রয়েছ_হৃদয়ে #৯ম_পার্ট,১০ম

0
744

#রয়েছ_হৃদয়ে
#৯ম_পার্ট,১০ম
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
৯ম_পার্ট

সূর্যদয় এর পরও আমরা আরো বেশ কিছুক্ষণ সেখানে রইলাম। হু হু করা বাতাস, শান্ত স্রোতে নিবির এক সম্পর্ক গড়ে উঠলো সকলের।
আলো যখন পুরোপুরি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জগৎ-সংসার আলোকিত করে বসলো; তখন সবার ঘোর একটু একটু কাটলো।
আলো ফুটতে-না ফুটতেই জেলেরা চলে এলো মাছ ধরতে! সে আরেক অভিনব দৃশ্য!
নিশাত বলল, “আহারে! কোন মাছগুলোর জীবন না জানি আজ দফারফা হতে চলেছে!”
ইফাজ বলল, “মাগো মা…কত্ত পিরিত! গিলার বেলায় তো ঠিকই গিলিস….তখন প্রেম কই যায়!”
নিশাত সাদিয়ার মতো সব কথা কানে নেয়ার পাত্রি না। অতএব সে তার স্বভাবসুলভ মুখ ভেঙচে ইফাজের কাছ থেকে সরে গেল।
বেচারা ইফাজ! শয়তানির গুড়ে বালি…হা হা হা!

মৃদুমন্দ হেসে আমি ওদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পুনরায় অপরূপা সৌন্দর্যের প্রকৃতিতে মননিবেশ করলাম।
সৈকতের চারপাশে বিশাল বিশাল নারিকেল গাছের সারি; কি যে সুন্দর লাগে দেখতে!
গঙ্গামতির জঙ্গল থেকে কত রকম পাখির ডাক ভেসে আসছিল! কত কত ডাক এর আগে কখনও শুনিওনি! বন-মোরগ গুলোও আলোর দেখা পেয়ে সমুদ্র বিলাসেই বেরিয়ে আসছিল যেন! অন্যদিকে এর মাঝেই রোহান দুই তিনটা বানরের সাথেও বন্ধুত্ব করে ফেললো! ভাবা যায়? ভাবা না গেলেও ভাবতে হবে কারন- পাগলদের কার্যকলাপ এমন হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
সকলের উল্লাস- পুরো সমুদ্র মাতিয়ে ফেললো!
আমাদের মুগ্ধতার শুরুটার মোহ এতটাই বেশি ছিল যে, ১৮ কিলোমিটার এড়িয়া জুড়ে এতো বিশাল সুন্দর সৈকত তক্ষুনি পুরোপুরি ঘুরে দেখার স্বাদ জেগে উঠলো মনে। কিন্তু তাতো সম্ভব না। একটু আশাহত তো হয়েছিলামই!

রিসোর্টে যাওয়ার আগে ইফাজ আর রবিন জেলেদের কাছ থেকে টাটকা মাছ কিনে নিল। তাজা মাছের স্বাদই নাকি আলাদা! আর কুয়াকাটা এসে সকাল-দুপুর-রাত মাছ ভাত না খেলে নাকি জনম-ই বৃথা! কত্ত চিন্তা-ভাবনা খানাদানা নিয়ে; হা হা!

আমরা রিসোর্ট গিয়ে খাবার-দাবার শেষে রেডি হয়ে আবার বেড়িয়ে পড়লাম।
গাইড হিসেবে শাহিন তো ছিলই সাথে। তার সাজেশনেই সিরিয়ালে ঘুরেছি আমরা।

গঙ্গামতি তো সকালেই ঘুরে ফেলেছি, তাই এরপর আমরা গেলাম লাল কাঁকড়ার দ্বীপ। শাহিনের কাছেই জানতে পারলাম, মূলত ওটা তারুয়া দ্বীপ। এখন লাল কাঁকড়ার চর কিংবা লাল কাঁকড়ার দ্বীপ হিসেবেই বেশি পরিচিত।
সাত কিলোমিটার সৈকত জুড়ে চিকচিক করা বালুর বুকে লাল কাঁকড়ার মেলা যেন! নিজের চোখে না দেখলে ওই মুগ্ধতা উপভোগ করা অনেকটাই অসম্ভব।
ঐ সৌন্দর্যের মাঝেও ছিল হালকা ভয়ভীতি। ছেলেগুলোর তো কোনো ভয় নাই, কিন্তু মেয়েগুলো প্রথমে একটু ভয় পেল। একটু বলতে- দূর থেকে দৃশ্য দেখে তারা সেখানে যেতেই নারাজ! তার উপর মাহিরার পায়ে যখন একটা ছোট্ট-মিষ্টি-দুষ্টু কাঁকড়া উঠে গেল তখন তো তার সে-কি গগনবিদারী চিৎকার! রোহান কাঁকড়াটা ছুটিয়ে দিতে দিতে বলল, “আস্তে চিল্লা গরু! তোর তো কিচ্ছু হবে না কিন্তু তোর এই গরু মার্কা চিল্লানিতে নিশ্চিত বেচারা নিরীহ কাঁকড়া গুলো হার্টফেইল করবে।”
ছেলেগুলো রোহানের কথায় মজা পেয়ে পুরো দ্বীপ কাঁপিয়ে হেসে উঠল। আমি নিরপেক্ষ দলের। খুব বেশি ভীতুও না আবার আহামরি সাহসিও না। প্রথমে হালকা শঙ্কিত হলেও পরে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। বেচারা নিরিহ সুন্দর কাঁকড়াগুলো কি আর এমন করবে?

ইফাজ বাঁদরটা করল আরেক কান্ড! আস্ত একটা কাঁকড়া নিয়ে সাদিয়ার হাতে ছেড়ে দিল। সাদিয়া লাফিয়ে উঠে প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিল। শেষে ইফাজকে কিল-ঘুষি মেরে শান্ত হলো। ইফাজ হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, “সাদিয়া-চাদিয়া কাঁকড়া খায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া!”
সাদিয়া ঠোঁট উল্টে বলল, “বেয়াদপ-অসভ্য-খারাপ ছেলে! তুই আমার সাথে আর কথা বলবি না!”
ওদের খুনশুটি আমাদের ট্যুরের মজা অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আর রোহান? সে তখন আমায় চিনেই না! তার সকল সখ্যতা তখন প্রকৃতির সাথে!

লাল কাঁকড়ার চর থেকে আমরা বৌদ্ধ-মন্দির হয়ে লেবুর চর গেলাম। এখানে এসেছি যখন তখন দুপুর গড়াতে আরম্ভ হয়েছিল। রোহান বলল, “জুছি? পেটের ভেতর কে যেন ঘুটঘুট করছে! মনেহয় কিছু খেতে চাচ্ছে।”
পাশ থেকে রাহাত বলল, “আমার পেটও বোধহয় তোর পেটের সাথে সন্ধি করেছে। দ্বারা ব্যবস্তা করছি।”
বলে শাহিনকে সাথে নিয়ে কই যেন গেল, খাদক দুইটা।
কিছুক্ষণ পর চারটা বড়ো বড়ো ইলিশ মাছ নিয়ে এলো। একটা হোটেলে মাছগুলো দিয়ে ভেজে দিতে বলল।
শাহিন খুব জোড় দিয়ে বলল, “এই তাজা ইলিশ মাছ দিয়া এই বিচে বইয়া গরম গরম ভাত খাইলে- এক জনম ভুলতে পারবেন না; এইয়া মুই গ্যারান্টি দিয়া কইয়া দিলাম।”

আসলেই কথাটা সে খুব একটা ভুল বলে নাই। এত তৃপ্তি করে খেলো সবাই! সারাটা দিন আমাদের স্বপ্নের মতো রঙিন ভাবে কেটে গেল।
সেদিন আর সূর্যাস্ত দেখা গেল না। হাতে আরো একদিন ছিল, তাই অতোটা আফসোস হয়নি। রাতে আমরা গেলাম রাখাইন পল্লী বার্মিজ মার্কেট। রাখাইনদের তৈরি কত রকমের পোশাক, সাজগোজের ইউনিক জিনিসপত্র, শো-পিস, সেই সাথে মানুষগুলো!
সারাদিন ঘুরেটুরে আমি বোধহয় খানিক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই মার্কেট আর বেশি ঘুরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। ওরা সবাই আগ্রহ নিয়ে এটা সেটা দেখছে, কিনছে। রোহান একটু দূরে ছিল, মাঝে একবার আমায় ডেকে কি যেন জিজ্ঞেস করেছিল! আমি কথা বলতেও খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করছিলাম না তখন। মার্কেট থেকে বেরিয়ে একটু বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির বিশালতায় খানিক ডুবে গেলাম।

এক্সাক্ট কতক্ষণ সময় পর আমার সঠিক খেয়াল নেই- ফাহাদ এসে দাঁড়াল আমার পাশে। ছেলেটা স্মার্ট, ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াস, গানও গায় দারুন। বিশেষ করে ওর গানের গলা আমার অসম্ভব ভালো লাগে। আমাদের সেইম ডিপার্টমেন্ট। আমাদের ডিপার্টমেন্ট সেইম হলেও আমার সাথে খুব বেশি যে কথাবার্তা হয়, তা কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যে হাই-হ্যালো এই যা! ইভেন আমার চাইতে বেশি ওর রোহানের সাথে সখ্যতা। অবশ্য আমার ধারনা, এই জগৎ-সংসারের সকলের সাথেই রোহানের সখ্যতা রয়েছে। পাগল মানুষগুলো ভাব জমাতে পারে ভালো।

আমি ফাহাদের দিকে চেয়ে সৌজন্যমূলক হাসলাম। বিপরীতে ফাহাদও হাসলো। জিজ্ঞেস করলো, “একা দাঁড়িয়ে আছো যে?”
আমি উত্তম দিলাম, “এমনি, ইচ্ছে হলো।”
ফাহাদ একটু টেনে বলল, “ওঁ…!”
আমি বললাম, “অসুবিধা নেই, তুমি যাও, দেখ ঘুরে, আমি এখানেই আছি।”
ফাহাদ মৃদু হেসে বলল, “না থাকি। তুমি একা…..একটু থাকি!”
আমি একটু বিব্রত বোধ করলাম। আর আমার বিব্রতবোধ আরো বাড়ানোর জন্যই ও একটা উইয়ার্ড কাজ করে বসলো। ফট করে আমার ডান হাতটা ধরে বসলো! বলল, “কিছু হয়ে থাকলে বলতে পারো। আমি তো তোমার বন্ধুর মতোই, না? এনি প্রবলেম তারিন?”
আমি কিছুতেই ওর কাজটাকে নরমালি নিতে পারলাম না। যেহেতু ওর সাথে আমার তেমন কোনো সখ্যতা নাই, সেহেতু এটাকে আমার ব্যাড ম্যানার মনে হলো। তবুও যথাসাধ্য স্বাভাবিক থেকে বললাম, “কিছু হয়নি বলেছি তো। হাতটা ছেড়ে দাও।”
ও আমার কথাটাও নরমালি নিল না। ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “কেন? তোমায় টাচ্ করার রাইট নাই আমার?”
আমি কিছুতেই ওর কাজটাকে নরমালি নিতে পারলাম না। যেহেতু ওর সাথে আমার তেমন কোনো সখ্যতা নাই, সেহেতু এটাকে আমার ব্যাড ম্যানার মনে হলো। তবুও যথাসাধ্য স্বাভাবিক থেকে বললাম, “কিছু হয়নি বলেছি তো। হাতটা ছেড়ে দাও।”
ও আমার কথাটাও নরমালি নিল না। ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “কেন? তোমায় টাচ্ করার রাইট নাই আমার?”

আমি খুব অ্যামব্যারেজড ফিল করলাম। কেন ওর এই অদ্ভুত কাজ আর কথা- আমি জানি না! একটু কঠিন করেই বললাম, “শুধু তুমি কেন? আমার পারমিশন ব্যাতিত, কারোরই এই রাইট নাই।”
আমি বুঝতে পারছিলাম, ফাহাদ প্রচন্ড রেগে যাচ্ছিল। বলল, “কারোরই রাইট নাই তো, রোহান কী করে টাচ্ করে? কই…ও তোমার হাত ধরলে তো কিছু বল না! ওর সব রাইট আছে? কী হয় ও তোমার? এত দরদ কেন ওর জন্য?”
ছেলেটার বলা প্রতিটা কথা কি পরিমান যে খারাপ লেগেছে, বোঝাতে পারবো না। আমি সবার সাথে রাগ দেখাই না কিংবা সহজে ধৈর্যহারা হইনা বলেই হয়তো তখনও নরমাল বিহেইভ করছিলাম। বললাম,
“রোহান আমার ফ্রেন্ড, তুমি নও। তুমি বাড়াবাড়ি করছো ফাহাদ। আমার ব্যাড ফিল হচ্ছে। হাত ছেড়ে কথা বল, প্লিজ।”

ফাহাদ খুব শাউট করলো। কিড়মিড় করে বলল, “ও আচ্ছা! ও ফ্রেন্ড তাই সাত খুন মাফ! আর আমরা ছুঁলেই ব্যাড ফিল হয়! ওয়াও! হোয়াট আ নাইস লজিক!”
বলেই বিদঘুটে ভঙ্গিতে হাসলো।
কি জঘন্য ওর কথার ধরন! এই জঘন্য কথাগুলো বলেও থামলো না। আমার হাতটা এত জোরে ছুড়ে ফেললো যে সেটা পাশের কিছু একটার সাথে বাড়ি খেল। ব্যথায় আমার চোখে পানি এসে গেল প্রায়! আমি ঝামেলা, ঝগড়াঝাঁটি একেবারেই পছন্দ করি না। তাই নিরবেই ওর বাড়াবাড়ি ধরনের অভদ্রতা মেনে নিলাম।
কিন্তু আমি মেনে নিয়ে সব ঝামেলা চুকে গেলে তো হতো-ই! ব্যাথা যা পেলাম তার চাইতে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম। ভয়টা ছিল রোহানকে নিয়ে। আমি তো জানি ও কেমন পাগল! মার্কেটের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর প্রার্থনা করছিলাম, “রোহান যেন না আসে, আল্লাহ্‌!”

কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য, প্রার্থনা কবুল হলো না! ঐ যে ফাহাদ চেঁচাচ্ছিল, সম্ভবত তখনই ওরা শুনতে পেয়েছিল। সবাই- সাথে রোহান এসে উপস্থিত হলো দুই মিনিটের মাথায়। ফাহাদ তখনও ওখানেই ছিল। ওর ভেতর কোনো অনুতাপ নাই। আমি মারাক্তক বিচলিত হলাম, ভয় পেলাম। তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করলাম সব সামলে নিতে। অনিচ্ছাকৃত হাসি মুখ করে সকলের উদ্দেশ্যে বললাম, “তোদের কেনাকাটা শেষ? চল তবে ফেরত যাই। আজ আর ঘুরতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”
কেউ কোনো রা’শব্দ করলো না। রোহান কেমন যেন শীতল চোখে একবার আমার দিকে, একবার ফাহাদের দিকে চাইলো! ওর ঐ অসম্ভব ঠান্ডা চোখ জোড়া দিয়ে যেন সব বুঝে যাচ্ছিল! আসন্ন বিপদে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। এর মাঝেই মাহিরা বলে উঠলো, “আল্লাহ্‌! তোর হাতে রক্ত কিসের!”…..

(চলবে)

#রয়েছ_হৃদয়ে
#১০ম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
মাহিরা ‘রক্ত’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সকলে আমার দিকে চাইল! সবার অমন চাহনি দেখে আকাশস্পর্শী বিস্ময় নিজেও নিজের হাতের দিকে চাইলাম। হায় আল্লাহ্‌! হাত কাটলো কিভাবে? ওড়না দিয়ে হাত চেপে ধরলাম।
কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখান সন্ধ্যা হয়! আমার দশাও ঠিক তেমন ছিল। চারদিক থেকে বিপদ সংকেত ভেসে আসছিল।
মাহিরা এসে হাত ধরলো। আমি শঙ্কা এড়ানো হাসি দিয়ে বললাম, “আরেহ তেমন কিছু না। ওই…কিছুর সাথে লেগে কেটে গেছে বোধহয়। অল্প একটুই তো….অসুবিধা নাই। এ আর এমন কি। ফিরে চল প্লিজ।”
বলতে বলতেই আমি ভয়ে ভয়ে রোহানের দিকে চাইলাম। আশ্চর্যের বিষয় ও ঠিক আগের মতোই নিশ্চুপ ছিল। মুখের নির্মল সরলতাটা নেই! আমার কাছেও আসছে না।
ওর অমন কঠিন মুখ আমি ভয় করি। আমার ওর সেদিনের সেই সিনক্রিয়েট এর কথা মনে পড়ে গেল! ভয়ে চুপসে থাকা আমার মনটা আরো খানিক চুপসে গেল।
রোহান তার স্বস্থান থেকে দু’কদম এগিয়ে গিয়ে ফাহাদের মুখমুখি দাঁড়াল। ফাহাদ তেজ নিয়ে বলল, “কী? কী দেখিস?”
রোহান অসম্ভব ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কী করছিস তুই?”
ফাহাদও দাপুটে কন্ঠে জবাব দিল, “কিছু করি নাই।”

আমি আর চুপচাপ কিছু দেখতে পারলাম না। রোহানের কাছে গিয়ে বললাম, “প্লিজ, চলো যাই। ও কিছু করে নাই, সত্যি।”
রোহান আমার দিকে চাইলও না! যেন আমি কি বলেছি, শুনতেই পেল না! সে ফাহাদকে আবার জিজ্ঞেস করলো, “কী করছিস, বল?”
ফাহাদ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “না বললে কি করবি তুই?”
রোহান ফুঁসে উঠে ফাহাদের কলার চেপে ধরলো। সবাই চমকে উঠলো। আমি খুব শক্ত ভাবে বললাম, “কোনো সিনক্রিয়েট করবা না রোহান। তুমি আমায় প্রমিস করেছিলে। প্লিজ শোনো আমার কথা?”
রোহান ভ্রু’কুঁচকে একবার আমার দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
ফাহাদ বলল, “গুন্ডামি দেখাস? হিরো সাজতে আসছিস? এসব করে সবার কাছে হিরো সাজতে পারিস, বাট আই ডোন্ট কেয়ার। কলার ছাড় রোহান!”
ছেলেটা কেমন ভয়ানক হয়ে উঠলো। ফাহাদের কলার আরো শক্ত করর ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ছেড়ে দিব? জুছিকে ইঞ্জার্ড করার পরও?”
বলতে বলতেই ফাহাদের কলার টেনে মাটিতে শুইয়ে পরপর দুই-তিনটা ঘুষি দিয়ে ফেললো মুখে-পেটে!
ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটলো যে, কেউ ধরে সারতে পারলো না। ও যখন আরো ডেসপ্যারেট হয়ে উঠতে যাচ্ছিল তখন সবাই আটকালো বহু কষ্টে! কেমন দানবীয় হয়ে উঠলো ছেলেটা! সবাই যখন আটকাচ্ছিল তখন খুব উগ্রভাবে বলল, “ওর সাহস কি করে হয় জুছিরে টাচ করার! ওরে জাস্ট মেরে ফেলবো আমি! কে আমার বন্ধু-না অন্য কিছু তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, কিচ্ছু না!”

ফাহাদ ওর মতো উগ্র না। তাই হয়তো উল্টো অ্যাটাক করেনি! ইভেন মুখেও কিছু বলেনি!

অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেল। রোহানকে আর ফাহাদকে উঠিয়ে আলাদা আলাদা বসানো হলো। হলদেটে আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম ফাহাদের ঠোঁট কেটে গিয়েছে, ভ্রুর পাশটা ফুলে গিয়েছে। সাদিয়া ইমোশনাল, এমন হঠাৎ ঘটনায় হকচকিয়ে কেঁদে ফেললো।
আমার মনে হলো রোহানের জেদ তখনও কমেনি! কেমন ডাকাতে একটা ছেলে, ডানপিটে, বেয়াদপ, অভদ্র!
পরিস্থিতি অল্প স্বাভাবিক হলে তেজীয়ান ছেলেটা মাহিরাকে বলল, “জুছির হাতটা একটু দেখ তো প্লিজ!”
মাহিরা বাধ্য বালিকার মতো কাছে এসে হাত দেখল। ওর ব্যাগের মধ্যে সবসময়ই ফার্স্টএইড বক্স থাকে। এ নিয়ে কত হাসাহাসি করেছি! কিন্তু এখন…! মাহিরা ব্যাগ থেকে গজ-তুলা হাবিজাবি বের করে কি কি যেন করলো।
ও যখন এসব করছিল সেদিকে কিন্তু আমার মন নেই! আমার ভেতর তখন বহু ভাবনা-অন্য ভাবনা!
নিভুনিভু রাগ আমার আকাশের চূড়ায় উঠে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে! ইচ্ছে হলো নিজের হাতটা নিজেই কেটে ফেলি! মাহিরার থেকে হাত ছাড়িয়ে রোহানের আড়ালে চলে গেলাম।
কে বলেছে আমার প্রতি ওর এতো দরদ দেখাতে? আমার আরো মনে হলো, ফাহাদের কথাই তো ঠিক! গুন্ডামি করে এ কেমন হিরো সাজা! এ কেমন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ!

সবাই যখন ওদের সামলাচ্ছিল তখন আমি একা একাই রিসোর্টে ফিরে এলাম। অতো মানুষের সামনে তো রাগ, দুঃখ, অভিমান প্রকাশ করা যায় না। এসব প্রকাশ করতে হয়, নির্জনে, খুব একা-সন্তর্পণে!

ফাহাদের জন্য প্রচন্ড মায়া লাগছিল। নিজেকেও দোষী মনে হলো। ও তো খুব বেশি খারাপ কিছুও করেনি। আর সব না শুনে- না বুঝে রোহান এত বাড়াবাড়ি কেন করলো! মার খেয়েও ছেলেটা চুপ ছিল! এতে অবশ্য খানিক অবাক হয়েছিলাম। ও নিজেও খুব দাপুটে। একদমই চুপচাপ সয়ে যাওয়ার মতো ছেলে নয়! তাহলে কেন? তবে নিরবে সয়ে গিয়েছে বলেই মায়া লেগেছিল বেশি।

আমি রুমে দরজা আটকে বসে রইলাম। ওরা এসে বেশ কয়েকবার আমায় ডাকলো। আমি সারাশব্দও করলাম না। অভিমানি মন তখন আহ্লাদী হয়ে উঠলো। কেন ছেলেটা এমন করলো? এতো করে নিষেধ করার পরও শুনলো না আমার কথা? সবার এতো আনন্দ, ট্যুরের মজাটা কেন নষ্ট করলো এমন করে?

ওরা অনেক ডাকছিল যখন, তখন খুব রাগ হয়ে বললাম, “আর একবার ডাকলে ভয়াবহ কিছু করে ফেলবো। আমি কোনো দরজা-ফরজা খুলবো না, কারো কথা শুনবো না।”

ওদের কে কি বলল জানি না। ওরা আর ডাকলো না। আমি ওই দরজার সাথেই হেলান দিয়ে বসে রইলাম। রাতে খেলামও না।
অমন করেই বসে থেকে ঘুমিয়ে গেলাম।

ঠিক মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। মাথা ব্যথা করছে, ঘার ব্যথা করছে। মন এবং শরীর দুটোই অসুস্থ, সুস্থতার প্রয়োজন অনুভব করলাম। অর্থাৎ বিষন্নতা কাটাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু রুমে বসে থেকে তো বিষন্নতা কাটবে না। রিসোর্টের পূর্ব দিকটা খুব সুন্দর। মাঝরাতে ওখানে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে- ভাবনা থেকেই সেখানে যাওয়া আমার। কে জানতো আস্ত একটা পাগল তখন সেখানেই বসে!
আমি ওই মৃদুমন্দ আলোতে পেছন দিক থেকেই বুঝে গিয়েছিলাম। যখনই বুঝলাম ও সেখানে, আমি ফিরে আসতে চাইলাম। কিন্তু ওই ছেলেটা যবে থেকে জীবনে এলো আমি আমার সব ইচ্ছে খাটাতে পারি না; সেদিনও পারলাম না।
কিভাবে টের পেল জানি না। ছুটে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ক্লান্ত-বিষন্ন চোখমুখ। বন্ধুকে মেরে একটু অনুতপ্ত কি হয়েছিল সে? কে জানি! আমি বললাম,
“ফালতু ঢং করলে, ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারবো এখন। সরো সামনে থেকে।”
রোহান বলল, “সরবো না, মারো।”
আমার মনে তো রাগ। খুব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম, “তুমি তো টেরোরিস্ট। তোমারে মারার সাহসও তো আমার নাই! তোমার কত্ত পাওয়ার তা তো সবাই আরো একবার দেখলাম! খুব ভয় পেয়েছি মহারাজা! এই যে দেখুন ভয়ে কাঁপছি! হাত জোর করে বলছি, প্লিজ পথ ছেড়ে দিন!”
রোহান হেসে দিল! আশ্চর্য! কেমন বেয়াদপ! রাগের সময় এমন করে হেসে দিলে কেমন লাগে বলেন? কটমট করে তাকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না?

আমি জানি ওর সাথে কথা বলে পারবো না। নাম্বার ওয়ান বদমাইশ, পারবো কী করে?
তাই ওর থেকে সরে গিয়ে সুইমিং-পুলের পাশে বসে পড়লাম। বেয়াদপটাও আমার পাশে এসে বসল। আমি মোটেও ওর দিকে তাকালাম-টাকালাম না। বসে থেকে রাগ পুষলাম।
বেশ খানিক বাদে ছেলেটা কি যে সুন্দর করে ডাকলো,
“এই মেয়ে? একটুখানি তাকাবে এইদিকে? এই দেখো? স্যরি তো। খুব স্যরি! দেখো? ও…..জুছিরানী?”
উঁহু, আমি তাকালাম না। রাগের মাথায় অদ্ভুত কথা বললাম, “দেখ? বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমি এই সুইমিংপুলে ঝাপ দিব!”
রোহান এবার আওয়াজ করে হেসে ফেলল। পুলে পা ভিজিয়ে বলল, “ওকে, তাহলে আমিও ঝাপ দিব। এই যে দেখ, আগে আগে পা ভিজিয়ে রাখলাম!”

আমি বিরক্ত হয়ে তাকালাম ছেলেটার দিকে। আচ্ছা ওর এমন নির্মল-সতেজ-সুন্দর-প্রাণবন্ত মুখটা দেখলে কে বুঝবে এইটা এমন ডাকাত? ঘারত্যাড়া, একটু থেকে একটু হলেই যাকে তাকে মারে? কে বুঝবে বলেন; আমার জন্য ও এতোটা ডেস্পারেট? এখন কই তার সেই রাগ-জেদ-তেজ?
আগেও বহুবার বলেছি ওর সাথে আমি রাগ ধরে রাখতে পারি না। আর কথা বলার পর তো মোটেও না।
ওকে হাইপার হয়ে কিছু বলেও লাভ নাই, কারো কথা সে আমলে নেয় না। আমার কথা তো একদমই না! তাকে ছোট অবুঝদের মতো বোঝাতে হয়!
আমি বললাম, “ফাহাদ তোমার বন্ধু হয় না? তুমি জান, তুমি অকারনে ওকে মেরেছো?”
“অকারণে মারিনি। ও তোমায় ব্যাথা দিয়েছে।”
“ইচ্ছে করে দেয়নি।”
“আমি তা জানতে চাই না।”
“এমন বাচ্চাদের মতো কেন কর?”

“বেশ করি!”
“পাগল তুমি!”
“তোমার কাছে আরো একশবার হতে রাজি।”
“শোনো?”
“হু!”
“হু বল কেন আবার? আমার বারন তো শোনো না, আমার ডাকও আর শুনতে হবে না।”
“সব শুনবো। সব সইবো। শুধু তোমায় কেউ কষ্ট দিলে, আমি কখনো সইবো না, কসম!”

“কেন? আমার জন্য এতো কিসের দরদ?”

আর কোনো জবাব দিল না ও। শুধু কেমন করে যেন চাইলো। চোখের ভাষা পড়তে জানিনা বলেই সেই ভাষা আর পড়া হলো না। আমার কথা না শোনায় বরং ওর উপর পুনরায় রাগের জন্ম হলো।
দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, “তুমি খুব খারাপ! আমার সাথে আর কথা বলবে না। তুমি বললেও আমি আর বলবো না, কক্ষনো না!”
বলে আর দাঁড়ালাম না। আসতে আসতে শুনলাম, তার কন্ঠে যাদুর টান!
“ও আকাশ, ও চাঁদ, ও রাত আধার-কালো? তারে তোমরা বলে দিও, তাহার দারুন নিষ্ঠুরতায়, আমার করুন মৃত্যু হলো!”……(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here