#রয়েছ_হৃদয়ে
#১১তম_পার্ট,১২
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
১১তম_পার্ট
পরদিনই ছিল আমাদের ট্যুরের শেষদিন। ঠিক ছিল ওদিন ঘুরে পরদিন ভোরে ফেরার পথে পা বাড়াবো।
কিন্তু রোহান যা করলো তারপর সবার মনের আনন্দে একটু ভাটা পড়লো। আমার নিজের-ই তো ঘুরাঘুরির ইন্তেকাল ঘটিয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু আমি তো জানতাম-ই না, সকালে আমার জন্য কতখানি চমক অপেক্ষা করছিল!
সকালে রুম থেকে বেড়িয়েই সকলের সাথে দেখা হলো। কাল রাতে অতো বড়ো একটা ইন্সিডেন্ট হলো সেই মলিনতার ছাপ কারো চোখেমুখে নাই! বরং তারা হই-হই রব তুলে হাসিঠাট্টা করছে! আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে গেলাম, আদতে কিছু সত্যি-ই কি হয়েছিল কাল? আশ্চর্য! সবাই এতো স্বাভাবিক কি করে?
আরেকটু চোখ বুলিয়ে লক্ষ্য করলাম, রোহান আর ফাহাদ নাই! আমি চোখ ভড়া বিস্ময় নিয়ে ওদের খুঁজে বেড়ালাম এবং ব্যর্থ হলাম। আমায় দেখতে পেয়ে মেয়েগুলো এগিয়ে এলো। মাহিরা হাত ধরে বলল, “হাতে ব্যথা করেছে পরে?”
আমি বললাম, “না।”
ওরা আর কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগে আমিই জিজ্ঞেস করলাম, “রোহান আর ফাহাদ কই?”
সাদিয়া এক গাল হেসে বলল, “ওরা? ওরা তো ওইদিকে। রোহান টেনেটুনে নিয়ে গেল।”
আমি একপ্রকার আর্তনাদ করে বললাম, “টেনেটুনে নিয়ে গেল মানে? যেতে দিলি তোরা? অদ্ভুত তো…!”
বলতে বলতেই আমি সাদিয়ার দেখানো স্থানের দিকে পা বাড়ালাম। আমার মনের ভয় তো দূর হয় নাই। নিশ্চিন্ত হই কি করে? উদগ্রীব হয়ে ওদের কাছে গেলাম।
কিন্তু রিসোর্টের পেছন দিকে এসে যেই দৃশ্যটা দেখলাম, ট্রাস্ট মি, আমি কল্পনাও করিনি এমন হবে বা হতে পারে!
দুজন পাশাপাশি বসে আছে। রোহানের ডান হাত ফাহাদের কাঁধে! আমি পেছন থেকে দেখছিলাম। রোহান খুব হেসেখেলে কিছু বলছে, ফাহাদ যদিও নিশ্চুপ। কিন্তু আমায় মুগ্ধতায় জড়াতে ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল। আমার সেই মূহুর্তে মনে হলো, ‘এই মাথাখারাপ-ডানপিটে-বদমাইশ ছেলেটা পৃথীবির সবচাইতে আদুরে, সবথেকে মায়াময়! ওর ভেতর যেই মায়া আছে তা সারা পৃথিবী বিলিয়েও ফুরাবে না।
পাগল! রাগতেও সময় লাগে না, ভালোবেসে আপন করে নিতেও সময় লাগে না।
এমন করে এক নিমিষে সকল ব্যথা ধুলায় উড়িয়ে দিতে আর কে পারে?
আমার সেদিনের সকালটার ওই সুন্দর-মধুর দৃশ্যটি সারাটা দিন কেমন যেন মুগ্ধতায় জড়িয়ে রাখলো।
সকালে খেয়ে আমরা আমাদের ট্যুরের শেষদিনকে স্মৃতির পাতায় মুড়িয়ে রাখতে বেড়িয়ে পড়লাম।
ফাহাদ যেতে চাচ্ছিল না। বন্ধুর উপর মান তার তখনও ভাঙেনি। না ভাঙাটাই স্বভাবিক। কিন্তু বদমাইশটার সাথে অভিমান করে থাকবে, এমন সাধ্য কার আছে? রোহান এবারও টেনেটুনে ফাহাদকে নিয়েই বের হলো। যাবে না মানে? প্রয়োজনে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। যেতে তাকে হবেই!
ওর কান্ড দেখে সবাই হেসে কুটিকুটি হলো।
অতঃপর তারা অর্থাৎ মিস্টার রোহান এন্ড ফাহাদ আমাদের ফেলেই আগে এগিয়ে গেল।
আমি মনে মনে আনন্দিত হয়ে বাকিদের বললাম, “এই পাগলটাকে তোরা কেউ কিছু কেন বলিস না? এমন ছন্নছাড়া! কখন কি করে কিছুরই ঠিক নেই!”
ইফাজ বলল, “ওয় তুমি ছাড়া আর কেউরে মানে?”
আমি দুঃখী হয়ে বললাম, “আমাকেও মানে না। এই ছেলেটা কাউকে মানে না, কাউকে না। ভীষণ বেপরোয়া!”
আমরা প্রথমে সেদিন কুয়াকাটার কুয়া দেখতে গেলাম। যেই কুয়ার নামানুসারে কুয়াকাটার নামকরণ। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এর কাছেই এই কুয়ার অবস্থান।
সেখান থেকে গেলাম শুঁটকি পল্লী। শুঁটকি পল্লিতে যাওয়ার জন্য সবচাইতে উতলা ছিল ইফাজ। ও শুঁটকি পাগলা। দুনিয়ার সবচাইতে সুস্বাদু খাবার নাকি শুঁটকি মাছ। সাদিয়া মুখ বিকৃত করে বলল, “ইহঃ কি জঘন্য রুচি রে তোর!”
ইফাজ ধমকে উঠে বলল, “তোর মতো মাথা মোটা কাতলা মাছ শুঁটকির স্বাদ কি বুঝবো রে? সর এনতে। তোর জন্য এই শুঁটকি পল্লী নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হলো।”
সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। শুঁটকি পল্লীতে কেউই বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না। সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে গেলাম আরো একটি অপরূপ সুন্দর স্থানে। ঝিনুক বিচ। হরেক রকমের ঝিনুক- বিচের বুককে বিচিত্র সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি হিসেবে উপস্থাপন করলো সকলে ধারে। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। তারপর এগিয়ে গেলাম কাছে।
ভরদুপুর তখন। সুনীল আকাশের বুকে পরিষ্কার মেঘের ভেলা। মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের কিরণ। স্বচ্ছ পানিতে সেই কিরণ পদাচরণ করে ঝলমলিয়ে উঠছে!
আমি ঝিকিমিকি করা সেই পানিতে পা ভেজালাম, মন ভেজালাম, মনভুলানো সৌন্দর্যে হারিয়ে গেলাম কই যেন!
ঠিক সেই সময়টাতে রোহান এলো কাছে। আমি ওর দিকে তাকাতেই সে তার সেই ভুবনজয়ী হাসি হাসলো। চোখ দুটো সঙ্কুচিত করে তাকালো। এই মোহনীয় দুপুরে- ওর ওই অদ্ভুত সুন্দর ধূসর চোখ দুটো যেন তার সকল রূপ নিয়ে, সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিল আমার দৃষ্টিতে, আমার পৃথিবীতে! আমার কেমন যেন লেগে উঠল, মন কেমন করে উঠল!
ওর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। রোহান আমার কাছে হেলে আলতো করে বলল,
“জুছি? দেখ? এই ঝিনুকে তুমি আছো!”
আমি জানি না, কত কত অদ্ভুত কথা ওর ঝুলিতে! আমি তাকিয়ে দেখলাম ওর মুঠো ভর্তি ঝিনুক। আমি মুদু হেসে ওর সুরেই কইলাম, “আমি তো দেখছি, এই ঝিনুকে তুমি আছো!”
রোহান মুঠো বুজিয়ে আমার ঠিক সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। বিচের জলধারা নিরব স্রোতে ওর পায় ছুঁয়ে আমার পা ছুঁলো। রোহান বলে, “যেখানে তুমি আছো, সেখানে আমি আছি। বলো তো মেয়ে? তুমি হিনা কি করে বাঁচি?”
আমি হেসে দিলাম। ছন্দে ছন্দে কথা বলার বদ অভ্যাস তৈরি হয়েছিল তার। রোহান তার চোখ দুটো আরো ছোট ছোট করে, ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত করে বলল, “ইশশ! আবার হাসে! হাসলে তো তোমায় জুছি লাগে!”
আমি ওর থেকে সরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
“দেখ? এখন আমার পা খালি। অযথা জুছি জুছি করবা না।”
রোহান আমার পিছুপিছু আসছিল, কথা শুনে ঝিনুক রাজ্য কাঁপিয়ে হাসলো। তারপর বলল, “তুমি তো আমার জুছিরানী। তোমায় দিনে একশবার এই নামে না ডাকলে আমার যে শান্তি লাগে না! রাগো কেন? প্লিজ রেগো না!”
আমার মনে হয়, ঐ ট্যুরের খন্ড খন্ড স্মৃতি, ওর দারুন মজার সব কথোপকথন, ওর পাগলামি- ওর প্রতি আমার টান বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তখন বুঝিনি অবশ্য।
সঠিক সময়ে আমরা কেউ কিছু বুঝি না! বলা বাহুল্য মোস্ট অব দ্যা টাইম, বুঝেও অবুঝের ভান ধরে থাকতে পছন্দ করি কিংবা বিষয়গুলো আমলে নেই না, ভাবনার গভিরতায় হারাই না, হারাতে চাই না!
আমার প্রতি ওর দরদ, কেয়ারনেস এর মাত্রা কতটা যে বেশি ছিল তার আরো একবার প্রমাণ মেলে ঝিনুক বীচ থেকে ফেরার পথে।
খালি পা থাকায় ঝিনুকে পা কেটে গেল। ব্যথায় উঁহ করতেই রোহান ফিরে তাকালো। খুব বেশি যে কেটেছিল তা না, তবে রক্ত বের হচ্ছিল, শরীরে রক্ত বেশি ছিল বোধহয়…হা হা!
রোহান টাকানোর পর তার নজর সর্বপ্রথম আমার পায়ে চলে গেল। ছুটে এসে বসে প্রথমে ঝিনুকটা ছুড়ে দূরে ফেললো। রক্তে রক্তিম স্থানটা হাত দিয়ে চেপে ধরে থেমে থেমে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল, “এ…এই? কত রক্ত! প্লিজ কেউ কিছু কর!”
আজব! আমি বুঝি না, সামান্য পা কাটায় এতো উত্তেজিত হওয়ার কী আছে?
বললাম, “একটুও ব্যথা নাই, সরো তো!”
ও আমায় বলল, “একটু কেয়ারফুলি হাঁটবা না? এত কেয়ারলেস কেন তুমি? খালি পায়ে কেন হাঁটছিলে? আমার খুব রাগ হচ্ছে জুছি!”
বলতে বলতে সে তার রুমাল দিয়ে পা বেঁধে দিল। তারপর দাঁড়িয়ে বলল, “আমায় ধরো জুছি।”
আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, “বাহ! তুমি তো খুব আহ্লাদ করতে জান!”
কথাটা বলে আমার হাসির মাত্রা আরো বেরে গেল। রোহান খুব গম্ভীর মহাশয় হয়ে বলল, “হাসবা না তো!”
বাকিরা আমাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। রোহানের ডাক শুনে ওরা পুনরায় ফেরত এসেছিল। আরেকটা কথা, ফাহাদ রোহানের সাথে কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আমার প্রতি ওর মান এইটুকুও ভাঙেনি কিন্তু! আমি নিজেও চেষ্টা করিনি বলেই হয়তো! আমার দিকে ঠিকঠাক চাইছিলোই না। যদিও তাতে বিশেষ অসুবিধা নেই।
ফাহাদ গম্ভীর কন্ঠে বলল, এদিকে কই যেন একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। ড্রেসিং করিয়ে আন, ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।
ফাহাদের পাকনামি আর রোহানের অতিরিক্ত কেয়ারনেসের ঠেলায় সেদিন আর আমার সূর্যাস্ত দেখা হলো না। বাকিরা গেল, কিন্তু আমি যেতে পারলাম না। রোহান নিজেও গেল না। সে আমায় নিয়ে গিয়েছিল একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আহ আফসোস! আমার পা ড্রেসিং-ট্রেসিং করিয়ে রিসোর্টে ফিরলো, তবেই সে শান্ত হলো। ইশশ এর এক ভাগ যত্ন যদি তার নিজের প্রতি থাকতো!
সূর্যাস্ত না দেখতে পারার আফসোসে আমি খুবই অসন্তুষ্ট ছিলাম ওর প্রতি। রোহান বলল, “এহ! ঢংগিরানী! দেখি দেখি…এদিক তাকাও? ওরে আল্লাহ্! আমার আহ্লাদীর আরো আহ্লাদ বাড়িয়ে দাও প্লিজ।” বলেই হাসছিল।
আমায় হাসতে বারন করে অথচ নিজেই অকারণে হাসে!
অসম্ভব সুন্দর, রঙিন, মধুময়, বর্ণিল ট্যুর শেষ হওয়ার সময় হয়ে এলো।
পরদিন খুব ভোরেই আমরা রোয়ানা হলাম ফেরার পথে। ঘুরাঘুরির ঘোরেই বোধহয় এতদিন শরীরের বোধশক্তি সব চাপা পরে ছিল, ক্লান্তির রেশ মাত্র ছিল না। কিন্তু ফেরার পথে পা বাড়াতেই শরীরের সকল লুকায়িত ক্লান্তি যেন ঝেঁকে বসলো। বাসে উঠে আমি সিটে সমস্থ শরীর এলিয়ে দিলাম। এক বিন্দু শক্তিও যেন গায়ে নেই। রোহান বুঝলো আমার অবস্থা। আস্তে করে বলল, “খারাপ লাগে জুছি?”
আমি সায় জানালাম। ওর কাছে সত্যি-ই আমি আহ্লাদী। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দায়িত্ববান পুরুষের মত করে বলল, “হাত-পা কেটে, রাতে ঠিকঠাক না ঘুমিয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ। তোমায় এমন দেখতে আমার ভালো লাগছে না। একটু ঘুমাও।”….(চলবে)
#রয়েছ_হৃদয়ে
#১২তম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
ট্যুরে যাওয়ার সময় জার্নিটা যতটুকু ইনজয় করেছিলাম, আসার সময়কার অনুভূতি ঠিক তার উল্টো ছিল। শরীর ভালো না থাকলে দুনিয়ার কি-ই-বা ভালো লাগবে?
যাইহোক ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে অবশেষে ফিরলাম আমরা। পথে পথেই অনেকে নেমে গেছে, যখন যার বাসা পড়েছে। শেষ অব্দি থেকে গিয়েছিলাম আমি, শম্পা, রোহান আর ইফাজ।
বাকিদের তেমন কোনো ঝামেলা নাই। কিন্তু আমি আর শম্পা পড়লাম মহা যন্ত্রনায়। রাতে হোস্টেলে ঢোকা একপ্রকার অসম্ভব। তার উপর মাঝরাত। শম্পা কিছুক্ষণ উসখুশ করে কাকে যেন ফোন করলো। ফোনে কথা শেষে সে চিন্তামুক্ত হাসলো। বলল, “আমার খালার বাসা কাছে আছে। খালাকে সব খুলে বললাম, খালা বলল চলে যেতে। বাঁচলাম রে।” তারপর মিসটেইক করে ফেলেছে এমন মুখ করে বলল, “শিট! তোর কথা তো বলিনি! দাঁড়া আবার ফোন দেই।”
আমার শরীর-মন দুটোই তখন ভীষণ রকম ক্লান্ত। ইচ্ছে হচ্ছিল রাস্তার মাঝেই বসে পড়ি! করলামও তাই। ফুটপাতে বসে পড়লাম। মেজাজ খিটখিটে হয়ে রইলো। বললাম, “থাক, প্রয়োজন নেই। তুই চলে যা।”
শিলা চলে গেলে থাকলাম আমি, রোহান আর ইফাজ। রোহান কিন্তু চুপচাপ তখনও।
ইফাজ বলল, “এখন কি করবা? ওকেও চলে যাইতে বললা! হোস্টেলে ফেরা কি পসিবল?”
আমি বললাম, “তোমরা যাও তো! আমার চিন্তা আমি করবো।”
রোহান মুখ খুলল। ইফাজকে বলল, “তুই তো উল্টা যাবি। তুই বরং চলে যা, লেইট করিস না।”
ইফাজ বলল, “আর ইউ শিউর?”
“হুম।”
সবাই ঠিকুই চলে গেল। না করে পারলে কে কার চিন্তা করে?
রাত আনুমানিক একটা বাজে! শহরও নির্জন হতে শুরু করেছে। গাড়ি-টারি কমতে শুরু করেছে আরো আগ থেকে। রোহান উঠে কাছেই একটা দোকানে গেল। আমি একা পড়ে রইলাম। অতো বড় শহরটায় আমার কেউ নাই ভেবে এতো দুঃখ হলো! মিনিট দুয়েক পর রোহান এসে আমার পাশে বসলো। এক কাপ চা আর একটা পাউরুটি এগিয়ে দিয়ে বলল, “খালি পেটে দুঃখ করতে হয় না। দুঃখ করতে হয় ভরা পেটে, বুঝলে?”
আমি তাকালাম। নিয়ন আলোয় ওর সহজ-সরল মুখটা দেখেই অর্ধেক ক্লান্তি কমে গেল! অমন অদ্ভুত কথায় একটু হাসিও পেল। তবুও কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললাম, “বেশি কথা বলো। সবাই চলে গেল, তুমি যাচ্ছো না কেন? যাও তো!”
রোহান একটু হাসলো। রহস্যময় হাসি। একটু কাছে এসে বলল, “তোমায় রেখে একলা একা, কোথায় যাব বলো? তুমি বরং আমার সাথে, আমার বাড়ি চলো।”
আমি পাউরুটি খেতে খেতে বললাম, “বেশি কবিগিরি করলে একদম চা ঢেলে দিব মাথায়।”
রোহান কাছে ঘেঁষে বলল, “ঢেলে যদি শান্তি পাও, তবে নাহয় ঢালো। তবুও তুমি আমার সাথে, আমার বাড়ি চলো। যাবে কি প্লিজ? বলো?”
আমি হেসে দিলাম। আল্লাহ্ ওরে অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়েছে। এ যেন আমার মন ভোলানো, প্রাণ ভাসানো, কথায় বেঁধে ফেলার মতো তীব্র পাওয়ার! আমি সবসময় যেই কথাটা বলি সেই মূহুর্তে সেই কথাটাই বললাম, “তুমি এমন কেন রোহান?”
রোহান উঠে দাঁড়াল। ওর শরীরের আঁধার ছায়ায় আমায় ঢেকে বলে, “তুমি এমন বলেই!”
একটু থেমে বলে, “চলো, ওঠো।”
আমি বললাম, “পারবো না। যাব না। তোমার সাথে কেন যাব? তোমার বাড়ি কেন যাব?”
রোহান একটু নিচু হয়ে বলল, “আমার সাথে তো তোমায় যেতেই হবে, আমার বাড়ি তো তোমায় যেতেই হবে আমার জুছিরানী!”
বলেই সে একটু হেঁটে সামনে গেল। একটা রিকশাওয়ালা ঘুমিয়ে ছিল রিকশার উপর, তাকে ডেকে তুলল। রিকশাওয়ালা ‘যাবে না’ বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। বেচারা জানে না কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছে। রোহান বলল, “দ্যাখো মামা? এক-দুই-তিন বলার মধ্যে যদি না ওঠো, তবে কিন্তু আমি কাতুকুতু দিব।”
আমার কি যে হাসি পেল। আস্ত একটা মাথাখারাপ ছেলে!
বেচারা রিকশাওয়ালা ওর কথা আমলে নিল না। রোহানও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। ঠিকই কাতুকুতু দিল। রিকশাওয়ালা হুড়মুড়িয়ে পড়ে যেতে নিলে রোহান ধরলো। তিনি বিশ্বাস-ই করতে পারছিল না, এমন সত্যি সত্যি কেউ করতে পারে। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থেকে চোখ কচলিয়ে বলল, “ধুর মামা! কি করেন? পাগল হইলেন নাকি!”
রোহান বলল, “এখন না গেলে টের পাবেন পাগল নাকি মহা-পাগল। জলদি ওঠেন।”
তারপর আমায় ডেকে বলল, “এই জুছি? তুমি একটু বলে দাও তো, আমি কী?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “মামা এইটা একটা মাথাপাগলা ছেলে। প্লিজ নিয়ে চলেন। ডাবল ভাড়া দিব।”
রিকশাওয়ালা শেষমেশ বাধ্য হয়ে রাজী হলো। রোহান আমার দিকে চেয়ে চোখ মারলো। ভাবখানা এমন যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে।
আমি রিকশায় উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে বলল, “জুছি? ফিলিংস শান্তি শান্তি। মাঝরাতে রিকশা ভ্রমন, জোশ না?”
আমার মাথায়ও বদমাইশি ভর করলো। সাথে সাথে বললাম, “জোছনা কে?”
হায় আফসোস! ভুলবশত বদমাইশের সর্দারের সাথে বদমাইশি করে ফেলেছি।
রোহান মৃদুমন্দ হাসলো, খানিক কাছে আসলো। আলতো স্বরে বলল, “আমার জোছনা তো তুমি! আকাশের অর্ধচাদের অর্ধেক জোছনা, আর আমার পাশে বসে জগত ভাসানো পরিপূর্ণ জোছনা! এই যে দেখ অপরূপা জোছনায় ভেসে যাচ্ছি, মরে যাচ্ছি! বাঁচাও প্লিজ! নয়তো চলো, দুজন মিলে জোছনা ভেসে বিলাস করি!”
বলেই হা হা করে হাসলো। আমি চরম বিস্মিত হয়ে হা করে রইলাম। ইন্সট্যান্ট এমন করে কথার মারপ্যাঁচে আর কে ফেলতে পারে?
আমি বললাম, “তুমি দারুন ফাজিল।”
রোহান বলল, “তুমি এই ফাজিলকে সহ্য করো কেন?”
“ভালো লাগে।”
“আমারও।”
“কী?”
“তোমায় ভালো লাগাতে, ভালোলাগায় ভাসাতে, সঙ্গে আমিও ভাসতে।”
নিস্তব্ধ আবছায়া রাত। শিনশিন করা বাতাস এসে গায়ে লাগে। রিকশাওয়ালা বলল,
“এতো রাইতে কি এইসব ভালো লাগে? কি ঝালায় ফালাইলেন কন দেহি?”
রোহান বলল, “এই যে আমার জ্বালা সইলেন? এর বিনিময়ে হলেও জগতের একটুকরো মোহনীয় ভালোবাসা আপনার হয়ে যাক!”
তিনি তৃপ্ত না হয়ে পারলেন না বোধহয়। বললেন, “আপনে আসলেই একটা আজব মানুষ মামা। এমন আজব মানুষ আর দেহি নাই। কেমন কারবার….কাতুকুতু দিয়া ঘুম ভাঙায়!”
বলেই খিটখিট করে হাসলেন। অস্পষ্ট হাসি আমার মুখেও ধরা দিল। রোহান বলল,
“ডানে ঘুরাও মামা। কইন্যারে আমার বাড়ি নিয়া আইসা পড়ছি। তুমি বলো মামা? এ এক বিরল ঘটনা না? ভারী আশ্চর্যজনক না?”
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বিরল ঘটনা ক্যান হইবো, মামা? মামি আপনার বাড়ি যাইবো না তো কই যাইবো?”
এবার আমি হেসে দিলাম। খুব হাসলাম, হাসি থামেই না! মুখে হাত রেখে হাসলাম। রোহান বলে,
“দেখছো মামা? কেমনে হাসে? অন্তর পুরে অঙ্গার হইবো না, কও?”
“হ, হওনের তো কথা।”
একটা শিতল দীর্ঘশ্বাঃস ফেলে ছেলেটা আমার দিকে চাইল। নিয়ন আলোয় দেখতে পেলাম তার মুখে অস্বচ্ছ হাসির রেখা। বলল, “আইসা পড়ছি। নামো চাঁদনীর মা।”
আমি অবাক না হয়ে পারি, বলেন? কপাল কুঞ্চিত করে বললাম, “চাঁদনীর মা মানে?”
রোহান বলল, “তুমি জোছনা, তোমার মেয়ে হইবো চাঁদনী। তাইলে তুমি চাঁদনীর মা হইলা না?”
পৃথীবির যত আজগুবি সব কথায় তার ঝুলি ভর্তি ছিল। যখনই প্রয়োজন পড়ত তখনই সে তার সৎ-অসৎ দুই ব্যবহার-ই করতো!
আমি জানি না, ওর ফ্যামিলির মতো এতো ফ্রেন্ডলি ফ্যামিলি আর আছে কিনা! যেখানে ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি থাকা সমাজ বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে, সেখানে ট্যুর শেষে মাঝরাতে তাদের ছেলে তাঁর মেয়ে বান্ধুবিকে নিয়ে এলো; আর তাঁরা এমন করে সমাদর করলো যেন আমি তাদেরই মেয়ে! ভীষণ অবাক হয়েছি সেদিন আমি।
দরজা খুললেন রোহানের মা। মা তো মা-ই, তিনি আমারও মা। খুলেই বললেন, “আহারে আম্মাজানটার মুখটা দেখো। দ্রুত ভেতরে আসো।”
ওর বাবা বললেন, “তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে মা? রোহান বলল, তুমি একটু অসুস্থ নাকি?”
আঙ্কেলের কথায় বুঝতে পারলাম, রোহান আমার কথা আগেই বলে রেখেছে বাসায়। রোহানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আরো নিশ্চিত হলাম। এবং বুঝলাম, তাই তাঁরা রাত জেগে অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য।
এরই মাঝে রায়হান জুনিয়র চোখ কচলাতে কচলাতে এলো। লম্বায় আমাককে ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়। ছেলেগুলো এত দ্রুত লম্বা হয়ে যায়! রায়হানকে দেখে মনে হলো, একেবারে রোহানের কপিক্যাট। সে খুব তাংকু একটা পার্ট নিয়ে বলল, “হেই আপু? চিনতে পারছো? আই এম রায়হান জুনিয়র। ওই যে সিক্রেট….!”
আমি একগাল হেসে বললাম, “ইয়েস মিস্টার রায়হান জুনিয়র। আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি।”
রোহান তার এক হাত দিয়ে রায়হানের গলা প্যাঁচিয়ে ধরে বলল, “এই গোল্লা? তুই আবার কী করছি? কিসের সিক্রেট, হুম? বল, বল?”
রায়হান না পেরে বলল, “আম্মা? আব্বা? দেখ তোমাদের বড়ো ছেলে আমাকে মারে। বাঁচাও তোমাদের নিরীহ নিষ্পাপ ছেলেটাকে। প্লিজ?”
ওর মা বাবা বেচারাকে বাঁচাবে কি? তাঁরা কেউ পাত্তাই দিল না ছেলেদুটোর কান্ড-কারখানাকে। যেন এমন হরহামেশাই হয়, এতে বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দেয়ার কিছু নেই।
তাই বোধহয় তাঁরা ওদিকে মনোনিবেশ না করে-আমায় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নানান খবরাখবর জানলো। আঙ্কেল বললেন, “তোমার মতো এমন মিষ্টি, ভালো মেয়েটা এই তারছিড়ার পাল্লায় কেমনে পড়লো! এ তো অষ্টম আশ্চর্যকর ঘটনা!”
তাঁর বলার ভঙ্গিতে আমি হেসে ফেললাম।
রোহান ততক্ষণে রায়হানকে নিয়ে ভিতরে চলে গিয়েছিল।
তাঁরা তাদের ছেলেকে ভুলে, ঘুম বিসর্জন দিয়ে আমার যত্নে ব্যস্ত হয়ে গেল। মানুষ দুটো এতো বেশি অমায়িক! এত স্নেহ করলো! এত আদর আমি আমার পরিবারের বাইরে আর কারো কাছে পাইনি। খুব শক্ত মনের আমি- মমতায় নরম হয়ে গেলাম। পরম ভালোবাসায় শিক্ত হয়ে গেল মন। রাতে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে মা আমায় একটা রুমে নিয়ে গেল থাকার জন্য। বলল, “এটা তোমার রুম!”
এমন ভাবে বলল, যেন সত্যি-ই ওটা আমার রুম! আমি অবাক হয়ে কেবল পুরো পরিবারটার ভালোবাসা গ্রহন করলাম।
ঠিক ঘুমানোর আগে পাশের রুম থেকে আমার ফোনে মেসেজ এলো, “জুছি ঘুমাচ্ছো? শোনো একটা কথা? এই মায়ার বাড়িটা আমার, সাথে তোমারও।”
আমার মনে হলো, ঠিক-ই তো! এই পৃথিবীর যা কিছু ওর, তা সবই তো আমার! ছেলেটাও! এই পাগল ছাড়া তো আমার চলে না, চলবে না কিছুতেই!….(চলবে)