রুপকথা,পর্ব-৩

0
962

#রুপকথা,পর্ব-৩
লেখক- ইতি চৌধুরী

সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। প্রকৃতির ব্যাপারটাই এমন। প্রকৃতি নিজের প্রয়োজনে বয়ে চলে। প্রয়োজনে নিজেকে পরিবর্তনও করে। কিন্তু কারো জন্য সে থেমে থাকে না। তেমনি সময়ও বয়ে চলে। তাকে বয়ে চলতে হয়।
ইদানিং ভীষণ ব্যস্ত রোদ। সপ্তাহ দুই পরেই সে আমেরিকা চলে যাবে, পিএইচডির জন্য। পেপারস নিয়ে নানারকম দৌড়াদৌড়িতে ইদানিং এলাকার বন্ধুদের সাথে ঠিকঠাক আড্ডা দেয়া হয়ে ওঠে না তার। আজ হাতে সময় আছে। তেমন একটা ব্যস্ততাও নেই। তাই বিকেলটা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটাবে বলেই মনঃস্থির করেছে। এলাকার মাঠের অপজিটের টং দোকানেই বসে তাদের আড্ডার আশর। হোয়াটসঅ্যাপে এলাকাবাসী নামে একটা চ্যাট গ্রুপ আছে তাদের। সেখানেই দুপুরে ম্যাসেজ করে রেখেছিল রোদ আসরের নামাজের পরে আড্ডা হবে আজ সবাই যেন উপস্থিত থাকে। হয়তো এটাই বিদেশ যাওয়ার আগে বন্ধুদের সাথে তার শেষ আড্ডা। তারপর বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক সময় পর দেখা হবে। ততদিনে কে কোথায় থাকে তার কোনো ঠিক বেঠিক নেই। এলাকার মসজিদটা রোদের বাসা থেকে বেরিয়ে বাম পাশে আর মাঠ ডান দিকে রাস্তায় অন্য মাথায়। নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয় রোদ। মসজিদেই তার দেখা হয় ইউসুফ ও রাদিনের সাথে। তিনজনই একত্রে মাঠের দিকে রওনা হয়। নিজের বাড়ি ক্রস করে পাশের বিল্ডিংয়ের দোতলায় চোখ পরতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় রোদ। বছর খানিক আগের সেই ঘটনার পর আর ইতিকে দেখেনি সে। ঐদিনের ঐ ঘটনার পর ইতি আর এই বারান্দায় আসেনি। এমনকি পথে ঘাটেও তাদের আর দেখা হয়নি। যেন মেয়েটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সেদিন রাগে রোদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় রাগের বশে সব ভুলে গিয়েছিল সে। এর সম্পূর্ণ দোষ রোদ নিজেকে দেয় না। ইতিরও দোষ ছিল। হয়তো কম তবু ছিল। তার বাড়াবাড়ির জন্যই বিষয়টা এলাকায় ছড়িয়ে পরেছিল এবং সেখান থেকেই তার বাসায়ও জানাজানি হয়েছে। অথচ প্রেম ঘটিত কোনো সম্পর্ক তাদের মাঝে ছিল না। তবু মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর ঐ ঘটনার জন্য মনে মনে সে অনুতপ্ত। মাথা গরম করে এমন একটা কান্ড তার ঘটানো একদম উচিত হয়নি। মাথা গরম ছেলে সে নয়। কিন্তু সেদিন কি থেকে কি হয়ে গেছে তা রোদ নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি তার আগেই অঘটন যা ঘটার তা ঘটিয়ে ফেলেছিল সে। অন্যথায় এমন কাজ করার মতো ছেলে সে নয়ই। এখনো সে অনুতপ্ত। বাসা থেকে বের হলে প্রতিবার অবচেতন মনে রোদের দৃষ্টি ঐ বারান্দায় যায় যদি একবার মেয়েটাকে দেখা যায় সেই আশায়। সরি বলতে একদমই কার্পন্য করবে না সে। কিন্তু ইদানিং বারবার মনে হয় আর বেশি সময় নেই তার হাতে। এই সীমিত সময়ে কী সে সুযোগ পাবে একবার সরি বলার। নিজের কৃত কর্মের জন্য মাফ চাইবার। কিন্তু ঐ ঘটনার পর ইতিকে আর এই বারান্দায় দেখা যায়নি। সে কি আর আসবে না? ছন্নছাড়া প্রশ্ন ঘোরে রোদের মনের অলিতে গলিতে কিন্তু উত্তর নেই গলির কোনো ডাকবাক্সে।

ভাবনাদের আপাতত দূরে ঠেলে সামনের দিকে আগাতে নিলেই রোদ দেখে সামনে থেকে এগিয়ে আসছে রিতু। এই মেয়েটাকে সে সেদিন ইতির সাথে দেখেছিল। রিতুকে এগিয়ে আসতে দেখে রোদ তার সাথে থাকা ইউসুফ ও রাদিনকে বলে,
‘তোরা যা আমি আসছি।’
পাশ থেকে রাদিন জিজ্ঞেস করে,
‘তোর আবার কী হলো?’
‘কিছু হয়নি। যা আমি এক্ষুণি আসছি।’
ইউসুফ ও রাদিন আর কথা বাড়ায় না, চলে যায়। রোদ দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। রিতু এগিয়ে এসে এক নজর রোদকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে রোদ বলে,
‘একটু দাঁড়াবেন প্লিজ?’
বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব করে রিতু জিজ্ঞেস করে,
‘আমাকে বলছেন? কিছু বলবেন?’
লজ্জাবোধ করে রোদ তবু দমে থাকবে না আপাতত সে। ভুল হয়েছে তার দ্বারা এবং সেই ভুলের জন্য সে ক্ষমা চাইবে। কারো কাছে ক্ষমা চাওয়াতে কোনো লজ্জা নেই। তাছাড়া সে দোষ করেছে তাহলে ক্ষমা চাইতে লজ্জার কী আছে? ক্ষমা চাওয়া মহৎ গুণ। বাকি ক্ষমা করা না করা ইতির ব্যাপার।

আমতা আমতা করে রোদ বলে,
‘আমি ইতির সাথে একটু কথা বলতে চাই প্লিজ।’
এই কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না রিতু। ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়েই থাকে। তা দেখে রোদ চোখে মুখে আরও করুণ ভাব টেনে বলে,
‘প্লিজ, একবার। কয়দিন পরেই আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কবে আসবো জানি না। একবার দেখা করতে চাই।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবারে রিতু বলে,
‘একটু অপেক্ষা করুন এখানে।’
রোদকে অপেক্ষা করতে বলে রিতু বাড়ির ভেতর চলে যায়। অনুতপ্ত মনে অপেক্ষা করতে লাগে রোদ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এক বছর আগে ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই অন্যায়টা সে করেছিল। আজ এক বছর পর ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রোদ তার করা ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে বলে ইতির জন্য অপেক্ষা করছে। এটাকেই সম্ভবত রিভেঞ্জ অব ন্যাচার বলে। সময় ঠিকই তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয় যেকোনো মাধ্যমে।

কিছুক্ষণ পরেই আবার রিতু ফিরে আসে। রিতুর সাথে ইতিকে দেখতে না পেয়ে পেছনে তাকায় রোদ। ভাবে হয়তো সে পেছনে আছে। রোদকে পেছনে তাকাতে দেখে রিতুর হাতে থাকা একটা ডায়েরি ও চিরকুট সামনের দিকে তাক করে বলে,
‘পেছনে তাকিয়ে লাভ নেই, এটা নিন।’
ভ্রু কুঁচকে রোদ জিজ্ঞেস করে,
‘এটা কী?’
‘দেখতেই তো পাচ্ছেন কী।’
‘তা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এটা কেন? আমি তো বললাম…’
রোদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রিতু আরেকটু এগিয়ে এসে রোদের হাতে ডায়েরি ও চিরকুটটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘এর বেশি কিছু করার নেই আমার হাতে। তবে আগে ডায়েরিটা পড়বেন তারপর চিরকুট পড়বেন।’
রোদকে কিছু বলার বা জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে গেল রিতু। রোদ এই মুহূর্তে অনুভব করছে রিতু নামের মেয়েটা তাকে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে কঠিন কোনো ভুলভুলাইয়াতে ফেলে দিয়ে গেল। দৃষ্টি রিতুর যাওয়ার পথ থেকে সরিয়ে এনে ডায়েরিটার দিকে রাখে রোদ। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে তার জন্য। এখন সে কী করবে? বন্ধুদের কাছে যাবে না বাসায় ফিরে গিয়ে ডায়েরি পড়তে বসবে? তালগোল পাকিয়ে যায় তার। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে ডায়েরি রাতেও পড়া যাবে কিন্তু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সুযোগ সে হয়তো আর পাবে না। তাই রোদ আর অপেক্ষা করে না। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে চিরকুটটা পকেটে গুঁজে নিয়ে হাঁটা ধরে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে।

তবে বলা বাহুল্য এক বছর আগের ঐ ঘটনার পর একদিনের জন্যও সে ইতির কথা ভুলতে পারেনি। জোঁকের মতো ইতি তার ভাবনায় লেপ্টেছিল, এখনো আছে তবে সামনেও থাকবে কিনা তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। এক মুহূর্তের জন্যও তার ভাবনা থেকে বিদায় হয়নি ইতি। যে হাত দিয়ে মেয়েটাকে আচমকা চড় মেরে বসেছিল সেই হাতের দিকে তাকিয়ে পার করেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। অনুশোচনা মানুষকে ভেতর থেকে কুঁড়ে খায় যা বাহির থেকে টের পাওয়া যায় না। রোদের ভেতরটাও অনুশোচনায় ঝুনাঝুনা হয়ে গেছে কেবল একবার ইতির কাছে ক্ষমা চাইবে বলে কিন্তু সেই সুযোগ সে আজও পায়নি। ভেবেছিল আজ নিয়তি তাকে সুযোগ দিবে কিন্তু নিয়তি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একটা ডায়েরি ও চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছে। কে জানে কী আছে এই ডায়েরিতে। হয়তো ইতি একগাদা গালি লিখে পাঠিয়েছে তাকে। আপাতত ইতির গালি গ্রহণ করতেও কোনো আপত্তি নেই রোদের।

মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতেই মাঠের কোণায় এসে উপস্থিত হয় রোদ। তাকে দেখেই রাদিন জিজ্ঞেস করে,
‘এতক্ষণে আসার সময় হলো তোর? আমি তো ভাবলাম আর আসবিই না।’
রাদিনের কথায় হদিস হয় রোদের। সে কিছু বলার আগেই পাশ থেকে ইমন জিজ্ঞেস করে,
‘তোর হাতে এটা কিরে?’
এক পলক ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে রোদ বলে,
‘ব্যক্তিগত জিনিস।’
হয়তো রোদের অজান্তেই ইতি তার ব্যক্তিগত স্পেসে জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিনে অনুমতিতে হয়ে গেছে ব্যক্তিগত কেউ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here