হলুদ_বসন্ত #পর্ব_১২,১৩

0
1146

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১২,১৩
#Eshika_Khanom
পর্ব_১২

“সাজেক উপত্যকা বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থল। রাঙামাটির একেবারে উত্তরে অবস্থিত এই সাজেক ভ্যালিতে রয়েছে দুটি পাড়া- রুইলুই এবং কংলাক। ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়া ১,৭২০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। আর কংলাক পাড়া ১,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সাজেক ভ্যালি “রাঙামাটির ছাদ” নামেও পরিচিত।”

এতোক্ষণ ধরে সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে একটা বই থেকে জোরে জোরে রিডিং পড়ছিল আয়াত। আদ্রাফ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পড়াটুকু শেষ হতেই আয়াত আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটি হাসি দেয়। আদ্রাফ আয়াতকে ভেঙ্গিয়ো বিপরীতে আরেকটা হাসি উপহার দেয়। বিচ্ছিরি এমন মুখের ভঙ্গিমা দেখে আয়াত মুখ কুচকে আদ্রাফকে বলে,
“এতো সুন্দর করে একটা হাসি দিলাম আর আপনি এটা কি করলেন?”

আদ্রাফ নিজের গায়ে থাকা টিশার্টটি টানটান করে নিয়ে বলল,
“আমিও তোমার হাসির বিনিময়ে একটা হাসি দিলাম।”

মুখ ফুলিয়ে মাথা আদ্রাফের মুখের বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে নিল সে। আদ্রাফও কিছু বলল না, আপনমনে ফোন চালাতে লাগলো। কোনো জায়গায় ভ্রমণকালে আদ্রাফের গান শুনতে খুব ভালো লাগে। তাই তার ভালোলাগার কাজটিই যাত্রাপথে করতে লাগলো সে। অপরদিকে আয়াত খুব বোরিং ফিল করছিল। কতক্ষণ বিরক্তি নিয়ে সে আদ্রাফের দিকে তাকাচ্ছে তো কতক্ষণ জানালের পাশে মাথা হেলিয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করছে। কিছু সময় পার হতেই আয়াত ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে বারবার আয়াতের মাথা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছিল। আদ্রাফ হালকা হেসে আয়াতের মাথা আয়ত্ত করে নিজের কাধে সন্তোপর্ণে এলিয়ে নেয়। এভাবেই গাড়িতে করে তারা চলতে থাকলো নিজের গন্তব্যে।

সাজেক যাত্রা পথের আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিঁচু পাহাড়ি রাস্তার সাথে চারিদিকে সীমাহীন সবুজের সমারোহ মাখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইতিমধ্যে মন কেড়ে নেয় সদা সর্বদা। রিসোর্টের প্রায় কাছাকাছি চলে আসায় আদ্রাফ আয়াতকে আস্তে করে ডাক দিতেই আয়াত জেগে যায়। আর চারপাশের দৃশ্যে চোখ বুলিয়ে ভাললাগার কিছু অনুভূতির জাগরণ করতে লাগে। তবে এসবের থেকেও আদ্রাফের কাছে আয়াতের হাস্যজ্বল মুখটাই সর্ব সুন্দর মনে হচ্ছে। তাইতো আদ্রাফ বাহিরের সৌন্দর্যে সময় নষ্ট না করে প্রিয়তমার হাসিতেই চোখ দুটো আবদ্ধ করতে ব্যস্ত।

আদ্রাফ এবং আয়াত পৌছে গেল সাজেকের রুন্ময় রিসোর্টে। আদ্রাফ রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। রিসোর্ট আগে থেকেই বুক করে নিয়েছে আদ্রাফ, তাই তাদের বেশি সমস্যা হলো না। আদ্রাফ দুইটি রুম নিয়েছে তাদের জন্যে। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে একটি চাবি আয়াতের হাতে ধরিয়ে দিল। আয়াত প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আদ্রাফের উপর। আদ্রাফ আয়াতের মনের কথা বুঝতে পেরে বলল,
“তুমি আর আমি আলাদা রুমেই থাকব, যেভাবে বাড়িতে থাকতাম আমরা।”

আয়াত আদ্রাফের কথা শুনে হতাশ হয়ে তাকালো হাতে গচ্ছিত চাবির উপর। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“বিয়ে করেছি, হানিমুনে এসেছি, তাও আমরা স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকবো। বাহ কি সুন্দর জীবন! আয়াত এতো সুন্দরভাবে জীবন পার করার জন্যে তুই এখনো নোবেল পাসনি? ছি! ছি! ছি!”

আদ্রাফ ভ্রু কুচকে আয়াতের দিকে নিজের মুখ কিছুটা এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,
“কি বিড়বিড় করছেন মিসেস আদ্রাফ?”

আয়াত ভ্যাবলার মতো হেসে বলল, “নাহ কিছু না তো, কিছু না।”

আদ্রাফ হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
“তবে কি নিজের রুমে যাওয়া হবে? আয়াত খুব ক্লান্ত লাগছে।”

আয়াত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দুইজনেই নিজেদের রুমে গিয়ে একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে আরামের এক ঘুম দিল।

সাজেক ভ্যালিতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। তবে রিসোর্টগুলোতে সোলার প্যানেল রয়েছে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জেনারেটর চালু থাকে। সেক্ষেত্রে রাতে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করা বিপদজনক। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা। বিদুৎ না থাকায় চারিদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আয়াত একা একা রুমে গুটিয়ে বসে আছে। ভেবেছিল সাজেকে আসার পর কতই না মজা করবে! কিন্তু তার মজার মাথায় ঠাডা পড়েছে। আদ্রাফ এতোই ক্লান্ত যে আজ তাকে ঘুরতেই নিল না। সে এখন নিজের ফোনে বসে বসে ক্যান্ডি ক্রাশ গেমস খেলছে। ১০৭ লেভেল খেলার পর সে আর আগাতেই পারেনি তাই বিরক্তিতে খেলা ছেড়ে দিয়েছিল। আজ আবার সেই খেলাতেই নিমগ্ন সে। শীতের পরিবেশে সাজেক ভ্যালির রুপ থাকে অনন্য। জায়গাটি একেক ঋতুতে একেক রুপ ধারণ করে। কুয়াশা জমে রয়েছে। ঠাণ্ডায় মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে সে। কিছু সময়ের পর দরজায় থেকে খটখট আওয়াজ শোনা গেল। ভয় পেয়ে গেল আয়াত, বিছানার এক প্রান্তে আরও গুটিয়ে নিল নিজেকে। দরজার অপর পাশ থেকে শোনা গেল এক অতি পরিচিত মোহনীয় কন্ঠস্বর। মৃদু কণ্ঠে সে ডাকছে,
“আয়াত, এই আয়াত, দরজা খোলো। তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?”

শান্তির এক নিঃশাস ফেলল আয়াত। চট করে উঠে গিয়ে চলে গেল দরজা খুলতে। যখনই দরজা খুলতে যাবে তখনই মাথায় এক অন্য ভয় চেপে বসলো। কাপা কাপা কণ্ঠস্বরে সে প্রশ্ন করল,
“কে?”

অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো,
“আমি আদ্রাফ।”

ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল আয়াত। পুনরায় প্রশ্ন করল, “কে?”

ওপাশে থাকা ব্যক্তি ভ্রু কুচকালো। বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আমি আদ্রাফ, তুমি দরজা খোলো।”

আয়াত পুনরায় প্রশ্ন করল, “কে?”

এবার আদ্রাফ বলল, “আয়াত তুমি দরজা খুলবে? ”

আয়াত অন্য পাশে থেকে বলল, “আগে বলুন কে?”

আদ্রাফ বলল, “আরে আমি আদ্রাফ, আমি আদ্রাফ।”

ওষ্ঠাধর প্রশস্ত করে একটা হাসি দিল আয়াত। ঝট করে খুলে দিল দরজা। দেখতে পেল, আদ্রাফ রাগী চোখে তাকিয়ে রয়েছে। আয়াত হাসিটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আসুন, ভিতরে আসুন।”

আদ্রাফ ঘরটির ভিতরে ঢুকে বলল, “এতো সময় কেন লাগলো? এতোবার জিজ্ঞেস করলে কেন আমি উত্তর দেওয়ার পরও?”

আয়াত অসহায়ত্ব নিয়ে বলল, “যদি আপনার জায়গায় কোনো জ্বীন-ভূত আসতো?”

আদ্রাফ অবাক স্বরে বলল, “কি?”

আয়াত ভাব নিয়ে বুকে দুই হাত গুজে বলল, “আমি শুধু সতর্ক ছিলাম। নিশ্চয়তার জন্যে এমন করেছি।”

“এই তোমার, তোমার এই সতর্কতা কিভাবে মাথায় এলো?”

“ওমা ছোটবেলা শুনেননি?”

“কি শুনব?”

“রাতে গুমোট পরিবেশে মাঝে মাঝে জ্বীন-ভূতও দরজায় কড়া নাড়ে। এরপর আপনি দরজা খুললে আপনার ঘাড় মটকে দিবে।”

আদ্রাফ মাথায় হাত রাখলো। হতাশ হয়ে প্রশ্ন করল,
“এটা কোথা থেকে শুনেছ?”

“আমার ফ্রেন্ডের মুখে শুনেছি। ওকে নাকি ওর দাদী বলেছে।”

আদ্রাফ কোমড়ে দুই পাশে দুই হাত দিয়ে বলল,
“আর কি শুনেছ? আমিও একটু শুনি।”

আয়াত বলল, “রাতে জ্বীন-ভূত এসে দরজায় কড়া নাড়তে পারে। তাই আমাদের উচিত কে এসেছে তা তিনবার জিজ্ঞেস করে দরজা খোলা। যদি মানুষ হয় তবে তো সে উত্তর দিবে। আর জ্বীন-ভূত হলে একবারও উত্তর দিবেনা। বরং আপনার তৃতীয়বার প্রশ্নের সময় বিরক্ত হয়ে চলে যাবে।”

আদ্রাফ হেসে দিল আয়াতের কথা শুনে। তারপর হাসতে হাসতেই বলল,
“আর সেই ভূত যদি ধৈর্যশীল হয়?”

আয়াত আদ্রাফের কথা না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল, “মানে?

আদ্রাফ আয়াতের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” জ্বীন-ভূত যদি মিথ্যে উত্তর দেয় তিনবারই সবর সহকারে? যদি বিরক্ত না হয়ে চলে না যায়, এখানেই থাকে ঠায় দাঁড়িয়ে। তখন কি করবে?”

আদ্রাফ কথা শুনে আয়াত মহা চিন্তায় পড়ে গেল। এটা তো সে ভেবে দেখেনি। আদ্রাফের হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। আয়াতকে আর কোনো চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে তার হাত ধরে নিয়ে চলে গেল রিসোর্টের বাহিরে।

“জায়গাটা বেশ সুন্দর, ধন্যবাদ আমায় এখানে নিয়ে আসার জন্যে।” আদ্রাফের কাধে মাথা রেখে বলল আয়াত। আদ্রাফ বলল, “হুম। জায়গাটা বেশ সুন্দর, যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। রাতের পরিবেশটা অনন্য এক রুপ নিয়েছে।” আয়াত নিশ্চুপ থেকে রইল। সময়টা বেশ উপভোগ করছে সে। আদ্রাফের কাধে মাথা রেখেই যদি সে এভাবেই সারাজীবন সময় পার করে নিতে পারতো তবে সে হতো সবচেয়ে সুখী।

#চলবে

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১৩
#Eshika_Khanom

পূর্বাকাশে যখন সূর্যের উদয় ঘটেছে তখন যেন কিছু নতুন আমেজ কারো জীবনের সঙ্গী বানিয়ে নিয়ে এসেছে। আবার কারো জন্যে নিয়ে এসেছে দুঃখের কলসি। আয়াত যখন আদ্রাফের সাথে সকালবেলা দেখা করতে যায় তখন আদ্রাফের মুখের অবস্থা দেখে কিছুটা চমকে উঠে। আদ্রাফের মুখমণ্ডলে এবং বাহুতে কিছু র‍্যাশ দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ আদ্রাফের এই র‍্যাশের কারণ খুজে বের করতে অস্থির হয়ে উঠে আয়াত। আদ্রাফ তখন আয়াতকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
“এই পাগল মেয়ে, শুধু শুধু এই র‍্যাশের জন্যে এতো অস্থির হয়ে উঠার কি আছে আমার বলোতো?”

আয়াতের মন মানে না। আদ্রাফের মুখে ও বাহুতে এমন হালকা লাল আবার কালচে র‍্যাশ তার কাছে স্বাভাবিক লাগেনা। আয়াত আদ্রাফকে বলে,
“আপনার মুখে হাতে তাহলে এসব র‍্যাশ কেন?”

আদ্রাফ ঠোঁটের হাসিটুকু আরও চওড়া করে বলল,
“এই শীতে তো অনেকের অনেক কিছুই হয়। আমারও তেমন কিছুই হয়েছে বোধহয়।”

“বোধহয়? ”

“হুম।”

“চলো নাস্তা করে ফেলি। আজ তো আবার বাসায় যেতে হবে। আর এমনিতেও শরীরটা আমার ওতো ভালো লাগছে না আয়াত। তাই আজ জলদিই বাসার জন্যে রওয়ানা দিব। আর সাজেকে থাকা যাবেনা। আচ্ছা আয়াত তুমি আবার এজন্যে রাগ করবে না তো?”

আয়াতের কেমন যেন এক অজানা ভয় কাজ করছে। সে মাথা নাড়িয়ে জানালো সে মোটেই রাগ করবে না।
.
.
.

ডক্টরের থেকে কিছুটা দূরে বসে রয়েছে আদ্রাফ। সাজেক থেকে সে ফিরেছে বেশ কিছুদিন হয়েছে। ইতিমধ্যে তার অসুস্থতা আরও একটু করে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেহের র‍্যাশগুলো বেশির ভাগই কালচে রং ধারণ করেছে। শীতও প্রায় শেষের দিকে। পাখিরা জানান দিচ্ছে, “ওরে তোরা শোন, বসন্ত আসছে, হলুদ বসন্ত।” বেশ সময় ধরে ডক্টর আদ্রাফের রিপোর্টগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আদ্রাফ তার দিকে। আদ্রাফের মন বলছে, “তোর আর থাকা হবে না রে।” এক বড় নিঃশ্বাস ফেলে তাকালেন ডক্টর আদ্রাফের দিকে। মুচকি এক হাসি উপহার দিলেন তিনি। তারপর আদ্রাফকে বললেন,
“আদ্রাফ এক লম্বা শ্বাস নাও তো।”

বাধ্য ছেলের মতো ডক্টরের কথা শুনে একটি লম্বা শ্বাস নিল সে। তারপর ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমিই ঠিক তাইনা ডক্টর?”

আদ্রাফের জন্যে যে হাসিটা মুখে সাজিয়ে রেখেছিলেন ডক্টর, আদ্রাফের কথা শুনে সেটা নিমিষেই মিলিয়ে গেল অন্তরালে। শুকনো মুখ হয়ে গেল যেন তার। সেভাবেই সে আদ্রাফকে উত্তর দিল,
“আমায় মাফ করো আদ্রাফ। জীবনের শেষ দরজার কড়াঘাত করাটাই এখন বাকী তোমার।”

হাসতে লাগলো আদ্রাফ। মানুষ তো কষ্ট পেলে বুক ফেঁটে কাঁদে, আর আদ্রাফ? তার বুক ফাঁটা আর্তনাদ প্রকাশ করছে হাসির মাধ্যমে। জড়িয়ে ধরল সে ডক্টরকে। তারপর ছেড়ে দিয়েও হাসতে লাগলো। কিন্তু কিভাবে যেন চোখের এক কোণ থেকে কিছুটা জল তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
.
.
.

নিজেকে পুরোই ঘরবন্দী করে ফেলেছে আদ্রাফ। এখন আর কারো সাথে সে কথা বলতে চায়না, দেখা করতে চায়না। গুটিয়ে ফেলেছে সে নিজেকে। আয়াতের থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলছে। মায়া বাড়াতে চাইছে না আদ্রাফ আর কারো সাথে। অঝোরে কাঁদে সে বসে বসে নিজের ঘরে। নামাজ পড়ে, খোদা তায়ালাকে ডাকে। শেষ মূহুর্তে এছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। আদ্রাফের দাদী দিলারা জামান আদ্রাফের এই অবস্থা দেখে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আয়াত নিজেকে আর দাদীকে সামলায়। আদ্রাফের কাছে যেতে চাইলে তার ধারে কাছেও যেতে পারেনা। নিজের মনকে কিছুতেই মানাতে পারছে না সে। বসন্ত যেখানে প্রকৃতিকে, মানুষকে এসে নতুন রুপে রাঙায় সেখানে যেন পুরো আদ্রাফের পরিবারের মধ্যকার সকল রঙ শোষণ করে ফেলেছে।

অনেক সময় পরে আদ্রাফ বেরিয়েছে নিজের রুম থেকে। বাগানে এসে বসেছে সে। নুহাশকে ডেকে পাঠিয়েছে সে। নুহাশও ভালো নেই, হাজারো শোকে কাতরপ্রায়। তবুও বন্ধুকে সতেজ রাখার জন্যে মুখে কিছুটা হাসি ফুটিয়ে মুখোমুখি হয়েছে তার। আদ্রাফের সামনে বসে ভালো করে সে তাকায় আদ্রাফের পানে। বুকটা কেঁপে উঠে নুহাশের। কেমন শুকিয়ে গেছে আদ্রাফের চেহারা, চোখমুখ আবার ফুলে গিয়েছে। হুট করেই যেন আবার আদ্রাফ ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নুহাশ এগিয়ে আদ্রাফের কাধে হাত রেখে বলে,
“যাইহোক, এমন হয়ে গেলি কেন তুই? কি অবস্থা করেছিস নিজের? এমনিতেই তুই অসুস্থ, তারপর আবার সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিস আদ্রাফ।”

আদ্রাফ বলে, “আর হব না আমি অসুস্থ। এটাই তো জীবনের শেষ অসুখ, শেষ অসুস্থতা। তারপর মুক্তি, সবকিছু থেকে মুক্তি।”

নুহাশ বলল, “আমি জানি তোর অবস্থা। আমি জানি হাজার চাইলেও সেই সত্য থেকে লুকানো সম্ভব নয়। মরতে একদিন আমাদের সবাইকেই হবে আদ্রাফ। হাজার চাইলেও আমরা কেউ তোকে এই ভয়ানক সত্য থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবো না। জানিস আদ্রাফ, মনটা এখনো মানছে না আমার। কিন্তু সেদিন আমি তোর রিপোর্ট দেখেই সব বুঝতে পারলাম। পুরো ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিস তুই। জানি আদ্রাফ আমি, কিন্তু এই শেষ সময়টুকু আমাদের সবার সাথে হেসে খেলে পার কর। দেখবি অতো আফসোস থাকবে না। আয়াতের অবস্থা দেখেছিস কি তুই? দাদীও অসুস্থ কিছুটা সেটাও তুই জানিস। আর ঐদিকে আয়াত কেঁদেকেটে নিজের জীবনকে অর্ধেক করে ফেলেছে। আমরা নাহয় আমাদের জীবনের পূর্বের সময়টুকুতে অনেক মজা করেছি, কিন্তু আয়াতের কথা চিন্তা কর। মেয়েটা কি সারাজীবন এভাবেই কষ্ট পাবে?”

নুহাশের কথাগুলো আদ্রাফের কর্ণকুহরে পৌছতেই কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ল সে। নুহাশের এক হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
“নুহাশ আমার কিছু কথা ঠাণ্ডা মাথায় শুনবি ঠিক আছে? তুই কি রাখবি আমার কিছু কথা?”

নুহাশ বলল, “হুম, কি কথা বল?”

আদ্রাফ বলল, “সবাই তো বুঝেছিসই যে আমি আর বেশিদিন নেই। তাই আমি আমার সময় শেষ হওয়ার আগেই একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আমার অবর্তমানে আমার সকল সম্পত্তি আমার দাদী এবং আয়াতের নামে দিয়ে যেতে চাই। আর দাদীর অবর্তমানে সবকিছুই আয়াতের নামে থাকবে। আর আমার সকল সম্পত্তির পাওয়ার অব এটর্নি আমি তোর আর আয়াতের নামে দিয়ে যেতে চাই।”

“আমার নামে কেন?”

“কারণ আছে। এটাই আমার সিদ্ধান্ত এবং ইচ্ছে নুহাশ।”

নুহাশ কি যেন চিন্তা করল। ভাবুক দৃষ্টি নিয়ে কিছু সময় মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”

আদ্রাফ নুহাশকে বলল,
“আমাকে কখনো ভুল বুঝিস না প্লিজ। মনে করবি না যে আমি শুধু তোকে ব্যবহার করছি। আমি সত্যিই তোকে অনেক বেশি বিশ্বাস করি নুহাশ। আর তোকে ভরসা করেই সব দায়ভার দিচ্ছে।”

নুহাশ বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”

আদ্রাফ বলল, “হুম”।

নুহাশ প্রশ্ন করল, ” তবে কি আমি উকিলকে দিয়ে সব কাগজপত্র তৈরি করাবো?”

আদ্রাফ বলল, “হ্যাঁ খুব জলদিই করিয়ে ফেল। আমার না কেমন যেন এখন ভয় লাগা কাজ করে। আমার সাহস যেন সব মরে গিয়েছে।”

নুহাশ বলল, “তুই সাহসী ছিল, আছিস এবং যতদিন বাঁচবি তুই সাহস নিয়েই বাঁচবি।”

আদ্রাফ বলল, “হুম।” নুহাশও সম্মতি দিল।

আদ্রাফ নুহাশের হাত আরও আগলে নিয়ে বলল,
“আমার আরও একটা ইচ্ছে আছে।”

“কি?”

“রাগ করবি না বল।”

“তোর উপর কিভাবে রাগ করি আমি আদ্রাফ? বল তুই।”

“আমি চাই আমার মৃত্যুর পর তুই আমার পরিবারকে আগলে রাখ এবং..”

“হুম তা তো রাখবোই ইনশাআল্লাহ। তুই চিন্তা করিস না। আর এবং কি?”

“নুহাশ আমি চাই আমার মৃত্যুর পর তুই আয়াতকে বিয়ে করবি। করবি তো?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here