রয়েছ_হৃদয়ে #১৫তম_পার্ট

0
1173

#রয়েছ_হৃদয়ে
#১৫তম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
বরাবরের মতই রোহানের থার্ড ইয়ারের রেজাল্টও দুর্দান্ত হলো। এবং রেজাল্ট এর পর সেই আগের মতোই বিদ্যমান রইলো তার ছন্নছাড়া উদাস উদাস স্বভাব। যেন ভালো রেজাল্ট করা পানিভাত! এ তেমন কষ্টসাধ্য কিছুই নয়! দিনরাত না পড়ে আড়ামছে যে ফাটাফাটি রেজাল্ট করা যায় তার পারফেক্ট এক্সামপল ছিল সে।
আমায় বলে, “বুজলে জুছি? লাইফ ইজ ভেরি ইজি। আমরা মানুষরাই শুধু শুধু কমপ্লিকেটেড বানাই।”
আমিও তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, “হুম, তুমি পাগল, তোমার কাছে তো লাইফ ‘সো ইজি’ হবেই!”
রোহান সুন্দর হেসে বলে, “পাগল হয়ে যদি সুখে থাকা যায়, তো আজীবন পাগলই থাকতে চাই।”

লাইফকে খুব বেশিই ইজি করে নেওয়ার কারণেই কিনা জানি না; ফোর্থ ইয়ারের মাঝামাঝি সময় থেকে ও খুব অসুস্থ থাকতে লাগলো। কিছুদিন পরপরই জ্বর, কাশি, ঠান্ডা লেগেই থাকতো। কেয়ারলেস ছেলেটা নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র সিন্সিয়ার না। নিজেকে নিয়ে সে এক সেকেন্ডও ভাবে না। ভালো ডক্টর দেখানোর কথা বললে হো হো করে হাসে! রুগ্ন, মায়াকাড়া মুখটি করে বলে, “শোনো জুছি? রোগশোগ হচ্ছে উপভোগের জিনিস। গরম সিঙারা যেমন আয়েশ করে খাও, এর স্বাদ যেমন উপভোগ করো; অসুখবিসুখ এর স্বাদও তেমন উপভোগ করতে হয়। টেইক ইট ইজি। কাইত হয়ে পড়ে থাকলেই তো মুশকিল। উফফ! তোমরা মেয়েরা অসুখ নিয়ে এতো ঢং করো!”

আমি ব্যর্থ হই, হতাশ হই। ভেবে পাই না, একটা মানুষ ঠিক কোন লেভেলের মাথা খারাপ হলে; সিঙারা খাওয়ার সাথে অসুখকে মিলাতে পারে!

তবে ওর চাঞ্চল্যে তুমুল ভাটা পড়েছে ঐ সময়টায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজী অনেক কমে গিয়েছিল। শুধু আমার সান্নিধ্যই সে কমাতে পারেনি আজন্মকাল!
শরীর ভর্তি জ্বর নিয়েই গরমের মধ্যে শাল পেঁচিয়ে ক্যাম্পাসে আসে। ‘কেন এসেছে জ্বর নিয়ে’ জিজ্ঞেস করলে বলে,
“তোমারে না দেখে থাকতে পারি না। তোমায় না দেখে থাকা; জ্বর আর মাথাব্যথার চাইতেও বেশি কষ্টসাধ্য! কি যে ছাতার জ্বর দুদিন পর পর! মনেহয় যেন জ্বরের পুরো গুস্টি সুদ্ধ সিরিয়াল ধরে আমার প্রেমে পড়া শুরু করেছে। হা হা হা!”

আমি ওর হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি। অসুস্থ একটা মানুষ, হাসলে এমন সুন্দর দেখায় কেন? আশ্চর্য!
উত্তপ্ত শরীরের উষ্ণ হাত দিয়ে মাঝেমধ্যে আমার হাত ধরে। আমি বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলি, “ধরবে না। উদাসিন, খামখেয়ালি পনায় পূর্ণ ছেলেকে আমি মোটেও পছন্দ করি না। সরো….সরে বস! তুমি না সরলে কিন্তু আমি চলে যাব! কথা তো কিছু শোনো না আমার। আসবে না কাছে।”

ও আরো কাছে আসে। নিষেধ অমান্য করে তার ভয়ানক গরম হাত দিয়ে আমার হাত ধরে। ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে একটা গানই বলে,
“বল তুই আমায় ছেড়ে, কোথায় যাবি?
বল তুই আমায় ছাড়া, কেমনে রবি?
তোর পরানে আমার এ মন
বান্ধিয়াছি সারাজীবন,
তোরে ছাড়া বাঁচি না!”

আমি উদাস হয়ে বলি,
“বাসা থেকে খুব জ্বালাজ্বালি শুরু করেছে। আজ এই পাত্র, কাল সেই পাত্র করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। কিভাবে এদের শায়েস্তা করা যায় বলতো রোহান?”
রোহান চোখ বুজে সুনিল আকাশে চেয়ে বলে,
“আমায় বিয়ে করে ফেলো জুছি! খুব ভালো আইডিয়া, না? হুম? আমার থেকে বেশি ভালো তোমায় কেউ বাসতে পারবে না। কক্ষনো না। ট্রাস্ট মি!”
আমি হেসে উড়িয়ে দেই। ওর সব কথার মতোই কৌতুক ঠেকে কথাটা। আমি বলি,
“যাও! ফাইজলামি ভাল্লাগে না সবসময়।”

রোহান আর কিছু বলে না। খুব কাশে। চোখে পানি এসে যায় তার। গলার এক পাশ, চোখের নিচটা ফুলে থাকে প্রায় সময়। তার তপ্ত শরীরের হাত খানা দিয়ে আমার হাত তখনও ধরা। আমার ভীষণ মায়া লাগে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে! অসুস্থতাকে গরম সিঙারা সাথে তুলনা করেও শেষে বোধহয় হার মানে।
বলে, “একটা রিকশা ডেকে দাও তো জুছি। জ্বর বোধহয় আজ ভালো মতোই প্রেমে পড়েছে। যাই একটু বাসায়, একটা ঘুম দিলেই জ্বর মহাশয় তুরতুর করে পালাবে। হা হা!”
জগতে সকল হাসি আল্লাহ্‌ বুঝি ওকেই দিয়েছে! ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীর নিয়েও কেমন মুগ্ধ হাসি হাসে!

আমি তখনই ওকে হসপিটাল নিয়ে যেতে চাইলাম। ওর এই ঘনঘন অসুস্থতা আর হেলাখেলা করতে পারলাম না। ও বলল, এখন যাবে না। বাসায় গিয়ে তারপর যাবে। আমি জোর করলাম, আমার কথা শুনলোই না! খুব রাগ হলো আমার। সমসময় নিজের ইচ্ছায় চলে! নিজেকে নিয়ে নিজেও ভাবে না, অন্যকেও ভাবতে দেয় না। হেসেখেলে সবকিছুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। এ কেমন মানুষ? নিজেকে নিয়ে, নিজের অসুস্থতা নিয়ে এত উদাসিনতা!
এই অসুস্থতার জন্য মাঝের এক্সামটাও ওর খারাপ হলো। ফাইনালের জন্যেও কোনো প্রিপারেশন নিচ্ছিল না। আমি ওকেই দোষ দেই। এতোটা উদাসিন বেখেয়াল হওয়া তো ঠিক না। শরীর, মন সুস্থ রাখতে হবে না?
আমি সেদিন শাসিয়ে বলে দিলাম, আজ যদি হসপিটাল না যায়, ডক্টর না দেখায়, তাহলে যেন নেক্সট টাইম আমার সামনে না আসে। ও প্রমিস করলো যাবে, আজ সত্যি-ই যাবে।

রাতে ফোন করলাম, ও জানালো গিয়েছে। কিছুই হয়নি। জ্বর, মাথাব্যথা এসব হাবিজাবি নিয়ে এত ভাবা নাকি বোকাদের কাজ! কিছুক্ষণ কথা বলে সেদিনের মতো রেখে দিলাম।
এরপরের কয়দিন সাংঘাতিক ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ক্লাস, প্র্যাকটিকেল, পড়ার প্রেশার, এক্সামের টেনশন সব মিলিয়ে নিশ্বাঃস ফেলার ফুরসুরৎ পেলাম না। সামনেই ফাইনাল। কী যে চাপ। রোহানের সাথে কথা হয় না, দেখা হয় না সপ্তাহ ধরে!
ও যে এতদিন আমার সাথে দেখা এবং কথা না বলে আছে তাও এক প্রকার বিস্ময়! কিন্তু আমি তা নিয়ে ভাবলাম না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম। কারণ অসুস্থতার জন্য ওরও তো কত পড়া মিস গেল! ছেলেটা ফাঁকিবাজ হলেও প্রত্যেকবার পরিক্ষার আগে আগে খুব সিরিয়াস হয়ে যায়। এবারও হয়তো তাই হয়েছে! আমাদের বাঁধন ছাড়া সম্পর্ক নিয়েও তেমন ভাবি না। এক্সাম শেষ হলে সব ঠিক করে নিব, বাঁধন ছেড়া সম্পর্কটা খুব শক্ত করে বেঁধে নিব, অমনটাই ভাবি।
আমি বোকা। আমি তো জানি না, সব ভাবনা- ভাবনানুযায়ী হয় না!
ওই সময়টা আমি খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলাম। মাহিরা, শম্পা দুইটা মেয়েই বিয়ে টিয়ে করে পড়াশোনা ছেড়ে দিল। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলো না। বলে, এত পরে-টরে কী হবে?
প্রত্যেকের এক-একটা কাজকর্মে এত বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল যে, আমিও কেমন যেন হয়ে গেলাম। আমার সেই বিতৃষ্ণা বাড়াতেই পাক্কা পনেরো দিন পর রোহান এলো। শরীরে সেই রাশভারী শালটা প্যাঁচানো। মেজাজ তো সাংঘাতিক খারাপ আমার। কথা-টথা কিচ্ছু বলছি না। কতদিন পর ওর হাসি দেখলাম! কিন্তু হাসিটা প্রাণবন্ত নয় কিন্তু। তবুও ওর হাসিতে মায়ায় হারালাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“কেমন আছো রোহান?”
রোহান বলল, “আমি? আমি তো বিন্দাস আছি জুছি। দেখছো না, কত স্ট্রোং? অসুখ-টসুখ সব ফিনিশ। আই এম সুপার-ডুপার ফাইন নাও, স্যি? তুমি কেমন আছো, আমার বিউটিফুল কুইন?”
আমি বলবো না ভেবেও না বলে থাকতে পারলাম কই? মন তো অর্ধেক গলে গিয়েছে তাকে দেখেই। বললাম, “ভালো আছি, তোমার মতো বিন্দাস নাই। পরিক্ষা টেনশনে পাগল ছাড়া আর কে বিন্দাস থাকতে পারে?”

রোহান এরপর একটু চুপচাপ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে, কোনোরূপ ভণিতা ছাড়াই বলল, “আমার একটুও প্রিপারেশন নাই। পড়ায় মন বসে না। তুমি ছাড়া আর কিছু ভাবতেও মন চায় না আজকাল। এতদিন অসুস্থতায় ভুগে এখন একটু রিল্যাক্স করতে মন চাচ্ছে। আমি এক্সামটা দিব না, জুছি। তুমি কি খুব রাগ হবে?”
বিশ্বাস করুন, ওর উপর এর আগে আমার এত রাগ কখনোই হয়নি। আমি খুব রাগ নিয়েই বললাম, “ফাজলামো করো রোহান? প্লিজ ফাজলামো করবা না।”
রোহান বলল, “আমি ফাজলামো করছি না। আমি সত্যি-ই পরিক্ষাটা দিচ্ছি না।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। তুমি আমার সামনে থেকে যাও।”

রোহানের ঘন চুলগুলো দুহাতে উল্টে একটা তপ্ত নিশ্বাঃস ফেললো। বলল, “তাড়িয়ে দিচ্ছো? চলে গেলে থাকতে পারবে?”

আমার তো তখন ভীষণ রাগ। বললাম, “খুব পারবো। কেন পারবো না? তুমি আমায় জ্বালাবে না। প্লিজ যাও।”
আমি তখনও সিক্সটি পারসেন্ট শিওর ছিলাম ও মজা করছে। এক্সাম কেন দিবে না?
ও বলল, “এত জলদি তাড়িয়ে দিও না প্লিজ। আর একটু থাকি? এমনিতেই কতদিন তোমায় না দেখে থাকতে হবে ভেবে কাহিল হয়ে যাচ্ছি। থাকি আর একটু?”
আমি না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “মানে?”
রোহান বলল, “তোমায় বলেছিলাম না, ইন্ডিয়ায় আমার একটা খালা থাকেন? রিল্যাক্স হতে একমাসের জন্য সেখানেই যাচ্ছি। ঘুরবো, ফিরবো, খুব চিল করবো। তুমি তো এক্সাম রেখে যাবে না, তাই তুমি বাদ।”
বলেই ওর সেকি হাসি! যেন দারুন মজার একটা কথা এটা। এই কথা শুনে জগৎ শুদ্ধ সবার হাসা উচিত। প্রয়োজনে হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়ে দেয়া উচিত।
কিন্তু আমি দুঃখ ছাড়া কিছু পেলাম না। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম কেবল।
প্রচন্ড রাগে আমার কান্না পেয়ে গেল। আমার কেন যেন মনে হলো ও জীবনে কোনো কিছু নিয়েই সিরিয়াস না। ইভেন আমাদের সম্পর্ক….!
খালি মুখেই যেন ওসব মায়ার কথা বলে! নয়তো, পরিক্ষার পর করবো ভাবা আমার সব প্ল্যান ও এমন করে নষ্ট করে দিতে চাইতে পারে? বারোদিন বাদে পরিক্ষা আর সে কিনা একমাসের জন্য বেড়াতে যাবে?

আমাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে পরদিনের ফ্লাইটেই সে সত্যি সত্যি ইন্ডিয়া চলে গেল! এমনকি যাওয়ার আগে আমায় জানাল না অব্দি!…….(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here