ঘুম ফোলা চোখমুখে তাকে অনেক বিরক্ত দেখা গেল৷ বয়স বোঝা যায় না লোকটার। ত্রিশ ও হতে পারে। চল্লিশের কোঠাও পার হয়ে গেছে এমনও মনে হয়। চেহারা বা জেসচার কোনোটাতেই দামী আলোকচিত্রী রাজন মানিক মনে হলো না অনির কাছে। তবু্ও বড় বেশি তাচ্ছিল্য যেন তার চোখে। ইমরানের চোখে তাচ্ছিল্য দেখেই ও মানুষের চোখ পড়তে শিখে গেছে।

কফির কাপে সিপ নিলো রাজন, সামনে কেউ আছে তোয়াক্কাই করল না। টেবিলের উপর কাপ রেখে জোরে চিৎকার করল ‘আলকাস? আলকাস?’

কেউ না আসাতে বিড়বিড় করল ‘কাজের সময় কই থাকে এরা?’ রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে অনির দিকে ফিরে বসে বলল ‘কী ব্যাপার?’

অনি ইতস্তত করল। তারপর বলল ‘স্পেশাল ফটোসেশান করব।’

‘টাকা জমা দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’

অনির হাত থেকে মানিরিসিট আর ইনফরমেশন পেপারটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বলল ‘এটা তো ফুয়াদের প্যাকেজ। জুনিয়র ফটোগ্রাফার। মেকওভার, কস্টিউম আর প্রপস আমাদের। আড়াই ঘন্টার সেশন। বেস্ট এডিটেড কপিগুলোর প্রিন্ট দেওয়া হবে। মডেলিং পোর্টফোলিও রাইট করে দেওয়া হবে। পডকাস্ট রেডি করে দেওয়া হবে।’

অনি জিজ্ঞাসু হলো ‘আপনি করবেন না?’

রাজনের গাঢ় ভুরুদুটো কুঁচকে গেল ‘আমি সেভেন্টি থেকে শুরু করি। ইনডোর, আউটডোর সেশন থাকে। ম্যাগাজিনে ছবি আসে। কাভারেও আসতে পারে।’

অনির চোখ উজ্জ্বল হয়েই দপ করে নিভে গেল।

রাজন বলল ‘কোনো অসুবিধা নেই। ফুয়াদ আর আমি একই। এমনিতেও সব ছবি আমি তুলি না। ওরাই করে সব। আমি ফিনিশিং টাচ দিয়ে দেই।’

‘সত্তরই দেবো। আপনিই করবেন কাজটা।’ অনিকে চমকে দিয়ে পরশ বলে উঠল৷ ‘এই সপ্তাহেই টাকা দিয়ে যাব। আর কী করতে হবে বলুন?’

‘ওয়েট। আমার শিডিউল কবে দিতে পারব দেখতে হবে। আর সব কাজ আমি করিও না। বিয়েশাদির ব্যাপার না তো? বিয়ের বায়োডাটায় অনেকে ফ্যাশন ফটো করায় আজকাল। আমার তোলা ছবি দিয়ে সেটা হবে না। আমি শুধু প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি করি। সেটা আর ব্যাক্তিগত থাকে না। মডেলের ছবি আমি ম্যাগাজিন, আমার আইডি, পেইজ সবজায়গাতেই পোস্ট করি।’

‘অসুবিধা নেই।’

‘ওকে তাহলে দেখা হবে। পেমেন্ট ক্লিয়ার করে জেনে নেবেন সবকিছু। বেশি কিছু না। প্রিফটোশ্যুট মেকওভার, হেয়ারস্টাইলিং, আউটফিটের মেজারমেন্ট সব আমরাই করে দেবো।’

‘আচ্ছা আসি আমরা।’

দুইভাইবোনে বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠতেই অনি মুখ খুলল। ‘কী হলো ভাইয়া? এতগুলো টাকা?’

‘হ্যাঁ দেবো। তোর জন্য আমার সামর্থ্যের বেস্টটা করব আমি। শুধু তুই কথা দিবি পড়াশোনা করবি ঠিকঠাক। আর এইকাজেই যদি তোর মন লাগে তুই করবি কিন্তু কোনোধরণের লোভ করা যাবে না। বুঝতে পেরেছিস?’

অনি অনিশ্চিত মাথা নাড়ল। পরশের কথা ও বুঝতে পেরেছে কীনা বোঝা গেল না। পরশ আবার বলল ‘তোর শখ হয়েছে যখন, করবি। কিন্তু এই কাজটা কিন্তু পড়াশোনার মতো সহজ না। পড়ার সময় কী হয় দেখ, তোকে একাই পড়তে হয়৷ তোর যদি মেধা থাকে, তুই যদি পরিশ্রম করিস তো তুই ভালো করবি। মিডিয়া কিন্তু সেরকম না। এখানে টিমওয়ার্ক হয়।’

অনির চোখে প্রশ্ন।

‘মডেলিং বল, বা নাটক হোক বা সিনেমা – এখানে পরিচালক থাকে, মেকআপ করার লোক থাকে, ক্যামেরার লোক থাকে, গল্প লেখে কেউ, গানের সুর দেয় কেউ – এমনকি কাজ শেষ হওয়ার পরেও পোস্ট প্রডাকশন এর অনেকগুলো সেক্টর আছে ; এইসবকিছু মিলেই কিন্তু কাজ হয়। আর্টিস্ট একা যতই পরিশ্রম করুক না কেন, যেগুলো বললাম, তার কোনো একটা কাজ ঠিকঠাকমতো না হলে পুরো কাজটাই ঝুলে যায়। বুঝেছিস? তাই ভেবেচিন্তে যা করার করবি।’

অনি আবারও মাথা নাড়ে।

‘এটা মাথায় রাখবি, কাজ করার জন্য বা কাজ পাওয়ার জন্য কোনো লোভ রাখবি না, অনি। লোকে খুব খারাপ জানে এই জগতটাকে। তুই খারাপ কিছু করবি না, এটা আমার অনুরোধ তোর কাছে। রাতারাতি বড় হওয়ার, নাম করার লোভ করিস না।’

বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই এন্টিওয়েভ প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন করে ফেলেছে অনি। যত ছোটো প্রডাকশনই হোক না কেন, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে চেহারা দেখিয়ে ফেলেছে। পরশ জানে, এইটুকুও অনি একা একাই করে ফেলত, অনুমতি না পেলেও। হয়তো গয়না বেচে দিতো নইলে অন্য যেকোনোভাবেই টাকা জোগাড় করে নিতো ও। ফটোশুট ও করাতোই! বাধা পেলে আরও বেশি অসহযোগ করত। তাই পরশ সাথে থেকে, পাশে থেকে, নিজে নিয়ে এসেছে ওকে এখানে।

‘কথা দিচ্ছিস, অনি?’

জেদি অনি এইমূহুর্তে বিগলিত অনেকটাই। তরল মন ঝটপট সায় দিলো ‘হ্যাঁ, ভাইয়া।’

‘লোভ করবি না?’

‘না।’

‘পড়াশোনা করবি?’

‘হু।’

‘হ্যাঁ বল?’

‘হ্যাঁ।’

অনি ঝট করে পরশকে জড়িয়ে ধরল, ‘থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া!’

*****

‘এগুলো কী সর্বনাশের কথা পরশ? আমাদের মতো ঘরে এইসব নাটক-সিনেমা কী মানায় বাবা?’

‘কেন মানাবে না, মা? কাজ তো কাজই। অসৎ না হলে কোনো কাজই ছোটো বা খারাপ না।’

‘এত কথা মানুষ কেন বুঝবে? সমাজে চলতে হয় আমাদের। ছিঃ ছিঃ করবে মানুষ।’

‘আমাদের নিয়েই সমাজ মা, সমাজের জন্য আমরা না। আমার দুটো বোন, তুমি আর আমি – আমরা যদি ভালো থাকি, সমাজ কী বলল তাতে কিছু আসবে যাবে না।’

‘এসব বললে হয় না, বাবা। তোমার চাচারা রাগ করবে।’

‘বড়চাচাকে আমি সব বলেছি, মা। প্রথমে বকেছেন, পরে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললে আর কিছু বলেননি। আমি সাপোর্ট না দিলে অনি খারাপ কিছু করে ফেলত মা। ও এখন কারো কথা শুনবে না, ওর পক্ষে কথা না বললে।’

‘না, না, পরশ কাজটা ভালো হয়নি’ অস্থির হলেন সুমনা বেগম ‘সাইদা আপা কী না কী মনে করবে আবার?’

‘কে কী মনে করবে, মা?’

ছেলের দৃষ্টির সামনে একটু ইতস্তত করলেন সুমনা বেগম ‘সাইদা আপা। অনির শাশুড়ি!’

‘অনির আবার শাশুড়ি কীরকম? ওর বিয়েটা তো ভেঙে গেছে?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু সাইদা আপা আশা করে আছেন, ইমরান ফিরলে আবার ওদেরকে এক করে দেবেন। এভাবে ভাঙতে চাইলেই কী ভাঙা যায়?’

‘মা, এই আশা তুমি আর মনে রেখো না। এসব থেকে বেরিয়ে এসো। বেরিয়ে এসে অনির হাতটা শক্ত করে ধরো। অন্ধকার যে চোরাগলিটাতে ওর জীবনটা ঢুকে গেছে, সেখান থেকে বের করে আনতে না পারলেও, ওর হাতটা শক্ত করে ধরো। যেন, হোঁচট খেয়ে পড়ার মূহুর্তে ও জানতে পারে, আমরা আছি ওর সাথে। ওর পাশে। তাহলে গলির শেষপ্রান্তে একটা রাস্তা ও নিজেই বানিয়ে নিতে পারবে।’

‘তাই বলে নিজে গিয়ে এইভাবে এইপথে এগিয়ে দেওয়াটা তোমার ঠিক হয়নি। এমনিতেই কথা শোনে না। আরও আস্কারা পেয়ে বসল। অনি অবুঝ, কিন্তু তোমার বুদ্ধির প্রশংসা সবাই করে বাবা।’

‘সেটাও ভেবেছি মা। কিন্তু ও মনস্থির করেই ফেলেছে। মডেলিংই করবে। ওকে আমরা আটকাতেও পারতাম না। আমরা ওর হাতটা ছেড়ে দিলে, যদি খুব খারাপ কারো খপ্পরে পড়ে যায়, সেই ভয়টাই আমি পাচ্ছি, মা।’

‘হাত, পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখি না কেন?’

‘সেটাই তো আমরা করেছি মা। ওকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছি! ও যে বেঁচে আছে, সেটাই খুব বেশি মনে হয় না তোমার? যে জীবনটা আমরা ওকে দিতে চেয়েছিলাম, সেটা ওকে মেরে ফেলেছে। এখন ওর মতো করে একটা জীবন, ও বাঁচুক! এত ভেবো না মা।’

‘ভাবতাম না পরশ। মেয়েটা যদি খুব চালাক চতুর হতো, তবে ভাবতাম না। এই মেয়েতো মনের খেয়ালে চলে, লোকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে যাবে।’

এই ভয়টা পরশেরও। অনি এত বেশি আবেগপ্রবণ যে ঝড়ের মুখে একেবারে হুড়মুড় করে ভেঙে যাবে।

রাজন মানিক ডেট দিয়েছে। ওনার স্টাইলিং টিমের সাথে অনির বেশ কয়েকটা গ্রুমিং সেশন হবে…

চলবে
Afsana Asha
#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_১৪

‘এই যে আপু এদিকে তাকাবেন! হ্যাঁ, হ্যাঁ একদম। চোখ মেলে দিন। ভুরু কুঁচকে থাকবেন না। কোথাও আনকম্ফোর্টেবল হলেই বলবেন।’

‘আলো লাগছে চোখে? বলবেন আপু।’

‘চুলে হালকা করে হাত দিন আপু। আনমনে কিছু ভাবছেন। হ্যাঁ হ্যাঁ, আরেক পা সামনে আসুন, হাতটা ফুলটার উপর ছুঁয়ে দিন। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। না না আরেকটু হাসুন। ক্লোজআপ যাবে।’

স্টুডিওতে একের পর এক ফ্ল্যাশ পড়ছে। কথোপকথন কানে আসছে। ফটোজোনে পরশকে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে স্টুডিও দেখা যাচ্ছে। কাজ অনেক গোছানো এদের। আজকে টেস্ট ফটোশুট হচ্ছে।

রাজন মানিক আজ কাজ করছেন না, আসেনওনি এদিকে। কিন্তু তার টিম অনেক করিৎকর্মা। স্টাইলিং টিম আজকে অনির পোজ, লুক, ব্যাকগ্রাউন্ড আর লোকেশন নিয়ে আউটলাইন রেডি করবে। বেস্ট ছবিগুলো ডেমো হিসেবে রেখে ফাইনাল ফটোশুটের কস্টিউম, লোকেশন, লাইটিং ফিক্সড করবে।

একটা টিমে কতধরণের মানুষ পরশ অবাক হয়ে দেখে – হেয়ার স্টাইলিস্ট, ওয়ারড্রব স্টাইলিস্ট, নেইল স্টাইলিস্ট, ব্যাকড্রপ স্পেশালিস্ট, প্রপস ম্যানেজার, লাইট টেকনিশিয়ান, আরও আরও কত!

কাজের ব্যাপ্তি দেখে টাকাটা খুব বেশি মনে হচ্ছে না পরশের কাছে। চারটে সেশনে অনিকে একদম নতুন করে গড়েপিটে নিয়েছে ওরা। হেয়ারস্টাইলিং, কমপ্লিট মেকওভার তো হয়েছেই, দুইকেজি ওজন ঝড়িয়ে বডিশেপে চেঞ্জও আনতে হয়েছে অনিকে। ওজন ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত রাজন মানিক ডেট দেয়নি।

বিভিন্ন রকম জামায় ট্রায়াল চলেছে সমানে। হাইহিলে অভ্যস্ত করানো হয়েছে। জামা, গয়না, জুতো, একসেসরিজ সবই ফটোগ্রাফার এর টিম স্পন্সর করছে।

অরিজিনাল সেশনের জন্য পাঁচটা ড্রেস পছন্দ করা হবে। আউটডোর আর ইনডোর মিলিয়ে সারাদিনের সেশন। অনি ফট করে বলল ‘পাঁচটা না, প্লিজ চারটা। চারটাতেই কাজ হবে।’

টিম এসিস্ট্যান্ট জাহিন অনির চার দুর্বলতা ধরে ফেলেছে। ও হেসে ফেলে ‘আচ্ছা যান, চারটা। নইলে বাড়ির থেকে এক্সট্রা নিয়ে আইসেন। আলাদা কয়টা ছবি তুলে আটটা বানায় দেবো।’

অনির মুখ দেখে আশ্বস্ত মনে হলো।

অনির উপরেও ধকল কম যাচ্ছে না। খাবার, ঘুম, এক্সারসাইজ – পুরো লাইফস্টাইলে রুটিনবাঁধা তো আছেই – হাঁটা, কথা বলা, হাসি এমনকি তাকানোটাও শিখতে হচ্ছে। পিন্টারেস্ট থেকে ফ্যাশন ফটোগ্রাফির ছবি নামিয়ে ট্রায়াল দেওয়ানো হচ্ছে অনিকে দিয়ে, বেস্ট লুকটা টিম মার্ক করে নিচ্ছে।

অনিকে একেকটা ছবি বারবার দেখিয়ে এক্সপ্লেইন করছে ওরা, চোখ থেকে ঠোঁটের কাজ। দাঁড়ানোর ভঙিমা বা বসার কায়দা। হাসির মাপটুকুও বুঝিয়ে দিচ্ছে ওরা অনিকে।

লাল রঙের একটা অফ শোল্ডার গাউন পরে অনি দৌঁড়ে এলো ‘ভাইয়া দেখ, দেখ, কেমন লাগছে? ভালো না?’

আসলেই সুন্দর দেখাচ্ছে অনিকে। পরশ হেসে ফেলে বলে ‘তুই তো সুন্দরই!’

‘সেই সুন্দর না ভাইয়া! হিরোইনদের মতো লাগছে কীনা সেটা বলো?’

‘ভালোই তো মনে হচ্ছে!’

‘আমি মডেল হতে পারব তো? এই ফটোশুটটা হলে সব ডিরেক্টর, প্রডিউসারদের কাছে ছবি পাঠালে, ওরা আমাকে ডাকবে না?’

‘ডাকবে না কেন?’

‘ধরো, আমি নিজেই গেলাম আমার ছবি আর ওই যে বলল, পোর্টফোলিও, ওইটা নিয়ে যদি যাই, একেবারে তারা যদি কিছু একটিং করে দেখাতে বলে দেখিয়ে দিলাম। বলো?’

‘হুম।’

‘তুমিও যাবে আমার সাথে। সময় হবে না? আচ্ছা সময় না হলে আমি একাই যাবো!’

‘অতদূর এখনি কেন ভাবছিস? সে যখনকারটা তখন দেখা যাবে।’

‘আপু চলে আসেন? ফ্রন্টলাইট দিয়ে কাজ হবে এখন। আমরা রেডি।’ কল এলো অনির।

কতধরণের লাইটের ব্যবহার, অবাক হয় পরশ। ফ্রন্ট লাইট, ব্রড লাইট, ব্যাক লাইট, রিম লাইট, বাটারফ্লাই লাইট! কোনোটা নাইনটি ডিগ্রি এঙ্গেলে শ্যাডো তৈরি করছে তো কোনোটা ফরটি ফাইভ ডিগ্রিতে। লম্বা স্ট্যান্ড দিয়ে মডেলের একেবারে মাথার উপর আলো ফেলে নাকের নিচে আলোছায়ার খেলা তৈরি হয় বাটারফ্লাই লাইট দিয়ে। ছবি তোলার এত কায়দা, এত এত যন্ত্রপাতির ব্যবহার, অজানাই থাকত পরশের কাছে। ফ্রন্ট লাইট একেবারে রোদের মতো, মুখের উপর পড়ে। বিদ্যুৎ শক্তিকে আলোক শক্তিতে রূপান্তর করলে কিছুটা তাপশক্তিও নির্গত হয়। এই তাপে মুখ ঝলসে যায়।

‘এই লাইটটা অনেক গরম, জানো ভাইয়া?’ কাজে ফিরতে ফিরতে বলল অনি। তবুও আনন্দিত ও। ওর চোখেমুখে সেই আনন্দ দেখে পরশ স্বস্তি পাচ্ছে। শুধু একটা চিন্তা কাঁটার মতো গলায় আটকে রয়েছে। বারবার সরিয়ে দিতে চাইলেও ফিরে ফিরে এসে মাথা খেয়ে নিচ্ছে।

সাদামাটা অনি, যে কখনো ভবিষ্যৎ ভাবেনি, কিছু হতে হবে, কেউ একজন হতে হবে, জীবনে এমন কোনো পরিকল্পনা ছিলো না কোনোদিন, কোনো কাজ করার স্পৃহা দেখায়নি কখনো, হেসেখেলে দুরন্তপনায় ব্যস্ত ছিলো সে কেন এতটা ডেসপারেট হলো?

এই এত আয়োজন, এত পরিশ্রম কেন? এত তাড়াহুড়োই বা কেন?

মডেলিংয়ে আগ্রহ কেন তৈরি হলো অনির?

সত্যিই কি এটা ওর আগ্রহের জায়গা নাকি কাউকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য?

ইমরানকে কি ভালোবেসে ফেলেছিল ও? এখনো কি ভালোবাসে অনি ইমরানকে? অনির প্রথম ভালোবাসা কি ইমরান?

প্রথম ভালোবাসা ভুলে ও কি এগিয়ে যেতে পারবে নাকি আঁকড়ে ধরে তিলে তিলে শেষ করে দেবে নিজেকে? এই ডানাভাঙা পাখিটার কতখানি প্রাণশক্তি আছে কে জানে? ঠিক কতটা আকাশ উড়তে পারবে ও? ধেয়ে আসা উড়ো ঝড়ের মোকাবেলা করতে পারবে কী, নাকি পথভুলে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে?

এসব ভাবলেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে ওর। ভাঙচুর করতে ইচ্ছে করে। লোকে বলে ‘কার্মা’। কৃতকর্মের ফলই নাকি ভোগ করতে হয় মানুষকে।

তবে অনির এই শাস্তি কেন? জীবন বোঝার আগেই জীবনের সব আনন্দ কেন ঝরে গেল মেয়েটার। এইটুকু জীবনে এই মেয়েটার অন্যায় কোথায়? কোন কর্মের জন্য শাস্তি হচ্ছে ওর?

জীবনে আরেকবার কোনোদিন ইমরানকে সামনে পেলে একটা খুন অবশ্যই করবে পরশ। সেটাই হবে ‘কার্মা!’

*****

‘মা একটু দোয়া করে মাথায় ফুঁ দিয়ে দাও না?’

‘যাহ যাহ সর? যাইতেছিস হারাম কাজে। বেলেল্লাপনা, বেহায়াপনা করতে, আবার দোয়া চাস?’

কালো হয়ে যায় অনির মুখটা। ‘আর ওইসব বেলেল্লা, বেহায়ারা যখন নাটক করে, সিনেমা করে তখন যে হুঁশ থাকে না, টিভির সামনে বসে বসে হাঁ করে গেলো, সেইটা দোষের না?’

‘যা, সামনে থেকে?’ অনিকে বকেই সুমনা কাঁদতে শুরু করেন, ‘চার আঙুল কপাল। সেই কপালে যা লেখা আছে তাই তো হবে। আমার কপাল আমি নিজে পোড়াইছি নাকি তোর কপাল সাধ করে পোড়াইছি যে এইভাবে তুই শাস্তি দিবি? কারো কোনো কথাই কানে নিবি না? আর তোরও বা দোষ কী দেবো, আগের হাল যেদিকে যাবে পরের হালও তো সেদিকেই যাবে!’

‘আগের হাল কি আমি?’ পরশ এগিয়ে এসে বলল ‘আজকের দিনেও মেয়েটাকে না বকলে পারতে, মা!’

‘সাধ করে আর বকিনি। ওকে বুঝানোর বদলে বগলদাবা করে ঘুরছ তুমি। ও ভুল করছে বলে সবাই ভুল করব?’

‘কোনটা ভুল মা? এই যে ও কোনো একটা কাজ করতে চাইছে। এটা? নাকি যেটা আমরা করেছিলাম সেটা? পনেরো বছর বয়সের একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলাম লোভে পড়ে, সেই ছেলের বিয়েতে মত আছে কীনা একবারও জিজ্ঞেস না করেই। আমাদের লোভটা ভুল ছিলো না?’

‘অনি কি আমার শত্রু, যে আমি ওর সর্বনাশ হবে জেনে ওকে বিয়ে দিয়েছিলাম? বারবার ওই এক কথা কেন বলো তোমরা?’

‘সেটাই তো বলছি মা। জেনেশুনে কেউ ভুল করে না, ভুল করছি জেনে কেউ ভুল করে না। ভুল হয়ে যায়। যেমন আমরা ভুল ছিলাম। হয়তো অনি ভুল না। ও যা করছে, সেটা যে ভুল না তা হয়তো একদিন বুঝতে পারব।’

‘আর যদি ভুল হয়, ভুল করে?’

‘ফিরে আসবে। কিন্তু আফসোস থাকবে না তো।’

‘এত জ্ঞানের কথা তোমারে বলতে বলিনাই। এখনো বাপের সম্পত্তির আয়ই খাও। এতটা লায়েক হওনাই যে কথায় কথায় মা, চাচা – সবাইকে জ্ঞান দিবা। মেয়েটার সর্বনাশ করতেছ তুমি। ও মরবে। এই নায়িকারা কী করে বেড়ায় তা তো দুনিয়া জানে। অনিকে আর সমাজে নেওয়া যাবে?’

‘ও তো এমনিতেই সমাজছাড়া। গ্রামে গিয়েছিলে তো, রটনা শোনোনি? ভালো ভালো ভাবো মা। দেখবে সব ভালো হবে।’

‘ভালো কিছু হবে না বাপ। আমি মা হয়ে বলতেছি, ভালো হবে না। মায়ের মন সব টের পায়। ভালো হবে না।’

চোখের পানি মুছে সুমনা সোজা হয়ে বসেন ‘আচ্ছা, বাপ। ছবি তোলার শখ করেছে ওর। তুলুক। আমার টাকা যা গেছে, যাক। তারপরে আর না। আর না বাপ। ওরে তুমি বুঝাও। সাইদা আপা ঠিক ঘরে তুলবে আবার ওকে। কিন্তু পচা পাঁকে পড়লে আর কেউ ওকে টেনে তুলবে না। ওরে বুঝাও।’

‘তুমি বোঝো মা। তুমি আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখছো।’

‘আমার আরেকটা মেয়ে আছে পরশ। অলিরে বিয়ে দিতে হবে না? সীমা, রিমার বিয়ে কীভাবে দেবে, অনি এমন বদনামির লাইনে গেলে? সব ভেসে যাবে বাপ!’

‘কার কী হবে সেটা তুমিও দেখোনি, আমিও দেখিনি। যেটা দেখিনি সেটা নিয়ে কথা বলাটা বাতুলতা। দোয়া করতে না পারো অভিশাপ দিও না। আর অন্য কারো জন্য অনিকে কোনো স্যাক্রিফাইস করতে দেবো না আমি। অনি, অনির মতো করে বাঁচবে, তাতে কেউ ডুবুক বা ভাসুক!’

‘অনি মরবে।’

‘মরুক। মা হয়ে বারবার মরতে বলছ, ওর মরাই উচিত। যে মরার কথা বলছ তুমি হয়তো সেটাই হবে ওর জীবনের পূর্ণতা! ভবিষ্যৎ কে দেখেছে মা?’

রাগ করে বললেও, মুখে সন্তানের মরণকামনার অপরাধবোধে বারবার জিভ কেটে তওবা পড়েন সুমনা! ‘আল্লাহ হেদায়েত করো’ নামাজের পাটিতে বসে দোয়ায় হাত ওঠে তার…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here