#রয়েছ_হৃদয়ে
#৬ষ্ঠ_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
আশ্বিন মাস তখন। এত চমৎকার প্রকৃতি, এত সুন্দর আবহাওয়া! আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর কিছু ছেলে-মেয়ে এবং রোহানের ডিপার্টমেন্ট এর কিছু ছেলে-মেয়ে ঠিক করলো তারা একটা ট্যুর দিবে। মোটামুটি সবাই রাজি হলেও আমি বেঁকে বসলাম। আমার সবসময়ই মনেহয়, সারা জগৎ ঘুরে বেড়ানোর চাইতে; ঘরের কোণে বসে গরম গরম এক কাপ চা খাওয়া অনেক মজার কিংবা আনন্দদায়ক!
আমি যাব না শুনে রোহান মুখ ফুলিয়ে বলল,
“এই ক্যান্সেল সব! যেতে হবে না কাওকে!”
সে কি অভিমান তার। আমি বললাম, “মেয়েদের মতো করো কেন রোহান? সবাই যাচ্ছে আমি একা না গেলে কী ক্ষতি হবে? আমার ভাল্লাগেনা এসব ট্যুর-ফ্যুর!”
রোহান ছোট্ট করে বলল, “আচ্ছা!”
রোহানের চোখেমুখে তখনও অভিমানের ছায়া স্পষ্ট। সে আমারে রাগ দেখাইতে পারে না, পারে খালি মেয়েদের মতো অভিমানে মুখ ফুলাতে! পাগল একটা!
আমি শেষে হার মেনে বললাম, “ওকে ফাইন, যাব…যাব। কেউ যেন ঢং না করে!”
রোহান কি সুন্দর হেসে দিল সঙ্গে সঙ্গে! বলল, “সত্যি জুছি?”
আমি বললাম, “হু!”
রোহান বাচ্চাদের মতো করে বলল, “তিন সত্যি বলো জুছি?”
আমি বললাম, “যাও! পারবো না।”
বলেই উঠে এলাম। রোহান তারস্বরে বলল, “থ্যাংকিউ আমার জুছিরানী!”
আমি বললাম, “পাগল, বোকা!”
এর এক সপ্তাহ পর আমাদের ট্যুরের ডেইট ফিক্সড হলো। সবাই খুব এক্সাইটেড। ইফাজ, মাহির, নিশাত, ফাহাদ, সাদিয়া, শম্পা সহ সবাই সারাক্ষণ জুরে রাজ্যের প্ল্যান করে। কত কি কেনাকাটা করলো। পাঁচদিনের ট্যুর। কিছু তো প্রিপারেশন আছেই না? তবে আমি কিছু কিনলাম না। হয়তো ট্যুরে আগ্রহ কম বলেই…হইহুল্লোরও কম ছিল আমার মাঝে। কিন্তু অমন একটা পাগল সাথে থাকলে স্থির কী করে থাকি?
রোহান বলল, “তুমি শাড়ি পরবে জুছি? পরী লাগে! কিনবে কিছু?”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “পারবো না। আমার ভালো লাগে না। পরী জিন যাই লাগুক, আই ডোন্ট কেয়ার।”
সে আমায় জোর করলো না ঠিক, কিন্তু ইচ্ছে মতো কিছু শাড়ি কিনলো। আমি বিরক্ত হয়ে তাকালে বলল, “আমার ইচ্ছে আমি কিনবো। একশটা কিনবো, হাজারটা কিনবো, কেউ যেন অমন করে না তাকায়। আই অলসো ডোন্ট কেয়ার!”
আমি আর বিরক্ত হতে কিংবা রাগ করে থাকতে পারলাম কই? ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম,
“মাথা খারাপ তোমার, যা মন চায় কর!”
সেই রাতে- মাঝরাতে তার মেসেজ এলো,
“সে হাসলে- আকাশ হাসে, বাতাস হাসে,
হাসে উদাস মন!
আমার মনের মনিকোঠায় হোক তার সুখাসন।”
আমার আর সেবার ট্যুরে যাওয়া হলো না। যেদিন যাব তার আগেরদিন আমার দেশের বাড়ি থেকে কল এলো, বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন; আমি যেন দ্রুত বাসায় যাই!
বাবা আমার অত্যাধিক পরিমানের প্রিয় ব্যক্তি। বাবার অসুস্থতার সংবাদ আমায় অপ্রতিভ করে তুলল মূহুর্তের মাঝে। সেদিন সন্ধ্যার ট্রেনেই বাড়ির পথে রোয়ানা হলাম। ট্রেনে আমার তিন ঘন্টার জার্নি। ট্রেন জার্নি আমি বরাবরই উপভোগ করি, কিন্তু সেদিন অসম্ভব। কেবলই মনে হচ্ছিল, কখন বাসায় যাব, বাবাকে দেখবো! ট্রেন ভর্তি মানুষের কোলাহল, জাগতিক চিন্তা-চেতনা কোনো কিছু বাবাকে নিয়ে করা দুশ্চিন্তাকে ভেদ করতে পারছিল না। এমনকি ট্যুরের কথাও বেমালুম ভুলে গেলাম! ঠোঁট উল্টে কান্না পাচ্ছিল বাবার চিন্তায়। বাসায় ফোন করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, ব্যাগে আমার ফোন নেই! দুই একবার খুঁজে যখন পেলাম না তখন আর খুঁজলাম না। কই ফেলে এসেছি কে জানে! বাসায় এখন ফোন করি কী করে?
পুরো পথ হা-হুতাশ করে, ক্লান্ত, জীর্ণশীর্ণ হয়ে রাত দশটায় বাসায় পৌঁছালাম। ভাইয়া আমায় দেখে উল্টো অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এই তারু? ফোন কই তোর? ফোন বন্ধ কেন? সবাই কত্ত চিন্তা করতেছে!”
আমি ভাইয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না, বলা বাহুল্য সেই প্রশ্ন আমার কর্নপাত হলো না। ক্লান্ত আমি বিবর্ণ হয়ে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
“মা কই ভাইয়া? বাবা? বাবা কেমন আছে? ভালো আছেন তো?”
ভাইয়া বললেন,
“চিন্তা করিস না, মেজর কিছু হয় নাই আল্লাহর রহমতে। আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছে এখন। বাবা ঘুমাইতেছে, মা রুমেই আছে। কাল সকালে কথা বলিস নাহয়। খাবি ক….”
ভাইয়ার কথা শেষ করার আগে আমি ভেতরে চলে এলাম। ভাইয়াটা অতিরিক্ত কথা বলে। তার কথার স্প্রিট এত যে, শুরু হলে আর থামে না! মুখে স্কচটেপ মেরে দিতে ইচ্ছে করে। বাবা ঘুমে থাকায় রাতে আর তাদের কারো সাথেই কথা হলো না।
বহুদিন বাদে নিজের রুমে এলাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করেছি। ফ্রেশ হয়ে চিন্তামুক্ত একটা ঘুম দিলাম। আশ্চর্য! প্রিয়দের প্রতি ভালোবাসা কি কেবল তাদের অসুস্থতার খবরেই প্রতিফলিত হয়? মনের অস্থিরতা, স্মৃতির প্রখরতা তখনই শুধু বাড়ে? নাকি আমিই এমন নির্দয়, মায়াহীন, নির্জিব!
এরপরের দুই-তিনদিন- দিনের সিংগভাগ বাবার সাথে কাটালাম। বাবার বাচ্চাদের মতন অভিমান, আদুরে আদুরে কথায় হঠাৎ করে রোহানের কথা মনে পড়ল আমার! বাবার সাথে ওর স্বভাবের অদ্ভুত মিল পেয়েছিলাম বলেই হয়তো!
আমি জানি না, ওকে কেন ওর মত সিরিয়াস হয়ে ভাবিনি কখনও! টান ছিল, মায়া ছিল কিন্তু সিরিয়াসনেস কখনোই ছিল না ওর প্রতি। এখন মনেহয়, কেমন যেন অনাদরে গড়া একটা মায়ার সম্পর্ক ছিল আমাদের!
তিনদিন পর চলে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবার আহ্লাদী কথার জেরে আর আসতে পারলাম না। তার এক কথা, “কতদিন পর এলি মা! আর দু’দিন থেকে যা না!”
ভাইয়া বলল, “থেকে যা তো তারু… এত ঢং করিস কেন? ঢং এর ডিব্বা…বুড়ি হয়ে গেলি তবু তোর ঢং কমলো না।”
ভাইয়ার সাথে আমার সাপেনেউলে সম্পর্ক। ‘ফট করে অতি অল্পে রেগে যাওয়ার’ বদ অভ্যাস থাকার ফলেই ভাইয়ার ফাইজলামি- আমি ফাইজলামি হিসেবে না নিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে ফেলি। কিন্তু এখন তো আর অত ছোট নাই। তাই রাগ সামলে বললাম,
“নাম ভেঙাবা না তো ভাইয়া। তারু-মারু আবার কি ডাক? তোমাকে কি আমি তাসু ভাইয়া ডাকি?”
ভাইয়া বাকা হেসে বলল, “তাসিন থেকে তাসু! নাইস তো! ডাকতে পারিস….নো সমস্যা। কিন্তু একটু লেডিস লেডিস হয়ে গেল না? এক কাজ করতে পারিস, তাসু না ডেকে, তাসিনের ‘তা’ বাদ দিয়ে ‘সিন’ ভাইয়া ডাকতে পারিস…ইউনিক হবে! কিউট করে ডাকবি, সিন ভাইয়া, সিন ভাইয়া!”
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল! এরপর আমার মাথায় একটা থাপ্পড় মেরে ফোন স্ক্রল করতে করতে কই যেন বেড়িয়ে গেল। আমি বুঝি না, সব ছেলেগুলোই কি এমন বদ হয়, বদের হাড্ডি? এক রোহান- এক ভাইয়া! সব গুলো যেন এক সুতায় গাঁথা। আবার রোহানের কথা মনে পড়লো। আশ্চর্যান্বিত হয়ে উপলব্ধি করলাম; বাবা, ভাইয়া, আশেপাশের সকল ছেলের মাঝে আমি রোহানের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছি! ভারি অদ্ভুত!
পাঁচদিন পর হোস্টেলে ফিরে এলাম। আসতে আসতে বিকেল হলো। নতুন ফোনে নতুন সিম নিলাম। আগেরটাও পুনরায় উঠালাম। রোহানের সাথে কিন্তু আমার এই চার-পাঁচদিন কথা হয়নি, কিংবা হওয়ার সুযোগ ছিল না। ওরা ট্যুর থেকে ফিরেছে কিনা তাও জানি না। গিয়েছিল তো?
রুমে ফিরে শম্পাকে দেখে চমকালাম। ভাবলাম, ওরা বুঝি ফিরে এলো। শম্পাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই কিরে? কবে ফিরলি? কেমন ঘুরলি? খুব মজা হয়েছে না? ইশশ মিস করলাম।”
শম্পাও আমায় দেখে চমকালো। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। আমি আরো কিছু কথা জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু সে কোনো রা’শব্দ করলো না। বুঝলাম, বোঝাতে চাচ্ছে সে খুব রেগে আছে। মনে মনে একটু মন খারাপ হলো এই আশংকায়, শেষে বুঝি আমার জন্য সব ক্যান্সেল হলো….আহারে!
রাতে ভাইয়া ফোন দিয়ে মহা ইম্পরট্যান্ট কথা বলার মতন করে বলল, “এই তারু? তোরে জিগাইতে ভুইলা গেছি, তোর বফ তোরে সয় কেমন? না মানে…বিলাইর মতন যে খ্যাঁতখ্যাঁত করস সারাদিন…বেচারা পাগল হয়ে যায় নাই?”
আমি হুংকার দিয়ে বললাম, “ভাইয়া…!”
ভাইয়া হেসে দিয়ে বলল, “মিস ইউ বিলাই! জলদি আসিস তো আবার। তোর খ্যাঁতখ্যাঁতানি প্রচুর মিস করতেছি।”
পরদিন ক্যাম্পাসে গেলাম আমি। সারাদিন ওর সাথে দেখা হলো না, হলো বিকেলে হোস্টেলে ফেরার পথে। অন্যদের সাথে কথা বলছিল। আমায় দেখতে পেয়ে দূর থেকে তাকালো! আমার খুব অস্বস্তি হলো ক্যান জানি! অন্যসময় কিন্তু ও আমায় দেখলেই ছুটে আসতো। সেদিন এলো না। আমার দিকে ঐ একবার তাকালো তারপর চোখ নামিয়ে নিল!
আমার খুব ইগোতে লাগলো। আজব! আমি কি ইচ্ছে করে যাই নি নাকি!
পরদিন গেলাম। প্রথম ক্লাস শেষে মাঠে এসে বসলাম। রোহানও এলো। আমি তাকালে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো?”
আমি বললাম, “ভালো।”
রোহান আর কিছু বলল না। চুপ করে রইলো। আমি বুঝি কেন চুপ সে। তাই নিজেই জিজ্ঞেস করলাম, “রাগ করেছো?”
রোহান বলল, “তোমার উপর আমি কখনো রাগি না জুছি! খুব চাই একটু রাগি; ট্রাস্ট মি, পারি না!”
আমি বললাম, “স্যরি।”
রোহান তাকালো। আমি দেখলাম একটা ছেলে, অভিযোগে পরিপূর্ণ মুখ, চোখ দু’খানা কিছু যেন বলতে চায়- বলতে গিয়েও পারে না।
আমি ডাকলাম, “শোনো রোহান?”
রোহান বলল, “শুনবো না। কিচ্ছু শুনবো না জুছি, তোমার কোনো কথাই আমি শুনবো না।” বলেই সে উঠে চলে গেল। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না।
আমি দেখলাম, কৃষ্ণবরণ দারুন রাগের ছেলেটাকে! আমার কেন হাসি পেল? ভারী অদ্ভুত!….
(চলবে)