#এক্কা_দোক্কা – ৪
আভা ইসলাম রাত্রি
আজ ঐশীর বিয়ে। এই নামটা কেমন যেনো চেনা চেনা মনে হচ্ছে না? হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘ আজ হিমুর বিয়ে ‘ বইটা বেশ জনপ্রিয় ছিল। সে বইয়ে হিমু ছিল বেপরোয়া এক সত্তা। তবে ঐশী ঠিক তার উল্টো। সে জানে তার লক্ষ্য কি, তার পথের রাস্তা কতটা দুর্গম!
জুভানের সামনে এগিয়ে আসছে ঐশী। তার গায়ে জড়ানো পুরনো যুগের ডিজাইন করা লাল জামদানি শাড়ি। গলায় একটা চিকন চেইন, কানে সুন্দর একটা ঝুমকো! এইতো! তার সাজ এটুকুই। তবুও কি সুন্দর লাগছে এই মেয়েকে! মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ মা দুর্গা! জুভান মোবাইলে হাত চালাতে চালাতে বাঁকা চোখে ঐশীর পানে তাকালো। ঐশীর অগোচরে একটা সুন্দর ছবিও তুলে ফেললো। ক্যান্ডিড ছবি, তবুও কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। ঐশী গুটিগুটি পায়ে হেঁটে মাদারের পাশে এসে দাঁড়ালো। মাদার চোখের ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে বললেন,
-” বসো। ”
ঐশী বসলো। মাদার জুভানের দিকে চেয়ে বললেন,
-” বিয়ে পড়ানো তবে শুরু হোক। ”
জুভান মিহি হাসলো। অতএব, কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। মাদারের কক্ষের বাইরে অনেক ফুসুরফুসুর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই আশ্রমের মেয়েরা! জুভানকে দেখে মাদারের মত এদেরও চক্ষু ভরকে গেছে। কে আগে জুভানকে দেখবে সে নিয়ে হচ্ছে বিশাল হইচই। একজনের গায়ের উপর লেপ্টে যাচ্ছে অপরজন। আড়চোখে বিষয়টা লক্ষ্য করতেই ঐশী হেসে ফেললো।
দশ লাক আশি হাজার টাকা কাবিন ধ্যার্য করে কাজী ঐশীর উদ্দেশ্যে বললেন,
-” বলো মা, কবুল! ”
ঐশী কিছুটা সময় নিল। মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে লাগলো প্রতিহিংসার আগুন। চোখের শুভ্র অংশ ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে লাগলো। রাগের তীব্র আগুন ঝলসে দিতে লাগলো ঐশীর আপাদমস্তক। দুহাত আপনা আপনি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। ঐশী রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
-” কবুল, কবুল, কবুল। ”
কাজী এবার জুভানের দিকে মগ্ন হলেন। জুভানক কবুল বলতে বলা হলে সে ঐশীর দিকে চেয়ে বলল,
-” কবুল, কবুল, কবুল। ”
কক্ষের সবাই সজোরে বলে উঠলো, ‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘
দোয়া পাঠের সময় মাদার আশ্রমের সকল মেয়েকে ডেকে আনলেন। বলা হয়, যে দোয়ায় আমিনের সংখ্যা বেশি সেই দোয়ায় নাকি বরকত হয়। তাই মাদার আশ্রমের সকল মানুষকে এনে দোয়া পাঠ করা শুরু করলেন। তবে আশ্রমের মেয়েরা দোয়া পাঠের বদলে ফ্যালফ্যাল চোখে জুভানকে আগাগোড়া নিরীক্ষণ করছে। কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে,’ কি হট দেখছিস? ঐশীর তো কপাল খুলে গেলো রে। আমার ফুটো কপাল যে কবে খুলবে? ‘
ঐশী দোয়া পাঠের মধ্যে এসব শুনে মিহি হাসলো। জুভান বা চাওয়া সত্বেও দোয়া পাঠে মন দিল। জুভানের বাবা মা কেউই নামাজ পড়তেন না। তাই ছোটবেলা বাসার দারোয়ানের সাথে মাঝেমধ্যে জুম্মার নামাজে যেত সে! আর এখন তো নামাজ কি সেটা প্রায় ভুলতে বসেছে সে। তবে আজ আল্লাহর কাছে হাত পাততে খুব একটা মন্দ লাগছে না। বরং হৃদয়ে শান্তি ফোয়ারা বইছে যেনো।
অতঃপর, বিদায় মুহূর্ত এলো। ঐশী নিজের কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। মাদার চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন ঐশীর পাশে। সম্পূর্ণ ব্যাগ গোছানোর পর ঐশী দম ছাড়লো। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ঐশী ব্যাগ কাধে নিয়ে মাদারের সামনে এসে দাঁড়ালো। মলিন কণ্ঠে বলল,
-” আমার আপনাদের কথা খুব মনে পড়বে, মাদার। ”
ঐশীর কথায় মাদার নিজেও বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। ঐশীর মুখটা টেনে ধরে তার ললাটে চুমু আঁকলেন। ঐশী চোখ বুজে ফেললো। মাদার কান্নামাখা কণ্ঠে বললেন,
-” ভালো থাকবে! আর নিজের যত্ন নিবে। সাথে নিজের স্বামীরও খেয়াল রাখবে। মনে রেখো, আজ থেকে তুমি শুধু তুমি নও। তুমি মানেই তোমার স্বামী, তার ইজ্জত, তার সম্মান, তার পরিবার! তাই নিজের পাশাপাশি তাদেরও যত্ন নিও। ”
ঐশীর চোখ ভিজে এলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাদারকে। মাদার মলিন হেসে ঐশীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। ঐশী মনেমনে আওড়ালো, ‘ যত্ন নেওয়ার জন্যেই ত এতকিছু। আজ থেকে আমি শুধু আমি নই। আমি মানেই আমার প্রতিশোধ, আমার বদলা। দোয়া করুন, যাতে আমি আমার কাজে সফল হই। ‘
ঐশীকে গাড়িতে তোলা হলো। জুভান ঐশীর পাশে বসতেই ঐশী একটু সরে বসলো। জুভান লক্ষ্য করলো বিষয়টা, তবে পাত্তা দিল না। গাড়ি চলমান। আশ্রম থেকে জুভানের বাসা বেশ দূরে। প্রায় দু ঘণ্টা লাগে পৌঁছাতে। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঐশীর মাথা ভো ভো করে উঠলো। রাত প্রায় বারোটা। ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। এই মুহূর্তে কিছু না খেলেই নয়। ঐশী নিজের ব্যাগ বের করলো। ব্যাগ থেকে টিফিন বিস্কুট বের করে তার প্যাকেট ছিঁড়লো। ঐশীর ভাত খেতে মন চাইছিল। কিন্তু ভাত না পাওয়ায় এই বিস্কুট দিয়েই পেট ভরতে হবে, কিছু করার নেই। নববধূকে বিয়ের গাড়িতে মচমচ করে বিস্কুট খেতে দেখে জুভানের ভ্রু কুঁচকে এলো। সে বিশাল বিরক্তি নিয়ে ঐশীর দিকে তাকালো। অথচ ঐশী জানালার দিকে চেয়ে আনমনে বিস্কুট খেয়ে যাচ্ছে। জুভানের দিকে তার তাকানোর সময় কই? জুভান বুঝতে পারলো, ঐশীর ক্ষুধা লেগেছে। তাই সে কোনোরূপ রাগ প্রকাশ না করে ড্রাইভারকে বললো গাড়ি থামাতে। হঠাৎ গাড়ি থেমে যেতেই ঐশীর হুশ এলো। সে ভ্রু কুঁচকে জুভানের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
-” গাড়ি থামলো কেনো? আমরা কি পৌঁছে গেছি? ”
জুভান উত্তর দিলো না। বরং মাস্ক আর সানগ্লাস পড়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। ঐশী বিস্কুট খাওয়া বাদ দিয়ে অবাক চোখে জুভানের পথের দিকে চেয়ে রইল।
একটু পর জুভান ফিরে এলো। হাতে টেস্টি ট্রিটের একটা বার্গার আর একটা কোকাকলা। জুভান ঐশীর হাত থেকে বিস্কুটের প্যাকেট ছোঁ মেরে নিয়ে বাইরে ফেলে দিল। জুভানের এমন কাজে ঐশী অবাক হয়ে গেলো। জুভান ঐশীর হাতে বার্গারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-” নাও, খাও। ক্ষুধা লেগেছে বললেই তো পারো। এসব ফালতু বিস্কুট খেয়ে পেট ভরবে? রাবিশ মেয়ে! ”
ঐশী মানা করলো না। জুভানের হাত থেকে বার্গারের প্যাকেট নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। খেতে খেতে বলল,
-” আমাদের মত এতিম মেয়েদের দিনে দুবেলা ভাত জুটে সেই অনেক। আর যেদিন ভাতও পেট ভরে না খেতে পারি সেদিন আপনার কথামত এই ফালতু বিস্কুট খেয়েই আমাদের ক্ষুধা মেটে। আপনার মত বড়লোকরা সেটা বুঝবে না, মিস্টার মির্জা। ”
জুভান অবাক হয়ে রইলো। ঐশীর কথার মারপ্যাঁচ বুঝতে পেরে হুট করে সে নিজেকে খুব দুঃখী দুঃখী মনে করতে লাগলো। মেয়েটা আর কত কি সহ্য করেছে কে জানে?
গাড়ি এসে থামলো ঠিক জুভানের বাসার সামনে। জুভান নেমে দাড়ালো। ভারী শাড়ি নিয়ে ঐশী যখন বেসামাল, তখন জুভান ঐশীকে সাহায্য করলে গাড়ি থেকে নামতে। ঐশীর হাতের ভাজে হাত রাখলো জুভান। ঐশীর নরম তুলতুলে হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে ঐশীকে নামালো গাড়ি থেকে। ঐশীর হাতটা যেনো আস্ত মাখন। জুভানের হাতের ভাজে যেনো ডুবে যাচ্ছে ঐশীর মাখন ন্যায় হাত। জুভান আনমনে বলে ফেললো,
-” এটা হাত নাকি মাখন? মনে হচ্ছে ধরে জাস্ট চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। ঐশী, কি মাখো এই হাতে? ”
#চলবে