#রয়েছ_হৃদয়ে
#৭ম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
ঐ যে বলেছিলাম না? ওর প্রতি আমার অনেক মায়া….যা আমি অনুভব করি! সেই মায়া থেকেই তার অভিমান আমি আটকে রাখতে দিলাম না। কখনো কারো রাগ, দুঃখ, অভিমানে প্রাধান্য না দেয়া এই আমি ছেলেটার সবকিছুই খুব করে প্রাধান্য দিতে আরম্ভ করলাম!
তাদের প্ল্যান ছিল শ্রীমঙ্গল, আমি তা পরিবর্তন করলাম। ঠিক করলাম, কুয়াকাটা ট্যুর দিব। একেবারে হুট করেই আমার ইচ্ছে হলো রোহানকে একটু চমকে দিতে! জাস্ট আগেরদিন রাতে বাকিদের বললাম। তারাও আমার উপর ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ ছিল, অতঃপর যেতে পারবে ভেবে তারাও প্রচন্ড উৎসুক হয়ে উঠলো। রোহানকে জানাতে চাইলো, আমি কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করে দিলাম।
হোস্টেলে ফেরার দুদিনের ভেতর, ২৭ জুন ভোর ৭টায় আমরা কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।
তাকে ভোর ছয়টায় কল দিয়ে বললাম, আধঘন্টায় কলেজ আসো। সে ঠিক সাড়ে ছয়টায় এসে উপস্থিত হলো। এই যে আমার উপ রেগে আছে, তবুও আমার কথা কিংবা আমার দেয়া সময় সে নড়চড় করল না। বোধকরি রাতে পরে ঘুমানো টিশার্ট এর উপরই একটা কুঁচকানো শার্ট পরে চলে এসেছে। ঘুম তার তখনও পুরোপুরি কাটেনি।
অমন ঘুম কাতুরে মুখ দেখলে কেউ বুঝবেও না তার ভেতর এত্ত জেদ! আমার উপর সে রেগে বোম হয়ে আছে! শুধু আমি জানি ছেলেটা ঠিক কেমন ছেলেমানুষ, কেমন তার রাগ-জেদ!
সকলকে একসাথে দেখেও ঘুমুঘুমু চোখে প্রথমেই কিছু বুঝলো না। চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, “এত্ত সকালে….কেন ডেকেছো জুছি?”
আমি মৃদু হেসে তার মত করে বললাম, “ইচ্ছে হয়েছে তাই। গাড়িতে উঠে বস ঝটপট। কোনো কথা নয় রোহান।”
রোহান বিনাবাক্যে মাইক্রোতে উঠে বসলো। বাসে উঠে সবাইকে খেয়াল করে দেখলোও না বোধহয়। একটা সিটে গিয়ে বসেই ঘুম! আমি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ভাবলাম, আমায় বলে, ঘুমুশ্রী আর নিজে? ইশশ!
পাক্কা দুই ঘন্টা সে ঘুমাল। আশেপাশের এত হুইহুল্লর তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারল না।
দুই ঘন্টা পর ঘুম ভেঙে সে পাশে আমায় দেখে হঠাৎ করে চমকে গেল…নিজের অবস্থান নির্নয় করে আরো খানিক বিস্মিত হলো….বাস ভর্তি চেনা মুখগুলো দেখে আরো একটু! আর ওর এই চমকানো মুখশ্রীর পুরোটাই কিন্তু আমি খুব করে ইনজয় করেছি। শুধু আমি একা নই, সবাই।
রোহান ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “আমরা সবাই কই যাই জুছি?”
আমি বললাম, “স্বপ্নপুরি!”
রোহান হঠাৎ খুব ছোট বাচ্চার মতন করে বলল, “ইশশ…আই উইশ…”
পাশ থেকে ইফাজ বলে, “দোস্ত মিশন কুয়াকাটা! উই আর সো এক্সাইটেড!”
রোহান অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে,
“ফান করিস কেন?”
ইফাজকে এই প্রশ্ন করার ফাঁকে আমার দিকে চাইলো আড়চোখে, যখন দেখল মৃদুমন্দ হাসছি তখন আমায় বলল, “এই? কী বলে জুছি?”
আমি বললাম, “কী বলে? জানি না তো!”
রোহান উঠে মাইক্রোর জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চারপাশ দেখে। ড্রাইভারকে ডেকে বলে, “এই মামা? কই যাচ্ছি আমরা?”
ড্রাইভার মামা বলে, “সদর ঘাট যাই মামা!”
এরপর…সে কি নিদারুণ উচ্ছ্বাস তার সমস্ত মুখে! কি দারুন বাচ্চামিপনা তার সারা কর্মকান্ডে!
ধপ করে বসে আবার আমার পাশে। আমি বুঝতে পারি তার সকল রাগ উধাও। আমার দিকে চায়, আমিও চাই। সে বলে, “এসব তোমার প্ল্যান, জুছি?”
আমি কিছু বলি না। রোহান বলে, “এই মূহুর্তে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে জুছি! কিন্তু বলবো না!”
আমি বললাম, “পাগল!”
রোহান বলল, “পাগলী!”
ওর সদা হাস্যজ্জ্বল মুখখানায় পুনরায় সেই হাসির আভাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরো পৃথীবি ভাসিয়ে দিল! কে বুঝবে এই সুন্দর হাসির টগবগে যুবগটার আগাগোড়া ছেলেমানুষিতে ভরপুর!
আমি খোলা জানালা দিয়ে মুখটা বের করলাম একটু সতেজতায় ডুবে যেতে! স্নিগ্ধ বাতাস এসে আমার খোলা চুল খানিক এলোমেলো করে দিল। ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে হাতে রাখা ব্যান্ড দিয়ে বাঁধতে গেলে রোহান বলে, “বাঁধ কেন? থাকুক না খোলা!”
বলেই সে আমার হাত থেকে ব্যান্ডটা কেড়ে নিয়ে নিজের হাতে রাখলো।
ঢাকা লঞ্চ টার্মিনাল এলাম আমরা নয়টা পঁচিশ মিনিটে।
সবগুলো মুক্তপাখির মতো উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো। রোহান তখনও বোধহয় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না, আদো এসব সত্যি ঘটছে তো? খানিক বাদে বাদে আমার দিকে চাইছে।
লঞ্চে উঠতে গিয়ে মাহিরা বলল, “দোস্ত আমার ভয় লাগছে। লঞ্চ ডুবে যাবে না তো?”
রোহান বলল, “ড্রামা কুইন। ঢং করবি না তো।”
সাদিয়া বলল, “দোস্ত আমি কিন্তু সাতার জানি না। ডুবে গেলে আমায় কেউ প্রটেক্ট করিস প্লিজ!”
আমাদের মোট জনসংখ্যা ছিল নয়জন, ডাবল কেবিন নিলাম তিনটা। দুটো আমাদের মেয়ে বাহিনীর জন্য আর একটা ছেলে বাহিনির জন্য। ইফাজ আর নিশাত বরিশালের হওয়ায় এসব নিয়ে খুব একটা ঝামেলা আমাদের পোহাতে হয় নাই, ওরাই সব সামলেছে। লঞ্চ যখন ছাড়ল তখন আমরা কেবিনের বাহিরে। নদিতে ভাসছি, ভেবেই অদ্ভুত শিহরন খেলে গেল মনে। বাকিরাও আমার মতোই উচ্ছ্বসিত ছিল। রোহান লঞ্চের গ্রীল ধরে রেখে শরীরের অর্ধেক বের করে বলে, “এই জুছি? টাইটানিক টাইটানিক ফিল হচ্ছে কেন বল তো?”
মাহিরা, সাদিয়া, শম্পা সমস্বরে বলে উঠল, “এই পাজি ভয় দেখাবি না।”
আমি বললাম, “এত ভয় পাস কেন ওর কথায়? বেশি ফাইজলামি করলে ধাক্কা মেরে নদিতে ফেলে দিবি, এক্কেবারে খাঁটি টাইটানিক ফিল পাবে তখন।”
সবাই বেশ মজার হাসি হাসলো। রোহান বলল, “এই হৃদয়হীনা…এদিক আসো, শোনো?”
আমি কোনোমতে বললাম, “পারবো না।”
সাংঘাতিক ঘুমে তখন আমার চোখ ঢুলুঢুলু। এর বেশি কথা বলা দায় হয়ে দাঁড়াল। একটু ঘুমের খুব প্রয়োজন অনুভব করলাম। রোহান তার পুরোনো ডায়লগ দিল, “ইশশ জুছি…এত্ত ঘুমাও! কেমন ট্যুর দিচ্ছো? যাত্রাতেই ঘুম!”
আমি ওর দিকে একবার তাকালাম, ওর এলোমেলো কুঁচকানো টি-শার্ট আর শার্টের দিকে চাইলাম। তারপর কেবিনে এসে রোহানের জন্য বরাদ্দকৃত ব্যাগটা নিলাম।
দুদিন ঘুরে ঘুরে তার জন্য চারটা শার্ট, দুটো টি-শার্ট, দুটো প্যান্ট কিনেছিলাম। যেহেতু তাকে টোটালি না জানিয়ে, উইদাউট এনি প্রিপারেশনে আনবো বলে ঠিক ছিলাম তাই আমি নিজেই কিছু টুকটাক কিনে নিয়েছিলাম তার জন্য!
ওকে ব্যাগটা দিয়ে বললাম, “কোনো ফাও কথা বলবা না…যাও।”
মানুষকে চমকে দিতে পারায় অনেক আনন্দ, না?
ওর হাতে ব্যাগটা দিয়ে, কেবিনে এসেই ঘুম….
কতখন ঘুমালাম জানি না। ভয়ানক কোনো বিপদ হলে মানুষ যেমন আর্তনাদ করে ঠিক তেমন করে আমায় ডাকতে লাগলো মাহিরা। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসতেই খুব ইনোসেন্ট হেসে বলল, “ইয়ে মানে কেমন আছিস দোস্ত?”
কথায় আছে না, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে!
মাহিরার দশাও ঠিক তেমন হয়েছে। রোহানের সাথে থাকতে থাকতে ওর পাগলা রোগ মাহিরাকেও ধরতে বসলো বুঝি!
আমি বিরক্ত হলাম না, কি লাভ? এরা তো বদলাবার নয়। বললাম, “কতখন লাগবে?”
নিশাত বলল, “দেরি আছে। ওঠ, ফ্রেশ হ, একটু বের হই চল।”
আমি স্কার্ফটা পেঁচিয়ে বেড়িয়ে গেলাম কেবিন থেকে। আমার সাথে সাথে বাকিরাও বেড়িয়ে পড়ল। লঞ্চের ছাদে এসে সত্যিকারের পাখি মনে হলো, এই এক্ষুনি উড়ে যাব বুঝি। ছেলেগুলোও সেখানেই ছিল। ফাহাদ মারাক্তক সুন্দর গান গাইতে পারে। আমরা সবাই যখন এক হলাম, স্নিগ্ধ মায়া-কাতর বাতাসের তাল তাল মেলাতেই ওর কন্ঠে ভেসে উঠলো….
ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া!
বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে,
কান্দে রইয়া রইয়া…..
এত সুন্দর দৃশ্য, এত সুন্দর সুরে সকলে মোহিত না হয়ে পারলো কই?
খুব সুন্দর মূহুর্ত গুলোতে আমার যেই কথাটা সবসময় মনে হয়, তাই মনে হলো……জীবন এত সহজ-সরল-সুন্দর কেন? এত সুখ, এত আনন্দ, এত মায়া!
রোহান আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরলো, খুব শক্ত করে! আমি তাকালে দেখলাম, ওর দৃষ্টি সামনে ফেরানো। পরনে আমার দেয়া শার্ট, টিশার্ট! ডান পাশের ভ্রুটার কিনারে একটা কাটা দাগ। এর আগে আমি দেখিনি! এত আদর লাগলো দেখতে!
আমি বললাম, “এই বাচ্চা ছেলে? তোমার অভিমান ভেঙেছে?”
রোহান আমার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলো। আমি বুঝি না, এই ছেলেটা কথায় কথায় এমন মেয়েদের মতো লজ্জা পায় কেন?
মাথার পেছন চুলকে, রোহান বলল, “ছেলে মানুষ কি অভিমান করে, জুছি?”
আমার খুব হাসি পেলো। হেসেও ফেললাম। বললাম, “তুমি এমন অনেক কিছুই করো রোহান, যা অনেক ছেলে মানুষ করে না।”
রোহান বলল, “করবো, আজীবন করবো, এমনই থাকবো! চলবে? চলবে, জুছি?”
আমি বললাম, “হু, খুব…খুব চলবে।”
ওরে আমি কেমনে বলি? তুমি এমন বলেই রোহান, তোমার জন্য এত মায়া! তুমি এমন না থাকলে, আমার চলবে না কিছুতেই!
আমাদের লঞ্চ বরিশাল এসে পৌঁছাল সন্ধ্যের দিকে। ক্লান্ত ছেলেমেয়ে গুলোর চোখেমুখে ক্লান্ত তো খানিক ছিলই…তবে বিতৃষ্ণা ছিল না। প্রকৃতির মোহে আকৃষ্ট ছিল সকলে।
আমাদের প্ল্যান ছিল, ইফাজ কিংবা নিশাত কারো বাসায় এবার যাব না, ডিরেক্ট কুয়াকাটা যাব। প্ল্যান মোতাবেক লঞ্চ থেকে নেমে টিকেট কেটে নিলাম। বাস ছাড়ার আগে আগে পাশের একটা হোটেলে আমরা হালকা পাতলা কিছু খাওয়া-দাওয়া করলাম।
বাস ছাড়ার আগে সবাই উঠে গেলেও রোহান হঠাৎ যেন হারিয়ে গেল! ফোন-টোন সব অফ! এখন ওকে ছেড়ে তো যেতে পারবো না, সম্ভবই না, বাসও তো থেমে থাকবে না। আমি রাগ নিয়ে বললাম, “তোমরা যেতে চাইলে চলে যাও, আমি যাব না। স্টুপিডটা সবসময় এমন করে!”
নেমে যাব, ঠিক তক্ষুনি ফাজিলটা এসে উপস্থিত। একগাল হেসে বলল, “আমি কি খুব বেশি স্টুপিড, জুছি?”
আমার রাগ তরতর করে আরো বেড়ে গেল। সিটে গিয়ে বসলাম চুপচাপ। রোহান বসলো আমার পাশে। সে অনুতপ্ত, বুঝেও বুঝলাম না, মোটেও গললাম না। বাস ছেড়ে দিল। জানালা খুলে দিতেই হু হু করে মশ্রিন বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল শরীর মন! রোহান একটু হেলে পরে দরদ দিয়ে বলল, “এই মেয়ে? রাগ করেছো? এদিক তাকাও…প্লিজ!”…….
(চলবে)