হলুদ_বসন্ত #পর্ব_১৬ (বোনাস),১৭

0
2360

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১৬ (বোনাস),১৭
#Eshika_Khanom
পর্ব_১৬ (বোনাস)

নদীর ধারে বসে রয়েছে নুহাশ। তার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তা ভাবনা। প্রেমদিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে হাজারো ভালোবাসা। ফুলের প্রস্ফুটনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে নতুন প্রেম। নৌকায় নৌকায় ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে কিছু ভালোবাসার মানুষ। আবার পরিবারের সাথে হাঁটতে বেরিয়েছে অনেকেই। একলা একলা অনেকের সেই মূল্যবান মূহুর্তের সাক্ষী হয়ে থাকছে নুহাশ। তপ্ত বেলায় স্মরণ করছে নিজের বন্ধুর কথা। জানা নেই আর কয়টা দিন সে তার বন্ধুর সাথে থাকতে পারবে। মরণ ছাড়া তো আদ্রাফের সকল কষ্ট থেকে মুক্তির আর কোনো পথ নেই। প্রেমিক প্রেমিকাদের দেখলে আগে খেয়াল আসতো আয়াতের। আর এখন সব কিছু শুধরে নিয়েছে নুহাশ, নিজেকে শুধরে ফেলেছে। নিজের প্রবৃত্তির সাথে যুদ্ধ করে জিতে গিয়েছে সে। পণ করেহে নুহাশ, আয়াতের প্রতি কোনো কিছু সে অনুভব করলেও সেটা পূর্ণতা পেতে দিবেনা নুহাশ। নিকের সিদ্ধান্তে ইনশাআল্লাহ সর্বদাই অটল থাকবে সে।

জ্যাকেটের পকেটে হাত গুজে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে থাকল নুহাশ। শীতের আমেজে ভালোবাসাও জমে উঠেছে যেন অনেকের। আবার সামনে আসছে নতুন বছর। নুহাশের কাছে যে পরিবেশে কিছুটা বিরহ বিরাজমান, সেই পরিবেশই কারো কারো কাছে আনন্দের। সময় একেকজনের কাছে একেক রুপে রয়েছে। একটি বাচ্চা ছেলে আর বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে আসছে সেই নদীর ধার দিয়ে। দেখে মনে হয় ছেলেটা আট বছর বয়সী এবং মেয়েটা ছয় বছর বয়সী। তারা পরিবেশটাকে মাতিয়ে তুলেছে। অনেকক্ষণ ধরেই তাদের দুষ্টুমি পর্যবেক্ষণ করছে নুহাশ। মাঝে মাঝে তাদের কীর্তির জন্যে হেসেও উঠছে। শুধু নুহাশ একা নয়, উপস্তিত অনেকেরই নজর কাড়ছে সেই বাচ্চা দুইটি। দৌড়াতে দৌড়াতে বাচ্চা মেয়েটি অসাবধানতায় নুহাশের সাথে ধাক্কা খেলো। মেয়েটা পড়ে যেতে নিলে ধরে তাকে নুহাশ। বাচ্চা ছেলেটা তখন তার দিকে তেড়ে এসে তার এক ঝুটি হালকা টান মেরে বলল,
“কীরে বসন্ত? দেখে দৌড়াতে পারিস না? এখনি তো ব্যথা পেতি যদি আংকেল তোকে না ধরত।”

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সেই মেয়েটি। প্রতিবাদী স্বরে বলল,
“তাই বলে আমায় মারবে তুমি?”

“ভুল করলে একশবার মারবো।” এটা বলেই আবার বাচ্চা ছেলেটা মেয়েটার ঝুটি ধরে টান দিল। এবার হালকা কেঁদে দিল মেয়েটি। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল ছেলেটি মেয়েটির চোখের জল দেখে। নু্হাশ এদের কাজ দেখে হেসে দিল। তবে একটি বিষয় নুহাশের নজর এড়ালো না, ছেলেটা দেখতে একদম ছোটবেলার আদ্রাফের মতো। আর মেয়েটার সাথেও কিছুটা আয়াতের মিল রয়েছে। বাচ্চা ছেলে ও মেয়েটা নিজেদের মধ্যেই ব্যস্ত। ছেলেটা তখন মেয়েটাকে বল,
“আংকেল তোকে বাঁচিয়েছে, চল আমি আর তুই আংকেলকে থ্যাংক ইউ বলি।”

সম্মতি দিল মেয়েটি। দুজনেই একসাথে বলল,
“থ্যাংক ইউ আংকেল।”

নুহাশ হালকা হেসে দুই হাত দিয়ে একই সাথে দুইজনের গাল টেনে বলল, “ওয়েলকাম। আচ্ছা তোমাদের নাম কি?”

ছেলেটা ঝটপট বললো, “আদ্রাফ।”

চমকে গেল নুহাশ। তখনই মেয়েটা উত্তর দিল,
“আর আংকেল আমার নাম হলো আয়াত।”

বেশ বড় ধরণের শক খেলো নুহাশ। এতোটা মিল দেখে অবাক না হয়েও উপায় নেই। আদ্রাফ বাচ্চা আয়াতের হাত ধরে বলল,
“আচ্ছা চল যাই আমরা।”

বাচ্চা মেয়েটাও সম্মতি দিল। একে অপরের হাত ধরে তারা সেই জায়গা থেকে প্রস্থান করল। কিন্তু তখনও নুহাশ অবাক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই।
.
.
.

জায়নামাজ বিছিয়ে সেখানে বসে দোয়া করছিল আদ্রাফ।হঠাৎ খুব বেশি পরিমাণেই কাশি শুরু হল তার। মুখ চেপে কাশতে লাগলো সে। নার্স দুইজন বিশেষ কাজে একটু বাহিরে। আদ্রাফ বসা থেকে উঠে দৌড়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। মুখে বিদ্যমান শ্লেষা ফেলে দিল বেসিনে। তবে বেসিনে শ্লেষার বিপরীতে যা দেখলো তা দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে গেলো সে। বেসিনে দেখা যাচ্ছে তাজা রক্ত। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বেসিনটা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিজের মুখটাও ধুয়ে নিল সে। ফোনের রিংটোনের শব্দ পেলো আদ্রাফ। রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ডক্টর ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করেই প্রথমে সালাম দিল সে। ডক্টরও সালামের জবাব দিলেন। তারা কিছু সময় নিজেদের মধ্যে কুশলাদি বিনিময় করলেন। অতঃপর ডক্টর আদ্রাফকে বললেন,
“আদ্রাফ তোমার স্ত্রী এসেছিল আমার কাছে।”

কথাটা বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিল আদ্রাফ। তবুও প্রশ্ন করল, “কিসের জন্যে? ”

ডক্টর বললেন, “তোমার রোগের প্রতিকারের জন্যে।”

“তারপর?”

“এইডসের যে ভ্যাক্সিন ট্রায়াল করা হয়েছিল সেটা নিয়েই কথা বলল। প্রশ্ন করেছিল যত খরচই হোক সেটার মধ্যে তোমাকে সুস্থ করা যায় নাকি?”

হাসলো আদ্রাফ। তবে সে হাসির মধ্যেও অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আদ্রাফ প্রশ্ন করল,
“ওকে সব বলেননি? ”

ডক্টর বললেন, “আমি বলেছি তুমি এখন লাস্ট স্টেজে আছো। ভ্যাক্সিন দিলেও তোমার সুস্থ হওয়াটা অনিশ্চিত। আর সেই ভ্যাক্সিন ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে শুধু, তাই সরকার অনুমোদিত নয়। তাই সেই ভ্যাক্সিন লাখ লাখ টাকার বিনিময়েও আদ্রাফকে দেওয়া যাবেনা।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে আদ্রাফ বলল, “এরপর কি করলো আয়াত?”

ডক্টর বললেন, “কথাটা শুনে মেয়েটা খুবই আশাহত হয়েছে। শেষ একটা আশা নিয়ে সে এখানে এসেছিল। তবে আর কিছুই করার নেই।”

বুকটা ধক করে কেঁপে উঠলো আদ্রাফের। তার মনে হলো আয়াত অনেক কেঁদেছে। ডক্টরকে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”

ডক্টর প্রশ্ন করলেন,
“তোমার শরীরের কি অবস্থা?”

“পরে জানাবো,” এটা বলেই আদ্রাফ ফটাফট ফোন রেখে চলে গেল আয়াতের কাছে। গিয়ে দেখলো মেয়েটা হাঁটু মুড়ে সেখানে মাথা গুজে বসে রয়েছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আদ্রাফ তার দিকে। এক হাত দিয়ে আয়াতকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল। হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলেও আয়াত বুঝতে পারলো আদ্রাফ এসেছে। চুপটি মেরে আদ্রাফের বুকের মুখ লুকালো। আদ্রাফ সেভাবেই আয়াতের চোখের জল মুছিয়ে দিল। আদ্রাফ বলল,
“কি হলো আর তোমার ডক্টরের কাছে গিয়ে? আর এখন বসে বসে কাঁদছে এখন ম্যাডাম। খালি ঢং করে।”

আয়াত কান্না করে দিল আরও বেশি। আদ্রাফের চেষ্টা বিফল হলো। আয়াতের ধ্যান অন্যদিকে সরাতে চেয়েও পারলো না। আয়াত বলল,
“ভাগ্য কেন এতোটা নিষ্ঠুর আদ্রাফ?”

আদ্রাফ উত্তর খুঁজে পেল না কোনো। আয়াত আবারও বলল,
“আল্লাহ এতোটা কঠোর না হলে কি হতো না? আমাদের এতো শাস্তি না দিলে কি হতো না?”

আদ্রাফ আয়াতকে স্বান্তনা দিয়ে বলল,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। এর মধ্যেও হয়তো ভালো কিছু নিহিত রয়েছে। তাই হতাশ হয়ো না। ”

“কিসের ভালো? আপনাকে পেয়েও পেলাম না আমি এটা ভালো?”

“আল্লাহই জানে আয়াত। আচ্ছা এখন কান্না বন্ধ করে আমার বুকে একটু মাথা রেখে বসে থাকো তো।”

এরপর আদ্রাফ অশ্রুসিক্ত নয়নে আয়াতের দিকে তাকিয়ে তার দুই গালে হাত ডুবিয়ে বলল,
“দেখ আমি তো আর কয়েকদিনই আছে। এখন তুমি যদি এভাবে কাঁদয়ে থাকো তাহলে কিন্তু আমার কষ্ট নিয়েই কবরে যেতে হবে। তুমি কি চাও আমি অশান্তিতে মরি?”

আরও কেঁদে দিল আয়াত। আদ্রাফও আয়াতকে নিজের মাঝে লুকিয়ে নিয়ে কাঁদতে লাগলো। সত্যি বিধাতা দুইটি ভালোবাসাকে এতো কষ্ট না দিলেই কি হতো না? তাদের কষ্ট দেখে গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরও সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পরে মিলিয়ে গেল। সময়টা যেন সেভাবেই থমকে গেল নিশ্চুপ ভালোবাসার বিনিময়ের মাধ্যমে।

অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। এখনও আদ্রাফের বুকেই মাথা রেখে বসে রয়েছে আয়াত। এতোক্ষণ হালকা কাশি আসছিল আদ্রাফের। তবুও নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে। তবে এখন আর পারছেনা আদ্রাফ। কাশির পরিমাণ বেরে গেল। আয়াতকে ছেড়ে দিয়ে মুখে হাত দিয়ে কাশতে লাগলো আদ্রাফ। ব্যস্ত হয়ে আয়াতের আদ্রাফের দিকে পানি এগিয়ে দিল। আদ্রাফ মুখ থেকে হাত সরিয়ে অন্য হাত দিয়ে আয়াতের থেকে পানি নিল। তবে খেয়াল করল না তার অপর হাতে রক্ত লেগে রয়েছে। আদ্রাফের হাতে রক্ত দেখে থমকে গেল আয়াত।

#চলবে
#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১৭
#Eshika_Khanom

শুভ্র রঙা শাড়ি পরিহিতি এক রমণী হেঁটে আসছে আয়াতের পানে। নূরে আলোকিত তার চেহারা। মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণে। ঘন কালো চুলের মধ্যে কিছু চুল আবার আধাপাকা। নদীর পাড় ঘেষে হাঁটছেন তিনি। কিছু সময়ের মধ্যেই একদম আয়াতের সামনে এসে দাঁড়ালেন। অবাক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে আয়াত তার দিকে। বলার জন্যে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। ঠিক তখনই সেখানে আদ্রাফ উপস্তিত হয়। আয়াতকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি করে হেঁসে বলে,
‘ইনি তোমার শাশুড়ী, আর আমার মা।’

এই রমণী তথা আদ্রাফের মা আয়াতকে মিষ্টি হেসে বুকে জড়িয়ে নেয়। পরক্ষণেই আবার ছেড়ে দেয়। আদ্রাফ আয়াতের গালে হাত দিয়ে বলে,
‘এবার তবে আমি আসি।’

আয়াত এবার কথা বলল,
‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’

‘এইতো আম্মুর সাথে যাচ্ছি।’

‘ফিরবেন কখন?’

‘ফেরা হবে না।’

বলেই আদ্রাফ তার মায়ের সাথে চলতে থাকলো অন্য এক পথে। আয়াত আদ্রাফ আদ্রাফ করে ডাকতে লাগলো। দৌড়তে থাকলো তাদের পিছু পিছু। থামলো না আদ্রাফ, তবে থেমে গেলো আদ্রাফের মা। আদ্রাফ নিজের পথেই অবিচল। আদ্রাফের মা আয়াতের হাত ধরে বলল,
‘মারে আমার ছেলেকে আমার সাথে যেতে দে। ভয় নেই, তুই ওর থেকে আলাদা হবি না। কিছু সময় পর আমি এসে আবার তোকেও আদ্রাফের কাছে নিয়ে যাবো। আমরা পুরো পরিবার একসাথে থাকব।’

আয়াতের ললাটে স্নেহভরা চুম্বন এঁকে দিয়ে আদ্রাফের মাও চলতে থাকলেন। একদময় আদ্রাফ ও আদ্রাফের মা পরস্পরের হাত ধরলেন। মিলিয়ে গেলেন ও কূলের বাগানের মাঝে। হঠাৎ সেখানেই দাদীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। আয়াতের পানে স্নেহভরা হাসির বিনিময়ে প্রকৃতির মাঝেই মিলিয়ে গেল সেই প্রতিচ্ছবি।

চোখ খুলে ফেললো আয়াত। হ্যাঁ ঘামছে সে। জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। পাশেই হেলান দিয়ে নিদ্রারত আদ্রাফকে দেখতে পেল। উঠে বসল আয়াত। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো। মাথাটা চেপে ধরল নিজের। খুব যন্ত্রনা করছে। বুঝতে পারলো স্বপ্ন দেখেছে। তবে একে শুধুই স্বপ্ন বলা চলে না, এটি দুঃস্বপ্ন। আজই দাদীর কাছে থেকে জোর করে এলবাম থেকে আদ্রাফের বাবা মায়ের ছবি দেখেছিল। তাই হয়তো এমন একটা স্বপ্ন দেখেছে। আদ্রাফকে দেখে চোখে জলভরা হাসি দিল আয়াত। মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিল। তটজলদি বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। ওযু করে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে শুরু করল।

কিছুটা শারীরিক সুস্থতা অনুভব করেই ঘর থেকে বেরোলেন দাদী। আজ পুরো বাড়িটা ঘুরে হুরে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে তার। এক পর্যায়ে রান্নাঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। ইচ্ছে ছিল রান্নাঘরেই প্রবেশ করবেন। তিনজন সার্ভেন্ট তখন রান্নাঘরে কাজ করছিল। সাথে একজন নার্স যেন তাদের সাথে আড্ডায় মজে ছিল। তাদেরই কথোপকথন প্রবেশ করার পূর্বে শুনতে পেলেন তিনি।

‘আদ্রাফ স্যার আর কয়দিন বেঁচে আছে কিছু জানো?’

নার্স উত্তর দিল, ‘দিনকয়েক তার শারীরিক অবনতিই হচ্ছে। এইডস যেন তার শরীরে চাড়া দিয়ে উঠেছে। অসুস্থতা লাগামহীন। বেশিদিন আর তার হাতে নেই।’

থমকে গেলেন দাদী। তবে কোনো সাড়াশব্দ করলেন না। আরও কিছু কথা মনে মনে শুনতে চাইলেন। মনকে আশ্বাস দিতে থাকলেন, তিনি ভুল কিছু শুনতে পেরেছেন এবং বুঝতে পেরেছেন।

একজন সার্ভেন্ট প্রশ্ন করল,
‘তার কিভাবে এইডস হয়েছে কিছু জানো?’

নার্স না বোধক উত্তর দিল। সার্ভেন্ট বলল,
‘আমি তো জানি ঐসব খারাপ কাজগুলো করলে, বা ওসবের সাথে জড়িত থাকলে এইডস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

অপরজন বলল, ‘হতেও পারে। বড়লোকের একমাত্র ছেলে, সফল ব্যবসায়ী। টাকা তো তার হাতের কোণের ময়লা।’

নার্স প্রশ্ন করল,
‘আয়াত ম্যাডামকে কোথায় থেকে পেল? মেয়েটারও তো জীবন নষ্ট করছেন স্যার।’

তখন একজন ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
‘দেখো, স্যার আবার সেখানের থেকেই তুলে এনেছে নাকি মোটা অংকের বিনিময়ে? নাহলে কি এইডস রোগীর সাথে কেউ থাকে?’

আরেকজন বলল, ‘ভাত ছুড়লে কি আর কাকের অভাব হয়?’

চারজনের মধ্যেই হাসির রোল পড়ে গেল। কষ্টগুলো নিজের মনেই চাপা দিয়ে রাখলেন তিনি। সার্ভেন্টদের কিছুই বললেন না। রান্নাঘর থেকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন সোজা আদ্রাফের ঘরে। আদ্রাফ তখন বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আদ্রাফের ভাষ্যমতে, এই ঘরে নার্সবিহীন সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবুও আজ নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করলেন না তিনি। ঘরে প্রবেশমাত্রই দেখলেন প্রতিটি দেয়াল আয়াতের ছবি দ্বারা সজ্জিত। বিশেষভাবে অবাক হলেন তিনি। ধীরপায়ে এগিয়ে বসে পড়লেন আদ্রাফের মাথার পাশে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। আদ্রাফের কপালে নিজের ডান হাত ছোয়ালেন। সাথে সাথেই হাত সরিয়ে ফেললেন তিনি। আদ্রাফের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কারো হাতের স্পর্শে আদ্রাফ চোখ মেলে তাকাল। দাদীকে দেখে বিস্মিত হলো সে। উঠে বসে দাদীকে বলল,
‘তুমি এখানে এসে কি করছ দাদী? তুমি অসুস্থ, জানোই তো তোমার এখানে আসা ঠিক না।’

অস্থির হয়ে উঠেছে আদ্রাফ। দাদী অবাক নয়নে আদ্রাফের দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখভর্তি লালচে ও কালচে র‍্যাশ। চোখ মুখ ফুলে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। ঘন কালো চুলও পড়তে শুরু করেছে। আদ্রাফের কপালে হাত দিয়ে বললেন,
‘তোর তো জ্বর আদ্রাফ৷ শুয়ে পড়, আমি জলপট্টি দেই।’

‘উফফ দাদী, নার্স আছে তো। তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন?’

দাদী বললেন, ‘নার্স কি তোর আপন নাকি আমি?’

‘হায় আল্লাহ কি বলছ? অবশ্যই তুমি।’

‘তাহলে আমায় করতে দে।’

বাধ্য ছেলে হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল আদ্রাফ। বুঝতে পেরেছে সে, আজ দাদীকে থামানো যাবে না। মনের মধ্যে ভয় দেখা দিয়েছে, দাদী হঠাৎ এমন স্বরে কথা বলছে কেন?

দাদী কিছু সময়ের মধ্যেই এক স্বচ্ছ পাত্রভর্তি জল শুভ্র রঙের এক কাপড়ের অংশ নিয়ে হাজির হলেন। যত্নসহকারে আদ্রাফের মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলেন। অনেকটাই আরাম অনুভব করছে আদ্রাফ। তবে শুধুই জলপট্টি দেওয়ার ফল নয় এটা, দাদীর স্নেহময় স্পর্শ এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।

আবেশে নিদ্রা জেঁকে ধরল আদ্রাফকে। ঘুমিয়ে পড়ল কিছু সময়ের মধ্যেই। জলপট্টি দেওয়ার ফলে জ্বরের আগ্রাসন কিছুটা কমে আসলো। দাদী মনে মনে হাসলেন আর বললেন,
‘তোকে ছোট থেকে নিজ হাতে কোলে পিঠে আদর যত্নে ভালোবাসা দিয়ে বড় করলাম। কিন্তু তোর মিথ্যেকে ধরতে পারলাম না। আমি জানি তুই কোনো খারাপ কাজে জড়িত নেই। আমি জানি তুই আয়াতকে খুব ভালোবাসিস। আমার তোর প্রতি শুধু একটা বিষয়েয় অভিযোগ রে। এতোকিছুর পরও তর সবচেয়ে আপনের তালিকায় আমি নেই দেখেই আমি তোর মিথ্যেটা বুঝতে পারলাম না। এই জ্বালা সওয়া যে বড় কষ্টের আদ্রাফ। আমি সইতে কি পারব তাও জানিনা।’

ভরা চোখে দাদী তাকালেন আদ্রাফের দিকে। কি নূরময় চেহারা! একদম মায়ের মতো হয়েছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন আদ্রাফের মুখখানা আজ যেন খুব বেশিই নিষ্পাপ লাগছে দিলারা জাহানের কাছে। নয়নজোড়ায় ভেসে উঠছে ছোট আদ্রাফের স্নিগ্ধ সেই চেহারা, মিষ্টি এক চাহুনী।

রাতের খাবার শেষ করে শুয়ে পড়েছে সবাই। আধার যেন নিষ্পেষিত করছে সময়কে। প্রতি ঘন্টায় যেন আদ্রাফের অসুস্থতা বেড়েই চলছে। বেশ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে নুহাশকে বন্ধুর বিষয়ে। কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছেনা। এমনিতেই এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি তারা। জানা আছে, সব চেষ্টাই বিফলে যাবে। খোদা তায়ালার কাছে যেন কয়েক বান্দা খুবই প্রিয় হয়ে উঠেছে। ডক্টরের সাথে যোগাযোগ করল নুহাশ। জানালো আদ্রাফের অবস্থা। ডক্টর বললেন,
‘জানেনই তো আদ্রাফের হাতে আর দিনকয়েক সময় আছে।’

নুহাশ উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘তাই বলে তো আর এভাবে বন্ধুকে ভুগতে ভুগতে মরতে দিতে পারিনা আমি।’

‘কি আর করার? অসুস্থতা এখন পুরোপুরি আদ্রাফকে ঘায়েল করে ফেলেছে। ক্বলব থেকে শুধু রুহ এর মুক্তি বাকি।’

‘ডক্টর এসব দয়া করে বলবেন না। জ্বরে আদ্রাফের গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্ঞান নেই তার। দাদী ঘুমিয়ে পড়েছে তাই কিছু জানেনা এখনও। আয়াত কেঁদে কেটে সারা হচ্ছে।’

‘ইমিডিয়েটলি হস্পিটালে ভর্তি করুন। হাতে আর বেশি সময় নেই।’

ফোন কেটে দিল নুহাশ। তৎক্ষনাৎ এম্বুলেন্স কল করল। ভর্তি করা হলো তাকে হাসপাতালে। আদ্রাফ যার অধীনে সে ডক্টর জলদিই সেখানে উপস্থিত হলেন। আয়াতকে আসতে দেওয়া হয়নি। ঘরে বসে আদ্রাফের জন্যেই দুয়া করছে সে। আদ্রাফের চেক আপ করা হয়েছে। আইসিউতে নেওয়া হয়েছে তাকে। প্রাণভোমরাগুলো যেন আজ মুক্তি চাইছে।
.
.
.
নতুন এক ভোরের দেখা মিলল। সময়ের পরিক্রমায় সূর্য মাথার উপর দাঁড়াতে প্রস্তুত। ঘড়ির কাঁটা দশের কাঁটায় ছুইছুই। হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত আয়াত। ভাবলো যাওয়ার আগে একবার দাদীর সাথে দেখা করে যাওয়া প্রয়োজন। যেই না ভাবা তখনই সেই কাজ করল। দাদীর ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল আয়াত। দরজা ভেজানো ছিল, হালকা ধাক্কার বিনিময়েই খুলে গেল। তবে পরবর্তী দৃশ্য দেখার জন্যে প্রস্তুত ছিল না আয়াত। জায়নামাজের উপর কাত হয়ে পড়ে আছেন দাদী। আখিজোড় বন্ধ, মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে। দৌড়ে এগিয়ে গেল আয়াত তার পানে। ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠেছে সে। গায়ে হাত দিয়ে দেখ গেল, দেহ জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। আয়াতের কণ্ঠে দাদী বলে এক চিৎকারের ডাক শোনা গেল। বাড়িতে উপস্থির সকল সার্ভেন্ট সেই কামড়ায় হাজির হলো। তবে আর তো কোনো আয়োজনেই লাভ নেই, প্রাণপাখি অনেক আগেই খাচা ভেঙ্গে উড়ে গিয়েছে দূর আকাশে, অসীম এক গন্তব্যে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here