উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৫

0
3386

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
৭.
চোখ খুলে তাকাতেই বৃষ্টি দেখতে পেল তার উপর বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে! পাতার ফাকে টুকরো টুকরো আকারে বিশাল আকাশটাকে দেখা যাচ্ছে। চোখটা একটু ঘোরাতেই দেখলো তার সামনে আজব মানুষ! বৃষ্টি লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। দুজন লোক বিকট শব্দ করে তার দিকে একটু এগিয়ে এলো! বৃষ্টির গলা শুকিয়ে গেছে! এ তো জংলী! আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে জঙ্গলের ভেতর! একটু দূরে আরো পাচজন জংলী দাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। অদ্ভুত সাজে সজ্জিত দুজন মানুষ তার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসতেই বৃষ্টি ভয় পেয়ে খুব জোরে চিৎকার দিলো। বৃষ্টিকে ভয় পেতে দেখে দুজনই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! এ তো মেয়েলি কন্ঠ! একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা পাচজন দৌড়ে এলো চিৎকার শুনে। বাকি দুজনকে হাসতে দেখে একজন পুরুষ কন্ঠ তাদেরকে ধমক দিলো। সাথে সাথে সব নিরব হয়ে গেল!
– এতোক্ষণ পর একটা মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে তার সেবা না করে তোরা এভাবে ভয় দেখাতে শুরু করেছিস! মানুষ এভাবে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়, সে খেয়াল কি আছে তোদের! সবজায়গায় ফাজলামো না করলে চলে না!
বৃষ্টি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে লোকটির কথা শুনে যাচ্ছে আর ভাবছে, ” জংলী আবার এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে! জানা ছিলো না!” লোকটা বৃষ্টির কাছে এসে বসতেই বৃষ্টি ভয় পেয়ে আরেকটু পিছিয়ে গেলো। ভয় কাটাতে লোকটা বললো,
– ভয় পেয়ো না। আমরা তোমার কোন ক্ষতি করবো না। আর আমরা জংলীও না। তোমার মতোই সাধারণ মানুষ। নাম কি তোমার?
– বৃষ্টি।
– বাসা কোথায়?
– ঢা..ঢাকা।
– ঢাকা হলে এখানে কি করছো?
– আমি কোথায়?
– তুমি এখন সিলেটে। এ জায়গার নাম বিছানাকান্দি। লেকের ধারে পড়ে থকতে দেখি তোমাকে। সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসি জংগলের মাঝে। ঢাকা থেকে সিলেটে কিভাবে এলে?
– বাসে।
– সেটা জিজ্ঞেস করিনি। সিলেট কেন এসেছো, আর কার সাথে এসেছো?
– বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছি।
– বন্ধুরা কোথায়?
– জানি না। আমি তো তাদের সাথে খাসিয়াপল্লী ঘাটে গোসল করছিলাম! তারপর আর কিছু জানি না!
– খাসিয়াপল্লীঘাট থেকে বিছানাকান্দি চলে এসেছো!
তাদের মধ্যে অন্য একজন বললো,
– গোসল করতে গিয়ে ফাঁদে পড়ে স্রোতে ভেসে এসেছে বোধহয়!
বৃষ্টি এতোক্ষণ কাপা কাপা কন্ঠে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো। তার শরীরে এখনো ভেজা কাপড়! দুপুর পেরিয়ে বিকেলের শেষের দিকে, এখনো ভেজা কাপড় গায়ে! কন্ঠে তো কম্পন ধরবেই! সাথে শরীরও কাপছে, লোকটা তাদের মধ্যে একজনকে বললো,
– সিমি, তোর কাপড়চোপড় দিয়ে হেল্প কর। ঠান্ডা লাগছে বোধহয়!
– আচ্ছা, চলো আমার সাথে।
বৃষ্টি ঘুরেফিরে এক এক বার এক এক জনের দিকে তাকাচ্ছে। সবাই জংলী বেশে অদ্ভুত সাজে সেজে আছে। অথচ বলছে তারা জংলী না, স্বাভাবিক মানুষ!
মেয়েটি বৃষ্টির কাছে এসে তাকে ধরে দাড় করালো। বৃষ্টি ঠিকমতো হাটতেও পারছে না! পুরো শরীর কাপছে তার। আস্তে আস্তে হেটে তাদের সাথে জংগলের আরো গহীনে এলো। জায়গা টা একটু ফাকা! বড় বড় তিনটা তাবু টানানো! মেয়েটি বৃষ্টিকে একটা তাবুতে নিয়ে এলো। লং কটি আর জিন্সের প্যান্ট দিলো বৃষ্টিকে পড়ার জন্য। প্যান্ট একটু লম্বা হওয়ায় বৃষ্টির পায়ের গোড়ালিতে নেমে গেছে। সে ফোল্ড করে ছোট করে নিলো। কাপড় চেঞ্জ করে নিলে পাতলা একটা কম্বল এগিয়ে দিলো মেয়েটি। বৃষ্টি কম্বল মুড়ে তাবুতেই বসে রইলো। মেয়েটি এতোক্ষণে তার লতাপাতার অদ্ভুত পোশাক ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাক পড়ে নিলো। মেয়েটি খুব সুন্দর। বৃষ্টির মতোই ফর্সা, তার চেয়ে একটু লম্বাও হবে। বয়সেও বড় দেখাচ্ছে। তাই বৃষ্টি আপু বলেই সম্মোধন করে বললো,
– আপু তোমার নাম?
মেয়েটি একবার বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গায়ে লোশন মাখতে মাখতে জবাব দিলো,
– সিমি রওনাক।
– বাসা কোথায় তোমার?
– আমরা সবাই ঢাকা থেকে এসেছি।
অন্য একটি মেয়ে এসে বাইরে যাওয়ার জন্য ডেকে গেলো। বৃষ্টি কম্বল মুড়েই সিমির সাথে তাবুর বাইরে বেরিয়ে এলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। বৃষ্টি সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সবাই জংলী পোশাক ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাকে আছে। এরা মোট সাতজন। তিনজন মেয়ে আর চারজন ছেলে! সবার চেহারা মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর! সকলেই যথেষ্ট স্মার্ট! কিন্তু এরা জংলী পোশাক পড়েছিলো কেন, বুঝতে পারছে না সে। দুজন ছেলে এসে তিন তাবুর মাঝে ফাঁকা জায়গায় কিছু শুকনো পাতা রেখে তার চারিদিকে কয়েকটি লাঠি দাড় করালো এবং লাঠির মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। পরিবেশ টা খুব ভালো লাগছে বৃষ্টির কাছে তাই মৃদু হাসলো বৃষ্টি! ছেলেগুলোর দিকে আবার তাকিয়ে সে ভাবছে একটু আগে কোন ছেলেটি তার সাথে কথা বলেছিলো! আগুনের পাশে বসে লাঠিগুলো একটু নেড়েচেড়ে ঠিক করছিলো একটি ছেলে। মাথা ভর্তি সিল্কি চুল, চুলের ঝিকিমিকির সাথে চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে, আগুনের আলোতে চেহারাটা উজ্জ্বল আলোকিত হয়ে আছে। বৃষ্টি একেই সন্দেহ করলো, যে তার সাথে একটু আগে কথা বলেছিলো। ছেলেটি লাঠি ঠিক করে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে এলো,
– এখানকার পথ চেনা আছে তোমার?
– না।
– বন্ধুদের ফোন নম্বর মুখস্ত আছে? থাকলে কল করে বলে দাও। তারাও তো তোমাকে না পেয়ে টেনশন করছে।
ছেলেটির কথা শুনে এবার বৃষ্টি নিশ্চিত এই ছেলেই তার সাথে কথা বলেছিলো তখন। আর বন্ধুদের কথা তো এই মুহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিলো! অত:পর ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার কাছে ফোন আছে?
ছেলেটি তার ফোন বৃষ্টিকে দিয়ে বললো,
– কোথায় আছে তারা, সেটাও জিজ্ঞেস করে নিও। কাল সম্ভব হলে এগিয়ে দিয়ে আসবো।
– আচ্ছা।
ছেলেটি অন্য একটা ছেলেকে “রওনক ” নাম ধরে ঢেকে কিছু একটা বললো। নামটা শুনে বৃষ্টি একটু অবাক হলো। একটু আগে সিমি নামের মেয়েটা বলেছিলো তার নাম সিমি রওনক! তাহলে কি এদের দুজনের মধ্যে কানেকশন আছে নাকি! বৃষ্টি তার বান্ধবী রূপার কাছে কল করলো। তারা বৃষ্টির কথা শুনতে পেয়ে প্রান ফিরে পেয়েছে। পুলিশের সাথেও কথা বলেছে বৃষ্টি। আর সে সবাইকে নিশ্চিত করলো সে সম্পূর্ণ ঠিক আছে। আর কাল তাদের কাছে ফিরে আসবে। ব্যাপারটা এতোদূর পৌছে যাবে ভাবতে পারেনি সে। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে বিষয়টি তার বাবা-মাকে জানানো হয়নি! তাহলে এতোক্ষণে এলাহি কান্ড ঘটে যেত! বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছে বন্ধুদের সাথে। তারপর কল কেটে ছেলেটির ফোন তার কাছে ফিরিয়ে দিলো। ফোন হাতে নিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো,
– কোথায় আছে তারা, জেনেছো?
বৃষ্টি নিজের জিভে কামড় দিলো। কথা বলতে বলতে তো এটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি! আমতা আমতা করে বললো,
– না, মানে ভুলে গেছি জিজ্ঞেস করতে। সমস্যা নেই, পরে জিজ্ঞেস করে নিব।
– ওকে।
– ভাইয়া, আপনার নাম কি?
– নাম জেনে কি করবে? কিভাবে নিজের গন্তব্যে পৌছাবে সেটা ভাবো।

ছেলেটি নিজের কাজে লেগে গেলো। বৃষ্টি অবাক! কেউ নাম জানতে চাইলেও এমন ভাব দেখায়! এতোক্ষণ তো ভালোই ব্যাবহার করছিলো! তাবুর একপাশে দুজন ছেলে পাথর দ্বারা চুলো বানিয়ে তার উপর পাতিল বসিয়েছে। অন্যদিকে, সিমি আর সাথের মেয়ে দুটো মাদুরে বসে মটরশুঁটি বাছতে লাগলো। বৃষ্টি তাদের কাছে গিয়ে বসে মটরশুঁটি বাছতে লাগলো। অন্যদুজনের মধ্যে এক মেয়ে বললো,
– এতোটা নিশ্চিন্তে আছো কিভাবে! এখন যদি আমরা তোমাকে মেরে ফেলি!
বৃষ্টি হেসে জবাব দিলো,
– মেরে ফেললে মরে যাবো। এখন আর ভয় পাই না। তখন শুধু অদ্ভুত বেশে দেখেছিলাম তাই ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সত্যিই বুঝি তোমরা জংলী।
তিনজনই হাসলো তার কথা শুনে। অন্য একজন বললো,
– বাবাহ! সাহস আছে দেখছি।
– হুম, আছে একটু। কিন্তু তোমরা জংলী সেজেছো কেন?
– আমরা বন্ধুরা প্রায়ই বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে থাকি। এবার আমাদের প্লান ছিল জংগলে এসে জংলী সেজে শর্ট ফিল্ম বানানোর। যেই ভাবা সেই কাজ।
– ওয়াও! একদমই আলাদা পরিকল্পনা ! কতোটুকু হয়েছে?
– তিনদিন হলো এসেছি। আরো সপ্তাহের মতো লাগবে।
– তারপর ঢাকা ফিরে যাবে?
– হ্যাঁ। তবে এখানে কিন্তু সত্যিই জংলী আছে।
– তাই নাকি! আমার দেখার খুব ইচ্ছা।
– ভুল করেও ইচ্ছে মেটাতে যেও না। তাদের হাতে ধরা পড়লে আর ফিরে আসতে পারবা না! তারা মানুষ হয়ে মানুষকে খেয়ে ফেলে।
– ওফফ! ভয়ংকর! তোমরা কি স্টুডেন্ট?
– হ্যাঁ। আমরা সবাই মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
– কোন ভার্সিটি?
– জাহাঙ্গীরনগর।
– ওহহ! ভালো। আচ্ছা আপু, ওই ভাইয়াটার নাম কি?
তিনজনই বৃষ্টির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো! বৃষ্টি এভাবে তাকানোর কারণ খুজে পাচ্ছে না। সিমি বলে উঠলো,
– কেন! প্রেমে পড়ে গেছো নাকি?
এমন প্রশ্নে বৃষ্টি হকচকিয়ে গেল। তারপর বললো,
– কি বলছো এসব! আমি শুধু নাম জানতে চাইলাম। কারণ, ভাইয়াকে নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। নাম তো বললোই না, কেমন যেন এক্সট্রা ভাব দেখিয়ে চলে গেলো!
এবার তিনজনই হেসে উঠলো। তাদের হাসি দেখে একটা ছেলে এগিয়ে সে বললো,
– এতো হাসছিস কেন?
উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ছেলেটি মুঠ ভর্তি মটরশুঁটি নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো। সবাই বুঝতে পেরেছে ফাজিলটা মটরশুঁটি নেয়ার জন্যই এসেছে। তাই আপুরা রিজভী নাম ধরে বকাঝকা করতে লাগলো। সিমি বৃষ্টিকে বললো,
– ওর নাম আকাশ। এমনিতে মেয়েদের সাথে কমই কথা বলে। প্রেমে টেমে পড়ো না আবার। আগেই বলে দিচ্ছি, সফল হবে না।
আবারো তিনজন হেসে উঠলো, আর বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here