#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_২১,২২
Afsana Asha
পর্ব_২১
অনি হতচকিত হলেও উপস্থিত বুদ্ধি হারালো না। এরকম পরিস্থিতি ওর জন্য নতুন না। বিনোদন দুনিয়ার বিভিন্ন পার্টিতে অযাচিত স্পর্শ পায়নি এমন কোনো মেয়েকে খুজে পাওয়া যাবে না। মদ্যপ কেউ কেউ হুট করে এসে জড়িয়ে ধরে, কেউ থ্যাবড়ানো চুমুর লালায় মুখ ভরিয়ে দেয়, কেউ টেনে নিয়ে যেতে চায় আঁধার কোণায়। এইসব ভালোমতোই সামাল দিতে জানে অনি। পা-টা বাঁকিয়ে এনে হাঁটু পর্যন্ত উঁচু করে সর্বশক্তি দিয়ে পেন্সিল হিলের গুঁতো দিলো ইমরানের জুতোর উপর। ফরমাল শু দেবে গিয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল ইমরান। একপায়ে খুঁড়িয়ে কোনোরকমে টেবিলের এইপাশে রাখা নরম সোফাটায় বসে পড়ল। হঠাৎই কান গরম হয়ে উঠেছে, বেশ গরমও লাগছে। চিকন ঘামের স্রোত নেমে যাচ্ছে কপাল দিয়ে। বেশ ভালোরকমই লেগেছে। ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখছে ও। কী হলো সেটাও বুঝতে পারছে না। যতই অনির খেয়াল মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুক না কেন কল্পনায় অনি অনেকরকম করেই ওর কাছে এসেছে। এরকম আদর করাটাও নতুন না ইমরানের। স্বপ্ন বা কল্পনায় কি ব্যথার অনুভূতি হয়? ইমরান দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল৷ নিজের মানসিক স্থিতি সম্পর্কেও সন্দিহান হলো। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে না তো! অনিকে পাওয়ার তীব্র আগ্রহ কল্পনায় রক্তমাংসের আরেকটা অনি তৈরি করে নিয়েছে কি? স্বপ্নের সেই অনিকে স্পর্শ করলে কোনো অনুভূতি হয়নি কোনোদিন, কিন্তু আজকে তো উষ্ণতার সাথে সাথে অনির পেলবতাও ওকে ছুঁয়ে গেছে। স্বপ্ন বা কল্পনা কি এতটাও বাস্তব মনে হয়?
হতচকিত আর বিভ্রান্ত ইমরান তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়ার চিন্তা করল। অনিকে সামনাসামনি পেলেই শুধু এই ধাঁধাঁ থেকে বেরোতে পারবে ও।
*****
বিস্মিত সামাদকে প্রায় ঠেলে নিয়ে, জুতোজোড়া হাতে তুলে অনি দৌঁড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে পরশের কাছে এসে ওর হাত ধরে টানল।
‘ভাইয়া, চল এখান থেকে।’
একটুখানি সময়েই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে অনিকে। পরশ অবাক হয়ে জানতে চাইল ‘যাব মানে? হয়ে গেছে তোর?’
‘হ্যাঁ। চল আগে।’
‘কন্ট্রাক্ট পেপার কই? পড়েছিস ভালো করে?’
‘ভাইয়া আগে বেরো। বলছি সব।’
অনির চোখ পড়তে পারল না পরশ, শুধু বুঝল এতবড় কাজ পাওয়ার আনন্দটা মিলিয়ে গেছে। ‘সমস্যা কী অনি? ওরা তোকে বাদ দিয়েছে?’
অনি কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল ‘ভাইয়া চল না? না হয় আমি একাই যাচ্ছি।’
‘কী হয়েছে সেটা তো বলবি আগে।’
ভাগ্যিস এখানে উপস্থিত অন্যরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত নইলে ঠিক দেখে ফেলত তিরতির করে কাঁপছে অনি। ওর ঠোঁট ফুলছে। পরশ ওকে জোর করিয়ে বসালো। ঠান্ডা হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিলো। তারপর আদর করে জানতে চাইল ‘কী হয়েছে অনি? কেউ অসম্মান করেছে?’
অনির চোখভরা পানি। ভাষাহীন চোখদুটো টলটল করছে। যেকোনোসময়েই ছাপিয়ে উঠবে। ঠোঁট কামড়ে ধরে ও শুধু বলল ‘ইমরান!’
‘ইমরান?’ অবাক হলো পরশ ‘এখানে? একজন্য চলে যেতে চাইছিস তুই? কিন্তু কাজটা তো তুই নিজের যোগ্যতায় পেয়েছিস।’
‘ভাইয়া সেসব পরে হবে, এখন চলো।’
‘অনি এভাবে চলে গেলে তুই তো হেরে যাবি।’
‘ভাইয়া প্লিজ!’
অনি প্রায় ছুটে অফিসটা থেকে বেরিয়ে গেলো। পরশও পেছন পেছন ছুটল।
*****
ইমরানও প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরল। পারলে গাড়িটাকে উড়িয়েই নিয়ে আসত। পারেনি, তাই যা একটু দেরি হয়েছে। সাইদা পলাশডাঙা থেকে ফিরেছেন। আরো আরো অনেক লোকে বাড়ি ভরে আছে। হাসি আর গল্পের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
বাসায় ঢুকেই বসার ঘরে অনির ছোটোচাচিকে দেখল ইমরান। সাইদার সাথে বসে কথা বলছে। ইমরান একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলো, মুখে সালাম বলবে নাকি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে। বিয়ের পরপর কাউকেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা হয়নি, এখনও বোকা বোকা লাগল, তাই হাত কপালে উঠিয়ে বলল ‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’ ভদ্রমহিলা ভুঁরু কুঁচকে এত আস্তে করে সালামের উত্তর দিলেন যে কানে এসে পৌঁছলো না, ঠোঁট নাড়তে দেখে বুঝে নিলো ইমরান। ও আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। ভেতরের উত্তেজনা চেপে রেখে ছোটো ছোটো পা ফেলে এগোলো৷ বুকের ভেতর ড্রাম বাজছে, অনি নিশ্চয়ই ঘরে আছে।
অনিকে না পেয়ে যারপরনাই আশাহত হলো ইমরান। মেজাজও খারাপ হলো অনির উপর। নিশ্চয়ই সেইদিনের বাচ্চা মেয়েটি নেই আর ও। এই সময়ের কর্তব্যজ্ঞানটুকু তো করা উচিত ছিলো ওর। কল্পনার মতো করে কাছে নাইবা আসত, ইমরানের নয়নের তৃষ্ণাটুকুই না হয় মিটিয়ে দিয়ে যেত। চিন্তায় চিন্তায় এই বয়সেই কি হার্টফেইল হবে নাকি ওর? আচ্ছা, টেনশনে কি সত্যিই হার্টফেইল করে? টার্মটা কি আসলেই হার্টফেইল? নাকি অন্যকোনো কারণে হার্টফেইল হয়? চিন্তা করলে পায়ে ব্যথা করে কি? ইমরানের হৃদয়ের যন্ত্রণা যেন পায়ে এসে ঠেকেছে। ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। ইমরান হাসল। কল্পনার ব্যথা বাস্তবেও যন্ত্রণা দেয় তবে, মনে মনে ভাবল।
নানুভাই, মা ডাকছে তোমাকে।’ বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন সাইদা। হাতে একটা গ্লাস। ইমরানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘বেলের শরবত। এত রাতে আর কী খাবি? পিঠা আনছিলাম। এখন খেলে তো খিদা মরে যাবে। শরবত খা। একটু পরেই ভাত দিয়ে দেবো। পলাশডাঙা থেকে বেল আনছি। বেয়াইদের গাছের বেল। খুব মিষ্টি। দুধ-চিনি ছাড়াই শরবত বানিয়েছে বৌমা। খেয়ে দেখ, খুব মজা।’
একটানে শরবতটা খেয়ে নিলো ইমরান। বেশ খেতে। মুখ মুছে বলল ‘তোমার বৌমাকে তো দেখলাম না। আমার সামনে আসা বারণ নাকি?’
সাইদা হেসে ফেললেন ‘তুই তো পছন্দ করিস না। বিরক্ত হোস। এইজন্যই তো আমি বারবার সাবধান করে দিয়েছি, তোর সামনে যেন না আসে। ডাকছি এখনি।’ বলেই বাইরের দিকে মুখ করে ডাকলেন ‘বৌমা? এইদিকে এসো?’
ইমরানের চোখ আর হৃদপিণ্ড দুটোই যেন দরজার চৌকাঠে আটকে রইল। একটা হলদে কমলা শাড়ির আঁচলের প্রান্ত গোচরে এলো, ইমরান চোখ বন্ধ করে ফেলল সাথেসাথে।
সাইদা বললেন ‘সালাম করো। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো ‘
মেয়েলি হাতের স্পর্শ লাগল পায়ে। ইমরান চোখ খুলতেই ওর পায়ের কাছে নিচু হয়ে বসা মেয়েটি মুখ তুলে তাকালো। বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলিয়ে ইমরান আবিষ্কার করল এটা অনি না, অনির বড়চাচার মেয়ে সীমা। অনির চাইতে বছর দুইয়ের বড় জমজদের একজন।
‘এ কে?’ বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না ইমরান।
‘ওই তো বৌমা। ইকরামের বউ।’
‘ইকরাম বিয়ে করেছে? আমাকে বলোনি তো!’
‘বলেছি। তুই খেয়াল করিসনি নইলে গুরুত্ব দিসনি। আর তুই ফোনও করতি তিনমাসে ছয়মাসে। ভালো আছো মা? আমি ভালো আছি। এইটুকু বলেই শেষ। বেঁচে আছিস, এইটুকু ভেবেই স্বান্তনা নিয়েছি আমি।’ অভিমানে চোখ ভিজে উঠল সাইদার।
কথাগুলো মিথ্যে নয়। ইমরানের আসলেও সময় ছিলো না।
‘কবে বিয়ে হলো?’
‘গতমাসে। ইকরাম পছন্দ করেছে। আর আমরা প্রস্তাব দিলে ওরাও রাজি হলো।’
কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ইমরান, অনির সাথে যে ব্যবহার করেছে তারপরে বাপের বাড়ি, পলাশডাঙায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সাইদার। বেলায়েত মুন্সিরা এলাকায় প্রভাবশালী। অনির জন্য তারা সাইদার ভাইদের সাথে সবরকম মেলামেশা বন্ধ করে দেন। এতে করে ব্যবসায়ীক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত যেমন হচ্ছিল, তেমনি গ্রাম্য শালিস বিচারেও মাতব্বর বেলায়েত মুন্সি অকারণেই সাইদার বাপের বাড়ির লোকেদের নাজেহাল করছিলেন। সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে এবারে সাইদা ইকরামকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে বেলায়েত মুন্সি এবারে ভুল করেননি। ইকরামকে বেশ ভালোরকম জিজ্ঞাসাবাদ করেই বিয়েতে মত দিয়েছেন। ইকরাম আপত্তি করেনি, সীমাকে বেশ পছন্দই হয়েছে ওর!
কথা ওঠায় সংকোচ ছেড়ে মরিয়া হলো ইমরান, ‘আর অনি?’
ইশারায় সীমাকে চলে যেতে বললেন সাইদা। তারপর ইমরানের প্রশ্নের উত্তর করলেন, ‘অনি? সে মেয়ে তো একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। বেশ হয়েছে, আমার শিক্ষা হয়েছে। অমন হস্তিনী মেয়েমানুষ আমি কীভাবে পছন্দ করেছিলাম কে জানে। আমার আক্কেল হয়েছে বাপ। এবারে তুই যাকে পছন্দ করে দিবি, তাকেই নিয়ে আসব আমি।’
‘নিয়ে আসবা মানে?’
‘বিয়ে করাবো তোকে।’
‘কেন?’
কেন আবার? বিয়ে করবি না তুই? দেখ এখনি বিয়ের কথা তুলতে চাইনি আমি। এত তাড়া নেই আমার তোকে বিয়ে দেওয়ার। তুই কথা তুললি তাই বললাম। তুই আবার এই কথা ধরে পালাসনে যেন। তুই না চাইলে আমি তোর বিয়ে ভুলে যাব।’
‘কিন্তু আমার বিয়ে কী করে হবে?’
‘সে কী কথা। অন্যদের বিয়ে যেভাবে হয়। যেভাবে ইকরামের বিয়ে হলো।’
‘সে ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো বিয়ে করেছি।’
সাইদা আঁতকে উঠলেন ‘বিয়ে করেছিস, মানে? ওইদেশে? জাপানি নাকি বাংলাদেশি? দেশে আসবে? নাকি ওইদেশেই থেকে যাবি? এইদেশে আসছে নাকি?’
‘মা, ও মা, আমি অনির কথা বলছি।’
‘অনি?’ শান্ত হলেন সাইদা। ‘অনিরে দিয়ে কাজ কী? তালাকফালাক দিয়ে গিয়েছিস। জেদ করেই হোক, বা যাই হোক, তালাক তো দিয়েছিস। ওর কথা ভেবে আর লাভ নেই।’
‘না, মা। তালাক হয়নি।’
‘তালাক হয়নি?’ তারস্বরে চেঁচালেন সাইদা। ‘তালাক হয়নি মানে কি? ওই মেয়ে নিজে বলল, তুই রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে তালাক দিয়েছিস! ওইটুকু মেয়ে বানিয়ে বানিয়ে এতবড় মিথ্যে বলল?’ মাথায় হাত দিয়ে বসলেন সাইদা।
‘না মা, ভুল আমি করেছি। আমার ভুল হয়েছিল মা। তালাক দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তালাক হয়নি। আমি কাগজটা ফিরিয়ে এনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। অনি এখনো আমার স্ত্রী। ওকে নিয়ে এসো মা।’
সাইদা সব বুঝলেন। কিন্তু বিস্ময়ের রেশ কাটল না। বিড়বিড় করে বললেন ‘কী করে আনব ওকে? ও তো নাগালের বাইরে এখন। ও এখন নায়িকা। কোন নায়কের সাথে প্রেম আছে, সবাই বলে। দিনকয়েকের ভেতর বিয়েও নাকি হবে…। আরও কত কথা। ওই মেয়ের বদনাম হয়ে গেছে, বাপ। কারো ঘরে তোলার মতো নেই আর।’
‘বিয়ে কীভাবে হবে? ওর সাথে আমার তালাক তো হয়নি, মা? কী পাগলের মতো বলছ?’
‘কিন্তু অনি তো বলেছে, তালাক হয়েছে।’
‘সে তো, আমি ওকে বলিনি যে তালাকের কাগজ ফিরিয়ে এনেছি।’
‘এই পাঁচটা বছরেও বললি না?’
‘আমার ভুল হয়েছে মা। আমি বুঝতে পারিনি।’
‘আমি বুঝেছি। আর তুইও পরিষ্কার বুঝে নে, ওই মেয়ে আমি আর ঘরে তুলব না। ও একেবারে বখে গিয়েছে। অলক্ষী একটা। যা আমাকে বললি এখনি ভুলে যাবি। পেটের ভিতর দাফন করে দিবি। এসব কথা আর কেউ যেন না শোনে। সবাই যেমন জানে তালাক হয়ে গিয়েছে, এখনও তাই জানবে…’
চলবে
Afsana Asha
#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_২২
ইমরানকে নিয়মিত অফিস করতে দেখে সাইদা ভেবেছিলেন, তার কথায় কাজ হয়েছে। অনির ভুত তার ভূত নিয়ে ইমরানের মাথা থেকে নেমে গেছে। নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন তিনি।
অনিকে নিতে তার কোনো আপত্তিই ছিলো না। আপত্তি থাকত না।
ইমরান জাপান চলে যাওয়ার পরে, ডিভোর্সের গল্প শুনেও, তিনি নিজেই উপযাচক হয়ে অনির মা সুমনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। ইমরান দেশে ফিরলে তিনি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার অনিকে ঘরে নেবেন, এমনই ভেবেছিলেন প্রথম প্রথম। পরে আস্তে আস্তে এদিক সেদিক দিয়ে শুনলেন, তালাক হলে, তিনমাসের ভেতর ফয়সালা না হলে একই স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করা যায় না। তবে ইসলামি আইন আর রাষ্ট্রীয় আইনের মাঝে কিছু ফাঁকা জায়গাও আছে। সেখানে কিছু করা যায় কীনা সেসব খোঁজেও আগ্রহী ছিলেন।
অনি সাইদার পছন্দের বউ ছিলো, জটিলতা ঘোঁট পাকালেও অনিকে নিয়েই ভাবনার ঘনঘটা ছিলো। তখন অনির পা হড়কানোর সংবাদে দিশেহারা বোধ করেছিলেন। প্রথমে শুনলেন, নাটকে নামার কথা। তারপর একে একে এই নায়ক, ওই পরিচালকের সাথে অনিকে জড়িয়ে নানারকম মুখরোচক গালগল্পও কানে আসতে লাগল। কেউ কেউ তো এককাঠি বেড়ে ছবি তুলে তুলে ইকরামের মোবাইলে পাঠাতে লাগল। সেসব ছবি দেখে প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন সাইদা। পরে ধীরে ধীরে স্থিরতা ফিরে পান। ইমরানই যখন অস্বীকার করেছে, এটাই নিয়তি ভেবে তিনিও অনিকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা মুছে ফেলেছেন। বাপের বাড়ির সাথে মনোমালিন্য দূর করতে সীমার সাথে ইকরামের বিয়ে দিয়েছেন। বেলায়েত শিকদারের পরিবারের সাথে আবার সুসম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়েছে। অনির রসাতলে যাওয়ার সংবাদ আরও ভালোভাবে কর্নগোচর হয়েছে।
ইমরানের যে কাজে আগে রাগ হয়েছিল, পরে মনে হয়েছে, এটাই ভালো হয়েছে। এত চঞ্চল মেয়ে, কখনোই ভালো বউ হতে পারত না। আর যেসব গল্প ভেসে আসে সেসবের সামান্য অংশ সত্যি হলেও ওই মেয়ে আর কারো ঘরের বউ হওয়ার যোগ্য নেই। নাটকের নায়িকাদের সুখ দুঃখ দেখে চোখের পানি ফেলা যায়, দূর হতে অপলক তাকিয়ে চোখে ধাঁধা লাগানো যায়, কিন্তু ঝলসানো চোখ নিয়ে ঘরকন্যা করা যায় না। ওদের নাম তারকা, ওরা আকাশেই সুন্দর – মাটির পৃথিবীতে ওরা নিজেরাও বেমানান, সংসারধর্মেও নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।
পেশাগত জীবন আর ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা করে রাখাটা অনেকে ধর্মের মতো লালন করে। ইমরান হলো সেই জাতের লোক। মন অশান্ত হলেও কাজের জায়গায় বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেওয়া ওর স্বভাবে নেই। ও যখন ছাত্র ছিলো, খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করেছে, পরিবার বা ব্যাক্তিগত সম্পর্ক সেখানে জায়গা পায়নি। দুটোর ভেতর ব্যালেন্স করে চলার অপারগতা আছে ইমরানের, কিন্তু সেসম্পর্কে ও ওয়াকিবহাল নয়। পেশা আর সম্পর্ক, দুটোকেই যে সমান যত্ন করতে হয়, সেটা জানেই না ও। একটা শেষ করে আরেকটাকে কাছে টানতে চাইলে, জীবন দ্বিতীয় সুযোগ নাও দিতে পারে। পড়াশোনা শেষ করতে করতে প্রেম করার সময় যেমন থাকে না, শুধু প্রেম করলে পড়াশোনাটাও হয়ে ওঠে না। সবকিছুই একসাথে একইতালে করতে পারা চাই।
নিজের কাজটুকু গুছিয়ে নিতে নিতে ইমরান হঠাৎ আবিষ্কার করেছে, কেউই ওর অপেক্ষায় নেই। না পরিবার, না অনি। নিজেকে, নিজের বানানো একলার পৃথিবীটার বাইরে ওর জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই এটা ইমরানকে একটা বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে কিন্তু যার যা ধর্ম তা থেকে বেরিয়ে আসাটাও কষ্টসাধ্য। অনির কাছে আসার জন্য ও ছুটির দিনটা পর্যন্ত ধৈর্য রেখেছে। কাজ রেখে ছুটে আসেনি।
সাইদার ভাবনাচিন্তা তার সাথেই থাকল, পরের সপ্তাহে ছুটির দিনটাতে ইমরানকে দেখা গেল অনিদের বাসায়।
অফিসে যেসব ডকুমেন্টস ছিলো অনির, সেগুলোতে এই বাসার ঠিকানাই বর্তমান ঠিকানা হিসেবে লেখা ছিলো। যদিও ইকরামের কাছ থেকে খুব সহজেই নেওয়া যেত কিন্তু ভাইয়ের সাথেও তো সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয় ওর। ফোন নম্বরও দেওয়া ছিলো অনির, নির্দিষ্ট কাগজগুলোতে। ইমরানের সাহস হয়নি সেই নম্বরে ডায়াল করার। সরাসরি দেখা করে মুখোমুখি ডিল করাটাই বেস্ট অপশন মনে হয়েছে মার্কেটিং টপার ইমরানের কাছে।
অনির মা সুমনা, ইমরানকে দেখে অবাক হয়েছেন। তিনি জানতেন ইমরান দেশে এসেছে। কিন্তু সে যে এই বাসায় অনির খোঁজে আসবে সেটা ওনার ভাবনার বাইরে। আর ইমরান কথাও তেমন বলছে না, শুধু অনিকে ডেকে দিতে বলছে। অনি আজ চার বছর বাইরে একা থাকে, বাসায় আসে না, এই কথাটা কীভাবে ইমরানকে বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। যাহোক মন নরম হয়েছিল অনির প্রতি, আজ আবার ওকে গালমন্দ করতে ইচ্ছে করছে। উত্তেজনায় পরশকে ফোন করে ফেলেছেন। কাজটা ঠিক হয়নি। পরশ কেমন ব্যবহার করবে ইমরানের সাথে কে জানে!
সুমনার বড়ভাসুর, বেলায়েত শিকদারকে ফোন করাটা সঠিক হতো। তার বুদ্ধি আর বিবেচনার উপর সুমনার অগাধ আস্থা। তিনিও পরিবারের যেকোনো সিদ্ধান্তে সুমনাকে গুরুত্ব দেন। সীমার সাথে ইকরামের বিয়েতে বেলায়েত শিকদারের আপত্তি ছিলো। সুমনার অনুরোধেই তিনি এই আত্মিয়তা মেনে নেন। সুমনার ধারণা ছিলো, এতে করে দুই পরিবারের সম্পর্কের উন্নতি হলে অনির ভবিষ্যতে ইমরানকে মিলিয়ে দেওয়া যাবে। মনে মনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন তিনি, এই ক’বছর ধরে নামাজের পাটিতে বসে আর তো কিছুই চাননি তিনি, অনির গতি ছাড়া।
ইমরানের কোলের উপর নিজের ল্যাপটপ। কাজ করার সময় অসময় নেই ওর। তবে এখন কাজ করছে না, অফিস থেকে অনির ছবিগুলো নিজের ল্যাপটপ, মোবাইলে ট্রান্সফার করে নিয়ে এসেছে, সেগুলোই দেখছে। এখন এটাই ওর কাজ। আর যে কাজটাই ও করে খুব মন দিয়ে করে। এখন ওর একমাত্র কাজ, একমাত্র লক্ষ্য অনি। লক্ষ্যভেদে ইমরান অর্জুনের মতো।
দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভায় শর্ত ছিলো মাছের চোখে তীরবিদ্ধ করার। সেই মাছটা আবার চক্রের মতো ঘুরে ঘুরে জায়গাবদল করছিল। অন্য সব প্রতিযোগী যখন ব্যর্থ, অর্জুন নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করে। মাছের চোখ ভেদ করে চলে যায় অর্জুনের তীর। অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষক দ্রোনাচার্য তাকে শিখিয়েছিলেন, যেকোনো লক্ষ্যভেদ করতে চাইলে দৃষ্টি পুরোপুরি লক্ষ্যতেই স্থির থাকতে হয়। মাছের চোখ ভেদ করতে চাইলে, দৃষ্টি আশেপাশের কোথাও থাকলে চলবে না, মাছের স্থানবদল কীংবা সভার হর্ষধ্বনি কোথাও মনোযোগ দেওয়া যাবে না।
আজকের ইমরান যেন সেদিনের সেই অর্জুন। যখন পড়াশোনা করেছে, মন দিয়ে শুধু তাই করে গেছে, আজ যখন অনিকে পেতে চাইছে, সমগ্র চিন্তাচেতনা দিয়ে অনিকেই চাইছে।
কিন্তু সময়ও থেমে নেই ইমরানের শুভবোধ জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষায়, অনিও এগিয়ে গিয়েছে অনেকখানি। অন্তত অনির এই ছবিগুলো সেই কথাই বলছে। এই অনি ওর চেনা নয়। অন্যরকম। নতুন। একেবারে অচেনারকম নতুন। সেই বুনো সরলতা নেই, টানা সিঁথিপাটি অদৃশ্য। গেঁয়ো কায়দায় সিঁথি ঢেকে রাখার সেই ঘোমটাটাও নেই। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে অফ শোল্ডার টপস কিংবা শরীর দৃশ্যমান শিফন শাড়ি।
সাদা শার্টের সাথে মাথায় চড়ানো কাউবয় হ্যাট আর নগ্ন উরুতে সাহসী পোজ। সাথে চড়া লাল লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁটের এককোণা দাঁতে চেপে আবেদনময়ী ভঙ্গিমা। সাজানো চোখেই খুন হওয়ার দশা ইমরানের।
একটা ছবি থেকে যেন চোখই নড়ছে না ইমরানের। কালো লেদার প্যান্টের উপর স্লিভলেস ট্যাঙ্কটপ, লেদারের জ্যাকেটটা অবহেলায় কাঁধের দুপাশ দিয়ে ফেলে রাখা, ইটের দেয়ালে হেলান দিয়ে আনমনা দৃষ্টি ঢেকে কালো গগলস চোখে। সেই চড়া লাল লিপস্টিক! লাল রঙটা কি খুব বেশি এট্রাকটিভ নাকি অনিকেই এত বেশি আকর্ষণীয় লাগছে জানে না ইমরান। ও শুধু ক্ষণে ক্ষণে রোমাঞ্চিত হচ্ছে। সেদিনের অনি কল্পনা ছিলো না, সেদিনের স্পর্শটুকু মিথ্যে ছিলো না, সেই চুমুটাও সত্যি ছিলো – ভাবতেই গুজবাম্প এসে যাচ্ছে বারবার!
পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে, টাটানো ব্যথা একবার জানান দিয়ে উঠতেই একা একা হেসে ফেলল ইমরান। অনির সাথে দেখা হওয়ার আগের অপেক্ষাটা লম্বা হলেও ওর ভালো লাগছে। এই অপেক্ষাটাও আনন্দময় হয়ে উঠেছে। অনির হয়তো অভিমান, রাগ সব পাহাড়সমান হয়ে জমে আছে। এই নতুন অনিকে ওর অর্জন করে নিতে হবে। খুব সহজ হবে না, কিন্তু সবকিছু করার জন্যই ইমরান প্রস্তুত। অনি যা চাইবে, যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে সব। ইমরানের অপরাধের বোঝা যে একেবারে কম নয়, বেড়ে বেড়ে কোন আকাশে ঠেকেছে, খুব ভালো করে টের পাচ্ছে ও। তবুও অনির ক্ষমা আদায় করে নেবে ও। জয় করে নেবেই ওকে।
কলবেল বাজতেই ইমরান তড়াক করে উঠল। খুব গুছিয়েই এখানে এসেছে ও। কী বলতে হবে, কী করতে হবে, কীভাবে লাইন বাই লাইন এপ্রোচ করতে হবে, সবকিছু নোট করে মুখস্থ করে করে অনেকবার রিহার্সাল করাও হয়েছে। টেবিলে ঠান্ডা পানির গ্লাস রেখে গিয়েছিল অনির মা, সেই গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলো। আসুক এবার অনি। যুদ্ধযাত্রার দামাদোল বাজতে থাকল ইমরানের কানের কাছে!
না, অনি না। আবারও ভুল হলো৷ অনি আসেনি। পুরুষকণ্ঠ শুনতে পেলো ইমরান। বেশ রাগী চিৎকার ‘কোথায়?’
অনির মা চাপাকণ্ঠে কী উত্তর দিলেন ইমরান শুনতে পেলো না। পুরুষকন্ঠের চিৎকার আবার উঁচুতে উঠল ‘ও কেন এসেছে এখানে?’
‘আহ পরশ, আস্তে, শুনতে পাবে।’
‘সে শুনুক, কেন এসেছে?’
‘কিছু বলেনি। অনি কোথায় সেটা জানতে চেয়েছে শুধু।’
‘মানে? এতদিন পরে অনির খোঁজ কেন?’
‘পরশ, বাবা আমার। মাথা গরম কইরো না। শান্ত হয়ে শোনো কী বলতে চায়।’
‘রাখো তোমার মাথা ঠান্ডা!’
ঝড়ের মতো এসে পরশ ঢুকল আর কোনো কথার ধার না ধেরে সোজাসাপটা ইমরানের উপর চড়াও হলো। প্রথমে কলার ধরে টেনে ওঠালো, তারপরে চড় কষল গোটাদশেক, এরপরে এলোপাথাড়ি ঘুষি। সুমনা পরশকে জাপটে ধরে সরাতে চাইলেন কিন্তু পরশের গায়ে অসুরের শক্তি আজ। ও ইমরানকে মারছে আর চিৎকার করে চলেছে ‘হারামজাদার সাহস কতবড়! অনির জীবন শেষ করে ওর হয়নি। ও এখন মাটিচাপা দেওয়ার কাজটাও করতে এসেছে। আমি পণ করেছিলাম, খুন ওকে আমি করবই। আজকে তোর শেষদিন। নিজে বাড়ি বয়ে এসেছিস মরতে। বলে না, পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। তোরও পাখা গজিয়েছে। তাই উড়ে উড়ে মরতে এসেছিস!’
অলি এতক্ষণ সামনে আসেনি ইমরানের। অনিকে গরম খবর দিচ্ছিলো ফোনে। চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখে ইমরান মেঝেতে, তাকে সমানে লাথি মারছে পরশ। সুমনা ওকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরেও থামাতে পারছে না। অলিও এসে পরশকে টেনে সরিয়ে নিতে হাত লাগালো।
‘এই ছাড় আমাকে, আজকে ওকে মেরেই ফেলব।’ পরশের টকটকে লাল চোখদুটো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
‘বাপ, থাম। মরে যাবে ছেলেটা। আমার ভুল হইছে। আমি ওকে সরিয়ে দিচ্ছি। থাম পরশ, আর মারিস না।’
অলিও বোঝাতে চাইল ‘ছিঃ ভাইয়া, পাগল হয়ে গেলে? এমন ব্যবহার করে কোনো ভদ্রমানুষ?’
পরশ আরো ক্ষেপে গেল ‘এই ভদ্রতা শিখাস আমাকে? আমি ওকে মেরে ফেলব। মেরে ফেলে তারপর থামব।’
সুমনা আবার কাঁদলেন ‘পরশ, ছেড়ে দে। ও চলে যাবে।’
‘কোথায় যাবে? এতদিন মনে মনে এই দিনটাই চেয়েছি আমি। আজ ওকে মেরে আমি জেলে যাব।’
অলি আর ওর মা মিলে বহুটানাহেঁচড়া করে পরশকে সরিয়ে এনে সোফায় বসিয়ে দিলো। সহজে সরাতে পারত না, পরশ নিজেই ক্লান্ত হয়ে গেছে। বসে বসে হাঁপাতে থাকল। ফুঁসতে ফুঁসতে কেঁদেই ফেলল অনির নাম নিয়ে। অনির জীবনের সবটুকু অন্ধকার ও নিজে প্রত্যক্ষ করেছে। যার জন্য দায়ী একমাত্র ইমরান। ওর দেশে আসার খবরেই ফুঁসতে শুরু করেছিল পরশ। আজ নিজের ঘরে বাগে পেয়ে সেই সমস্ত রাগ অগ্নিস্রোতে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অনির একএকটা পতন, একএকটা ভুল, একটুএকটু করে অমানিশায় ঢেকে যাওয়া, সব চোখের সামনে ভেসে আসছে।
সুমনা ইমরানকে মেঝে থেকে তুলে দিলেন। ইমরানের ঠোঁট কেটে গেছে, মাথায়ও লেগেছে, মাথাচোখ ফুলে গেছে। শার্ট ছিঁড়ে রক্তারক্তি। নাক থেকে রক্ত পড়েছে। ভেঙেটেঙে গেছে কীনা কে জানে!
‘যাও বাবা, বাড়ি যাও। একটা ডাক্তার দেখায়ে যাও।’
ইমরান কিছু বলল না। নাক টানতে থাকল। শার্টের হাতায় নাক থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত মুছে নিলো।
সুমনা একটু শঙ্কিত হলেন, সাইদা কী করবে ইমরানের এই অবস্থা দেখে, সেটা ভেবে। সে এখন সীমার শাশুড়ী। এসবের আঁচ সীমার জীবনেও তো লাগবে। আবার থানাপুলিশ না হয়। চারিদিকে তাকিয়ে নিজের ছেলেমেয়েদের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হলেন তিনি৷ ভুলটা তার নিজের লালনপালনে নাকি ভাগ্যের, বুঝে উঠলেন না…
চলবে