#এক্কা_দোক্কা
#পর্ব_১
#ক্যাটাগরি- থ্রিলার+ রোমান্টিক
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
(১)
— মিস ঐশী, আপনাকে একথা জানিয়ে রাখা ভালো, এই বিয়ের মূল কারণ হবে শুধুমাত্র একটা বাচ্চা! আপনি দ্য রকস্টার ইজহার জুভান মির্জার সন্তানের সারোগেট মাদার হবেন! তার বদলে আপনি যা চাইছেন,আপনাকে তাই দেওয়া হবে! এবার বলুন, আপনি কি সত্যিই এই ডিলে রাজি, মিস ঐশী?
জুভানের ব্যক্তিগত অ্যাসিস্ট্যান্ট শাহাদাতের কথা শোনে একপ্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো ঐশী। মাথাটা হুট করে যেনো দুবার চক্কর দিয়ে উঠলো। বিদঘুটে লাগতে শুরু করলো আশপাশের বায়ু। কি বিশ্রী গন্ধ নাকি মধ্যে ধুম্রজাল তৈরি করলো। ভারসাম্য হারিয়ে পরে যেতে নিল সে পাশে থাকা চেয়ারের হাতল চেপে ধরলো বলিষ্ট হাতে। শাহাদাত ঐশীর শরীর খারাপ দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠলো। ঐশীকে আগলে নেওয়ার চেষ্টায় বলে উঠলো,
— আপনি কি ঠিক আছেন, মিস ঐশী?
ঐশী হাত উঁচিয়ে শাহাদাতকে আটকালো। গলা শুকিয়ে চৌচির হলে খুব কষ্টে এক ঢোক গলাধঃকরণ করলো সে। জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
— ধরতে হবে না, আমি ঠিক আছি।
ঐশী আশ্বস্ত করলেই শাহাদাতের মন খুব একটা প্রসন্ন হলো না। সে ভ্রু কুঞ্চিত করে চেয়ে রইল ঐশীর পানে। ঐশী নামক এই মেয়েটা শ্যামলা বর্নের। তবে চেহারার গঠন বেশ মায়াবী! তবে মেয়েটার চোখের দৃষ্টি তার চেহারা থেকে কেমন যেনো আলাদা, আলাদা! মাঝেমধ্যে মেয়েটার চোখ দেখে মনে হয়, কিছু একটা রহস্য আছে ও দুচোখে। যেদিকে তাকায়, সেদিকটা যেনো জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। নিজ দৃষ্টি দিয়েই সব ছাই করে দেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই মেয়ের। মেয়েটার কথা ভেবে মনেমনে বেশ আপসোস হলো শাহাদাতের। বাচ্চা এক মেয়ে। বয়স কত হবে? এই সতেরো কিংবা আটারো? বয়সটা না জানায় অনুমান করাটাও ঠিক হচ্ছে না। জুভান স্যারের কাছে সর্বদা ভদ্র উপাধি লাভ করায়, শাহাদাত ভদ্রতার খাতিরে ঐশীর বয়স নিয়ে মন্তব্য করলো না। অথচ আজকের পর এই বাচ্চা মেয়ের তার জীবন পূর্ণভাবে জাহান্নাম হতে যাচ্ছে, ভাবতেই গা শিরশির করে উঠলো শাহাদাতের! জুভান স্যারের চরিত্র সম্পর্কে আর কেউ জানুক বা না জানুক, শাহাদাত খুব ভালো করে জানে। স্যারের মেয়েবাজি নেশা দিন তো দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে! স্যারের জাহান্নামের মত জীবনে এই বাচ্চা মেয়েটা বোধহয় এবার পিষেই যাবে! শাহাদাত ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। বিপর্যস্ত ঐশীর পানে চেয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
— আপনি কি রাজি, মিস ঐশী?
আবারও সেই বিশ্রী ডিলের কথা কর্ণকুহুরে প্রবেশ করতেই চোখ বুজে ফেললো ঐশী। কি করবে, কোথা যাবে কিছুই ঠাওর করতে পারলো না সে। আদৌ কি তার এই ডিলে রাজি হওয়ায় উচিৎ? তার স্বপ্নপূরণ করার পথে এ বাঁধা কি না আসলেই নয়? ঐশী কোনরকমে বললো,
— আমাকে একটু ভাবতে দিন, প্লিজ।
শাহাদাত একটা দীর্ঘ দম ফেললো। বললো,
— আপনার যত সময় নেওয়ার আপনি নেন। তবে হ্যাঁ, দিনশেষে উত্তর হ্যাঁ হওয়াই কাম্য! কারণ আপনি তো জানেন, জুভান স্যারের না শব্দের মধ্যে এলার্জি আছে। এই একটা শব্দ শুনলে তিনি এই ভুবনের সব ছারখার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
ঐশী নতমুখে চেয়ে আছে মাটির দিকে। অস্থির দৃষ্টি ঘুরাফেরা করছে মাটির প্রতিটা অঞ্চল জুড়ে। কানের আশপাশে একটাই শব্দ ভাসছে, ‘ জুভান স্যার সব ছারখার করে দিবে ‘ অবশেষে ঐশী চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টানলো। শাহাদাত কিছুক্ষণ ঐশীর পানে চেয়ে রইলো। অতঃপর মেয়েটাকে একা ছেড়ে সে কক্ষ পরিত্যাগ করলো মধ্যবয়স্ক এ লোক!
‘একা থাকলে বুদ্ধির তলোয়ার ধারালো হয়’ তাই এই মুর্হুতে মেয়েটাকে একা ছেড়ে দেওয়ায় উত্তম। অন্তত এই সুযোগে মেয়েটার বুদ্ধি যদি একটু খুলে, রক্ষা পেয়ে যায় আগত ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় হতে।
লোকটা চলে যেতেই ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে ঐশী। দুহাতে নিজের চুল খামচে ধরে শির নত করে সে। মস্তিষ্ক জুড়ে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খায়, ‘ সফলতার প্রান্তে পৌঁছাতে এতবড় ত্যাগ সে করতে পারবে না! নিজের জীবনকে সে এভাবে ধ্বংস করতে পারবে না ‘ কিন্তু হাতে খুব বেশি সময় নেই তার। কি করবে সে? ঐশীর মাথা চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো। বক্ষস্থলের ধরফরানি বাড়তে লাগলো ক্রমশ। পরিপক্ক মস্তিষ্ক হুট করেই হয়ে উঠলো অবহেলিত, অচল!
___________________________
সেদিন রাতে বেশ রাত করেই আশ্রমে ফিরলো ঐশী। রাত তখন কটা বাজে? আটটা কিংবা নয়টা? আশ্রমে কক্ষে কক্ষে কোনো ঘড়ি নেই। সম্পূর্ণ আশ্রমে একটামাত্র ঘড়ি’ই আছে। মাদারের কক্ষে। তাই ঐশীর আর ঘড়ি দেখাও হলো না।
ঐশী বাথরুম থেকে গোসল করে বের হলো। চুলে গামছা পেঁচানো। তবুও তার ঘন কেশ থেকে টিপটপ পানি ঝড়ছে। যার দরুন তার জামার পিঠের অংশ ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে। তবে ঐশী সেদিকে বেপরোয়া! সে তটস্থ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনে দন্ডায়মান মাদারের পানে। মাদারের রুক্ষ দৃষ্টিতে আজ ঐশী নিজের মরণ দেখতে পারছে। মাদার ভরাট কণ্ঠে বললেন,
— এত রাত অব্দি কোথায় ছিলে? জানো না, আমাদের আশ্রমের কেউ সন্ধ্যার পরে বাহিরে থাকে না?
মাদারের ধমকে ঐশী কিঞ্চিৎ কেপে উঠলো। নিভুনিভু কণ্ঠে উত্তর দিল সে,
— বা.বাবা-মায়ের কবরের কাছে গেছিলাম, মাদার!
ঐশীর উত্তরে মাদারের রাগ অবশ্য একটুখানি দমলো। শিশু বয়সে বাবা মাকে হারিয়েছে মেয়েটা। তাই টান তো একটু থাকবেই। তবে তার শক্ত রাগ গলে পানি হওয়ার পূর্বেই তিনি রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
— সন্ধ্যার পর কবরের জায়গা ভালো থাকে না, জানো না সেটা?
— নিজেকে সামলাতে পারিনি, মাদার। খুব মনে পড়ছিল তাদের কথা।
— ঠিক আছে, ঠিক আছে। দ্বিতীয়বার এমন কাজ যেনো না হয়। কথাটা যেনো মনে থাকে!
— জ্বি, মনে থাকবে!
মাদার হনহনিয়ে ঐশীর কক্ষ পরিত্যাগ করলেন। তিনি চলে যেতেই ঐশী ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। মস্তিষ্ক জুড়ে ঘূর্ণিপাক খেতে লাগলো পূর্বের সব কথোপকথন। চিন্তায় চিন্তায় মাথাটা মনে হচ্ছে ফেঁটে যাবে। ঐশীকে চিন্তায় ডুবে থাকতে দেখে জান্নাত ওর পাশে এসে বসলো। ঐশীর কাধে হাত রাখলে ঐশী চমকে জান্নাতের দিকে তাকালো। জান্নাত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে তোর? কি নিয়ে এত চিন্তা করছিস?
জান্নাতের কথা শুনে ঐশীর সজাগ মস্তিষ্ক বলে উঠলো, জুভান স্যারের কথা জান্নাতকে বলা একটুও ঠিক হবে না। এমনিতেই জান্নাতের পেটে কথা থাকে না। তাই না বলাই উত্তম। ঐশী কথা আড়াল করার চেষ্টায় বলল,
— বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে রে।
জান্নাতের বোধহয় বিশ্বাস হলো না এ কথা! সে ভ্রু কুঞ্চিত করে চেয়ে রইল ঐশীর পানে। জান্নাতের এমন সন্দেহজনক চাওনি দেখে ঐশী ভরকে গেল। গলা ছেড়ে কেশে উঠে বললো,
— রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছিস তোরা?
জান্নাত এবার খানিকটা স্বাভাবিক হলো। বললো,
— সবাই খেয়ে নিয়েছে। শুধু আমরা বাকি। চল, খেয়ে নেই।
— তুই যা, আমি আসছি।
ঐশীর কথা শুনে জান্নাত আর দ্বিতীয় কথা বললো না। চুপচাপ পা বাড়ালো খাবার ঘরের দিকে। তবে মনে মনে একটা সন্দেহ থেকেই গেলো তার! ঐশী তাকে কিছু একটা আড়াল করছে, জান্নাত তা বেশ বুঝতে পারছে। এই ঐশী মেয়েটার এত কাছে থাকা সত্বেও মাঝেমধ্যে জান্নাতের মনে হয়, সে ঐশীকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কখনো কখনো এই মেয়ে একদম তরলের ন্যায় সহজ, আবার কখনো কখনো ঐশী হয়ে উঠে দুর্বোধ্য, অপ্রতিরোধ্য! ঐশীর মন পড়া যেনো এ ভুবনের কারো সাধ্য না।
না, ঐশী মনস্থির করে ফেলেছে। সে করবে এই বিয়ে! তার স্বপ্নপূরন করতে হলে এই বিয়েই হবে এক মোক্ষম চাল! এবার জমবে খেল! একে একে সব ধোঁয়াশা হতে পর্দা উঠবে! সবার মুখোশ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে! ঐশী অস্থির মনে অপেক্ষা করবে সেদিনের!
#চলবে