রয়েছ_হৃদয়ে♥ #অন্তিম_পার্ট

0
2310

#রয়েছ_হৃদয়ে♥
#অন্তিম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.

মৃদুমন্দ শীত পড়া শুরু হয়েছে তখন।
বিকেলের দিকেই চারপাশ কেমন ঘোলাটে হয়ে যায়। সেই সাথে অহর্নিশ ঘোলাটে হয়ে থাকে আমার মন।
রোহান যেদিন গেল, সেদিন থেকে ওর প্রতি আমার আহ্লাদিত অভিমান জন্মালো। প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্তে সেই আহ্লাদিত অভিমান ক্রমশ বেড়েই চলেছিল।
সত্যি বলতে কি, আমার এখন মনেহয় ওকে আমি তেমন করে বুঝতেই পারিনি কখনো! সবসময় সব দায় ওর উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে রাখতাম বলেই হয়তো তাকে সেভাবে বুঝে উঠতে পারিনি! ওর মায়া আর আদরের চাদরে জরিয়ে থেকে এমন স্বভাব হয়ে গিয়েছিল যে ঐ সময়টা ঠিক একলা আমাকে মেনে নিতে পারছিলাম না।
রেজিস্ট্রেশন এর লাস্ট ডেইটের দিনও আমি অধির অপেক্ষায় ছিলাম, ও ঠিক আসবে। পরিক্ষা দিবে। কিন্তু আসেনি।
পরিক্ষা শুরু হয়ে গেল, সবাই পরিক্ষা দিল, খালি ও-ই দিল না! সারাক্ষণ আমায় নিষ্ঠুর বলে আসা ওকেই ভীষণ নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল সেদিন! আমার সব ইচ্ছে আমি সেদিন বিসর্জন দিয়ে ওর প্রতি একমুঠো অভিমান পুষে নিয়েছিলাম!

একমাসের বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও ওর বিষয়ে কোনো খোঁজখবর নিলাম না। ইভেন, ওর সাথে কন্ট্রাক্টও করিনি, করার চেষ্টাও করিনি।
ওর বন্ধুগুলোকে এড়িয়ে চলেছি, তাঁরা কিছু বলতে চাইলে তাও খুব কঠিনভাবে এড়িয়ে গিয়েছি!
আমার এক্সাম, প্র্যাকটিকেল সব শেষ হলো। এক্সাম শেষে আমি খুব একাকীত্বে ডুবে গেলাম। ওকে ভাবিনি তা কিন্তু নয়, তবে ঐ যে অভিমান! ঠিক করলাম, বাসায় চলে যাব। যেদিন চলে যাব তার আগের দিন ইচ্ছে হলো ই-মেইল চেক করতে। করলামও তাই।
ই-মেইলে চেক করতে গিয়ে সেখানে ছেলেটার একটা ই-মেইল পেলাম।
“জুছি?
‘লক্ষ-কোটিবার সাধ জাগে তোমায় দেখার!
আই মিস ইউ।’
মাইনুল হাসান রোহান।
সোমবার, রাত তিনটা বিশ মিনিট।”

ছোট্ট একটা মেইল, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কেমন যেন লাগলো! এবং ই-মেইলটা আরো পনেরো দিন আগের! ঊনত্রিশ নভেম্বরের। আর এরপরের এতগুলো দিনে আর কোনো মেসেজ, ই-মেইল কিচ্ছু করেনি কেন তা ভেবে; অবুঝ মেয়ের মতো দুঃখ অনুভব করলাম। ওর সাথে যোগাযোগ করবো, সেই উপায়ও ছিল না। তার ওখানকার নাম্বার আমার কাছে নেই, তার ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সব ডিয়েক্টিভেট, বন্ধ পেলাম!
সারারাত ঘুম হলো না! খালি ইচ্ছে হলো ওকে একবার দেখতে পেতাম!

সেদিন সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে সারাদিন ঘুমালাম। বাড়ি ফেরা আর হলো না।
শেষ বিকেলে উঠে আছরের নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে সবে বসেছি, আমার ফোনে একটা মেসেজ এলো,
“জুছিরানী? একটু হোস্টেল থেকে বের হবা? প্লিজ?”
রোহানের মেসেজ। আমার যেন বিশ্বাসই হলো না। কত্তদিন পর! অন্যরকম অনুভূতি হলো। ভালোলাগা, রাগ, অভিমান সংমিশ্রণে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি! ফিরতি মেসেজে পাঠালাম, “না।”
রোহান সঙ্গে সঙ্গে কল করলো। এটা ওর পুরোনো স্বভাব। যখনই আমি তার মেসেজে নেগেটিভ রিপ্লাই করি, তখনই সে এমন করে।
আমি কল ধরে চুপ করে রইলাম। ও অন্যরকম করে বলল,
“প্লিজ…..প্লিজ জুছি! একটু আসো! জাস্ট…..জাস্ট দুই মিনিট! আমি তোমায় না দেখে আর থাকতে পারছি না!”

ওর কথা, ওর টান, ওর আবদার উপেক্ষা করার সাধ্য আমার কবেই বা ছিল? ওর উপর রেগে আমি কতক্ষণ-ই বা থাকতে পারি?

পাঁচটার পর হোস্টেলের বাহিরে যাওয়া যায় না। কঠিন নিষেধাজ্ঞা! পাঁচটা বাজতে বেশি সময় বাকিও নেই। তবুও আমি সবটা ম্যানেজ করলাম। এর মাঝে ওর আরো একটা মেসেজ পেলাম,
“প্লিজ…আসো! আমার খুব অস্থির লাগছে। আমার কাছে এসে আমায় খুব বকো, ট্রাস্ট মি, সব সয়ে নিব। তবুও একটু আসো, একটুখানি দেখি!”

আমি কখনোই রোহানের খুব জোড়াজুড়িতে অভ্যস্ত না। একটা শাল পেঁচিয়েই হল সুপারকে ম্যানেজ করে বেড়িয়ে এলাম।

ফিনফিনে শীত। একটু একটু কাঁপছি। আগের দিনের দেয়া কাজল চোখে ল্যাপ্টানো।
আমি গেইট থেকে বেরিয়ে একটু আগালাম। কুয়াশা ছুঁতে চাওয়া শেষ বিকেলটায় আধো আধো দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম, সবসময় ও আমার জন্য যেখানে অপেক্ষা করে ঠিক সেখানেই, হোস্টেল থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে।
আমি আরো একটু আগালাম। জানি না, ঐদিনের মতো বিস্মিত এর আগে কখনো হয়েছি কি-না! আমার মনে পড়ে না।
রোহান…রোহানকে চেনাই যাচ্ছিল না। মাত্র মাস খানেকের মাঝে একটা মানুষের এমন পরিবর্তন?
মাথায় চুল নেই, চোখের নিচে কালি! মনে হলো কত রাত ঠিকঠাক ঘুমায় না, ঠিকঠাক খায় না! মাত্র দুই কেজি ওজন হ্রাস পাওয়ার চিন্তায় যে ছেলে আমার কাছে করুন কন্ঠে দুঃখ প্রকাশ করেছিল; মনে হলো এই ক’দিনে তার বিশ কেজি ওজন কমে গিয়েছে! আমার ব্যক্তিগত বলিষ্ঠ তরুন-টাকে কেমন যেন অচেনা মনে হলো!
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। আমার বিস্ময় কাটে না কিছুতেই! রোহান তার কেশহীন মাথাটাতে অস্বস্তিকর হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“দেখ, মায়ের কান্ড! চুলগুলো সব ফেলে দিল! এত করে নিষেধ করলাম, শুনলোই না! উইয়ার্ড লাগছে, না?”
আমি চুপ হয়ে কেবল কিছু সময় ধরে ওকেই দেখলাম। বিশ্বাস করুন, আমার মনে তখনও কোনো আশংকার দানা বাঁধেনি! আমি বোধহয় ওর চাইতেও বেশি উদাসিন, খামখেয়াল! ও তো আমার প্রতি কখনো উদাসিন ছিল না, কিন্তু আমি বোধহয়……!
অসম্ভব মায়া হলো আমার। ও তো একটা মায়ার ছেলে, তাই হয়তো! বললাম,
“এই ছেলে? কি সমস্যা? এই হাল কেন করেছ নিজের? এত কেন ভাবাচ্ছো আমায়?”

ইশশ! কতদিন পর ওর হাসি দেখলাম! আচ্ছা? মানুষ পাল্টে গেলেও কি তাদের হাসি পাল্টায় না? এমন নিখুঁত, অম্লান, সুন্দর, মায়া মায়াই থেকে যায়?

ও একটু কাছে এলো। আমি দেখলাম। মুখটা কতখানি শুকিয়ে গিয়েছিল! বলল,
“আমায় তুমি ভাবো জুছি? আমি তোমায় ভাবাই? আমায় মিস করেছিলে? বলো, কতখানি? আমি তোমায় ভয়ংকর মিস করেছি। দম বন্ধ লেগেছে। তোমায় না দেখে থাকতে পারি না আমি, আমার ভীষণ কষ্ট হয়।”
আমার মনের সবটুকু দরদ দিয়ে সেদিন ওকে অনুভব করেছি আমি।
আবেগ দিয়ে বলেছিলাম, “মিথ্যা। এইটুকুও মিস করোনি! সত্যি যদি হতো, এত্তোগুলো দিন থাকলে কেমন করে?”
ও আমার হাতটা ধরে বলল, “সত্যি। খুব সত্যি মনে করেছি তোমায়। তুমি বুঝবে না। যদি পারতাম, উড়াল দিয়ে চলে আসতাম। মানুষ চাইলেই যখন-তখন সবকিছু যে পারে না!”

তারপর আমার হাতটা তার বুকে ঠেকিয়ে বলল, “দেখ? এখন কেমন, সুখ লাগছে! দুঃখের বুকে সুখ ঠেকেছে, দেখ আমার জুছিরানী!”

এরপর খানিক নিরবতা। হেমন্তের ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যায় আমাকে, আমার মনকে, আমাদেরকে। ঘোলাটে হয় চারপাশ, ঘোলাটে হয় রোহানের কন্ঠ। ছেলেটা এমন নিষ্ঠুর মায়া কি করে লাগাতে পারতো, বলতে পারেন?

আমার যেন কেমন লাগল। ঠিক তখনই হুট করে মনে হলো, এই ছেলেটাকে আমি খুব ভালোবাসি, খুব বেশি! ও যেমন বারবার করে বলে, তোমায় না দেখে থাকতে পারি না জুছি! আমারও বলতে ইচ্ছে হলো,
‘আমিও তোমায় না দেখে থাকতে পারি না রোহান। আই মিস ইউ এভ্রি মোমেন্ট! খালি বুঝি না, বোঝাতে পারি না, বলতে পারি না–ঠিক কতটা তোমায় মিস করি! তোমার মতো বলতে না পেরে আমায় ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই যে দেখ?’
কিন্তু তা বললাম না। বললাম অন্য কথা। তখন আমার কী হলো জানি না। ওই জীর্ণশীর্ণ, রোগে কাতর ছেলেটায় মোহিত হয়ে বলে ফেললাম,
“আমায় বিয়ে করে ফেলো তো রোহান! তুমি পুরো আমার হয়ে যাও! একটা পাগল নিজের করে বেঁচে যাই!”
আমি দেখলাম রোহানের হাত কাঁপছে, কাঁপছে ঠোঁট! জোরে জোরে দুই-তিনবার শ্বাস নিয়ে বলল,
“তোমায় একবার জড়িয়ে ধরবো জুছি?”
আমি ওর মুখ, ওর চোখ আর ওর আশ্চর্যরকম মায়াটা দেখলাম।

আমার পারমিশনের অপেক্ষা করল না ছেলেটা। জড়িয়ে ধরল আমায়। আমি ওর সমস্ত শরীরের কম্পন অনুভব করলাম। অনুভব করলাম, ঘনঘন নিশ্বাঃস! কেমন করে যেন বলল,
“তুমি আমার আজন্ম আফসোস, অতৃপ্ত মধুময় সুখ হয়েই রয়ে গেলে! তুমি আমার অসম্পূর্ণ এক গল্প হয়েই রয়ে গেলে জুছি! তোমায় আমার হাজার জনম ভালোবাসা হলো না!
তুমি আমার কল্প; কল্পনাতেই রয়ে গেলে জুছি। বারবার বহুবার তোমার প্রেমে আর পড়া হলো না! তোমার কাজল, তোমার খোলা চুল, তোমার হাসি আর সমস্ত তোমাকে বুঝি মুগ্ধ নয়নে আর দেখা হলো না! আমার জুছিরানী….তোমায় ঠিক আমার করে পাওয়া হলো না!”

আমি অনুভব করলাম আমার কাঁধে ওর চোখের পানি পড়ছে। ওর বুকের ধুকপুকানি থেমে থেমে কাঁপছে! ওর শার্টের ঘ্রান, ওর বাহুর বাঁধন, ওর তপ্ত নিশ্বাঃস আর আমি! আমি নির্বাক, নিশ্চুপ, বিস্ময়ের সাগরে ভাসছি! জিজ্ঞেস করছি না, কেন এমন বলছে। আঁচ করতেও পারছি না, কী হতে যাচ্ছে!
ইশশ, এমন উদাসিন, এত খেয়ালহীন কেন হলাম? নয়তো তাকে আমার করে আরো কিছু সময়…..
রোহানের ফোনে ফোন এলো। ছেলেটা তবুও আমায় আরো কিছুক্ষণ ধরে রইলো। তারপর ছেড়ে দাঁড়াল। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। ওর হাতে ক্যানোলার দাগ তখনই চোখে পড়লো।
অমন রুগ্ন প্রেমময় ছেলেটার প্রেমে আমি আজন্মের বাঁধনে বেঁধে গেলাম, সে জানলোও না!
ফোন রিসিভ করে বলল, “আসছি।”
ফোন রেখে সে তাঁর শীতল হাতটা আমার গালে রাখল। থেমে থেমে বলল, “যাচ্ছি আমি! ভালো থাকবে, মাই বিউটিফুল কুইন। এই দুনিয়ার সকল সুখ তোমার হোক!”

কাক ডাকা ঘোলাটে, অস্বচ্ছ শীতল সন্ধ্যায় ছেলেটা হারিয়ে গেল দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে; আমি নির্বাক, নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে কই যেন হারালাম!

ওই বিশ মিনিট, বিশ মিনিটের প্রতিটা মূহুর্ত আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। কী হয়েছিল, আমি ভাবতে পারি না।
ওর সাথে কেউ বোধহয় এসেছিল, ওকে নিয়ে। হয়তো দূরে ছিল, সময়টাও কি বেঁধে দিয়েছিল তাঁরা? আরো কিছুক্ষণ থাকতো যদি ও…..!
রোহান চলে গেল, হারিয়ে গেল, আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম।
হোস্টেলে ফিরে কারো সাথে কথা-টথা বললাম না! আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছিল। ঘুমিয়েও গেলাম।

পরদিন আমার জীবনে এক নিষ্ঠুর, বিভৎস, ভয়ংকর সকাল এলো।
সকাল দশটায় ঘুম ভাঙল। এগারোটা বাজে আমাকে জানানো হলো কারা যেন আমার খোঁজে এসেছে। রোহান ছাড়া তো আমার খোঁজ করার এখানে কেউ নেই। কে এসেছে? রোহানই কি? একটু খুশি একটু শংকা নিয়ে আমি বাহিরে এসে দেখতে পেলাম, ইফাজ আর রাহাত। কেমন মলিন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ! ওরা বলল,
“তারিন? আমাদের সাথে চলো তো।”
আশ্চর্যের বিষয়, আমি জানতেও চাইলাম না, কোথায়, কেন!
ইফাজের বাইকে উঠলাম আমি।
ওরা প্রথম হসপিটালের দিকে যেতে লেগেও গেল না। মাঝপথ থেকে গন্তব্য পরিবর্তন করল। ইফাজের ফোনে একটা ফোন এলো। ও বাইক থামিয়ে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কি বলল, জানা নাই। একবার আমার দিকে চাইলো। তারপর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে পথ পাল্টালো। আমি কিছুই জানতে চাইছি না। যোহরের আযান ভেসে আসছে চারদিক থেকে। আমার মনটা কেন যেন খুব হু হু করে উঠলো। মনে হলো আমার কাঁদা উচিত!

ঘন্টাখানিক এর ভেতর রোহানের বাড়ির সামনে এসে বাইক থামলো। কত মানুষ! কিছু মানুষ আমার চেনা, ক্যাম্পাসের। তাঁরা কেমন করে যেন চাইলো! কেউ কাঁদছে। কেউ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পরিবেশটা আমার একটু ভালো লাগলো না। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এই প্রথম আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“আমায় এখানে এনেছ কেন তোমরা? এখান থেকে নিয়ে চলো। এত মানুষ, আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ! রোহান কই? রোহান কী আছে এদিকে? ও আসতে বলেছে সবাইকে? আজ কি আছে? ওঁরা সবাই কাঁদছে কেন?”
ইফাজ কেঁদে ফেলল। ঝড়ঝড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ভিতরে যাও তারিন। আমি কিছু বলতে পারবো না, প্লিজ।”
এত কান্নার আওয়াজ। কী যে যন্ত্রনা লাগলো!
পুরোনো ধাচে বানানো খুব সাধারণ বিল্ডিং এর বাড়িটার সামনে মাঝারি অক্ষরে লেখা ‘রোহান মঞ্জিল!’
আমি ভেতরে গেলাম। রায়হান দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ছিল। চোখ ফুলে রয়েছে। আমায় দেখতে পেয়ে কাছে এসে দাঁড়াল। চোখ থেকে টপ টপ করে অশ্রু গড়াচ্ছে! আমার অবাক লাগলো সবকিছু। বললাম, “কাঁদছ কেন, রায়হান? পাগলটা কই?”
ও খালি বলল,
“আপু….আমার ভাইয়া….!”
পাশের রুম থেকে করুন কান্না ভেসে আসছে। রোহানের মা! কেউ কেউ শান্তনা দিচ্ছে তাঁকে।

আমি তখনও অদ্ভুত শক্ত। কোনোরূপ অনুভূতি হচ্ছিল না। খুব শান্ত, স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,
“ও কি খুব বেশি অসুস্থ রায়হান? কত করে বলেছি জান? আমার কথ্য শোনেনি, এত কেয়ারলেস ছেলেটা! ভালো ডক্টর দেখাচ্ছে না, না? ওকে একটু ডাক তো, খুব বকি। ফাজিল ছেলে একটা! মা কেমন করে কাঁদছে, ওর কি মায়া হচ্ছে না? ডাক না প্লিজ?”
রায়হান ভাঙা কন্ঠে বলল,
“কেমন করে ডাকবো আপু? কেমন করে ডাকলে বলো ফিরে আসবে ভাইয়া?”
রায়হান আমার সামনে থেকে সরে গেল। ওর আর বলার কিছু ছিল না বোধহয়। নাকি পারছিল না?

একজন অচেনা মধ্যবয়সী মহিলা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে যাচ্ছিল, আমায় দেখে দাঁড়াল। একটা দীর্ঘশ্বাঃস ফেলে বলল,
“তুমি মাইনুলের কী হও মা? আহারে এত ভালো পোলাডা।! শুনলাম ক্যামো-ট্যামো দিয়া গতকাইল ভোরেই ইন্ডিয়া থেইকা আইছে। আর কয়ডা ক্যামো দিলেই নাকি ক্যান্সার ভালো হইয়া যাইতো। কির থেইকা কি হইয়া গেল! আহারে! তুমি ওর কী হও মা?”

আমার মনে হলো আমি খুব জঘন্য, বিভৎস একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি! কি সব উদ্ভট ঘটনা ঘটছে, একেরপর এক! এরা সবাই কেমন আজেবাজে কথা বলছে।

যেই ছেলেটাকে বলতেই পারলাম না তাকে কত ভালোবাসি, কত মায়া, কত টান তাকে ঘিরে; সে কি-না নাই! কী ভয়ংকর মিথ্যা কথা!
আমার বিশ্বাস এক্ষুনি এই দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাবে। পাগল, কেয়ারলেস ছেলেটা পুরো দুনিয়ার সবচাইতে সুন্দর হাসিটা দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। ঠোঁট উল্টে বলবে,
“উঃ জুছি! তুমি কেমন বাচ্চাদের মতো স্বপ্ন দেখে ভয় পাও! ইশশ…বোকা!”

আমি ওর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওর রুম, ওর শার্ট! কাল কী এই শার্টটাই পরে গিয়েছিল? আমি হাতে নিলাম। ওর গায়ের ঘ্রান! ওর কী সুন্দর একটা ছবি টেবিলের উপর…হাসছে! আমার একটা ছবি ওর একটা বইয়ের উপর…কত পুরোনো! কই পেল এই ছবিটা?

আমি ওর সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি, শুধু ওকেই ছুঁতে পারছি না। পাশে একটা ডায়রি। তার উপরে লেখা, ‘আমার সকল না বলা কথা, আমার সকল অসম্পূর্ণ সুখ আমি তোমায় দিলাম জুছি! যত্ন করে রেখে দিও, প্লিজ।’
ডায়রিটা কাছে নিয়ে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। যেন ওর মতোই হারিয়ে না যায়!

বাহির থেকে কিছু কথা ভেসে আসলো, “লাশ দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হবে, কারো দেখার থাকলে দ্রুত দেখে নিন! লাশ এতক্ষণ রেখে দেওয়া ঠিক না।”
উফ! কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর প্রতিটা শব্দ!
রুমে কান্নার আওয়াজ আরো গাঢ় হলো। আকাশ, বাতাস ভারী হয়ে এলো। আমার দম বন্ধ হয়ে এলো।
এরপর আমার আর কিছু মনে নাই। ভাবতে পারি না। মনে করতে পারি না!

পরিশিষ্ট:-
রোহানের লিওক্যামিয়া হয়েছিল। ওর অবহেলায় বাসা বেধে ফেলেছিল ভয়ংকর রোগটা। টেস্ট করে জানতে পারার পরপরই ওর পরিবার ওকে নিয়ে ইন্ডিয়া যায়। আর আমায় কিনা ছেলেটা বলেছিল…!

ইন্ডিয়া গিয়েও টেস্ট করায়, পজেটিভ আসায় ট্রিটমেন্ট শুরু করে যত দ্রুত সম্ভব, ক্যামো দেয়।
একটু সুস্থ হতেই দেশে ফিরে আসেতে চায় রোহান। ওর পরিবার চেয়েছিল আরো একটু সুস্থ হয়ে ফিরতে। ওর জোরের কারণেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়। আবার কিছুদিন বাদে যাওয়ার কথা থাকলেও সেই কথা আর সত্যি হলো না। আমি বোকা, কিছু তো জানতেই পারিনি ততদিনেও! কেমন দূর্ভাগা, কেয়ারলেস দেখুন!
মিছে অভিমানে- শেষ সময়টায় আপন করে রাখতে জানলাম না।
আমার সাথে দেখা করে সেদিন বাসায় ফিরলো। মাঝরাতে হুট করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। হসপিটাল নিয়ে গেল ওকে। সকালে সব মিথ্যে করে চলে গেল, হারিয়ে গেল।
ও জানতেই পারলো না ওকে ছাড়া কতখানি শূন্য আমি!
ওর সেই কান্না, ওর সেই কথা, ওর স্মৃতি, ওর মুখ, ওর হাসি আর ওর পাগলামির স্মৃতি আমায় ঘুমাতে দেয় না।
একা যখন বসে থাকি, মনে হয় এই বুঝি পাগলটা এসে বলে,
“ইশশ জুছি! তুমি এতো ঢং শিখে গিয়েছো! আমি ক’দিন লুকিয়ে থেকে দেখলাম, আমায় ছাড়া কেমন থাকতে পারো! এই দেখো চলে এসেছি! আর ঢং করো না তো! এত ভালোবাসো আগে বলোনি কেন? তাই তো এমন পানিশমেন্ট পেলে। তোমার পানিশমেন্ট শেষ, দেখ আমি চলে এসেছি। হা হা হা! হাতটা একটু ধরো, আর একটুখানি হাসো তো মেয়ে। তুমি হাসলে অন্যরকম লাগে। তোমার হাসি জগতে সবচাইতে সুন্দর হাসি। কেমন যেন…!”

আমার জীবনের এই দুঃস্বপ্ন ভাঙে না। এই বিবর্ণ, করুন, নিষ্ঠুর জীবনের ভার বয়ে বয়ে মরে যাচ্ছি, আমার মানুষটা আসে না! সেদিন সেই প্রথম দিন যেমন করে এলো, অমন করে হারিয়ে গেল।
আমায় বেশিদিন না দেখে থাকতে পারা ছেলেটা কতদিন না দেখে আছে! দেখা দেয় না, ধরা দেয় না। মিথ্যাবাদী ছেলে আমায় ছেড়ে কেমন মজায় চলে গেল!
আহ! বেঁচে থাকা কী নিদারুন কষ্টের! হৃদয়ে জমে থাকা সুন্দর স্মৃতিগুলোর ভার বয়ে বেড়ানো কত যে কষ্টের, কেমন করে বলি? গলায় আটকে থাকা রুদ্ধশ্বাস কান্না আমি কাকে শোনাই!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here