রয়েছ_হৃদয়ে #১৩তম_পার্ট,১৪

0
950

#রয়েছ_হৃদয়ে
#১৩তম_পার্ট,১৪
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
১৩তম_পার্ট

পরদিন সকাল বেলাটা ঠিক আপন আপন আদর দিয়ে শুরু হলো। রোহান, রোহানের পুরো পরিবার আস্ত একটা বিস্ময়। আমার জানাই ছিল না, এমন করে কাউকে মূহুর্তের মাঝে আপন করে নেয়া যায়!
নাশতার টেবিলে মা-বাবা আমার সম্মুখে একগাদা নালিশের ঝুলি খুলে বসলেন। এই ছেলে তাদের কথা-টথা কিচ্ছু শোনে না বলে খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন। রোহানের ভাব এমন যেন এসব কথা শোনা তার জন্য ডালভাত। আমি মা-বাবার দলে আগে থেকেই অবস্থান করছি তাই তাল মিলাতে মোটেও অসুবিধে হয়নি। রায়হান আমার পাশেই ছিল। সে অলয়েজ কিছু না কিছু নিয়ে খুব বিজি থাকে। আই থিংক দেশ-বিদেশের মন্ত্রীরাও এত বিজি থাকেন না। সে ফিসফিয়ে বলল, “তোমায় বোধহয় আর সিক্রেট কথাটা বলা হলো না। আজই বলতাম, বাট খুব ইম্পরট্যান্ট একটা কাজ আছে তাই পারলাম না। ডোন্ট’ওরি…নেক্সট টাইম…ওকে?”
বলেই সে টেবিল থেকে উঠে গেল। একটু দূর গিয়ে আবার ফেরত এসে বলল, “ইউ আর সো প্রিটি, ভাইয়া ঠিক বলেছে!”
রোহান বড়ো বড়ো ভাব করে ডেকে বলল, “ওই গোল্লা? ফিসফিসানি নিষেধ এখানে। যা ভাগ, তোর না কি কাজ আছে?”

রায়হান চলে যেতেই মা-বাবা পুনরায় দুঃখ বিলাস করতে লাগলেন। বাবা বললেন, “আমার মতো ভালো মানুষটার ঘরে এমন বদ দুইটা কই থেকে আসলো কও তো আম্মা? হিসেব মিলে তোমার? আমার তো মিলে না!”

মা ফোড়ন কেটে বললেন, “হায়রে আমার ভালো মানুষটা! বুঝলে মা? অর্ধেক জীবন আমার আঙ্গার করছে এই বদ লোক আর বাকি অর্ধেক করেছে তার বদ পুত্রযুগল। কারে কমু কষ্টের কথা কও? কিশোরী কালে ভাবছিলাম, যেই মানুষটা জীবনে আইবো হে হইবো সেরা মানুষ, আমি হইমু সুখি মানুষ। ওমাহ! সে আইলো ঠিক কিন্তু কিছুকাল সংসার কইরা বুঝলাম, এ তো মানুষ না, এ হইলো বনমানুষ! তারপর ভাবলাম পোলা দুইডা তো আমার সাধনার ফল, অবশ্যই আমার মতো হইবো। ও আল্লাহ্‌! এরা দেখি বাপের ডুব্লিকেট! হায়রে আমার আর সুখি হওয়া হইলো না! সুখ এখন আমার কাছে বিলাসিতা। বুঝলা মা?” বলতে বলতে পারেনা কেঁদে দেয়!
বেচারা বাবা যে এমন করে ফেঁসে যাবে, তা তিনি ভাবেননি। আরো না ফেঁসে যায় তাই চুপ করে রইলেন। রোহান তো খিটখিট করে হাসছে। অন্যদিকে আমি না পারছি সইতে আর না পারছি হাসতে! কি জ্বালা বলুন?

অল্পকিছু সময়ে কেমন করে যেন আত্মবন্ধন তৈরি হয়ে গেল মানুষগুলোর সাথে। কার না হবে বলেন?
ফেরার সময় মানুষ দুটো এতো আদর দিলেন যে, আমি ভালোবাসায় বুদ হয়ে গেলাম। এতদিন ছিল ছেলেটার প্রতি টান এরপর হয়ে গেল পুরো পরিবারটার প্রতি।

সেদিন ক্যাম্পাসে আসার পথেই জেরিনকে দেখতে পেলাম। রোহান দেখেছিল কিনা আমার জানা নাই।
মেয়েটা খুব মিষ্টি দেখতে। মুখটা এমন যে, যতটা না ছোট বয়স- তার থেকেও ছোট দেখতে! শুধু চলাফেরার ধরনটা একটু ফাস্ট। খুব চঞ্চল, কিচ্ছু কেয়ার করে না টাইপ। নয়ত জাস্ট চ্যালেঞ্জ জেতার জন্য অত সাহস দেখানো ভাবতেও পারি না।
আমি জেরিনকে দেখতে পেলেও, জেরিন আমাদের দেখতে পায়নি কিন্তু। সিএনজিতে ছিলাম তো তাই। সে তার বন্ধুদের সাথে রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে আড্ডায় মশগুল।
আমি জানি না, মেয়েটাকে দেখলেই রোহান কেন আনইজি ফিল করতো। তবে আমার কিন্তু বেশ মজা লাগতো। আমার মাঝেমধ্যে মনে হতো, রোহান যেমন চঞ্চল, জেরিনও তো তেমন। দুজন পারফেক্ট মিলে। আবার কেন জানি খুব রাগ লাগতো মাঝেমধ্যে। হয়তো অদৃশ্য-অপ্রকাশিত সম্পর্কের টানে!

আমরা ক্যাম্পাস চলে এলাম। রোহান ওর ডিপার্টমেন্টে গেল, আমি আমার ডিপার্টমেন্টে। পাঁচ-ছয়দিন ক্লাস করিনি, মনে হলো কতকাল ধরে ক্লাস করছি না! প্রথম দুটো ক্লাস পরপর হলো তারপর ব্রেক পেলাম। রোহান বরাবরের মতোই খুব ছটফটে ছিল। আমি বুঝি না, সারাক্ষণ-ই ক্যান ওর আমার সাথে থাকা লাগবে? একটুখানি দূরত্ব কেন সইতে পারে না?
ক্লাস থেকে বের হয়ে সবসময়কার মতো আধপাগল ছেলেটার দেখা পেলাম। মহা বিরক্ত হওয়ার মতন করে বলল, “আজব! একসাথে দুটো ক্লাস কেন হতে হবে?”
আমি বললাম, “ফাঁকিবাজ!”

আমরা প্রথমে কেন্টিনে গেলাম। আমার প্রিয় সিঙারা খেলাম। একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলি? আমি যখনই সিঙারা খেতাম, রোহান মিটিমিটি হাসতো আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। আমি ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে বলতাম, “হাসছো কেন?”
ও বলতো, “এমনি! আমার ভালো লাগে।”
সেদিনও এর ব্যতিক্রম হলো না। প্রথম প্রথম রাগ হতাম, পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম!
ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “খাবে?”
রোহান বলল, “উহু! তুমি খাও, আমি দেখি। ইউ নো হোয়াট? দিজ ইজ ওয়ান অব দ্যা মোস্ট প্রিসিয়াস সিন্যারি! এন্ড আই লাভ ইট!”

আমার মনে হয় কি, আমি বোধহয় সর্বাধিকবার ওর কথার-ই প্রেমে পড়েছি!

খাওয়া শেষে আমাদের দুইজনেরই অন্যতম পছন্দের একটা জায়গায় এসে বসলাম। এই যে আমি ক্লাস করলাম, খেলাম, সময় গড়িয়ে মধ্যদুপুরে রূপ নিল? এই এতোটা সময়ে খনে খনে আমার জেরিনের কথা মনে পড়েছে। আমার কেন যেন মনে হলো, রোহানেরও হয়তো মনে পড়ছে! অথবা…..! আমি জানি না আমার মনে আরো কি কি ছিল! জানতে চাইনি বলেই হয়তো। নানান পিছুটান থেকে আমি আমার কোনো অনুভূতি সানন্দে প্রশ্রয় দিতে পারতাম না।
আমি হুট করেই রোহানকে বলে বসলাম,
“মেয়েটা দেখতে সত্যি দারুন। তোমার সাথে খুব যায়।”
রোহান কপাল কুঁচকে আমার দিকে চাইলো।হঠাৎ এমন কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল, “মেয়েটা? কার কথা বলছো? আর যায় মানে?”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
“জেরিনের কথা বললাম। আর যায় মানে, খুব মানায়। দুটো চঞ্চল পাখি হয়ে ঘুরে বেড়াতা দুজন, দারুন লাগতো দেখতে।”
রোহান মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“না।”
“কী না?”
“আমার ওরে চাই না।”
“কেন?”
রোহান একটু বাঁকা হয়ে আমার দিকে ফিরলো। আমি দেখলাম রোহান খুব দুঃখ পেলো! আমি জানি না, ওকে আমি দুঃখ করার মতো কি বলেছি! ভ্রু কিন্তু তখনও কুঁচকান। খুব মলিন একটা মুখ করে বলল,
“তুমি অলওয়েজ ওর কথা কেন বলো? তোমার কেন জেলাসি ফিল হয় না জুছি? তুমি কেন বুঝতে চাও না? আমার খালি তোমারে চাই! ট্রাস্ট মি জুছি? আর কিচ্ছু চাই না আমার!”
আপনারা জানেন? আমার তখন মনে হলো আমি পৃথিবীর অন্যতম সুখি মানুষদের একজন। আমার অনুভূতি সুপ্ত। ও যেমন হরবর করে বলে দিতে পারে, এমন দারুন করে কথার মায়াজালে বেধে ফেলতে পারে; আমি পারি না। আমার খালি মনে হয়, নিরবে প্রেম জমানো অধিক তৃপ্তিদায়ক। বললাম,
“আমাকে কেন চাও?”
রোহান বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা যেখানে বসে ছিলাম সেটা একটু উঁচুতে ছিল। ও নেমে আমার সামনে দাঁড়ানোর পর হালকা একটু লম্বা হয়ে গেল। আমার মাথার পাশ দিয়ে এক হাত দেয়ালে রাখলো। তারপর বলল,
আমি জানি না! আমি জানতে চাইও না। আমি শুধু জানি, তুমি ছাড়া আমার অসহ্য লাগে, জুছি! তুমি ছাড়া আমার চলে না! আমার শুধু তোমাকেই চাই। তুমি চাইলেও চাই, না চাইলেও চাই। চাই মানে চাই!”

আচ্ছা? আপনারা এমন জোড় করে ভালোবাসা কেড়ে নিতে দেখেছেন? আমি দেখেছি। চোখ ভর্তি মায়া, অন্তর কাঁপান প্রেম। ওর ছলছলে চোখ, নাক, সারা মুখ লাল বর্ণ ধারন করলো, প্রতিটা কথায় গলার রগ ভেসে উঠছিল।
আমার খুব নিষ্ঠুর হতে ইচ্ছে হলো। বললাম, “আমি চাই না।”
আমি ওর কৃষ্ণবর্ণ মুখখানায় ব্যথা দেখতে পেলাম, অস্থিরতা দেখতে পেলাম। চোখের পাতা ঘনঘন ফেলছিল। কিসের পূর্ব সংকেত এটা? ছেলেটা বলল, “কেন চাও না? একটুখানি চাও, প্লিজ?”

আমি বললাম, “তাতে কি লাভ?”
ও বলল, “আমি বেঁচে যাব। এই যে দেখ তোমার অমন হৃদয়হীনার মতো নিষ্ঠুর কথায় আমার কঠিন মৃত্যু হচ্ছে!”
আমি আর পারলাম না। খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম! আমি যখনই হাসি, ও কেমন নরম হয়ে যায়, স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন ওর কি হচ্ছিল কে জানে, স্বাভাবিক হলো না। একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাঃস ছেড়ে আমার সামনে থেকে সরে গেল!
আমি পেছন থেকে ডাকলাম, “এই রোহান? এই?”
ও তাকালোই না! আমি বুঝেছি, ওর নিদারুন অভিমান হয়েছে এই ভেবে, কেন ওর ইমোশনগুলো সিয়াসলি নেই না। কেমন পাগল দেখুন? সে জানলোও না, ওর এই ইমোশনের মায়ায় বহু আগেই পড়ে গিয়েছি! আমি খালি টাইম নিচ্ছিলাম। কোনো কমপ্লিমেন্টে জড়িয়ে লাইফটাকে কমপ্লিকেটিভ করছিলাম না। আমার চিন্তা ছিল, সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করি। ও নিজে আরো একটু ম্যাচিউরড হোক, নিজের একটা পজিশন ক্রিয়েট করুক যেনমতে অন্যের কাছে না শুনতে হয়, ‘আরে সেইম এইজ রিলেশনশিপ? ক্যারিয়ার শেষ, ফিউচার নাই!’
আমার মনে হয়েছিল, এসব ওকে বললে বুঝতো না। শেষে আমার নিজেরই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। সিনক্রিয়েট করে, বকাঝকা করে ওকে বুঝানো মহা মুশকিল কাজ। হিতে বিপরীত হতো।
অন্যদিকে ওরে ছাড়া আমার নিজেরও চলে না। তাই বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকতাম। যেমন চলছে তেমন চলতে থাকুক। কিন্তু আমর একটা ধারনা খুব..খুব…খুব বেশি ভুল ছিল। সময় আসলে ফুরিয়ে যায়। এবং এত দ্রুত ফুরিয়ে যায় যে আপনি টেরও পাবেন না কখন, কিভাবে ফুরিয়ে শূন্যের কৌটায় চলে এলো!

সেদিন সারাটা দিন ওকে আমি আর দেখতে পেলাম না। এত্ত অভিমান? কেমন বাচ্চা! বোকা বাচ্চা! আমার কেন যেন প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে হলো। আবার সব ভেবে পিছিয়ে রইলাম।
সেদিনের মতো ফিরে এলাম, পরদিন যথারীতি ক্লাসে গেলাম। ক্লাস শেষ করলাম। রোহানকে দেখতে পেলাম না। কি আশ্চর্য! এমন কেন করছে? এবার আমার নিজেই রাগ হতে লাগলো। নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে, ও কেন বোঝে না?

একটু খারাপ লাগা নিয়ে মাঠে গিয়ে বসলাম। ঠিক তক্ষুনি আমার ফোনে টুং করে একটা মেসেজ এলো, “মিস করছো?”
আমার রাগ হলো, আবার হাসিও পেল। তবে মুখে রাগটাই স্থান পেলো। কোনো রিপ্লাই-টিপ্লাই না করে বসে রইলাম। এবার কল এলো। আমি রিসিভ করতে বলল, “আই নো, ইউ মিসিং মি।”
আমি জবাব দিলাম, “নো, নেভার-এভার! ইউ আর রং, ইউ আর অ্যাবসোলুটলি রং, রোহান।”
রোহান বলল, “ওকে!”
আমি জানতাম ও ফের রাগ করেছে। এবং এখন ফোন কেটে দিবে। তাই ও ‘ওকে’ বলার সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “এই বেয়াদপ? সামনে আসো। ঢং করবা না একদম।”
রোহান বলল, “আসবো না। কক্ষনো না, জুছি।”
আমার মুখের কাঠিন্য দূর হয়ে গেল। না চাইতে হাসি ফুটে উঠলো। রোহান বলল,
“হাসবে না প্লিজ।”
আমি বুঝলাম ও আমায় ঠিকই দেখতে পাচ্ছে, খালি আমিই দেখতে পাচ্ছি না। বললাম, “তুমি আমায় দেখছো? কই তুমি? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
রোহান বলল, “পাবে না। যতক্ষণ না বলবে, ‘মিস করছো’ ততক্ষণ পাবে না।”
বলেই ফোন কেটে দিল। কি যন্ত্রণা বলুন? আমি এদিক-সেদিক চোখ বুলিয়ে কত খুঁজলাম, দেখতেই পেলাম না!
এমন করে চলল দুদিন। শেষে না পেরে বললাম, “ওকে, আই মিস ইউ। সামনে আসো।”
জাস্ট কয়েক সেকেন্ড এর মাঝে সে এসে উপস্থিত হলো। বিগলিত হেসে বলল, “কেন স্বীকার করতে চাও না কিছু? এমন নিষ্ঠুর কেন?”
আমি খুব কঠিন কন্ঠে বললাম, “এই মূহুর্তে তোমাকে আমার ভীষণ বকা দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু দিব না। কেন জান?”
রোহান খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো, “কেন?”
আমি একেবারেই স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলাম, “কারণ তুমি আস্ত একটা পাগল। পাগল-টাগল বকে কি লাভ বলো?”
রোহান জগৎ খুশি করে দেয়ার মতো আওয়াজে হেসে উঠলো।
ওর শুভ্র শার্ট, ওর গলা, ওর নাকের ডগায় এসে লাগলো মিষ্টি রোদ। ওর চোখে এসে ভর করল একগুচ্ছ মায়া! পাগল পাগল ছেলেটার দারুন সৌন্দর্যে কেঁপে উঠল এক তরুনীর শক্তপোক্ত হৃদয়!…… (চলবে।)

#রয়েছ_হৃদয়ে
#১৪তম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

.
ফাল্গুন মাস তখন। চারদিক কেমন ঝকঝক করা সৌন্দর্য। কাতর হয়ে বলতে ইচ্ছে করতো, এতো মনমাতানো মুগ্ধতায় মাতোয়ারা করে রাখার মতো স্বচ্ছতা কি কেবল সৃষ্টিকর্তা এই প্রকৃতিকেই দিয়েছেন?
আবার এও ভবতাম শুধু প্রকৃতিকে নয়তো, কিছু কিছু মানবকেও দিয়েছেন। যেমন,
যখনই আমি আর রোহান এই বিশাল সৌন্দর্যে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে থাকতাম, সর্বক্ষণ মনে হতো- ছেলেটা এই প্রকৃতির মতোই সহজ-সুন্দর-স্বতঃস্ফূর্ত!
যাকে চোখ সয়ে যায়, তার মতো চমকপ্রদ সৌন্দর্য বোধহয় অন্যকারো সৌন্দর্যকে স্পর্শ করে না, করতে পারে না কিংবা পারলেও মনে সাধ জাগে না। সেই মোহমায়ায় জড়ানো সৌন্দর্য একজনের প্রতি-ই দিনকে দিন বাড়তে থাকে!

তৃতীয় বর্ষে এসে অনুভব করলাম, ছেলেটা আমার ব্যাপারে প্রচন্ড হিংসুটে। কাজে কিংবা অকাজে আমার ধারে কাছে কাউকে সইতেই পারতো না। যদিও রোহান ব্যাতিত কোনো ছেলেদের সাথে আমার তেমন আহামরি সখ্যতা ছিল না। কিন্তু টুকটাক কথা, পড়াশোনারক হেল্প এর জন্য কারো কারো সাথে তো একটু কথা হতোই। এদের মধ্যে ফাহাদ, তারেক, আকাশ ছিল অন্যতম। ফাহাদের সাথে তো কুয়াকাটার সিনক্রিয়েটটার পর আর কথা হয়নি, মূলত ও-ই আমায় এড়িয়ে চলতো, রাগ কিংবা অভিমান যেকারনেই হোক। আমিও আগ বাড়িয়ে বলিনি। আর বাকি রইল তারেক আর আকাশ। ওদের সাথে কথা যতটুকু হতো- ‘এইটি পারসেন্ট’ হতো পড়াশোনা রিলেটেড। এমনই একদিন তারেক আর আমি মিলে একটা পড়া সল্যুশন করছিলাম। কোত্থেকে রোহান এসে তারেকের পাশে বসল। আমি দেখলেও বিশেষ হেলদুল করলাম না। আর তারেক তো নয়-ই। আমাদের কনভারসেশন এ খানিক ছন্দপতন হলেও পুনরায় পড়ায় মননিবেশ করলাম, ডিসকাশন শুরু করতে চাইলাম, পাগলের বুঝি আর সইল না। তড়িঘড়ি করে বলল, “তারেক? তোমায় কে যেন ডাকছে। গেইটের বাহিরে যেতে বলেছে, যাও দেখ, ফ্যাস্ট।”
তারেক বলল, “কে এসেছে? কেউ তো আসার কথা না! আচ্ছা এটা কমপ্লিট করে যাই।”
রোহান কি শোনে কারো কথা? বেচারা ছেলেটাকে যেতেই হলো। একপ্রকার ঠেলেঠুলে পাঠিয়েই ছাড়ল। ও যাওয়ার পর রোহান আমার কাছ ঘেঁষে বসলো।
খুব আলতো করে বলেছিল, “একবার কমিট করবা জুছি? তুমি আমার? শুধুই আমার? তোমার আশেপাশে কেউ থাকলে আমার প্রচন্ড হিংসে হয়, বিশ্বাস করো! সাংঘাতিক ডেস্পারেট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, অস্থির লাগে, ভীষণ পাগলামি করতে ইচ্ছে করে! এত নিষ্ঠুর কেন তুমি জুছি? একটুও কি মায়া হয় না এই অসহায় ছেলেটার জন্য? এই হৃদয়হীনা? বল?”
আমি বরাবরই ভীষণ নিষ্ঠুর। ওর কাছে নিষ্ঠুর হতে আরো একটু বেশি ভালো লাগতো। চোখমুখ শক্ত করে বললাম, “বাচ্চাদের মতো বিহেইভ করবা না, তুমি বাচ্চা নও। ও তোমার কি অসুবিধা করেছে? আমরা ফাজলামো করছিলাম না রোহান। তারেক তোমার মতো ফাঁকিবাজ না, ও পড়ছিল। কেন মিথ্যে বলে তাড়িয়ে দিলা। আর কিসের কমিটমেন্ট, হ্যাঁ? সবসময় বাড়াবাড়ি!”
আমি বহুদিন পর পুরোনো অভিমানে ভরা রোহানকে দেখতে পেয়েছিলাম। রোহান বলল, “আমার সব কাজ, সব কথা, সব কিছুই তোমার উইয়ার্ড লাগে, বাচ্চাদের মতো লাগে, বাড়াবাড়ি লাগে, নাহ? ওকে!”
বলেই চলে যেতে চাইলো। আমি বললাম, “ঢং করে খালি, ঢংয়ের ছেলে একটা! এই ঢংয়ের ছেলে শোনো? ফোর্থ ইয়ারটা ভালোভাবে কমপ্লিট করো, তারপর যত বলবা, তত কমিট করবো, সত্যি বলছি।”
রোহান পেছন ফিরে তাকাল। গুরুগম্ভীর আহ্লাদিত হয়ে বলল, “এখনও থার্ড ইয়ার শেষ হয় নাই, সে বলছে ফোর্থ ইয়ার অব্দি ওয়েট করতে! শোনো মেয়ে? আমি পারবো না। তুমি আমার, আমার মানে আমার, মানো কিংবা না মানো, বাড়াবাড়ি বলো আর যাই বলো।”
আমি বললাম, “জোর করছো?”
রোহান খুব জোড় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তুমি আমার জোড় করা সম্পত্তি। অন্য কাউরে সইতে পারি না, পারবো না!”
আমি মিটিমিটি হেসে বললাম,
“হিংসুটে ছেলে একটা! ছিঃ!”
রোহান মিষ্টি করে হেসে তার অভিমান বিসর্জন দিল, পাঁচ মিনিটের মাথায়। কাছে এসে আঙুল ধরে বলল, “হ্যাঁ, খুব! খুব খুব খুব বেশি হিংসুটে! এই দেখ, হিংসায় জ্বলেপুড়ে রোজ ক’বার মারা যাচ্ছি?”
আমি বললাম, “এহ! হাত ছাড় হিংসুটে রোহান!”
রোহান বলল, “ছাড়বো না। তুমি না আমার জোড় করা সম্পত্তি? ছাড়বো কেন, হু? আগলে রাখবো গোপনে, মায়াভরা যতনে।”
বলেই হাসতে হাসতে হেলে পড়ে। আমি না হেসে পারি বলেন?

ও আলাদা, সবার থেকে আলাদা, অন্যরকম! কেমন যেন মায়া মায়া….!

থার্ড ইয়ার ফাইনালের আগে আগে সেবার ইফাজ আর ফাহাদের বাইক এক্সিডেন্ট হলো। দুজনই খুব আঘাত পেল। আমরা খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে হসপিটাল গেলাম। রোহান পাগল প্রায় হয়ে গেল। ডক্টর যখন বলল, “রক্ত লাগবে।”
রোহান অস্থির হয়ে বলল, “আমার রক্ত নিন ডক্টর। আমাদের তিনজনের ব্লাড গ্রুপ সেইম।”
এর পরের তিন রাত ও সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। সারাদিন মেডিসিন, ব্লাড সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে; নিজেকে কাহিল করে ফেলেও কাউকে এতটুকুও তার ক্লান্তি টের পেতে দেয়নি। হাজার বলেও হসপিটাল থেকে ওকে নড়ানো যায়নি। অন্যকে সুস্থ করতে গিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিতেও যে মানুষ দু’বার ভাবে না, তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় বলেন?
আমি ভীষণ অবাক হয়ে চোখ ভর্তি আহ্লাদ নিয়ে নির্বাক তরুনী হয়ে সবটা দেখলাম খালি। মনের কোণে আরো একটু ভালোলাগা, ভালোবাসা, প্রেমময়তা বৃদ্ধি পেলো বোধহয়!

আসলে কি বলুন তো? ওর খাপছাড়া পাগল পাগল স্বভাবটার সাথে আর যেই জিনিসটা আমায় বেশি আকৃষ্ট করেছে তা হলো, মানুষের প্রতি ওর অকৃতিম মায়া। আমি আর কাউকে দেখিনি এত মায়া দিয়ে যে কাউকে ভালোবাসতে, যে কারো কথা ভাবতে, মানুষের কষ্টে বিচলিত হতে, যে কারো বিপদে নিজের সবটা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে!

ইফাজ আর ফাহাদ সুস্থ হয়ে হসপিটাল ছাড়ার পর সে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। বোধকরি বহুদিন বাদে সে নিশ্চিন্তে খেয়েছিলেন, শান্তির ঘুম দিয়েছিলেন।

পরিদিন, মায়ায় জড়ানো এক হলদে বিকেলে আমার সাথে তার আমোদ ভাগ করে নিতে এলেন। বহুদিন বাদে তার জগত জুড়ানো হাসিতে ভাসিয়ে দিয়ে বললেন, “এই জুছি? আমার এখন খুব শান্তি লাগছে। ইফাজ আর ফাহাদ তো আমার ভাই। খুব ভয় পেয়েছিলাম, জানো? থ্যাংকস টু আল্লাহ্‌ যে, মারাক্তক কিছু হয়নি। ফাজিল দুইটাকে তো আমি খুব ভালোবাসি।”
আমি খালি বললাম, “জানি তো। এও জানি, তুমি নিজের জন্যেও কখনো এত অস্থির হওনি, হবেও না; যতটা অন্যের জন্য হও। নিজেকে নিয়ে অতটা ভাবনা তোমার নাই, যতটা অন্যকে নিয়ে। খামখেয়ালিপনায় ভরপুর অগোছালো ছেলে একটা!”
রোহান কোমল হেসে নিজের স্থান হতে সরে আমার খানিক কাছে এলো। হাতের হলুদ ফুলটা নিয়ে কিছু একটা করতে করতে জবাব দিল, “আমায় নিয়ে আবার কিসের ভয়, কিসের ভাবনা? আই এম সুপার স্ট্রং, আলহামদুলিল্লাহ। জগতের সকল ভয়, সকল ভাবনা তো তোমাদের ঘিরে, তোমায় ঘিরে! কিন্তু সত্যি কথা, তোমায় নিয়ে ভেবে আমি সুখ পাই!”

আমি আকুল হয়ে শুনি ওর কথা। বুঝতে চাই কথার গভিরতা। আমার চতুর্দিক মোহমায়ায় আকৃষ্ট হয়ে থাকে। খুব ভাবাতো ওইসময়টাতে; ওর দূরন্তপনা, ওর সুন্দর কথা, ওর চোখ, ওর হাসি আর ও…..
সেই মুগ্ধতায় ঘেরা ফাল্গুনে আমাদের খুব সংক্ষিপ্ত, টুকরো অনুভূতি জড়ানো আরো খানিক কথোপকথন হলো। হৃদয় কাঁপানো, অন্তর কাঁপানো কথামালা!
রোহান খুব অল্প আওয়াজে বলল,
“হাতটা দাও তো আমার জুছিরানী, তোমায় একটু শক্ত করে বেঁধে রাখি।”
আমি ভাবনা ভেঙে কাটকাট কন্ঠে বললাম, “পারবো না।”
“প্লিজ?”
“উমম..উঁহু।”
রোহান সবসময় যেই কাজটা করে সেটাই করলো। চোখ দুটো ছোট ছোট করে, কাটা ভ্রুটা সামান্য কুঁচকে অন্যদিকে চাইল। বাচ্চা ছেলেমানুষ আহ্লাদ চাইলে যেমন করে তেমনটা! আমার এত হাসি পেল! একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে বললাম, “আহ্লাদের ছেলে একটা, খালি আহ্লাদ করে।”
রোহান নিজেও হেসে ফেললো। বহু কসরত করে এতক্ষণ যাবত ধরে বানানো ফুলের আংটিটা আমার আঙুলে পড়াতে পড়াতে বলল,
“এই যে দেখ?
আমার সব আহ্লাদ আমি, তোমার নামে লিখে দিলাম।
হলুদ ফুলের হলদে মায়ায় তোমায় আমি বেঁধে নিলাম!
সঙ্গে দিলাম আদর আর এক চিলতে মায়া,
ফাগুন আদরে সাজল তোমার মায়া-জড়ানো কায়া!”
এরপর একটু থামল। আমার কপালের ছোট চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে, কন্ঠে অদ্ভুত দরদ ঢেলে বলল, “তুমি ফাল্গুনের চেয়েও বেশি সুন্দর, তুমি আমার ফাল্গুনী, তুমি এই ফাগুনের হলুদ ফুলের মায়া। এন্ড নাথিং ইজ মোর বিউটিফুল দ্যান ইউ, জুছি! ট্রাস্ট মি!”

ওর এই এত এত কথার বিনিময়ে আমি হাসলাম কেবল। বললাম, “নো-ওয়ান ইজ মোর ফ্যান্টাসটিক ম্যান দ্যান ইউ। এক্সেপ্ট আল্লাহ্‌ ইউ আর দ্যা ওয়ান এন্ড অনলি পারসোন হু মেইড মি মোর বিউটিফুল, হু মেইড মি হ্যাপিয়েস্ট গার্ল। আর ইউ ট্রাস্ট রোহান?”
ছেলেটার বুঝি বিশ্বাস হলো না। মোহনীয় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “সত্যি জুছি? সত্যি বলছো? বলো?”
আমি ওর মতন করেই বললাম, “হুম, খুব সত্যি, একশ সত্যি, হাজার সত্যি।”
এরপর? এরপর তার মুখে যেই অসাধারণ সুন্দর হাসিটা ফুটে উঠেছিল, তা আমি লিখে প্রকাশ কি করে করি?
ফ্রেম-বন্দী, স্মৃতি-বন্দী সেই ভয়ানক সুন্দর ফাগুন আমি পুনরায় ফিরে পেতে চাই। কিন্তু কি আশ্চর্য! যা যায় তা যে আর ফিরে আসে না!
…….(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here