উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ২
(নূর নাফিসা)
.
.
সকাল থেকেই আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। নাস্তা করে চা বাগানের দিকে হাটতে লাগলো মেঘ। পাহাড়ি মেয়েরা চা পাতা তুলছে। মেঘ তাদের মধ্যে একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলো। এই মেয়েটিকেই তো দেখেছে কাল পাহাড়ে বাচ্চাদের পড়াচ্ছিলো! কিন্তু আজ দেখতে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। কাল তার পড়নে সালোয়ার কামিজ ছিলো কিন্তু আজ পুরো চাকমা মেয়েদের মতো মনে হচ্ছে। পড়নে স্কার্ট, খোপা করা চুল, পিঠে চা পাতা রাখার জন্য বেতের ঝুড়ি। পাহাড়ি কন্যাকে ভিন্ন কাজে ভিন্ন সাজে সাজতে দেখে খুবই ভালো লাগছে মেঘের কাছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু হলে মেয়েগুলো বাড়ি ফেরার জন্য ছুটতে লাগলো। মেঘ ভিজতে ভিজতে হোটেলে ফিরে এলো। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা বৃষ্টি হলো। বিকেলে মাধবপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই হোটেল ছেড়ে দিলো মেঘ। ব্যাগ কাধে নিয়ে হেটে যাওয়ার সময় পথের ধারে গাছপালায় আচ্ছন্ন উঁচু পাহাড়টা দেখে মনে হলো এই পাহাড়ে একবার ঘুরে যাওয়া যাক। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা একদম ঝকঝকে হয়ে আছে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ি রাস্তা পিচ্ছিল থাকে তাই স্যান্ডেল পড়ে নিলো মেঘ। খুব সাবধানে পাহাড়ের চুড়ায় উঠলো। বিভিন্ন গাছপালা আছে এখানে। দেখতে দেখতে আর একটু এগিয়ে দেখলো এই পাহাড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অন্য একটা পাহাড়ে ঝর্ণা বয়ে চলেছে। ওই পাহাড়ের উচ্চতা আরো অনেক বেশি। কেন জানি মনে হচ্ছে এটা হামহাম ঝর্ণা! এতো সুন্দর একটা দৃশ্য এখানে না এলে দেখতেই পারতো না মেঘ! নিচের দিকটায় তাকিয়ে দেখলো পাহাড়ের অর্ধেকটা থেকে শুরু হয়ে নিচের সম্পূর্ণ সমতল ভূমিতে চা চাষ করা! নিচের দিকে তাকাতেই হঠাৎ করে মাথাটা ঘুরে উঠলো মেঘের। তারপর আর কিছু মনে নেই তার!
৩.
চোখ খুলতেই দেখতে পেলো সে এক কাঠের ঘরে শুয়ে আছে। চারিদিকের বেড়া কাঠের আর টিনের চালা। আশেপাশে কাউকে দেখছে না। শোয়া থেকে উঠতে চেষ্টা করতেই মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো মেঘ। মাথাটা তার ভারী ভারী লাগছে! তাই আর উঠলো না। বা হাতটা নাড়াতে পেরেছে কিন্তু ডান হাতটা নাড়াতে গিয়ে ব্যাথা অনুভব করলো। কি হয়েছে তার সাথে, ভেবে পাচ্ছে না! অত:পর পা দুটো নাড়িয়ে দেখলো ঠিক আছে কি না! নাহ! পায়েও হালকা ব্যাথা আছে! তবে আঘাতটা বোধহয় ডান হাত আর মাথায় বেশি লেগেছে। সে তো পাহাড়ে উঠেছিল! ঝর্ণা দেখছিলো! নিচের দিকে তাকিয়ে চা বাগান দেখেছিলো! তারপর! তারপর কি হয়েছিলো! আর ভাবতে পারছে না!
হঠাৎ দরজা ফাক করে এক মধ্যবয়সী মহিলা প্রবেশ করলো ঘরে। মেঘকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে দ্রুত পায়ে হেটে খাটের ধারে এসে বসলো। মেঘকে জিজ্ঞেস করলো,
– ঠিক আছো তুমি, বাবা?
মেঘ জবাব না দিয়ে মহিলার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। মহিলাকে দেখতে পুরো ঢাকাইয়াদের মতো মনে হচ্ছে। কথাও ঠিক তেমনই স্পষ্ট! পড়নেও সুতি শাড়ি, স্বাভাবিকভাবে মেয়েরা যেমনটা পড়ে থাকে ঠিক তেমন! মেঘকে এভাবে তাকাতে দেখে মহিলাটি আবার জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন লাগছে এখন?
মেঘ মনে মনে বললো, “আর ভালোলাগা! হাত পা মাথা সব গেছে! ” তবুও মুখে অস্ফুট স্বরে জবাব দিলো,
– ভালো। আমি এখানে কিভাবে?
– পাহাড়ের গোড়ায় চা বাগানে পড়ে ছিলে। প্রায় এক দিন পর আজ তোমার জ্ঞান ফিরেছে। এমন অবস্থা কিভাবে হলো?
– পাহাড়ের গোড়ায়! আমি তো পাহাড়ের চূড়ায় ছিলাম!!
– তাহলে কি চূড়া থেকে পড়ে গেছো! নাফিসাও এটাই সন্দেহ করেছিলো।
– কে?
– নাফিসা। আমার মেয়ে। সে ই কাল বিকেলে চা পাতা তুলতে গিয়ে তোমাকে চা বাগানে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে নিয়ে যায়। তারপর দুজন লোকের সাহায্যে তোমাকে এখানে নিয়ে আসি। ডাক্তার ডেকে ওষুধ করাই। আল্লাহর রহমতে প্রাণ আছে তোমার সাথে।
– আমার ব্যাগ ছিলো সাথে, পেয়েছেন কি?
– হ্যাঁ, ব্যাগ, ফোন সবই সযত্নে আছে। তুমি বিশ্রাম নাও। আমি আসছি।
মেঘ মনে মনে বলে নিলো, আল্লাহ! এতো উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে বেচে গেলাম কিভাবে! সবই তোমার রহমত!
মহিলাটি চলে যাওয়ার পরক্ষণে মনে হলো উনি আল্লাহর রহমতের কথা বলেছেন! তার মানে তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের। কিন্তু শ্রীমঙ্গলে তো চাকমাদের বসবাস! আর চাকমারা হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী! যদিও উনাকে দেখে চাকমা মনে হয় না! এরকম বিভিন্ন কথা ঘুরপাক খাচ্ছে মেঘের মাথায়! ঘরের ভেতরে থেকে দিন না রাত বুঝতেও পারছে না! ছোট একটা জানালা আছে তা ও বন্ধ! এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখলো মাঝামাঝিতে ছোট খাটটা পাতানো। কাঠের একটা সুকেচ আছে। পাশেই একটা বুকশেলফ আর ২টা বেতের চেয়ার। বাসায় কি ব্যাপারটা জানানো দরকার! না থাক! শুধু শুধু টেনশন করবে। আর কোথাও বেড়াতেও যেতে দিবে না।
একটু পর মহিলাটি এলো হাতে একটি বাটি নিয়ে। খাটের পাশে রাখা টুলের উপর বাটি টা রেখে মেঘের পাশে বসলো।
– সোজা হয়ে বসতে পারবে?
মেঘ চেষ্টা করে পারলো না উঠতে। মহিলাটি তাকে ধরে একটু তুলে পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসালো। মেঘের হাত দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো।
– হাত নাড়াচাড়া করতে পারো?
– ডান হাতে অনেক ব্যাথা।
– চিন্তা করো না। ডাক্তার বলেছে হালকা একটু মচকে গেছে। একটু যত্ন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। বাসা কোথায় তোমার?
– ঢাকা।
– এখানে বেড়াতে এসেছো?
– হ্যাঁ।
– সাথে কেউ আসেনি?
– না।
– বাসায় খবর দিলে ওরা নিতে আসবে না?
– বাসায় জানাতে চাচ্ছি না। শুধু শুধু টেনশন করবে। কতোদিন লাগবে সুস্থ হতে? ডাক্তার এমন কিছু বলে নি?
– না, ডাক্তার তো তোমাকে ঠিকমতো চেকাপ ও করতে পারেনি সেন্স না থাকায়! একটু পর আসবে ডাক্তার।
– আন্টি এখন সকাল না বিকাল?
মহিলাটি মৃদু হেসে জবাব দিলো,
– বিকাল। এই দেখো, তোমার নামটাই তো জানা হলো না। নাম কি তোমার?
– মেঘ। মেঘ চৌধুরী।
– বাহ! পাহাড়ে মেঘের ছায়া!
আন্টির কথা শুনে মেঘও মৃদু হাসলো। বুঝাই যাচ্ছে বড়ই রসিক আন্টি! কথাবার্তা শুনেও মনে হচ্ছে যথেষ্ট শিক্ষিত। বাটিটা হাতে নিয়ে আন্টি বললো,
– তোমার জন্য স্যুপ এনেছি। ডান হাতে তো ব্যাথা! নিজ হাতে খাবে কিভাবে! আমি খায়িয়ে দিবো?
মেঘ উত্তরে শুধু একটা হাসি দিলো। আন্টিও হেসে খায়িয়ে দিচ্ছেন। আন্টিকে দেখে পুরো তার মায়ের মতো দেখাচ্ছে। কথাবার্তা, আচারব্যবহার সবকিছুতেই যেন মিল আছে! শুধু চেহারাটার মিল নেই। একটু পর ডাক্তার এলো সাথে একটা মেয়ে। মেয়েটাকে দেখে মেঘ অবাক! এটা তো সেই মেয়েটাই! ডাক্তার এসে চেকাপ করার পর বললো,
– কয়েকদিন রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।
মেঘ জিজ্ঞেস করলো,
– কতোদিন লাগবে?
ডাক্তার উত্তরে বললো,
– তা সঠিক বলতে পারছি না। তবে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে।
ডাক্তার মেয়েটির হাতে কিছু ওষুধ দিয়ে বললো,
– নাফিসা, ওষুধগুলো ঠিকমতো দিয়ো। আর কাটা জায়গায় ওয়েনমেন্ট লাগিয়ে দিয়ো। হাতের আর পায়ের ফোলা জায়গায় কয়েকদিন ঠান্ডা জলপট্টি দিয়ো। চার পাচ দিন পর এসে আমি মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দিয়ে যাবো।
– আচ্ছা।
মেঘ এবার নিশ্চিত হলো, এটাই আন্টির মেয়ে নাফিসা! রাতে আন্টি এসে খায়িয়ে দিয়ে গেলো। তারপর নাফিসাকে ডেকে দিলেন ওষুধ দেওয়ার জন্য। নাফিসা এসে আন্টিকে বুঝিয়ে দিলো কোনটা কিভাবে কখন দিতে হবে। ওষুধ দেওয়ার পর আন্টি হাতে আর পায়ের ফোলা জায়গায় ঠান্ডা জলপট্টি দিলেন। মেঘ ইতস্তত বোধ করে বললো,
– আমি আপনাদেরকে বিপদে ফেলে দিলাম।
– না, ঠিক আছে।
– আন্টি, সুস্থ হওয়ার ক টা দিন আপনাদের এখানে থাকলে অসুবিধা হবে?
– সুস্থ হওয়ার আগে তোমাকে যেতে দিচ্ছে কে? পরিবারকে জানাও নি , এখন তোমার দেখবাল করবে কে, শুনি?
মেঘ আর কিছু বললো না। সকালে চোখে সূর্যের আলো পড়লে ঘুম ভাঙলো মেঘের। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা ছোট জানালাটা খুলে দিয়েছে। মেঘকে উদ্দেশ্য করে নাফিসা বললো,
– উঠুন। বেলা অনেক হয়েছে। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিন। ওষুধ খেতে হবে।
নাফিসা ছোট বালতিতে করে পানি এনে দিলো মেঘের কাছে। মেঘ উঠতে পারছে না শোয়া থেকে। নাফিসা উঠতে সাহায্য করলো। আন্টি এসে খায়িয়ে দিয়ে গেলো। নাফিসা ওষুধ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। একটু পর তারাহুরো করে এ রুমে এসে সুকেচের ড্রয়ার থেকে কিছু নিয়ে আবার বেরিয়ে গেলো। মেঘ লক্ষ্য করলো নাফিসার পড়নে ছিলো স্কার্ট। হয়তো চা পাতা তুলতে যাবে এখন।
এভাবে কেটে গেলো এক সপ্তাহ। এর মাঝে ডাক্তার এসে মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দিয়ে গেছে। নাফিসা আর আন্টির সেবায় মেঘ এখন অনেকটা সুস্থ। কাটাছেঁড়া জায়গাগুলো শুকিয়ে গেছে। হাত পায়ের ব্যাথা আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। কারো সাহায্য ছাড়া একা একা হাটাহাটিও করতে পারে মেঘ। তবে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় আন্টি বেশিক্ষণ হাটতে দেয় না মেঘকে। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর থাকতে হয়, আর ঘরের সামনে ছোট উঠোনে একটু হাটে। মাঝে মাঝে পাশের বাসার লোকজনও দেখতে আসতো।