#রুপকথা,পর্ব-২
লেখক- ইতি চৌধুরী
অনেক সহ্য করেছে রোদ আর নয়। এভাবে আর নেয়া যাচ্ছে না। একটা চেনা নেই জানা নেই, অপরিচিত মেয়ে তাকে দিনের পর দিন বিরক্ত করেই চলেছে। মেয়েটার জ্বালায় আজকাল বাসা থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পরেছে রোদের। ব্যাপারটা পথে ঘাটে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলতো। কিন্তু তা থাকেনি। পথ পেরিয়ে ঘরে এসে ডুকেছে। এতদিন সে কিছু বলেনি কিন্তু এবার পানি মাথায় উঠে গেছে। কিছু না বললেই নয়।
হুটহাট রেগে যাওয়ার মতো ছেলে রোদ নয়। এবার তার রাগ হওয়ার পেছনেও যথেষ্ট কারণ আছে। বাসায় সে যথেষ্ট ভদ্র ছেলে হিসাবেই পরিচিত। এবং কি সত্যিকার অর্থেই সে ভদ্র ছেলে। বাড়ির বড় ছেলে সে। যেমন সবার আদরের তেমনি বাধ্যও। বাড়ির অন্যান্য ছোটদের জন্য উদাহরণ সে। সেই তার নামেই বদনাম! এটা কোনোভাবেই সে মেনে নিতে পারছে না।
সাত দিনে আগের ঘটনা,
রোদের চাচার এলাকায় একটা বড় ফার্মেসী আছে। এই এলাকার স্থানীয় ওরা অনেক বছর। রোদের জন্ম এখানে, তার বাবা চাচার জন্মও এখানে। ছোটবেলা থেকেই সে এলাকায় পরিচিত মুখ। সমবয়সী, ছোটরা যেমন তাকে ভালো পায় তেমনি বড়রাও পছন্দ করে। এলাকায় মোটামোটি সকলের কাছে ভদ্র ছেলের উদাহরণ সে।
রাতে খাওয়ার পরেই বাবার ঘরে তলব পরে রোদের। ঘটনা কী আন্দাজ করতে পারে না সে। কী হয়েছে জানার জন্য বাবার ঘরে আসতেই দেখে বাবা, চাচা দুইজনই একত্রে বসে আছেন। তাদের চোখ-মুখ দেখেই রোদ বুঝে ফেলেছে ঘটনা সিরিয়াস। বাবা চাচার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রোদ। জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু কী হয়েছে বাবা? হঠাৎ জরুরী তলব?’
বাবার পক্ষ থেকে কোনো জবাব পায় না রোদ। বরং রোদের বাবা শাহীন মাহমুদ যেন নিজের মুখের ভাব আগের চাইতে আরও গম্ভীর করে নেন। তা দেখে এবার রোদ চাচার দিকে তাকায় জবাবের আশায়। আবার জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে চাচা?’
রোদের বাবা শাহীন মাহমুদ কিছু বলেন না। এবারে তার চাচা শাকিল মাহমুদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
‘কী চলছে বাবা আজকাল তোমার জীবনে?’
রোদ অবাক হয়ে চাচার দিকে তাকিয়ে থাকে। চাচার কথার আগামাথা কোনোটাই তার বোধগম্য হয় না । না বুঝে, অপারগ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। বুঝতে পারিনি এমন একটা ভাব মুখে টেনে রোদ বলল,
‘ঠিক বুঝলাম না চাচা।’
‘হুম।’ বলে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন শাকিল মাহমুদ। তারপর আরও বলেন,
‘শুনতে পাচ্ছি তোমার নাকি পাশের বাসার মেয়ের কি যেন নাম? ওহ হ্যাঁ ইতি। তার সাথে প্রেম টেম চলছে।’
চাচার মুখে এমন কথা শুনে রোদ যেন আকাশ থেকে পরলো। সে প্রেম করছে অথচ সে নিজেই জানে না। এটাও কী সম্ভব! অবাক সুরে রোদ বলল,
‘আমি প্রেম করছি?’
‘তাই তো শুনলাম।’
নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে রোদের কাছাকাছি দাঁড়ায় তার চাচা শাকিল মাহমুদ। ভাতিজার কাছাকাছি এসে বলেন,
‘তুমি বুঝদার ছেলে। তোমার উপর আমাদের ভরসা আছে। কিন্তু এখন তোমার ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করার সময় বাবা। এই সময় প্রেম করাটা হয়তো তোমার জন্য অনুচিত। আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো তারপর প্রেম করার জন্য বাকি জীবনটাই তো পরে আছে।’
বলেই শাকিল মাহমুদ ভাতিজার কাঁধে হাত রাখেন। পেছন থেকে রোদের বাবা শাহীন মাহমুদ বলেন,
‘তুমি বাড়ির বড় ছেলে। ছোটদের জন্য তুমি আদর্শ উদাহরণ। কিছু করার আগে তোমার ভাবা উচিত তুমি যা করবে তোমার ছোটরা তাই শিখবে। তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না ছোটরা অসময় পথভ্রষ্ট হোক।’
বাবা চাচার কথা শুনে হতভম্ব রোদ। কি বলবে বা কি বলে নিজেকে এক্সপ্লেইন করবে বেচারা বুঝে উঠতে পারে না। তারা যা জানে আসলে সবটাই ভুল তা বলার জন্য মুখ খুলবেই এমন সময় রোদের বাবা আরও বলেন,
‘চল শাকিল আমিও তোর সাথে একটু বের হবো।’
বেরিয়ে যেতে যেতে শাহীন মাহমুদ আরও বলেন,
‘ওকে বলে দে এসব প্রেম টেম করে ভবিষ্যৎ নষ্ট করার সময় এখন নয়। সময় থাকতে যেন সুধরে নেয় নিজেকে। নাহলে ছোটগুলোও সব বিগড়ে যাবে ওকে দেখে।’
শাকিল মাহমুদ ভাতিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়। রোদ কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে তারপর নিজের ঘরে ফিরে যায়।
ঐ ঘটনার পর থেকেই রোদের মাথা বিগড়ে আছে। তার পক্ষ থেকে সে মেয়েটাকে মানে ইতিকে কোনো আশকারা দেয়নি তবু তার নামে এমন একটা অপবাদ রটিয়ে গেছে এলাকায়। শুধু যে বাসায় তাই নয় এলাকার অনেকেই এটা নিয়ে তার সাথে মশকরা করে, হাসি তামাশা করে। এই জন্যই মূলত চটে গেছে রোদ। অন্যথায় এই বিষয়টাকে তেমন কোনো গুরত্বই দেয়নি সে কখনো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গুরুত্ব না দিয়ে ভুল করেছে সে এতদিন। রোদ কিছু বলেনি বলেই এই মেয়ে প্রশ্রয় পেয়ে গেছে। কিছু কিছু ব্যাপার থাকে সেসব ক্ষেত্রে কিছু না বলাটাও প্রশ্রয় দেয়ার মতো। তেমনি রোদও কিছু না বলে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে। একবার শুধু মেয়েটাকে সামনে পাক এর বদমাইশি বের করে ছাড়বে। এসব প্রেম পিরিতির ভুত জলে ঢেলে মাথা থেকে টেনে নামাবে। এমনভাবে কড়া কিছু কথা বলে দিবে যেন দ্বিতীয়বার আর তার সাথে ফাজলামো করার সাহস না পায়।
আরও দু’দিন পরের ঘটনা। একদম সোনায় সোহাগা বলে যাকে। বেশির ভাগ সময়ই মেয়েটা বারান্দা থেকেই রোদকে বিরক্ত করেছে। পথে ঘাটে খুব কমই দেখা হয়েছে তবে দেখা হলে সেখানেও ছাড়েনি তাকে বিরক্ত করতে। মোটকথা ইতি কোনো সুযোগই ছাড়েনি রোদকে বিরক্ত করার, হেনস্তা করার। আজ সুযোগ এসেছে রোদের। বাসা থেকে বের হতেই দেখে গলির অন্য মাথা থেকে ইতি হেঁটে আসছে। দূর থেকে দেখেও ইতিকে চিনতে রোদের সামান্যতম ভুল হয়নি। এমন শত্রু দূর থেকে দেখেও চেনা যায়। পরণে তার গাড় নীল রঙের লং স্কার্ট ও ফতুলা। একটা সূতি স্কার্ফ সুন্দর করে গলা ও বুকে জড়ানো। কাপড় চোপড় পরিধানে মেয়ে যথেষ্ট শালীন। শুধু এর কাজ কর্মই অশালীন তবে অবশ্যই তা রোদের প্রতি। অন্য কারো সাথে কখনো এমন কিছু করতে দেখেনি রোদ। ইতি একা নয় তার থাকে আরেকজন আছে। সে যেই থাক গিয়ে তাতে রোদের কিছু যায় আসে না। আজ সে এতদিনের অত্যাচারের একটা শোধ তুলবেই।
কাছাকাছি এগিয়ে এসে রোদকে দেখে একটা চোখ মেরে হাসিহাসি মুখ করে ইতি বলল,
‘হাই হিরো কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?’
হুট করেই রোদের কী হলো কে জানে আরেকটু ইতির কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে সে আচমকা রাস্তায় দাঁড়িয়েই ঠাস করে একটা চর বসিয়ে দেয় তার গালে। আচমকা চর খেয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থম ধরে থাকে ইতি। ঘটনাটা যে সত্যি সত্যি ঘটেছে তা বুঝতে, ধাতস্থ হতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে তার। পাশ থেকে ইতির বোন রিতু রোদকে কিছু বলতে নিলে তাকে হাত ধরে বাঁধা দেয় ইতি। ইশারা করে চুপ থাকতে। রোদ রাগে ফেটে পরে ইতির উপর। সে যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সেই খেয়ালটাও হয়তো তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। প্রায় চিৎকার করেই রোদ বলে,
‘কী ভাবো কী তুমি নিজেকে? এসব করতে লজ্জা করে না? তোমার কী লজ্জা শরম বলতে কিছু আছে নাকি তুমি জন্মগতই এমন বেহায়া, বেশরম। মেয়ে মানুষের তো শুনেছি লজ্জা, শরম বেশি হয় তাহলে তুমি কোন দেশের নারী যার চোখে লজ্জার সামান্যতম পর্দাটাও নেই। এতদিন কিছু বলিনি। আজ প্রথম ও শেষ বারের মতো বলছি ফার্দার যেন না দেখি আমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে কোনো নাটক করতে। কে তুমি? আমার সম্পর্কে জানো কিছু? তোমার যোগ্যতা আছে আমার সাথে প্রেম করার? আমাকে ভালোবাসার? জানো কিছু আমার সম্পর্কে? ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্স নিয়ে পরেছি। কিছুদিন পরেই বাইরে চলে যাবো। কোন আক্কেলে আমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে মশকরা করো? বসে বসে তো বাবারটা খাও আর রঙ বেরঙিন জামা কাপড়, লিপস্টিক দিয়ে বেড়াও। জীবন সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে? আজ ফাস্ট ও লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম। মাথায় থাকে যেন।’
আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না রোদ। হনহন করে হেঁটে সেখান থেকে চলে যায়। ইতি একটা রা শব্দও করে না। রাগে পাশ থেকে ফোঁস ফোঁস করছে রিতু। ইতিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেকে রিতু বলল,
‘তুই কেন আমাকে কিছু বলতে দিলি না আপু? নিজেও তো বলতে পারতি।’
এখনও কিছু বলে না ইতি। রিতুর ভীষণ রাগ হয়। স্মিত হেসে ইতি বলে,
‘চল, বাসায় যাই।’
.
চলবে…