হারানো সুর-১৪তম পর্ব,১৫ তম পর্ব

0
722

হারানো সুর-১৪তম পর্ব,১৫ তম পর্ব
শাহরিয়ার
১৪তম পর্ব

সকালে নাস্তার টেবিলে ঝর্ণা এলো না। স্যার রেগে না খেয়েই চলে গেলো। বাড়িতে কি হচ্ছে? সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে দুই দিনের মাঝেই। এ মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে আসলে সত্যিই অশান্তির শেষ রবে না স্যারের জীবনে। কথা গুলো মনে মনে ভাবছিলাম এমন সময় ঝর্ণা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। মা খাবার টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। ঝর্ণা নিচে নামতেই মা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলতে শুরু করলো।

মা: কিরে মা তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস? কাল রাত থেকে না খেয়ে আছিস। আর এই সকাল সকাল ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় রওনা হলি?

ঝর্ণা: আমার ক্ষিদে নেই খালা মনি, আমি চলে যাচ্ছি ভেবেছিলাম কয়েকটা দিন এখানে থাকবো। কিন্তু তা আর হলো না।

মেয়েটা সারা রাত কেঁদেছে ওর চোখ দু’টো দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সত্যিই কি ঝর্ণা স্যারকে অনেক ভালোবাসে? কিন্তু স্যারতো ওকে ভালোবাসে না। এতো সুন্দর একটা মেয়েকে স্যার ভালোবাসে না, কিন্তু কেন? এই মেয়েকে যে কেউ ভালোবাসতে চাইবে। যদিও একটু অহংকারি কিন্তু চেহারাটা সত্যিই মায়াবী।

মা: দেখ মা জাহাঙ্গীরতো এমনই তুইতো জানিস। তারপরেও কেন রাগ করিস। আয় খালামনি তোকে খায়িয়ে দেই।

ঝর্ণা: তোমার ছেলে যদি জিদ্দি হয়, তবে আমিও কম জেদি না, তোমার ছেলেকে বলে দিও, একদিন সে আমারি হবে।

কথা গুলো বলে ঝর্ণা হেঁটে চলে গেলো বাড়ির বাহিরে। মা পেছন থেকে বহুবার ডাকার পরেও আর থামলো না। মা একা একাই বলতে শুরু করলো আজ কালকার ছেলে মেয়ে সব সমান। কেউ কাউকে একটুকুও ছাড় দিতে চায়না। উফ আমি যে কি করি। বলতে বলতে মাথায় হাত দিয়ে ডাইনিং এর চেয়ার টেনে বসে পরলো।

মা মন খারাপ করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন দেখবেন। স্যারতো একটু রাগি আমরা সকলে জানি। আসলে দু’জনই রাগি সমস্যা এই জায়গায়। একজন রাগ করলে আরেক জনকে নরম হতে হয়। তাহলেই সব কিছু ঠিকঠাক থাকে।
কিন্তু এদের দু’জনেরই মাথা গরম। সময় হোক দেখবেন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর তাছাড়া ঝর্ণার পড়ালেখাও তো এখনো শেষ হয়নি। পড়ালেখা শেষ হোক তখন দুই পরিবার বসে কথা বলে বিয়ে দিয়ে দিবেন দু’জনকে।

মা: চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমার কোন কিছুই ভালো লাগছে না। আমি একটু বিশ্রাশ করবো। বলতে বলতে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে শুরু করলো।

আমার ও মাথাটা কেমন ঘুরছে। এমন বদ মেজাজি মানুষ এরা দু’জন। যে এদের সাথে কেউ থাকলে সত্যি সত্যি মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। সত্যিই যদি এদের দু’জনের বিয়ে হয় তাহলে এই ডাইনিং এ একটাও কাঁচের প্লেট গ্লাস থাকবে না। কথা গুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। সাবাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আমি টেবিলে থাকা খাবার গুলো ঢেকে রেখে সাবাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।

আজ খুব করে শাকিলের কথা মনে পরছে, আমাদের পাঁচ বছরের সংসারে কোন দিন ঝগড়া লাগেনি। বিয়ের কিছুদিন পর আমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে শাড়ি চুড়ি সাজুগুজু করার নানান রকম জিনিস কিনে এনে দিতো। আমি আবার তা আম্মাকে দেখাতো। আম্মা দেখে শাড়ির আঁচলে মুখ ডেকে বলতো পাগল ছেলে হয়েছে আমার একটা বউ পাগলা। আচ্ছা শাকিল কি এখনো বউয়ের জন্য পাগল? কথা গুলো ভাবতে ভাবতে দু’ফোটা চোখের পানি টপটপ করে বইয়ের পাতার উপর পরলো। দ্রুত চোখের পানি মুছে নিয়ে একা একাই বলতে থাকলাম আমি তার কেউ না। আমি তার কেউ না, তার জীবনে নতুন কেউ এসেছে সেই সব।

সন্ধ্যার পর স্যার এসে যখন জানতে পারলো ঝর্ণা চলে গিয়েছে। তখন হাসতে হাসতে বললো ভালোই হয়েছে, পাগলটা চলে গিয়েছে। তা না হলে মাথাটা পুরোপুরি নষ্ট করে দিবে। চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে কথা গুলো বলছে স্যার। পাশের চেয়ারে গাল ফুলিয়ে বসে রয়েছে মা। চায়ের মগের চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই মার। ঝর্ণার জন্য মায়ের খুব মন খারাপ এটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তার উপর স্যারের কথা শুনে আরও রেগে যাচ্ছে মা।

তাই আমি বাধ্য হয়েই স্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম, মেয়েটা খুবি ভালো মিষ্টি আপনি অযথায় ঝর্ণাকে উল্টা পাল্টা কথা বলে মেয়েটার মন খারাপ করে দেন? চলে গেলো তারজন্য পুরো দোষটাই আপনার। আমার সাথে মা ও সুর মিলিয়ে স্যারকে অনেক কথা বললো স্যার শুধু হেসেই চলেছে। কোন কথা বা প্রতিবাদ করছে না। আমি ভাবছি মানুষটা এমন কেন? মুহূর্তেই রাগের অগ্নিমূর্তি আবার মুহূর্তেই মানুষটা অপরিচিত মনে হয়। ঠিক শিশু বাচ্চার মত, যেমন এই মুহূর্তে সাবাকে কোলে নিয়ে বসে চা খাচ্ছে আর মা আর আমার কথা শুনে হেসে চলছে।

মানুষটাকে বুঝতে পারা সত্যিই খুব কষ্ট কর। খুবি ভয়ংকর একজন মানুষ। আমার প্রচন্ড রাগ উঠে গেলো। নিজেকে অনেক চেষ্টা করেও কন্ট্রোল করতে না পেরে বলেই ফেললাম আপনার কি কোন প্রেমিকা রয়েছে? নাকি আগে ছিলো যাকে কথা দিয়েছিলেন জীবনে তাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করবেন না। আমার কথা শুনে মনে হয় স্যার আরও বেশী আনন্দ পেলো। হাসির শব্দ আরও বাড়িয়ে দিলো। মা কানে হাত দিয়ে বলে উঠলো এই ছেলে পাগল হয়ে গেছে এখানে আর থাকা যাবে না। স্যারের কোলে বসে সাবাও হাসছে। আমার খুব অসহ্য লাগছে। আমি স্যারের কাছ থেকে সাবাকে চেয়ে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। অদ্ভুত একজন মানুষ একে বুঝার সাধ্য আমার নেই।

হাসি আনন্দ আর পুরনো স্মৃতির কষ্ট সব মিলিয়ে আরও অনেক গুলো দিন কেটে গেলো। কলেজে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। মা খুব কড়া করে বলে দিলো পরীক্ষা খারাপ হলে আমার আর এ বাড়িতে থাকা হবে না। যেদিন যেদিন পরীক্ষা থাকে মা আমাকে সাথে করে নিয়ে যায়। সাবাকে নিয়ে পুরো সময় মা কলেজে বসে থাকে। পরীক্ষা দিতে আসার সময় আমার সমস্ত শরীর বোরখা আর হিজাবে আবৃত্ত থাকে। শুধু চোখ দু’টোই দেখা যায়। এই বুদ্ধিটা মা দিয়েছে, যেনো কেউ বুঝতে না পারে আমার বয়স কত। সবাই যেনো তাদের সম বয়সী মনে করে আমাকে। সহজেই যেনো পরীক্ষার হলে সকলের সাথে মিলে যেতে পারি সে জন্য মা এই বুদ্ধি করেছেন। আমারও এই বুদ্ধিটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

আজ আমার শেষ পরীক্ষা এদিকে মায়ের শরীরটা ভালো না। তাই মা স্যারকে বলে দিলো আমাকে কলেজে নিয়ে যাবার জন্য আর পরীক্ষা শেষে দিয়ে যাবার জন্য। মা সাবাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকবে। স্যার বললো তার পুলিশের চাকরি কখন কোথায় যেতে হয় ঠিক নেই।

আমি একাই যেতে পারবো কোন সমস্যা নেই। রিক্সা নিয়ে নিলেই যেতে পারবো আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না মা।

মা: তুই বললেই হলো নাকি চিন্তা করতে হবে না? কি চিনিস আর কি জানিস এই শহর সম্পর্কে? এখানে প্রতি পদে পদে বিপদ থাকে। তাই সাথে একজন মানুষ থাকা ভালো। আমি চাইলেইতো তোকে এতোদিন একাই পাঠাতে পারতাম। কই আমিতো তোকে পাঠাইনি।

মা স্যার ব্যস্ত মানুষ, কাজের মানুষ, সত্যিই কখন কোথায় থাকে ঠিক নেই। আমি সামলে নিতে পারবো।

জাহাঙ্গীর: হয়েছে হয়েছে আপনাদের আর অভিনয়, ঝগড়া মান অভিমান দেখাতে হবে না। ঠিকমত নাস্তা করে নেন আমিই নিয়ে যাবো।

মা খুশি হয়ে নিয়ে যাবি তা এতো অভিনয়ের কি আছে? এতোদিনতো আমিই নিয়ে গিয়েছি। আজ অসুস্থ বলে না তোকে নিয়ে যেতে বলেছি। নয়তো তোকে কি এতো বার বলতাম।

জাহাঙ্গীর: বললামতো নিয়ে যাচ্ছি। আর বলতে হবে না।

সকলে খাওয়া শেষ করে যার যার রুমে চলে আসলাম। জামা কাপড় পরে রেডি হয়ে বের হয়ে আসলাম। দু’তলায় যেয়ে মায়ের কাছে সাবাকে দিয়ে নিচে নেমে আসলাম। একটু পর স্যার ও নিচে নেমে আসলো। দু’জন মিলে বের হয়ে গেলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। রাস্তাতেই বেশ কয়েক বার স্যারের ফোন আসলো। আমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে স্যার বললো পরীক্ষা শেষে এখানেই এসে দাঁড়িয়ে থেকো। একটা ইমার্জেন্সী কেস এসেছে আমি দেখেই। তোমাকে নিয়ে বাড়িতে পৌছে দিয়ে আসবো। আচ্ছা ঠিক আছে বলে কলেজের ভিতর ঢুকে চলে আসলাম।

পরীক্ষা শেষে বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছি। স্যারের কোন খবর নেই। কি করবো বুঝতে পারছি না।

এদিকে থানায় প্রচন্ড ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে এক আসামি নিয়ে। অবশেষে সকল ঝামেলা শেষ করে থানা থেকে বের হয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে কলেজের পথে ছুটলো জাহাঙ্গীর।

প্রায় এক ঘন্টা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর স্যারের গাড়ির দেখা পেলো রত্না। গরমে আর রাগে ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে রত্না।

জাহাঙ্গীর: গাড়ি থেকে নেমে সরি সরি তোমাকে অনেকটা সময় দাঁড় করিয়ে রেখেছি। খুব ঝামেলা হয়েছিলো থানায় তাই আসতে দেরী হয়ে গেলো।

ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই বলে গাড়িতে উঠে বসে মুখ থেকে হিজাবটা খুলে নিলাম। পুরো মুখ গরমে ঘেমে একাকার। স্যার গাড়ির এসি ছেড়ে দিয়ে টিসু এগিয়ে দিয়ে।

জাহাঙ্গীর : ঠান্ডা কোথাও যেয়ে বসলেই পারতে। এই গরমের ভিতর যেখানে বলছি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এমন কোন কথা কি কোথাও লেখা রয়েছে?

না যদি এসে খুঁজে না পেলেন তাই সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।

স্যার একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে বসতে বলে নিজে নেমে গেলো। একটু পর দু’টো আইসক্রিম নিয়ে স্যার ফিরে এসে একটা আইসক্রিম আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি তা হাতে নিতে স্যার বললো এটা খেয়ে নাও ভালো লাগবে।

দু’জন আইসক্রিম খেতে খেতে গাড়ি বাসায় চলে আসলো। স্যার গেটের বাহিরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে আবার থানার পথে রওনা হয়ে গেলো। আমি আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলাম।

চলবে…

হারানো সুর-১৫ তম পর্ব
শাহরিয়ার

বাড়িতে ঢুকতেই সোফার উপর মা আর সাবাকে দেখতে পেলাম।

মা: কিরে আজ এতো দেরী হলো কেন?

আর বলবেন না আপনার ছেলে থানায় গিয়েছিলো, সেখান থেকে আসতে দেরী করেছে আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাই দেরী হয়ে গিয়েছে। সাবা কি জ্বালিয়েছে খুব?

মা: আরে না সাবা জ্বালায়নি, আর আমার ছেলেটাও হয়েছে ওর কোন দায়িত্ব বলতে কিছুই নেই দেখছি। আসুক আজ বাসায়।

না মা স্যারকে কিছু বলবেন না। থানায় খুব জরুরি দরকার ছিলো, তাই সেখানে আটকে গিয়েছিলো।

মা: তাই বলে একটা মেয়েকে দাঁড় করিয়ে রাখবে?

ইচ্ছে করেতো রাখেনি, কাজ ছিলো তাই একটু দেরী হয়েছে। আপনি বসুন আমি ফ্রেশ হয়ে আপনাকে চা করে দিচ্ছি। বলে সাবাকে কোলে নিয়ে নিজের রুম চলে আসলাম। সাবা আর আমি বেশ কিছুটা সময় দুষ্টমি করে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। মা আর আমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসলাম। মাথাটা খুব ব্যথা করছিলো। মায়ের সাথে গল্প করতে করতে চা খেয়ে নিলাম।

রাতে খাবার টেবিলে মা আর ছেলে দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া শুরু করলো। আমি বেশ উপভোগ করছিলাম তাদের ঝগড়া। সাবাকে কোলে বসিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছি আর তাদের ঝগড়া দেখছি। বেশ ভালোই ঝগড়া করতে পারে মা আর ছেলে।

দেখতে দেখতে বেশ কিছু দিন কেটে গেলো, কলেজ থেকে পরীক্ষার রেজাল্ট দেবার সময় হয়ে এসেছে। আমার খুব ভয় ভয় লাগতেছিলো। আর মাত্র একটা দিন তার পরেই রেজাল্ট দিবে যদি খারাপ হয়? এসব কথা ভেবে চলছি আমি। হঠাৎ নাস্তার টেবিলে স্যার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।

জাহাঙ্গীর: তোমাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

কিছুনা স্যার কাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। তাই একটু ভয় ভয় লাগছে।

জাহাঙ্গীর: কেন ঠিক মত লেখনি? যে এখন এতো ভয় ভয় লাগছে?

জ্বি লেখেছি, তারপরেও ভয় ভয় লাগছে।

জাহাঙ্গীর: ভয়ের কোন কারণ নেই, তুমি যে টিচারের কাছে পড়ালেখা করেছো, তার ছাত্র ছাত্রীরা কখনো ফেইল করে না।

মা: মাইর খাবি কিন্তু। বেশী কথা বলিস।

জাহাঙ্গীর: সত্যি কথাইতো বললাম।

বলে নাস্তা শেষ করে টেবিল থেকে উঠে পরলো।

মা: কাল তুই ছুটি নে অফিস থেকে, রত্নাকে নিয়ে কলেজে যাবি ওর সাথে। রেজাল্ট দেবার পর নিয়ে আসবি সাথে করে।

জাহাঙ্গীর: এর জন্য ছুটি নিতে হবে কেন? আমি যাবার পথে নামাইয়া দিয়া যাবো। পরে নিয়ে আসবো।

মা: না তা হবে না, কারণ কালকে বেশী সময় লাগবে না। আর গতবার কি করেছিলি তার মনে নাই?

মা স্যারের ছুটি নিতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো সমস্যা নেই। অযথাই প্রয়োজন ছাড়া ছুটি নিয়ে কি করবে স্যার।

জাহাঙ্গীর: আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখি ছুটি নিতে পারি কিনা।

বলেই স্যার বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আমি আর মা বসে গল্প করছি, আর নাস্তা খাচ্ছি। মা মন খারাপ করে বলতে শুরু করলো।

মা: জানিস রত্না ছেলেটা আমার কেমন জানি হয়ে গেছে। ছোট বেলায় বেশ চঞ্চল ছিলো। দৌড়া দৌড়ি হাসি আর আনন্দে একাই পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। স্কুল লাইফ কলেজ লাইফে শুধু বন্ধু বান্ধবিদের নিয়ে মেতে থাকতো। ভার্সিটিতে যাবার পরেও বেশ কিছুদিন ভালোই যাচ্ছিলো হাসি খুশি আনন্দে ওর দিন গুলো। তারপর হঠাৎ দেখতে পাই আমার প্রাণ চঞ্চল ছেলেটা আর আগের মত নেই। কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আমার খুব খারাপ লাগতো ওর জন্য, পরে আস্তে আস্তে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে তার মাঝে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এখন ও কতটা চঞ্চল এর থেকে অনেক বেশী চঞ্চল ছিলো ছেলেটা।

আমি মায়ের চোখের কোনে পানি দেখতে পেলাম। এই প্রথম উনার চোখে পানি দেখে কেমন জানি অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো নিজের ভিতরে। এই মানুষটাকে সব সময় হাসি খুশি দেখেছি আজ প্রথম এমন অবস্থায় দেখে প্রচন্ড মন খারাপ হচ্ছে। নিজেকে যতটুকু সম্ভব সামলে নিয়ে বললাম মা মন খারাপ করবেন না। স্যারতো এখন বেশ ভালো আছে। আপনি মন খারাপ করলে কি চলবে?

মা মুখে হাসি ফুটিয়ে সাবাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। আমি টেবিল পরিষ্কার করে নিজের রুমে চলে আসলাম।

রাতে স্যার বাসায় এসে জানালো সে ছুটি নিয়ে এসেছে। মা বেশ খুশি হলো, বললো ঠিক আছে কাল সকালে সাথে করে নিয়ে যাবি আবার সাথে করে নিয়ে আসবি।

জাহাঙ্গীর: জ্বি প্রফেসর মেডাম যা আদেশ।

মা: মাইর খাবি কিন্তু বেশী কথা বললে।

এরপর তিনজনই এক সাথে হেসে উঠলাম। রাতের খাবার শেষ করে যে যার মত রুমে চলে আসলাম। অতিরিক্ত চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক হচ্ছিলো না। গভীর রাতে ঘুমিয়ে পরলাম।

সকালে নাস্তা করো স্যারের সাথে বের হলাম। অনেক বেশী টেনশন হচ্ছিলো। কি হবে যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তবে আমার সব স্বপ্ন নিমেষেই ধূলোয় মিশে যাবে। স্যার হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলো তাই আমাকে বললো

জাহাঙ্গীর: এতো চিন্তা করার কিছু নেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমিও মনে মনে বলতে থাকলাম তাই জেনো হয়। এতো দিনের একটা লম্বা গ্যাপের পর পড়ালেখাটা একটু কঠিনই মনে হয়। স্যার কলেজের সামনে আমাকে নামিয়ে দিলো। বললো সে এখানেই থাকবে। রেজাল্ট দেবার সাথে সাথেই যেনো বের হয়ে চলে আসি। আমি মাথা নেড়ে জানালাম ঠিক আছে। কলেজের ভিতর ঢুকে পরলাম। রেজাল্ট দেয়া শুরু হলো। এক সময় রেজাল্ট হাতে আসলো। যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ হয়নি আমার রেজাল্ট খুবই ভালো হয়েছে আমি পাশ করেছি। কি যে আনন্দ লাগছে। কলেজের অন্য মেয়েদের মত বয়স হলে ওদের সাথে আমিও আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতাম। কিন্তু ওদের আর আমার বয়সের বেশ তফাৎ রয়েছে। তাই নিরবে কলেজ থেকে বের হয়ে আসলাম।

স্যার গাড়ি নিয়ে সত্যি সত্যিই সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কাছে যেতেই স্যার প্রশ্ন করলো কি রেজাল্ট কেমন হয়েছে?

মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম খুব ভালো হয়েছে আমি পাশ করেছি।

জাহাঙ্গীর: ওয়াও অভিনন্দন! এবারতো তাহলে তোমাকে পার্টি দিতে হয়।

কিসের পার্টি স্যার?

জাহাঙ্গীর: এই যে তুমি পাশ করছে তোমাকেতো কিছু খাওয়াতে হয়।

না না স্যার কিছুই লাগবে না। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলুন নয়তো মা চিন্তা করবে।

জাহাঙ্গীর: আরে কিছু হবে না। মা কোন চিন্তা করবে না। মা জানে আমি যেহেতু সাথে আছি চিন্তার কোন কারণই নেই।

তবুও স্যার বাড়ি চলুন, সাবা যত বড় হচ্ছে ততই জ্বালাতন করছে। না জানি মাকে কতটা জ্বালাচ্ছে।

জাহাঙ্গীর: চুপ করে গাড়িতে বসো।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে যেয়ে বসলাম।

জাহাঙ্গীর: আমরা হালকা নাস্তাতো করতে পারি তাই না?

জ্বি পারি।

স্যার গাড়ি নিয়ে এসে একটা কফিশপের সামনে দাঁড় করালো। তারপর বলতে শুরু করলো।

জাহাঙ্গীর: এখানের কফি আর ফুচকা খুব মজার আমি মাঝে মাঝেই এখানে এসে খেতাম আগে।

আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্যার ভিতরে ঢুকলো দুই প্লেট ফুচকার অর্ডার করলো। আমার গ্রামের কথা ছোট বেলার কথা বেশ মনে পরতে শুরু করলো। ছোট বেলায় মেলায় বেড়াতে যেতাম আমি আর রুমন তখন ঘুরাঘুরি শেষে বাড়ি ফেরার আগে ফুচকা খেতাম দুই ভাই বোন মিলে। জানি না রুমন কেমন আছে কোথায় আছে। ভাবতে ভাবতে টেবিলে ফুচকা চলে আসলো। দু’জন ফুচকা আর কফি খেয়ে সেখান থেকে সোজা বাড়িতে চলে আসলাম।

বাড়িতে ঢুকতেই মা প্রশ্ন করলো রেজাল্টের কি খবর আমি মাকে জানালাম খুবি ভালো হয়েছে। মা খুশি হয়ে বললেন দেখতে হবে না স্টুডেন্টস কার।

জাহাঙ্গীর: হুম হুম দেখছিতো কার স্টুডেন্টস। এবার তোমার স্টুডেন্টসকে বলো চা বানিয়ে দিতে আমার মাথাটা ব্যথা করছে।

মা: সে কিরে হঠাৎ করে কি হলো?

জাহাঙ্গীর: তেমন কিছুই হয়নি শুধু মাথাটা ব্যথা করছে।

আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন স্যার আমি চা করে দিচ্ছি। কথাটা বলেই রান্না ঘরের দিকে রওনা হলাম। চা রেডি হতে হতে স্যার ফ্রেশ হয়ে চলে আসলো। আমি চা বানিয়ে নিয়ে স্যারকে দিয়ে, দোতলায় মায়ের রুমে যেয়ে সাবাকে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। স্যারকে বললাম চা খেয়ে যেয়ে নিজের রুমে রেস্ট নিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে আমি নিজের রুমে চলে আসলাম।

দেখতে দেখতে খুব দ্রুত দিন গুলো কেটে যেতে থাকলো। এক দিকে পড়ার প্রচুর চাপ আরেক দিকে সাবার জ্বালাতন। মেয়েটা এখন প্রচুর জ্বালায়। কখনো কখনো স্যার আর মা সাবাকে তাদের কাছে রাখে তখন কিছুটা শান্তিতে কাজ বা পড়ালেখা করতে পারি। অথবা সাবা ঘুমালে গভীর রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করতে হয়। তবুও আল্লাহর রহমতে সব কিছুই ভালো ভাবে হচ্ছিলো। এটা ভেবেই শান্তি লাগছিলো। নিজে কিছুটা শিক্ষিত হতে পারছিলাম এটাই সব চেয়ে বড় কথা।

প্রায় আরও এক বছর এ বাড়িতে কেটে গেলো। সাবাও এখন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে চার বছর বয়স হয়ে গিয়েছে ওর। আর এদিকে আবারও আমার এক্সাম চলে এসেছে। গত বছরের মত এ বছরও মা আমাকে সাথে নিয়েই পরীক্ষার হলে আসে। এ বছর আমার প্রস্তুতি আল্লাহর রহমতে খুবি ভালো। এবং আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ সহায় হলে আমার রেজাল্ট ও ভালো আসবে। মা আমার প্রস্তুতি দেখে খুব খুশি হয়েছেন।

দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। আর এ বাড়িতে আমার দুই বছরের বেশী সময় পার হয়ে গিয়েছে। রাতে খাবার টেবিলে বসে মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো রত্নার যদি পরীক্ষা ভুল করেও খারাপ হয় তাহলে কোথাও থেকে একটা পাত্র খুঁজে নিয়ে এসে বিয়ে দিয়ে দিবো।

আমি হাসতে হাসতে বললেই হলো। আমাকে বিয়ে দিয়ে তাড়াতে পারবেন না আপনারা। কারণ আমি জানি আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে আর রেজাল্ট ও খুব ভালো হবে।

জাহাঙ্গীর: হলেই ভালো না হলে আম্মুর সাথে আমিও একমত তোমার বিয়ে দিয়ে দিবো।

দু’জনের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সাবা আমার জামা টান দিয়ে বললো আম্মু পানি খাবো। আমি সাবাকে পানি ঢেলে দিলাম গ্লাসে। আর মনে মনে বলছি সত্যিই যদি পরীক্ষা খারাপ হয়?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here