রয়েছ_হৃদয়ে #৩য়_পার্ট

0
793

#রয়েছ_হৃদয়ে
#৩য়_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

৩.
জেরিনকে নিয়ে আমাদের আর কথা হয়নি কখনো। রোহানও তেমন কিছু বলেনি আর আমিও জানতে চাইনি। ঐ যে বললাম, কোনো কিছু নিয়েই খুব বেশি ইন্টারেস্ট কাজ করে না আমার!
ওর স্কুল ফ্রেন্ড নিহান একদিন জানালো, জেরিনের এই কর্মকান্ড পুরোটাই প্ল্যান করে করা। জেরিন ওর ফ্রেন্ডদের সাথে চ্যালেঞ্জ ধরে অমন করেছে! রোহানকে দ্বিধাদন্দে ফেলা এবং চ্যালেঞ্জ জেতাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য! আমার খুব রাগ হলো। বাচ্চা একটা মেয়ে, অত সাহস পায় কই? এত পাকা কেন?

যাইহোক, আমি এই প্রসঙ্গ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু একদিন ঘটলো খুব মজার ঘটনা। ওর ফোনে দুজন কোনো একটা কাজ করছিলাম। ওর ক্লাসমেট ইফাজ তখন জেরিনের সাথের সেই পুরোনো ভিডিওটা দিল। রোহান প্রথমে না বুঝতে পেরে বলল, “কিসের ভিডিও দিল?”
আমি বললাম, “দেখ! আমি কী করে বলবো?”
রোহান ভিডিও প্লে করলো আর সেই সিন! ইশশ…ওর মুখটা যা হলো তখন! এমন ভাবে যে ছেলেরা লজ্জা পায় আমি জানতাম-ই না! খানিক অস্বস্তি নিয়ে বলল, “মানুষের আর কাজ নাই! যা পায় তাই….এদের জাস্ট…”
আমি বললাম, “আশ্চর্য! লজ্জা পাচ্ছো কেন? সুন্দর তো ভিডিওটা। খারাপ কি? মেয়েদের মতো লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু তো হয় নাই!”
রোহান বলল, “খুবই উইয়ার্ড।”
আমি বললাম, “মোটেও না। খুবই দারুন!”
একটু থেমে রোহান বলল, “তোমার জেলাস ফিল হয় নাই জুছি?”
আমি দারুন অবাক হলাম। বললাম, “জেলাস ফিল কেন হবে?”
রোহান হাসলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল, “কেন হয় নাই? আমার জায়গায় তুমি আর জেরিনের জায়গায় অন্যকেউ, অন্যকোনো ছেলে হলে; আমার খুব হিংসে হতো, রাগ হতো, মারতে ইচ্ছে করতো। ইউ নো হোয়াট? তোমায় ঘিরে আমার অনেক জেলাসি!”
বলেই নির্বাক গতিতে হেটে চলে গেল। আমি তখনও বসে। কি থেকে কি বলে গেল কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না!

ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনালের রেজাল্ট দিল যেদিন, চিন্তায় অস্থির আমি। খুব ভালো রেজাল্ট না হলে এক প্রকার ডিপ্রেশনে চলে যাব টাইপ অবস্থা! অন্যদিকে রোহানের কোনো হেলদুল নেই। সে ঘুরছে, খাচ্ছে, গল্প করছে। একেবারে ‘নো টেনশন, ডু ফুর্তি’ টাইপ ভাব-সাব। আমি বললাম, “তোমার টেনশন হচ্ছে না রোহান?”
রোহান বলল, “টেনশন-ফেনশন কেন করবো? আমি তো জানি আমি সুপার-ডুপার রেজাল্ট করবো। এক্সাম ভালো হয়েছে তো। এসব টেনশন-ফেনশন আমার কাজ না, বুঝলে জুছি।”

এক্সাম তো আমারও মোটামুটি ভালো হয়েছে, তবুও কেন ওর মতো রিল্যাক্স থাকতে পারি না? এমন ভাবনা মনে আসতেই নিজে নিজে কারেকশন করে নিলাম, ওহ আচ্ছা! পাগলদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নাই…হা হা!

কিন্তু আমাকে ভয়ানক অবাক করে দিয়ে রোহান ফার্স্ট ইয়ারে দুর্দান্ত রেজাল্ট করল!
আমি কোনো ভাবেই ভেবে পাই না, সারাবছর না পড়েও কেমন করে অত ভালো রেজাল্ট করে ছেলেটা? সেই পরিক্ষা আগে আগে ছাড়া, সারাবছর বদমাইশি, বাঁদরামি করে বেড়ায়, ঠিকঠাক ক্লাস করে না….তবুও কত ভালো রেজাল্ট।
আমি প্রায় প্রতিবার বলি, “একটু সিরিয়াস হয়ে যদি পড় রোহান; তুমি কলেজে টপ হবা, ট্রাস্ট মি! ইউ আর মোস্ট ব্রিলিয়েন্ট রোহান। কেন যে সিরিয়াস হও না!”
রোহান কন্ঠস্বর খানিক নামিয়ে এনে ‘মূল্যবান কথা’ বলার মতন করে বলে, “ব্রিলিয়েন্ট বলেই তো ফাও ফাও বেশি পড়ে টাইম ওয়েস্ট করি না। শোনো নি? অপচয়কারী শয়তানের বন্ধু!”
কথাগুলো বলেই বদমাইশের মতো চোখ মারে আর হো হো করে হাসে!
আমি আর কিছু বলি না। ভালো লোককে বুঝানো যায়, পাগলকে বুঝাবো কি করে?

সেকেন্ড ইয়ারে উঠে যে সে একেবারে ভালো, শান্তশিষ্ট ভদ্র হয়ে গিয়েছে তা কিন্তু নয়, বরং আরো ফাজিল হয়েছিল।
আমাদের দুজনেরই কমন ফ্রেন্ড মাহিরা যখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “দোস্তরা? আমার বফ আমাকে চিট করেছে। আমার মনে হচ্ছে ওই পোলা আমাকে ইনসাল্ট করেছে। কত্ত বড়ো সাহস! আমার সঙ্গে কমিটমেন্টে থাকা কালিন অন্য মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করে! দোস্ত আমি কেঁদে দিব এখন।”
রোহান বলল, “খবরদার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করবি না। আমি তো আগে বলেছিলাম, ওই মদনাকে টাউট-বাটপার লাগে।”
মাহিরা বলল, “মদনা বলিস ক্যান দোস্ত, হিজ ইজ হ্যান্ডসাম।”
রোহান ব্যাঙ্গ করে বলল, “ওরে আমার প্রেম রে!”
ঘটনা সেদিনের মতো এটুকুই ছিল। আমরা বুঝতেও পারিনি এরপরদিন ছেলেটার বেহাল দশা করে ছেড়ে দিবে। আমি আর মাহিরা বসে গল্প করছিলাম। রোহান ছিল না। হুট করে একটা ছেলে এসে মাহিরাকে অস্থির হয়ে বারবার করে ‘স্যরি’ বলতে লাগলো। মাহিরা যত বলছে, “ইট’স ওকে, থামো।” ছেলেটা তত বেশি ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছে।
আমি বুঝলাম যে এ-ই মাহিরার বফ। ছেলেটা
বলল,”আই স্যয়ার, আমি আর কারো সাথে ফ্লার্টিং করবো না। বিলিভ মি মাহি!”
মাহিরা খুব দুঃখি দুঃখি মুখ করে বলল,
“ইট’স ওকে। বাট আই ডোন্ট বিলিভ ইউ। আই উইল নেভার ফরগিভ ইউ…আই হেইট ইউ।”
বলেই সে উঠে চলে গেলো। অভিমান? নাকি হৃদয়-ভাঙন? কী নাম দেয়া যায় মাহিরার অনুভূতিটাকে?
ছেলেটা আমায় বলল, “আপু ওকে একটু বুঝাবেন প্লিজ? আদারওয়াইজ আমাকে আরো মার খেতে হবে।”
আমি বললাম, “বলবো।”
আমি আসলে মিথ্যে বলেছিলাম। মনে ঠিক ছিল, কখনোই বলবো না। ইভেন বলিওনি। উল্টো ডিমোটিভেট করেছিলাম। কারন ছেলেটার চোখেমুখে মাহিরার জন্য কোনো মায়া কিংবা প্রেম দেখিনি। সম্পর্কে মায়া-টান-প্রেম না থাকলে, সেটা আবার কেমন বন্ধন?

ছেলেটা চলে যাওয়ার পরপরই রোহান এসেছিল। আমার কিন্তু একটুও ধারনায় ছিল না, কাজটা রোহানের ছিল। আমার বিশ্বাস ছিল, রোহান আর যাই হোক, অমন ডানপিটে নিশ্চয়ই নয়!
রোহান আমার পাশে বসতে বসতে বলল, “জুছি? আজ একটা জায়গায় যাবা?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কই?”
রোহান আগ্রহ নিয়ে বলল, “তোমায় আমি ইদ্রিস চাচার কথা বলি না? আমি যেই টং দোকানে রোজ যাই? আজ চাচার মেয়ের ঘর আলো করে একটা পরি এসেছে নাকি! তাই সে খুব খুশি। সুখি-খুশি মানুষদের আশেপাশে থাকলে মনপ্রাণ স্বচ্ছ থাকে। সুখের ঘ্রান সবাই পায়, দুঃখের ঘ্রান পায় না। সুখের ঘ্রান নিতে যাবে? দোকানের পাশের জায়গাটা খুব সুন্দর। যাবে?”

আমি খুব অসম্ভব না হলে ওকে কখনই ‘না’ বলি না। আর এত সুন্দর করে কথাগুলো বলার পর না করি কি করে? বললাম, “যাব।”
রোহান খুব খুশি হলো। সুন্দর হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ জুছি।”

আমার বহু পুরানো একটা কালো শাড়ি ছিল। সচরাচর আমি শাড়ি পরি না। খুব অনাদরে পরে থাকা শাড়িটা সেদিন পরলাম।
রোহান রিকশা নিতে চাইলো। আমি বললাম, “হেঁটে যাই?”
“তোমার ইচ্ছে!”

প্রায় চল্লিশ মিনিট আমরা আহামরি কথা বলা ছাড়া হাঁটলাম। মাঝে একবার শুধু বলেছিল,
“জুছি? একটা কথা বলি?”
আমি বললাম,”হুহ।”
রোহান বলল,”থাক, কিছু না। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”
আমি বললাম, “মজা লাগছে।”
রোহান ওই প্রথম বলল, “পাগলী!”

আমি হাসলাম। আজীবন তাকে পাগল বানিয়ে এলাম আর সে কিনা আমায় পাগলি বলে! ফানি না?

রাস্তার পাশের অনেক চুড়িওয়ালি আন্টি বসেছিল। রোহান বলল, “একটু দাঁড়াও জুছি।”
আমি দাঁড়ালাম। ও আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে একটু পেছনে সেই চুড়িওয়ালি আন্টিদের কাছে গেল। দু’মুঠো রেশমি চুড়ি নিল। আমার কাছে এলো। হাতে দিয়ে বলল, “চট করে পরে নাও তো জুছি। হাতে হবে? দেখ তো!”

আমি পরলাম। পারফেক্ট হলো। রোহান বলল,
“জুছিরানী!”
আমি জুতো খুলে হাতে নিলাম। মিছেমিছে অভিমানী হয়ে বললাম, “ধ্যাত জুতাই পরবো না, সারাক্ষণ খালি জুছিরানী, জুছিরানী!”

রোহান কিটকিট করে হাসলো। আমি বললাম,
“বেয়াদপ ছেলে!”

ইদ্রিস চাচার টং দোকানটা সত্যি সুন্দর জায়গায়। পাশে খোলা মাঠ। নিজেকে সেখানে মুক্ত পাখি লাগে। ইদ্রিস চাচার টং দোকানে বসে, রোহানের ভাষ্যনুযায়ী ‘অমৃত চা’ খেলাম। সত্যি-ই অমৃত! ইদ্রিস চাচার সুখের ঘ্রান নিতে জানতে চাইলাম,”নতুন পাখির নাম কী চাচা?”
চাচা হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল,”রোহান বাজান রাখছে, পরী!”
আমি দূরে দাঁড়ান রোহানের দিকে তাকালাম। একটা ছেলে পাগল পাগল, কেমন যেন মায়া মায়া!
এত চমৎকার একটা দিন কাটলো সেদিন। ইদ্রিস চাচা, তার হাতের অমৃত চা, তাদের পরীর আগমন, দখিনা বাতাসময় শ্যামল মাঠ, আমি আর রোহান! কী যে সুন্দর মধুর স্মৃতি!

হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে সেদিন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। আমার তো চিন্তা, বেশি দেরি হয়ে গেলে হোস্টেললে ঢুকতে অসুবিধে হবে। কিন্তু রোহানটা মাঝে কি করলো কে জানে! আমায় রিকশায় বসিয়ে রেখে কই গেলো, আসলো খানিক বাদে। হাতে কি খেয়াল করিনি।

হোস্টেলের কাছে আসলে আমি নেমে গেলাম রিকশা থেকে। আগাতে লাগলে রোহান ডাকলো। আমি ফিরে তাকালে আমায় একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, “রুমে গিয়ে দেখ, এখন যাও।”
আমি রুমে এসে প্যাকেটটা বিছানায় রেখে দিয়ে ফ্রেশ হলাম, রাতের খাবার খেলাম, একটু পড়াশোনা করলাম। প্যাকেটের কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। শুতে গিয়ে দেখতে পেলাম। ভাবলাম, খুলে দেখি মহাশয় কি এমন সিক্রেট জিনিস দিলেন।
প্যাকেটটা খুলে আমি প্রচন্ড বিস্মিত হলাম। একটা চিরকুট এবং সাথে একটা কালো শাড়ি! কখন কিনলো? আমি দেখিনি কি করে? ইশশ, অন্ধ হলাম কবে এমিন!
চিরকুটে লেখা,
“একশ একটা কালো শাড়ি, মায়াময়ী তোমার হোক। কালো শাড়ি অঙ্গে জরিয়ে, অঙ্গ বরং অপ্সরী হোক! কাজল-কালো চোখ দু’খানায়, কেউ-বা পুড়ে অঙ্গার হোক! দারুন মায়ার এই মেয়েটা, ছন্নছাড়া এই ছেলেটার হোক!”

(চলবে)……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here