#এক্কা_দোক্কা – ৩
আভা ইসলাম রাত্রি
‘ প্রশান্তপাড়’, আশ্রমের নাম! নামের মধ্যে বিশাল অংশজুড়ে প্রশান্ত শব্দটা থাকলেও আদতে এই আশ্রমে প্রশান্তের ছিটেফোঁটাও নেই। আশ্রমে থাকা লোকদের বেশ নিয়ম মেনে চলতে হয়। নিয়মের একটু এদিক সেদিক হলেই কপালে জুটে জাত পাত নিয়ে বিশ্রী কিছু অপমান। ছোটবেলা থেকে ঐশী এসব অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছে। তার পেছনেও আছে এক নিগূঢ় সত্য! এবার সুযোগ এসেছে, সেই সত্যটাকে কাজে লাগিয়ে অসত্যের বিনাশ ঘটানোর। ঐশী তার টার্গেটের পথে চলমান।
জুভানের বাড়ি থেকে আসার পর কয়েকটা দিন কেটে গেছে। তবে জুভানের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে এ কদিন ঐশীকে কিছুই জানানো হয়নি। ঐশী পথ চেয়ে রয়, অপেক্ষায় অপেক্ষায় কাহিল হয়! অথচ জুভানের দেখা মেলে না। আজ একটা টিউশনি শেষ করে ঐশী আশ্রমে ফিরছিল। আশ্রমের সামনে দুটো ‘পাজোরা’ গাড়ি দেখে ঐশী কিছুটা অবাক হয়েছে। পাজোরা গাড়ি সাধারণত বড়লোকদের জন্য। হাইরোড দিয়ে যখন শো করে পাজোরা গাড়ি চলে, গরীবরা তখন ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশায় চড়ে কাজে চলে যায়।
ঐশীর খটকা লাগলো। এ আশ্রমে বড়লোকের কোনো ছেলে মেয়ে থাকে না। তবে এ গাড়ি কাদের? ঐশী অচল মস্তিষ্ককে খানিক চাপ প্রদান করতেই ভেতর থেকে উত্তর এলো, জুভান স্যার নয় তো?
হ্যাঁ, বরাবরের মত এবারও ঐশী সঠিক ছিল। জুভান তার কিছু সহকারি কর্মচারীদের নিয়ে আশ্রমে এসেছে। এই মুহূর্তে মাদারের সঙ্গে কথা বলছে সে। ঐশী মাদারের কক্ষের সামনে চুপটি করে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কি কথা হচ্ছে, উঁকিঝুঁকি দিয়ে তা জানার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কথাবার্তা কিছু শোনা যাচ্ছে না। ফিসফিস করে কথা বলছে তারা। গল্পের মাঝখানে মাদারের তীক্ষ্ম চোখ নিক্ষেপিত হলো ঐশীর দিকে। সঙ্গেসঙ্গে মাদার ডাক দিয়ে উঠলেন,
-” এভাবে উঁকিঝুঁকি দেওয়া ব্যাড ম্যানার্স ঐশী! যা শোনার ভেতরে এসে শোনো। ”
চুরের চুরি ধরা পড়ে গেলে লজ্জার চেয়ে বেশি ভয় হয়। ঐশীর বেলায়ও তাই। ঐশী মাথা নত করে ভেতরে প্রবেশ করলো। বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে। জুভান কি বলেছে মাদারকে? উলটাপালটা বললে আজ মাদার রেগে গিয়ে ঐশীর রাতের খাবার বন্ধ করে দেবেন, তখন? খাবারের কথা মনে পড়তেই ঐশীর পেট গুলিয়ে এলো। দুপুরের খাবারের পর আর একটা দানাও মুখে তুলে নি সে। ইতিমধ্যে ক্ষুধায় পেট চোঁ’চোঁ শুরু করে দিয়েছে।
ঐশী মাদারের সামনে এসে দাঁড়ালো। নম্র কণ্ঠে বলল,
-” আমি দুঃখিত, মাদার। আর কখনো কোথায় উঁকিঝুঁকি দেবো না। ”
-” এখানে থাকলে তো আবার উঁকিঝুঁকি দেবে। ”
-” আমি বুঝিনি আপনার কথা, মাদার। ”
মাদার ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেললেন। একটা মেয়ে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, বিষয়টা তিনি মানতেই নারাজ। তবে আশ্চর্যের কথা এই যে, এই ঐশী মেয়ে কি করে টিভি রকস্টার জুভানের মত এতবড় এক রাঘব বোয়ালকে হাতিয়ে নিল? মেয়েটা বাইরে যতটা ভোলাবালা দেখায় ভেতরে ততটাও না। চালাক বেশ! মাদার বললেন,
-” তোমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে! ”
বিয়ের কথা শুনে ঐশীর বুঝতে বাকি রইলো না, মাদার নিঃসন্দেহে জুভানের কথা বলছেন। ঐশী মনেমনে কুটিল হাসলো। লজ্জা পাওয়ার ভান করে মাথা নত করলো। ঐশীর এমন অভিনয় দেখে জুভান বাঁকা চোখে তার দিকে তাকালো। অভিনয় না শিখেও এই মেয়েকে পাক্কা এক অভিনেত্রী বলা যায়। এমন ভাব করছে, যেনো কিছুই জানে না। মাদার জুভানকে দেখিয়ে পুনরায় বললেন,
-” এনাকে চেনো নিশ্চয়ই। টিভিতে গান করে। ইজহার জুভান মির্জা। উনি তোমাকে বিয়ে করবেন বলে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। ”
ঐশী একপলক জুভানের দিকে তাকালো। পরক্ষণেই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়। মাদার ঐশীর লজ্জা পাওয়া দেখে ধরেই নিলেন মেয়েটা এই বিয়ে করতে রাজি। আর রাজি হবেন না কেনো? এত বড় ঘরের ছেলে যে! মাদার সৌজন্যতা স্বরূপ জিজ্ঞেস করলেন,
-” তুমি কি এই বিয়েতে রাজি, ঐশী? ”
ঐশী কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। মাদার একই প্রশ্ন পুনরায় করতেই ঐশী মাথা হেলিয়ে সম্মতি প্রদান করলো। জুভান বাঁকা হেসে ঐশীর দিকে তাকালো। মাদার শ্বাস ফেললেন। জুভানের দিকে চেয়ে বললেন,
-” ঠিক আছে তবে। আপনি আগামীকাল কাজী নিয়ে আসুন। ছোট করে অনুষ্ঠান করে আমাদের মেয়ে আমরা তুলে দেবো। ”
মাদারের কথায় অসম্মতি প্রদান করলো জুভান। পায়ের উপর পা তুলে বাবু হয়ে বসলো। ক্রমাগত পা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
-” না, আগামীকাল না। আমি চাইছি আজই এই বিয়েটা হোক। মিডিয়াতে জানাজানি হওয়ার পূর্বেই বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে ভালো। এখন আমি এখান থেকে একবার বেরুলেই মিডিয়া জেনে যাবে আমি এখানে কি করতে এসেছিলাম। অ্যান্ড আই ডোন্ট ওয়ান্না এক্সপোজ ইট। ”
মাদার হতবাক হয়ে গেলেন। বললেন,
-” আজ বিয়ে কি করে সম্ভব? প্রস্তুতি তো কিছুই হয়নি। ”
-” প্রস্তুতির দরকার কি? কাজী ডেকে আনুন, কবুল বলুক আর বিয়ে হয়ে যাক। সিম্পল! ”
-” কিন্তু এত রাতে কাজী কোথায় পাবো? ”
জুভান বক্র হাসলো। পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেনো কল দিলো। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই জুভান বললো,
-” এই মুহূর্তে একটা কাজী আশ্রমে নিয়ে আসো। এজ সোন এজ পসিবল। ”
ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই জুভান ফোন কেটে দিল। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে তা বৃত্তাকাএ ঘুরাতে লাগলো ক্রমাগত। জুভানের এরূপ অ্যাটিটিউড দেখে মাদার হতবাক। মনেমনে মাদার নিজেও জুভানের বিশাল ভক্ত। জুভান ডিজিটাল গানের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ক্লাসিক গানও গায়। মাদার তার গাওয়া ক্লাসিক গান বেশ পছন্দ করেন। তার এতদিনের পছদের গায়ক তার সামনে বসে আছে, তিনি তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। তবে আশ্রমের প্রধান হওয়ার কারণে জুভানের সামনে একটু ভাব নিয়ে কথা বলছেন। ঐশী একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কি একটা যেনো চিন্তা করছে। জুভান ধমক দিয়ে উঠলো,
-” এই যে মিস সুন্দরী, আপনাকে কি বসার জন্যে আলাদা করে বলা লাগবে? ”
জুভানের ধমক শুনে ঐশী ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো। মাদার নিজেও বেশ অবাক হয়েছেন জুভানের এহেন কাজে। ঐশী একবার মাদারের দিকে তাকালো। মাদারের কক্ষে বসা তো দূরে থাক, তার কক্ষের কোনোকিছু ছোঁয়া অব্দি যায়না। জুভানের বিশাল ভক্ত হওয়ার কারণে মাদার তার কথা ফেলতে পারলেন না। না চাওয়া সত্বেও ঐশীকে বললেন,
-” চেয়ারে বসে পড়ো। ”
ঐশী মিহি হাসলো। চুপচাপ চেয়ার টেনে বসে পড়লো সে। আসলেই, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে ব্যথায় পা খুলে পড়ে যাচ্ছে মনে হয়। হাঁটু টনটন করছে। ঐশী জুভানের প্রতি কৃতজ্ঞ হলো।
কাজী এসে গেছে। মাথায় টুপি, গায়ে জড়ানো কালো রঙের ঢোলাঢালা পাঞ্জাবি। হাতে একটা লম্বা খাতা। এটাই হয়তো কাবিননামা। মাদার ঐশীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-” যাও, তোমার মায়ের বিয়ের শাড়ি আছে না? ওটা গায়ে দিও। আর হ্যাঁ, কিছু গয়না গাটি পড়ে ফেলো। নাহলে একদম খালি খালি লাগবে। ”
ঐশী মাথা নেড়ে সায় দিল। মোবাইলে মগ্ন জুভানের একপলক চেয়ে চলে গেলো নিজ কক্ষে।
#চলবে