#দেয়াল_বন্দি(৫ম এবং শেষ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda
খালার চিল্লাচিল্লিতে আমি নিজেকে ঠিক করে নিলাম। খালা বাবার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতেছে। আমার মাকেও খালা অনেক কিছু বলতেছে।
রেডি না হয়েই আমি ড্রইং রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি আমাদের পরিচিত কয়েকজন স্বজনেরা এসেছেন। খালা সবাইকে মিষ্টি দিয়ে রায়ান ভাইকে বললো আংটি পরিয়ে দিতে। রায়ান ভাই আমার পাশে এসে আংটি পড়িয়ে দিলেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমি শুধু দেখে যাচ্ছি।
বাবা আমার হাতে আংটিটা দিয়ে বললো।
“এটা রায়ানকে পরিয়ে দাও”
আংটি বদলের পরে নিজেকে জিন্দা লাশ মনে হলো। বেঁচে থেকেও মনে হচ্ছে আমি মৃত। আবিদ ফোনটা অফ করে রেখেছে। অনেক অভিমানে ফোন অফ করেছে নাকি আমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য এত বাহানা। আবিদ কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতো? ভালোবাসলে তো এত সহজে ভুলে যেতে পারতো না।
রায়ান ভাইকে বলার পরেও সে আমার হাতে আংটি পড়িয়ে দিলো। কিঞ্চিৎ পরিমান সে ভাবলো না। নাকি বাবার কাছে টাকা পায় সেই দায়ে সেও রাজী হয়ে গেলো। আসলেই কেউ কারো না। সবাই সুযোগ-সন্ধানী।
আজ আমি মেয়ে মানুষ বলে আমার বিন্দু পরিমান দাম নাই। এই সমাজে আমি মূল্যহীন, আমার অনুভূতি মূল্যহীন, আমার ভালোবাসা অসহায়। না পেরেছি বাবাকে বুঝাতে, না পেরেছি আবিদকে ভালোবেসে আকড়ে ধরতে। আর রায়ান ভাই তো স্বার্থের দায়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলেন।
হায়তে মানুষ! হায়রে বাবা। হায়রে আমার ভালোবাসা।
আনুষ্ঠানিক বিয়ের আর মাত্র ছয়দিন বাকী আছে। সবাই কত আনন্দে আছে। আমার বাবা তো রায়ান ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। যতক্ষন না আমি কবুল বলবো, ততক্ষন হয়তো বাবার গলার কাঁটা হয়েই থাকবো।
আস্তে আস্তে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। না ঘুমাতে না ঘুমাতে চোখের নিচে কালো দাগ হয়ে গিয়েছে। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে তবুও আমার একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না।
সেদিন আংটি বদলের পরে রায়ান ভাই আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে, কিন্তু আমি কারো সাথেই কথা বলিনি। আর দরজাও আটকিয়ে রেখেছি। অনেকবার বাসা থেকে চলে যাওয়ার চেস্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি। প্রত্যেকবার কেউ না কেউ আমার রুমের সামনে থাকে যখনই দরজা খুলি। এখন তো আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছি। হয়তো আবিদ আমার ভাগ্যে নেই। তাই নিয়তির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। চেস্টা তো কম করিনি।
তবে মা অনেক রাতে আমার রুমে এসে খাবার খাইতে দিয়ে গিয়েছেন প্রতিদিনই। সে তো আমার মা। আমার মা অন্তত আমাকে বুঝেন। কিন্তু বাবার জন্য কোনো কিছু করতে সাহস পান না। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন।
“আল্লাহের উপর ভরসা রাখ। তিনি যা করবেন তোর ভালোর জন্যই করবেন।”
আমি শুধু মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতাম। তাকেও শক্ত করে কিছু বলতে পারতাম না। কারন আবিদ যে ফোনটা অফ করে রেখেছে। বাসা থেকে চলে যাওয়া বা সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত টা মায়ের জন্য বাদ দিয়ে দিলাম। মাঝে মাঝে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় ভাইয়া ও নেই, এখন যদি আমিও মায়ের কাছ থেকে চলে যাই আর বাবা আমার সাথে ভাইয়ার মতো সব সম্পর্ক শেষ করে দেয় তাহলে আমার মাকে বাঁচাতে পারবো না। আমার মা হার্টের রোগী। আমার বাবা তো মাকে গালিগালাজ করবে, সাথে আমার খালা’ও মায়ের সাথে বিষাক্ত ব্যবহার করবে। আর কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেয়ার জন্য প্রতিবেশী তো আছেই। আর যদি সুইসাইড করি তাহলে মা এম্নিতেই মরে যাবে। এতগুলো মানুষ আমার সাথে অন্যায় করলেও আমার মা আমার পাশে থেকেছেন। আমি কি করে তাকে একা করে দিবো? ভাগ্যে যা আছে তাই হোক।
কিন্তু আবিদকে কখনো ক্ষমা করবো না। আর ওর ই বা দোষ দিবো কি করে?? ও আমাকে গ্রহণ করলেও তো বাবা মানতেন না। সব প্রেশার আমার মায়ের ওপরে পড়তো। রায়ান ভাইয়া আর খালাকে তো আমি বিয়ের পরে দেখে নিবো। তারা যখন এতই চাচ্ছে বিয়ে টা হোক, তো বিয়েটা হয়ে যাক। আর বাবা! বাবার সাথে সব সম্পর্ক এখানেই শেষ। শুধু মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখবো, সম্ভব হলে নিয়মিত দেখা করবো। কিন্তু এই বাড়িতে আর কোনদিন ও না।
হঠাৎ করে করে আমার ভাইয়ার কন্ঠ ভেসে আসলো..
– কথা,এই কথা। কই তুই? মা, মা!
ভাইয়ার কন্ঠ শুনতে পেয়ে দরজা খুললাম। খুলে দেখি সত্যিই আমার ভাইয়া এসেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। খুব শব্দ করে আমি কান্না করছি। বাবা মা,খালা,রায়ান ভাই সবাই ড্রইং রুমে এসে হাজির। বাবা বলে উঠলেন….
– কি কারনে এই বাড়িতে, কে আসতে বলেছে আমার বাড়িতে? কার অনুমতি নিয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছো? কোন অধিকারে??
– আমি আপনার বাড়িতে অধিকার নিয়ে আসিনি, আমি এসেছি আমার বোনের কাছে।
– কে বোন? কেউ তোর বোন না।
– আপনি বললেই হবে না। আপনি আমাকে পরিচয় না দিতে পারেন, কিন্তু কথা আমার বোন, আর এখানে আমার মা’ও আছেন। লাগবে না আপনার পরিচয়। আমি তাদের কাছে এসেছি।
– দেখছেন আপনি? আপনার ছেলে কতটা বেয়াদব? আমার ছেলে রায়ান এভাবে বললে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতাম। (খালা বাবাকে বললেন।)
– আপনি চুপ করুন, একদম চুপ করুন। আপনি এখানে কোনো কথা বলবেন না। এখন আমি যা বলবো তাই শুনবেন চুপচাপ।
– বের হয়ে যা বাসা থেকে। এক্ষনি বের হয়ে যা বেয়াদব। নাহলে জুতাপেটা করে বের করে দিবো।( বাবা বললেন)
– তা আপনার যা ইচ্ছা হয় করুন, কিন্তু আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি সেটার ফয়সালা করেই এখান থেকে বের হবো।
– মানে? কিসের উদ্দেশ্য?
– একটু পরেই দেখবেন।
এরই মধ্যে কয়েকজন লোক আমাদের বাসায় প্রবেশ করলেন।
আমি তাকিয়ে দেখলাম আবিদ পিছনে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এটা আমার ভ্রম না তো? হতেই পারে। নাহলে আবিদের তো এখানে আসার কথা না। চোখটা কচলিয়ে ভালো মত তাকালাম। নাহ, সত্যিই আবিদ এসেছে।
– আবিদ সামনে আসো। (ভাইয়া বললেন)
আবিদ ভাইয়ার পাশে মাথা নিঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাইয়ার অপর পাশে। আবিদকে দেখে চোখের পানি আর আটকাতে পারলাম না। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেলো।
ভাইয়া আবারো বলতে শুরু করলেন…
– এই আবিদ ছেলেটাকে কথা ভালোবাসে। কিন্তু আপনার ভয়ে কথা আপনাকে ওর ভালোবাসার কথা বলতে পারেনি। ওর ভয় হচ্ছিলো যেটা আপনি আমার সাথে করেছেন ঠিক সে-ই কাজটা ওর সাথে ও না করে ফেলেন। ও আপনার সম্মানের কথা ভাবলো অথচ আপনি বাবা হয়ে আপনার মেয়েকে দুঃখের সাগরে ফেলে দিচ্ছেন। অবশ্য আপনি পারেনও বটে। আপনার কাছে আপনিই রাইট। আপনার সন্তানেরা কিছু না।
– এই ছেলে, এই। তুমি এত কথা বলছো কেনো?(খালা বললেন)
– নিষেধ করেছি কথা বলতে। চুপ থাকেন। আমি এখানে পুলিশ অফিসার নিয়ে এসেছি। জেলে ঢুকিয়ে দিবো। একটা মেয়ের অমতে বিয়ে দেওয়া অন্যায়। এটা আইন ভঙ্গ করা। আমি যা বলবো তা শুনুন সবাই।
আগামীকাল সাত তারিখ কথা আর আবিদের বিয়ে হবে। কাল ওর বাসার মেহমান আসবে সবাই। ওরা দুজন দুজনাকে ভালোবাসে। ওদের দুজনের বিয়ে দিয়েই আমি এখান থেকে যাবো। সাথে থাকবে আমার বন্ধু পুলিশ অফিসার। যদি উল্টাপাল্টা কেউ কিছু করতে যান তো খবর আছে।
আপনাদের মত কয়েকজন মানুষ সমাজটাকে দেয়াল বন্দি করে রেখেছেন। আপনারা সন্তানদের ভালোবাসাকে দেয়াল বন্দি করে রেখেছেন। এমনকি আপনারাও দেয়াল বন্দি হয়ে আছেন। নিজেদেরকে এই দেয়ালের মাঝ থেকে বের করে দেখুন, ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কতজনেই সুখে আছে। এরকম স্বার্থপরের মত হয়ে অন্যকে অসুখি করবেন না।
বাবা আমার মত কথাকে কষ্ট দিবেন না প্লিজ। যদি দিতে চান তো একা হয়ে যাবেন। মাকে আমি এখান থেকে নিয়ে যাবো। আর কথা থাকবে আবিদের কাছে।
খালা আপনি যে বাবাকে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়েছিলে। টাকাটা নিয়ে যাবেন। সাথে করেই নিয়ে এসেছি।
কথা আংটি ফেরত দিয়ে দে। তুই তো একটা গাধী। কিছুই করতে পারবি না। যা করার এই আবিদই করলো। এই আবিদই আমাকে সব কিছু বলেছে তোর আর ওর ব্যপারে। তুই কিচ্ছু করতে পারবিও না। আবিদ তোকে অনেক ভালোবাসে, বুঝলি?
আর মা। মা’ও কিন্তু আমাকে কল করেছিলো। সেও বলেছে তোর কথা। মাকে তো একটু জড়িয়ে ধর। সেও তোর কষ্ট দেখে আমাকে নিজ থেকে ফোন দিয়ে বলেছে।”
সব দেখে খালা বললেন,
– বুবু তুমি আমাদের সাথে এমন করতে পারলে? তুমি তো জানতে রায়ান ছোট বেলা থেকেই কথাকে পছন্দ করে।
ভাইয়া রেগে গিয়ে খালাকে বললেন,
– আপনি একটা কথাও বলবেন না। আর সম্পর্কের দোহাই তো একেবারেই দিবেন না। আপনি না আমাদের খালা হন? লোকে বলে খালা নাকি মায়ের প্রতিরূপ হয়। কিন্তু আপনি কি? জোর করে এদের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন শুধুমাত্র রায়ান পছন্দ করে বলে। অথচ কথা এই বিয়েতে খুশি থাকবে কিনা এই ব্যাপার টা একবারো ভাবেন নি। কথা যদি কিছু একটা করে ফেলতো তাহলে রায়ান ও কি কথার সাথে সাথে মরে যেত? কখনোই না। অন্য কোনো মেয়ের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিতেন। কিন্তু আবিদ ঠিকই কথার জন্য নিজের জীবন দিতে পারে। আপনাকে আমার আর কিছুই বলার নেই। আপনারা আসলে কোনদিনও বুঝবেন না।
সব কথা আমার ভাইয়া’ই বলে গেলেন। মা শুধু একটু হেসে দিয়ে বললেন…
“আমার ছেলের বউটাও যেনো কাল আসে কথার বাবা। নইলে কিন্তু আমিও আমার ছেলের সাথে চলে যাবো। বলে দিলাম।”
বাবা চশমাটা খুলে পরিস্কার করে পরে নিলেন। অন্য দিকে খালা আর রায়ান ভাই ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেলেন।
ভাইয়া আবিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমার বোনটাকে দেখে রেখো ভাই।”
আবিদ চোখে পানি নিয়ে বললো,
“জীবন ও দিয়ে দিবো ও চাইলে।”
আমি ভাইয়ার কাধে মাথা রাখলাম। আর ভাইয়া আবিদের কাঁধে হাত রাখলেন।
# সমাপ্ত