হারানো সুর-১৬ তম পর্ব,১৭তম পর্ব

0
727

হারানো সুর-১৬ তম পর্ব,১৭তম পর্ব
শাহরিয়ার
১৬ তম পর্ব

অনেকটা ভয় নিয়েই রাতে ঘুমাতে আসলাম। সেই সাথে মনটাও কেন জানি খারাপ হয়ে গেলো। এই দুই বছরে কখনো আমার এতো খারাপ লাগার অনুভূতি হয়নি। আজ মা আর স্যার বিয়ের কথা বলাতেই এমনটা হয়েছে সে আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। হয়তো মানুষ গুলোকে অনেক বেশী আপন মনে করি বলেই এতোটা খারাপ লাগছে। সাবা ঘুমিয়ে পরেছে, আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটা সেই ছোট ছিলো যখন এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। আর এখন পুরো বাড়ি সহ দৌড়ে বেড়ায়। সারাদিন মা মা করে ডাকতে থাকে। স্যারকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে আংতেল আংতেল ( আংকেল) করে ডাকতে থাকে। আর মাকে নানু নানু বলে ডেকে বেড়ায়।

দু’টো বছরের বেশী সময় শাকিল, মা, রুমন, চাচা, চাচী কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই। মানুষ গুলোকে মাঝে মাঝেই মনে পরে। জানি না এই মানুষ গুলো আমাকে মনে করে কিনা। এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম।

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে স্যার বলে উঠলো

জাহাঙ্গীর: রত্নাকে আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি, আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি।

মা: আমি আর সাবাও যাবো তাহলে সাথে।

জাহাঙ্গীর: বেশতো যাবে, ভালোই হবে অনেক দিন সকলে এক সাথে বের হইনা।

মা: নাস্তা শেষ করে আমি রেডি হয়ে আসছি। আমার জন্য অপেক্ষা কর।

স্যার বসেন আমি সাবাকে রেডি করে নিয়ে আসছি। বলে ডাইনিং থেকে চলে আসলাম নিজের রুমের দিকে। ড্রয়ার খুলে সাবার জন্য নতুন জামা কাপড় বের করে পরাচ্ছি এমন সময় দরজার সামনে এসে স্যার দাড়িয়ে।

জাহাঙ্গীর: রত্না একটু বাহিরে আসবা।

জ্বি স্যার আসছি, সাবাকে খাটের উপর রেখে খুব দ্রুত দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। স্যার বলেন।

জাহাঙ্গীর: কিছু না।

তাহলে ডাক দিলেন কেন? কিছু লাগবে?

জাহাঙ্গীর: না না তেমন কিছু না এমনিতেই ডাক দিয়েছি। কথাটা বলেই একটা শপিং ব্যাগ আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

এটা কি স্যার?

জাহাঙ্গীর: এটা তোমার জন্য উপহার, জানি পরীক্ষায় পাস করবে তাই অগ্রিম দিয়ে রাখলাম। এটা পরেই আজ বের হবে।

বলেই হাঁটা শুরু করলো, খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো, যদি সত্যি সত্যি পরীক্ষা খারাপ হয়। তখন কি সত্যি সত্যি আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবেন? তার আগেই মানুষটা চলে গেলো। আমি আবার রুমের ভিতর ঢুকে শপিং ব্যাগটা খুলতেই আকাশি আর সাদা রঙের একটা সুতির শাড়ি বের হয়ে আসলো। খুবি সুন্দর দেখতে শাড়িটা।

সাবাকে রেডি করে দিয়ে বললাম বাহিরে আযকেল বসে আছে তুমি তার কাছে যাও। মা রেডি হয়ে আসছি।

সাবা দৌঁড়ে বের হয়ে গেলো রুমের ভিতর থেকে। আমি স্যারের দেয়া শাড়িটা পরতে শুরু করলাম। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কাঁচের চুড়িও পরে নিলাম। এরপর রুম থেকে বের হলাম। স্যার আর সাবা ডাইনিং এ বসে আছে। মা এখনো নিচে নামেনি। আমি ডাইনিং এর সামনে আসতেই স্যার বলে উঠলো।

জাহাঙ্গীর: আরে বাহ বাহ আজতে তোমাকে বেশ।সুন্দর লাগছে। কপালে কালির ফোটা দেয়ার দরকার ছিলো যাতে কারো নজর লেগে না যায়।

স্যারের মুখে এমন কথা শুনে প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমি স্যারকে বললাম ধন্যবাদ আপনি পছন্দ করে কিনে দিয়েছেন, তা সুন্দর হবে না তা কি করে হতে পারে।

কথা বলতে বলতে মা চলে আসলো, আমাকে দেখে মা ও বলতে শুরু করলো রত্না তোকেতো আজ খুব সুন্দর লাগছে। আমি মা কি যে বলেন না, আমি সেই আগের রত্নাই আছি থাকবো চিরকাল।

চারজন বের হলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। আজ স্যার সাবাকে গাড়ির সামনে বসিয়ে সিট বেল্ট পরিয়ে দিয়েছে। আমি আর মা পেছনে বসে গল্প করছি। গাড়ি এগিয়ে চলছে কলেজের দিকে। মা বলে চলছে রেজাল্ট ভালো হলে আমাকে ভালো প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিবে। তাহলে কোন ঝামেলা ছাড়াই পড়ালেখা এগিয়ে যাবে। কথা বলতে বলতে গাড়ি চলে আসলো কলেজের সামনে। আমি আর মা পেছন থেকে নেমে দাঁড়ালাম। স্যার বের হয়ে এ পাশে এসে সাবাকে বের করে নিয়ে আমাদের সাথে দাঁড়ালো।

মা: চল সবাই প্রিন্সিপালের রুমে যেয়ে বসি। এখনো বেশ কিছুটা সময় বাকি রয়েছে রেজাল্ট বের হতে।

সকলে মিলে যেয়ে অফিস রুমে বসলাম। মা আর প্রিন্সিপাল স্যার গল্প জুড়ে দিলো। আমি আর স্যার খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের গল্প শুনছি। বেশ কিছুক্ষণ পর পিয়ন এসে স্যারকে ডাক দিলো। স্যার অফিস রুম থেকে বের হয়ে গেলো। পুরো কলেজ স্টুডেন্টস দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ পরেি হই হুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো। মা বললো আস্তে আস্তে বের হই। কিছুটা ভিড় কমুক। এতো ভিড়ের ভিতর যেতে পারবো না। প্রায় দশ মিনিট পর সকলে রুমের ভিতর থেকে বের হলাম। কিছুটা ভিড় কমার পর। আমার বুকের ভিতর দুরুদুরু শব্দ হচ্ছে, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছি কি হবে এটা ভেবেই। না বিয়ে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। কারণ আমি বিয়ে করতে চাইনা। একবারতো জীবনে বিয়ে করেছি। কিন্তু আমাকে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য পড়ালেখাটা চালিয়ে নিতে হবে আর তার জন্য আমাকে পাশ করতেই হবে। নয়তো এতো পরিশ্রম এতো কষ্ট সব বৃথা যাবে। ভাবতে ভাবতে এসে দাঁড়ালাম বোর্ডের সামনে যেখানে রেজাল্ট টাঙ্গানো রয়েছে। ভয়ে যেনো আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না।

অনেক কষ্টে যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন আমার চোখের কোনে পানি জমে গিয়েছে। আমি রোল নাম্বার মিলাতে শুরু করলাম। স্যার পেছনে দাঁড়িয়ে বললো ভয় পেওনা সব ভালোই হবে। এক সময় রোল নাম্বার খোঁজে পেলাম। আমি পাশ করেছি। এবং খুব ভালো করেই পাশ করেছি, আমি আরও কয়েকবার ভালো করে মিলিয়ে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরো কান্না করে দিয়ে বললাম আমি পাশ করেছি। মা আর স্যার দু’জনই বেশ খুশি হলো।

মা: কান্না করছিস কেন? আজতো তোর আনন্দের দিন। আজতো খুশি হবার দিন। তোর পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে।

আমি মাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম সব আপনার জন্যই হয়েছে। আপনাদের ঋণ আমি এ জীবনে শোধ করতে পারবো না।

জাহাঙ্গীর: আজ খুব আনন্দ করবো। ঘুরে বেড়াবো সারাদিন। চলো সকলে চলো।

স্যারের কথা মত আমরা কলেজ থেকে বের হয়ে গেলাম। সারাদিন ঘুরাঘুরি করলাম বাহিরে খাবার খেলাম। রাতে বাসায় ফিরে আসলাম। রুমে যাবার আগে আগে মা বললো এবার ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব শেষ।

মা আপনি কি বলেন এসব? ভার্সিটিতে ভর্তি হতে তো অনেক টাকি পয়সা লাগবে। দরকার নেই আমার ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হবার তার চেয়ে বরং সরকারি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাবো। আমি জানি আমি চেষ্টা করলেই কোথাও না কোথাও চান্স পেয়ে যাবো।

মা: ঐসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। সরকারি ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হলে কোথায় না কোথায় চান্স মিলবে তখন কোথায় থাকবি কোথায় খাবি? আমি আসেপাশে ভালো একটা ভার্সিটি দেখে ভর্তি করিয়ে দিবো। এখনতো সাবাও বড় হচ্ছে তুই ভার্সিটিতে যেয়েও রেগুলার চাইলে ক্লাশ করতে পারবি। বলতে বলতে উপরে উঠে গেলো।

আমি সাবাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে সাবাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে চিন্তা করলাম। মা যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন, কেননা আমারতো আর কোন আশ্রয় নেই এখন। বা আমার লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবার মতও কেউ নেই। তাই আমাকে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু অনেক গুলো টাকার ব্যাপার। ভাবতে ভাবতে এক সময় সাবাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।

বেশ কিছু দিন কেটে গেলো এভাবেই। অবশেষে মা আমাকে ভালো একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বাড়ির খুব কাছে হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মত সময় লাগে। আমার জন্য বেশ ভালোই হলো। মা কথা বলে রেখেছেন আমি সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লাশ করবো। স্যার ও বাড়ির কাছে হওয়াতে বেশ খুশি হয়েছেন।

আমি ভার্সিটিতে ক্লাশ করতে শুরু করলাম। যে কয়দিন ক্লাশ করি সে কয়দিন সাবাকে মা দেখে রাখেন। মাঝে মাঝে স্যার আমাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যান যেদিন আমার সকালে ক্লাশ থাকে। মানুষটার প্রতি আমার বিশেষ এক ধরনের মায়া জন্মে গিয়েছে এ মায়ার নাম কি আমি জানি না। তবে মানুষটার জন্য সত্যিই মায়া জন্মে গিয়েছে। এই মায়ার নাম ভালোবাসা কিনা আমি জানি না। যদি ভালোবাসা হয় তবে সে মায়া সে ভালোবাসাকে যে আমার গলাটিপে হত্যা করতে হবে। কারণ আমি যে তার যোগ্য না। দু’জনের মাঝে আসমান জমিনের ফারাক।

আমি বিবাহিত এক সন্তানের জননী। আর স্যার অবিবাহিত, দেখতে সুদর্শন। সব চেয়ে বড় কথা আমি এ বাড়িতে একজন আশ্রিতা। আসমান আর জমিন কখনোই এক হতে পারে না যেমন আমি আর স্যান। তাই প্রতিনিয়ত নিজের মনকে বুঝিয়ে রাখি। ইদানীং স্যারের আশে পাশে যেতে ভিষণ ভয় আর লজ্জা লাগে। মানুষটার চাহনীতে এক প্রকার ভালোবাসা আমি দেখতে পাই। তাই প্রচন্ড ভয় লাগে আমার।

মা এখন মাঝে মাঝেই বলে ঝর্ণার পড়ালেখা আর কিছু দিনের ভিতরই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ছেলেটাকে কোন ভাবেই রাজী করাতে পারছি না বিয়ে করানোর জন্য। এদিকে আমার ও বয়স হচ্ছে। আমার কিছু হয়ে গেলে ছেলেটা যে একবারে একলা হয়ে যাবে। ছেলেটা কোন ভাবেই যেন বুঝতে চায়না।

মায়ের কথা শুনলে হৃদয়টা ফেটে যায়, নিজেকে শান্তনা দিয়ে বলি এটাই বাস্তবতা আজ হোক কাল হোক ঝর্ণা আর স্যারের বিয়ে হবেই।

দেখতে দেখতে এভাবেই আরও দু’টো বছর কেটে গেলো। মা ইদানিং আমারও বিয়ে দিতে চায়। আমি মাকে অনেক বার বলেছি আমি বিয়ে করতে চাইনা। আল্লাহ আমাকে যেভাবে রেখেছেন ভালো রেখেছেন। মা আমার সে সব কথা শুনতে চান না। মা বলেন মেয়ে মানুষ আর কত কাল একলা থাকবি। যদি কখনো এখান থেকে তোকে চলে যেতে হয়। তখন একলা একটা মেয়ে মানুষ তুই পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবি না। পৃথিবীটা অনেক কঠিন।

দেখতে দেখতে জানুয়ারি মাস চলে আসলো। স্যার আর মা মিলে সাবাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলো। সাবা এখন অনেক কিছু বুঝে। আমি অনেক বুঝিয়ে রাখার চেষ্টা করি। তবুও মেয়ে সারাদিন নানু নানু করে বাড়ি মাতিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে এ নিয়ে মা বলেন আমার ছেলেটা সময় মত বিয়ে করলে হয়তো সাবার বয়সী নাতি নাতনী থাকতো আমারও।

মা আপনার অনেকদিন কুমিল্লা যান না আপনার বোনের বাড়িতে। যেয়ে ঘুরে আসুন, ঝর্ণার ও পড়ালেখা শেষের দিকে। ঝর্ণাও রাগ করে এ বাড়িতে আসে না। যাওয়ার পর স্যারের মন পরিবর্তন হতেও পারে।

মা: এটা তুই ভালো বলেছিস। দেখি জাহাঙ্গীরকে বলে।

কথাটা যতটা সহজে বলেছি, ঠিক ততটা সহজে হৃদয়টিকে মানাতে পারছি না। প্রচন্ড খারাপ লাগলেও আল্লাহর নিকট প্রতিটা মোনাজাতের প্রার্থনায় বলি নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমার মায়া বাড়িয়ে দিও না। যা আমার নয় তার প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করো না।

তিন চার কেটে গেলো হঠাৎ মা এসে আমাকে বললো, স্যার রাজী হয়েছে কুমিল্লা যাবার জন্য। মাকে খুশি দেখে আমার ও ভীষণ ভালো লাগলো। আমি বললাম এবার কিছু একটা হবে।

মা: খুশি মনে বললো আমিওতো চাই কিছু একটা হোক।

চলবে…

হারানো সুর-১৭তম পর্ব
শাহরিয়ার

মা বললো দু’দিন পর যাবে, আমাকে আর সাবাকেও সাথে যেতে বললো। আমি বললাম না মা সামনে আমার আর সাবার দু’জনের পরীক্ষা।

মা: তাও ঠিক কিন্তু তোরা দু’জন কি একা থাকতে পারবি যদি কোন সমস্যা হয়?

কোন সমস্যা হবে না মা, তাছাড়া গেটেতো দারোয়ান থাকেই সব সময় বাড়িতে তো আর বাহিরের লোকজন আসা যাওয়া করতে পারবে না।

মা: তবুও জাহাঙ্গীর তোদের দু’জন কেও সাথে নিতে বললো। অনেক দিন তুইও কোথাও দূরে ঘুরতে যাসনি।

চাইলেইতো আর সব কিছু সব সময় সম্ভব হয়না মা। আপনি স্যারকে একটু বুঝিয়ে বলবেন স্যার ঠিক বুঝে যাবে। মা আমি নিজে কিছু করতে চাই।
আমার এখন সারাদিন ঘর বন্দি হয়ে থাকতে ভালো লাগে না। বাহিরের জগৎটার সাথেও পরিচিত হওয়া দরকার।

মা: বেশতো তোর যদি ভালো না লাগে তুই এক কাজ করতে পারিস। পত্রিকায় চাকরির অনেক খবর আসে। সেখান থেকে ভালো দেখে এপ্লাই কর। কোথাও রেফারেন্স লাগলে আমি আছি জাহাঙ্গীর আছে। কোন রকম সমস্যা হবে না। কিন্তু তার আগে সেমিস্টারের পরীক্ষাটা ভালো করে দিয়ে শেষ কর।

আচ্ছা মা ঠিক আছে। বলে নিজের কাজ কর্ম করতে শুরু করলাম। আমি আসলে বুঝতে পেরেছি স্যারের প্রতি আমি বেশ ভালোই দূর্বল হয়ে পরেছি। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটা চাকরি করার খুব প্রয়োজন। স্যারকে ভুলে থাকার জন্য এই চাকরি করা প্রয়োজন। আমি কি করে এতোটা অবুঝ হলাম বুঝতেই পারছি না। জীবনে একবার ভালোবেসে ঠকেছি আবার কি করে কাউকে এ মন ভালোবাসতে পারে? তাও যার যোগ্য নই। যাকে কখনো মন খুলে বলতে পারবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাইতো আল্লাহর নিকট সব সময় চাই মা কিংবা স্যার কোন ভাবেই যেনো আমার অন্তরের ভিতরের কথা জানতে বা বুঝতে না পারে। আমার মেয়েটার ভবিষ্যৎ আমি কোন ভাবেই নষ্ট করতে পারি না। বিয়ে না করে আমি সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।

দেখতে দেখতে দু’টো দিন কেটে গেলো। সকাল সকাল মা আর স্যার রেডি হয়ে ডাইনিং এ চলে আসলো। আজ ভার্সিটিতে আমার ক্লাশ নেই। সকালে উঠেই নাস্তা বানিয়ে ডাইনিং এ রেখে রুমে চলে এসেছি। এসে সাবাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে স্কুল ড্রেস পরালাম। এরপর ওকে ডাইনিং এ পাঠিয়ে দিলাম নাস্তা করার জন্য।

জাহাঙ্গীর: তোমার মা কি করে মামুনি?

সাবা: ঘর গুছিয়ে রাখছে। আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে তাই।

স্যার দুই তিন বার উচ্চ স্বরে আমাকে ডাক দিলো। আমার ভিতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। এই মানুষটার সামনে আমি যেতে চাই না। সামনে পরতে চাই না কেন বুঝে না মানুষটা? অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

জাহাঙ্গীর: তোমার ঘর গোছানোর কাজ কি আগে? আমরা আর একটু পর বের হয়ে যাবো, তোমাদের সাথে যেতে বললাম যাবে না। বেশ ভালো কথা কিন্তু একটা মানুষ যদি বাড়ি থেকে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য রওনা হয়। তখন তাদের সাথে থাকতে হয় এটাতো তুমি বুঝ। নাকি বুঝ না?

মা: আহ থাম কি করছিস? ওর কাজ ছিলো সেগুলো করতে হবে না?

স্যার এতো গুলো বছরে কখনো আমার সাথে এতোটা উচ্চ স্বরে কথা বলেনি। আমার চোখ দু’টো ভিজে আসছে। বহু কষ্টে আটকে রেখেছে। যে কোন সময় তা সমুদ্রের স্রোতের মত বয়ে যেতে শুরু করতে পারে।

জাহাঙ্গীর: খুব শান্ত গলায় বললো নাস্তা খেতে বসো। আবার কবে এক সাথে খাবার খাবো তার ঠিক নেই।

আমি সাবার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। আসলে আমি কি বলবো তাও বুঝতে পারছি না। আর স্যারের এমন ব্যবহারেরই বা কারণ কি তাও আমার অজানা। নানান রকম কথা ভাবছি আর নাস্তা খাচ্ছি। এমন সময় মা বললো।

মা: চার বছরের ও বেশী সময় আমরা এক সাথে ছিলাম প্রায় সবটা সময়। এভাবে তোকে একা রেখে যেতে আমাদের একটু ভালো লাগছে না। বিশেষ করে সাবাকে। সেই পিচ্চি পুতুলটা আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে। ওকে না দেখে থাকতে আমার খুবি কষ্ট হবে। এ জন্যই বলেছিলাম তোরাও চল আমাদের সাথে।

অনেকটা সময়ে নিজেকে বেশ সামলে নিয়েছি। মুখে হাসি ফুটিয়ে মা আপনারা যান। পরবর্তিতে না হয় আমরাও যাবো আর দশ বারো দিন পর সাবার পরীক্ষা আপনিই বলেন এ সময় কি কোথাও যাওয়া সম্ভব?

এভাবেই আরও অনেক কথা হলো আমাদের সকলের মাঝে। এক সময় মা আর স্যার বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেলো কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম গাড়িটা অদৃশ্য হবার আগ পর্যন্ত। তারপর সাবাকে সাথে নিয়ে রওনা হলাম স্কুলের উদ্দেশ্যে।

সাবাকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম। বাড়িটা একদম ফাঁকা, মা থাকতো সব সময় বাড়িতে আজ মা নেই বাড়িতে, গল্প করার মত কেউ নেই। আমি আমার জীবনে দু’জন মানুষকে কখনো ভুলতে পারবো না। আমার শাশুড়ি আম্মা আর এক স্যারের মা। এদের দু’জনের কাছ থেকে এতো এতো ভালোবাসা পেয়েছি যা কাউকে বলতে বা বুঝাতে পারবো না।

বিকেলে সাবাকে পড়াতে বসেছি আজ বাড়িটা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। প্রতিদিন বিকেলে এ সময় মা আর আমি বসে গল্প করি টিভি দেখি আর চা খাই। আজ একদমই ভালো লাগছে না।

রাতের খাবার খেতে এসেও একই অবস্থা পুরো নিরব হয়ে রয়েছে বাড়িটা। মা নেই স্যার নেই। আজ খাবার খেতেও ভালো লাগছে না।

দেখতে দেখতে তিনটা দিন চলে গেলো। স্যারের সাথে কি তবে ঝর্ণার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলো? হলেই বা আমার কি? এমনটাইতো হবার কথা আমারতো কষ্ট লাগার কোন কারণ নেই বরং আমার আরও খুশি হবার কথা। তবে এতো কষ্ট কেন লাগছে বুঝতে পরছি না। মনে হচ্ছে বুকের উপর বিশাল বড় একটা পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।

সাবাকে পড়াতে বসেছি এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। আমি দৌঁড়ে যেয়ে দরজা খুলতেই মা আর স্যারকে দরজার সামনে দেখতে পেলাম। মা মুখটা কালো করে রেখেছেন। স্যারকে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই দেখতে পেলাম। আমি বাহিরে আরো কাউকে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু না আর কেউ আসেনি। মা আর স্যার বাড়ির ভিতর ঢুকলো।

আমি মায়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে দু’তলায় নিয়ে উঠতে শুরু করলাম। মা ও পিছু পিছু আসছে। দু’তলায় উঠে মায়ের রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম মা শরীর কি খারাপ লাগছে?

মা: নারে মনটাই ভালো নেই।

কেন মা কি হয়েছে?

মা: আর বলিস না কোন ভাবেই ছেলেটাকে বিয়েতে রাজী করাতে পারলাম না। কোন না কোন উসিলা দেখাবেই ছেলেটা। ঝর্ণা মেয়েটার মুখের দিকে আর তাকানো যায় না। বোনটার ও মন খারাপ। আরও কিছু দিন সময় চেয়ে এবারের মত চলে আসলাম।

কথা গুলো শুনে কেন জানি বুকের উপর থেকে পাথর চাপা কষ্টটা কমে যেতে শুরু করলো। মা চা খাবেন চা করি।

মা: হ্যাঁ কত দিন তোর হাতের চা খাই না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তুই যেয়ে চা রেডি কর।

আচ্ছা ঠিক আছে বলে আমি সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে আসলাম। রান্না ঘরে ঢুকে চায়ের পানি গরম দিলাম।

হঠাৎ করেই ডাইনিং এ এসে স্যার বললো এককাপ চা বেশী করে কইরো। সাবা আর স্যার ডাইনিং এ বসে গল্প করছে। তাদের সাথে এসে মা ও যোগ দিলো। আমি চা বানিয়ে নিয়ে ডাইনিং এ তাদের সাথে যোগ দিলাম।

সাবা: নানু গ্রামের বাড়ি দেখতে কেমন?

মা: খুবি সুন্দর তোমার পরীক্ষা শেষ হোক এক সময় তোমাকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে যাবো।

সাবা খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। স্যার সাবাকে বললো তুমি গ্রামে যেয়ে কি করবে? এখানেই ভালো আছো। গ্রামে ধূলাবালি কাদামাটি হাঁটতে পারবে না খেলতে পারবে না। তার চেয়ে আমাদের শহর খুব ভালো।

আমি স্যারের কথা শুনে হাসছি।

জাহাঙ্গীর: এই হাসছো কেন? আমি কি ভুল বললাম?

হ্যাঁ স্যার অনেকটা ঐরকমই।

জাহাঙ্গীর: মানে কি রকম?

ঐ যে বললেন ধূলোবালিতে ভরা, আসলে স্যার গ্রামের চেয়ে শহরে ধূলোবালি বেশী। আর কাদামাটির কথা বলছেন। গ্রামের মেঠোপথ, কৃষি জমি এসবের ঘ্রাণই আলাদা। গ্রামের কাদামাটি শরীরে মেখেই আমি বড় হয়েছি। আমি গ্রামের মেয়ে গ্রামে যে সুখ আছে তা আপনি পৃথিবীর কোন শহরে পাবেন না। আমার খুব ইচ্ছে যদি কখনো সুযোগ হয়। তবে গ্রামে খুব সুন্দর একটা দু’তলা বাড়ি করবো। যার ছাদে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস আর সে বাতাসে দোল খাওয়া ধান ক্ষেত দেখা যাবে।

স্যার কিছু বলতে যাবে তার আগেই মা স্যার কে থামিয়ে দিলো।

মা: কি শুরু করলি তোরা দু’জন। একটুতো থামবি, চা খেয়ে নেই শান্তিমত তারপর না হয় ঝগড়া করিস দু’জন মিলে।

আমি আর স্যার এক সাথে হেসে উঠলাম। সাবা বলে উঠলো সবাই চুপ করো নানু চা খাবে।

সাবার কথায় এবার সকলে এক সাথে শব্দ করে হেসে উঠলাম। আজ তিনদিন পর বাড়িটা পরিপূর্ণ হয়েছে। গত তিনটা দিন বাড়িটা নিরব নিস্তব্ধ হয়েছিলো। আজ গল্প হাসি আনন্দে মেতে উঠেছে পুরো বাড়িটা। বেশ ভালো লাগছে আসলে বাড়ি এমন না হলে কি হয়? হাসি থাকবে আনন্দ থাকবে, সে হাসি আর আনন্দে চাপা পরবে অনেক দুঃখ কষ্টের গল্প।

রাতের খাবার খেয়ে সাবাকে নিয়ে বিছানায় এসে শোয়ে পরতেই। মনে হলো ঘুমের দেশ থেকে আজ সকল ঘুম আমার চোখে বেড়াতে এসেছে। মুহুর্তেই ঘুমিয়ে পরলাম।

দেখতে দেখতে দিন চলে যায়। সাবার পরীক্ষা চলে এসেছে। আমার মাথায় খুব চিন্তা হচ্ছে আমার ও পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে আর কিছুদিন পর। আমি জানি সাবার পরীক্ষা ভালো হবে। ওর ব্রেণ খুবি ভালো। আমার প্রস্তুতিও আল্লাহর রহমতে ভালো। এবার পরীক্ষা শেষ হলে আর একটি বছর ভার্সিটিতে থাকবো। তারপর শেষ হয়ে যাবে আমার ভার্সিটি জীবন। তার আগেই আমাকে একটা জব জোগার করতে হবে যাতে করে নিজের একটা ঠিকানা করতে পারি।

দেখতে দেখতে সাবার পরীক্ষাও শেষ হয়ে এলো। এদিকে আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। সাবার স্কুল বন্ধ তাই ওকে বাসায় মায়ের কাছে রেখে আমি চলে আসি পরীক্ষা দিতে। মাঝে মাঝে স্যার আমাকে ভার্সিটিতে দিয়ে যেতে চায়। আমি কোন না কোন উছিলা দেখিয়ে স্যারের সাথে আসি না। মানুষটাকে যে আমার ভুলে যেতে হবে ভুলে থাকতে হবে। যেমন করে ভুলে আছি শাকিল নামক সেই বেঈমানটাকে। আমার জীবনে যে সুখের কোন সুর বাজে না। হারিয়ে খুজি বার বার সুখের ঠিকানা। নদীর জোয়ার ভাটার মত হয়ে গিয়েছে জীবনটা। সুখ এখন মনে হয় আমার কাছে মরিচিকা। হারানো সুর যতই খুজিনা কেন, সে সুর আর ফিরে পাবো না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here