উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৯

0
3296

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৯
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে বাজার করার জন্য নাফিসা বাজারের দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ দেখলো শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ইকো রিসোর্ট থেকে মেঘ বেরিয়ে আসছে। তার মানে সে এখানে উঠেছে! কারো বাড়িতে যায়নি!
মেঘও নাফিসাকে দেখে থেমে গেলো। মুচকি একটা হাসি দিয়ে নাফিসার কাছে এসে পাশাপাশি হাটতে লাগলো।
– এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো?
– আপনাকে জানাতে বাধ্য নই।
– আচ্ছা, জানাতে হবে না। সাথে গেলেই দেখতে পাবো।
– সাথে যেতে পারবেন না। বাজারে যাচ্ছি আমি।
– বাজারে কেন?
– বাজারে কেন যায় সেটা জানেন না! খাবার খেতে জানেন? খাবারটা তৈরি করতে অনেক উপকরণের প্রয়োজন হয়। আর সেগুলো বাজার থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। আমিও সেজন্যই যাচ্ছি।
– অনেক ভালো বুঝাতে পারো তুমি। শিক্ষিকা হলে মানাবে দারুণ। ভবিষ্যৎ নিয়ে কি প্ল্যান আছে?
– এতো কথা বলেন কেন আপনি? আর আমার সাথে সাথে কেন আসছেন?
– আমিও তো বাজারে যাবো, তাইতো একসাথে যাচ্ছি।
– আপনি কেন যাবেন?
– কেন আবার! বাজার করতে!
– রান্না করে খান আপনি?
– না, তোমার সাথে বাজার করবো।
– সরে দাড়ান। সরে দাড়ান! যেখানে ইচ্ছে যান। কিন্তু আমার সাথে আসবেন না আপনি।
নাফিসা দ্রুত পায়ে হেটে যাচ্ছে, মেঘও হেসে তার সাথে সমান তালে যাচ্ছে। বিরক্ত লাগছে নাফিসার, তবুও কিছু বললো না। বললেই কি হবে! শুনবে না একটা কথাও! বাজারের পাশেই মেঘ মসজিদ দেখতে পেল। নাফিসা নিজের ইচ্ছে মতো বাজার করেই যাচ্ছে। মেঘ সাথে সাথে ঘুরছে। বাজারে বেশিরভাগ বিক্রেতাই মহিলা। এই অঞ্চলে কর্মস্থলে পুরুষদের চেয়ে মহিলা ই বেশি দেখা যায়। তাদের ভাষা বাংলা হলেও একটু অন্যরকম। মেঘ লক্ষ্য করলো, নাফিসা বিক্রেতাদের সাথে তাদের ভাষায়ই কথা বলছে। কিন্তু মেঘের সাথে ও তার মায়ের সাথে স্বাভাবিক ভাষায় কথা বলে। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে অন্ধকার হয়ে আসছে। বৃষ্টি হতে পারে, তাই নাফিসা তারাতাড়ি বাজার করা শেষ করলো। বাজার করার পুরোটা সময়ই মেঘ নাফিসার সাথে সাথে ঘুরলো।
বাজার থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে রওনা দিতেই পথে নামলো বৃষ্টি। কোনো আবাস না দিয়েই একাধারে ঝপাঝপ বৃষ্টি নেমে গেলো। নাফিসা দৌড়ে একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় চলে এলো সাথে মেঘও।
– ওফ! এতো সকাল সকাল বৃষ্টি!
– মেঘলা দিনে ছাতা নিয়ে বের হবে না! এখন বাসায় যাবে কিভাবে?
– আপনি সাথে না এলে হয়তো এখন বৃষ্টি শুরু হতো না!
– মানে! আমার সাথে বৃষ্টির কি কানেকশন!
– মেঘ থেকেই তো বৃষ্টির সৃষ্টি হয়! মাটিতে মেঘকে হাটতে দেখে আকাশের মেঘের হিংসে হয়েছে তাই বাসায় যাওয়ার সময়টুকুও দিলো না!
নাফিসার কথা শুনে মেঘ হাহাহোহো করে হেসে উঠলো।
– দারুণ বলেছো! কিন্তু বৃষ্টি তো কুমিল্লায়! এখানে এসে পড়লো কেন হঠাৎ!
– মানে?
– আকাশের বৃষ্টি না, আমার বোনের কথা বলছিলাম। ওর নামও বৃষ্টি। মেঘের প্রতি হিংসুটে!
– হুহ! কি অদ্ভুত নাম! ভাইয়ের নাম মেঘ! বোনের নাম বৃষ্টি! আপনার বাবার নাম কি আকাশ আর মায়ের নাম কি ভূমি নাকি?
– হা হা হা….. হলে পারফেক্ট হতো। কিন্তু আফসোস! উনাদের বাবা মা সেটা রাখেনি! আমার বাবার নাম রায়হান চৌধুরী আর মায়ের নাম মোহিনী চৌধুরী।
– মোহিনী নামটা খুব সুন্দর।
– আচ্ছা! আর মেঘা নামটা?
নাফিসা আর কোন জবাব দিলো না। দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। বৃষ্টি থামার বদলে যেন আরও বেড়ে চলেছে! মেঘের কাছে বৃষ্টিটা খুব ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে ভিজতে! না, শুধু শুধু ইচ্ছে দমিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না! পকেট থেকে ফোন আর ওয়ালেট বের করে নাফিসার সামনে ধরলো। নাফিসা কিছু না বুঝতে পেরে মেঘের দিকে তাকালো।
মেঘ হেসে বললো,
– এগুলো রাখবে একটু তোমার কাছে?
– কেন?
– একটা কাজ আছে, কাজটা শেষ হলে ফেরত নিয়ে নিবো।
– সরি, আমি রাখতে পারবো না।
– বৃষ্টিতে ভিজবো আমি। এগুলো ভিজলে নষ্ট হয়ে যাবে।
– এখন আপনি বৃষ্টিতে ভিজবেন!
– হুম। মুহুর্তটা ভালো লাগছে খুব। সুতরাং অবহেলা করার মানে হয় না! ইচ্ছেমতো উপভোগ করাটাই শ্রেয়!
মেঘ কথাগুলো চমৎকার বলে! নাফিসা মেঘের সময়টা আর নষ্ট না করে ফোন আর ওয়ালেট হাতে নিয়ে নিলো। মেঘ প্যান্ট ফোল্ড করে দোকানের বারান্দা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো আর বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। চোখের পাতা বন্ধ করে আকাশ পানে মুখ করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলো মেঘ। এদিকে এখন না আছে কোন যানবাহন আর না আছে কোন লোকজন! অন্যরকম এক ভালো লাগা! অন্যরকম এক অনুভূতি! নাফিসা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো বৃষ্টিতে ভেজা মেঘকে। অজান্তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মেঘ নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা তার দিকেই তাকিয়ে আছে! মেঘ দুহাত মেলে হাতে বৃষ্টির পানি জমা করলো। অত:পর দু’হাতের পানি নাফিসার দিকে ছুড়ে মেরে হেসে বললো,
– ভিজতে ইচ্ছে হলে চলে এসো।
মেঘ তাকে এভাবে পানি ছিটিয়ে দিবে নাফিসা ভাবতেও পারেনি! মেঘকে ভিজতে দেখে তারও ইচ্ছে হচ্ছিলো বৃষ্টিতে ভেজার। কিন্তু হাতে বাজারের ব্যাগ আর মেঘের ফোন ও ওয়ালেট থাকায় মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে উত্তরে মেঘকে “না” জানালো। মেঘ আবার বললো,
– ব্যাগের জন্য আসতে পারছো না? ফোন আর ওয়ালেট তোমার বাজারের ব্যাগে রেখে ব্যাগটা শাটারের সাথে ঘেঁষে মাটিতে রেখে আসো।
নাফিসা মেঘের বলা কথাটা মনে করলো, ” মুহুর্তটা ভালো লাগছে খুব। সুতরাং অবহেলা করার মানে হয় না! ইচ্ছেমতো উপভোগ করাটাই শ্রেয়!” এক মিনিট পর তাই করলো সে। বারান্দা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো ভেজার জন্য। মেঘ রাস্তায় জমা পানির সাথে খেলা করছে। নাফিসা আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বুজে ঝুমঝুম বৃষ্টি উপভোগ করছে আর দুহাত মেলে হাতে বৃষ্টির পানি জমা করছে। মেঘ মুগ্ধ হয়ে নাফিসার দিকে তাকিয়ে আছে! সাথে আছে মন ভোলানো মুচকি হাসি! নাফিসা চোখ খুলে মেঘের দিকে তাকাতেই সেই হাসিটা দেখতে পেল। চোখ খুলে তাকাতে দেখে মেঘ তার মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। নাফিসাও মেঘকে পানি ছিটিয়ে দিলো, আবার মেঘ দিলো আবার নাফিসাও দিলো। এভাবে চার পাচ বার ছিটানোর পর মেঘ আবার দিতে গেলে থেমে গেলো। পানি ছিটাতে ছিটাতে নিজেদের অজান্তেই তারা একে অপরের কাছে চলে এসেছে! মেঘ তার হাতের পানি নাফিসার মাথায় দিলো আর তা কপাল, নাকমুখ বেয়ে সারা অঙ্গ স্পর্শ করে মাটিতে পড়লো! মেঘ আলতো করে দু’হাতে তার মেঘার মুখখানা স্পর্শ করলো। নাফিসা মেঘের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে। মেঘ তার ঠোঁট জোড়া এগিয়ে তার মেঘার কপালে আলতো করে চুমু একে দিলো। সাথে সাথে মেঘার সমস্ত শরীরে এক তরঙ্গের সৃষ্টি হলো। এ কেমন স্পর্শ! এ কেমন অনুভূতি! এই প্রথম কেউ তাকে এক ভিন্ন অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়েছে! মেঘা শিউরে ওঠে দু’হাতে মেঘের শার্ট খামচে ধরলো! মেঘ দু’হাতে মেঘার মাথা ধরে কপালের সাথে কপাল আর নাকের সাথে নাক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে বৃষ্টির পানি দুজনের মাথা স্পর্শ করে টুপটাপ মাটিতে পড়ছে। দুজনের ভেতরটা উথালপাতাল হয়ে আছে। মেঘ এভাবেই দুতিনমিনিট দাড়িয়ে থেকে মাতাল সুরে বললো,
– ভালোবাসি। ভালোবাসি মেঘা। খুব ভালোবাসি মেঘা।
নাফিসা মেঘের শার্ট ছেড়ে মেঘকে ছাড়িয়ে মেঘ থেকে একটু দূরে সরে গেলো। এতোক্ষণ সে কোথায় ছিলো তার নিজেরও জানা নেই। তবে এটা খুব ভালো জানা আছে, এই মানুষটা তাকে অন্য একটা জগতে নিয়ে গেছে। নাফিসা আবার বারান্দায় চলে এলো, সাথে মেঘও। বৃষ্টি আগের চেয়ে একটু কমেছে, কিন্তু শেষ হয়নি। সকাল সকাল বৃষ্টিতে ভিজেছে আবার হালকা বাতাস বইছে। যার ফলে দুজনেরই ঠান্ডা লাগছে। মেঘ নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো ঠান্ডায় হাত দুটো গুটিয়ে নিচ্ছে। তাই অন্যদিকে তাকিয়ে নাফিসাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ওড়না চিপে পানি ঝরিয়ে গায়ে দাও। ঠান্ডা কম লাগবে।
নাফিসা মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘ উল্টোদিকে ঘুরে দাড়িয়ে আছে। আশেপাশে একটু তাকিয়ে বারান্দার এক কোনে এসে ওড়না থেকে পানি ঝরিয়ে আবার গায়ে দিলো। আবার এসে মেঘের পাশে দাড়ালো। মেঘ একবার তাকালো নাফিসার দিকে, আবার বৃষ্টি দেখতে লাগলো। হঠাৎ কিছু একটা দেখে মেঘ দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। এভাবে হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়ায় নাফিসা একটু অবাক হলো। বারান্দার একটু কিনারার এসে দেখলো একটা অটোরিকশা! আর মেঘ সেই রিক্সার কাছেই গেছে। মেঘ রিকশা সাথে নিয়ে এলো দোকানের কাছে।
– মেঘা, এটায় উঠে যাও।
– না, আপনি যান এটায়।
– আমি অটোতে যাবো না। এইটুকু পথ এক দৌড়েই যেতে পারবো। উঠে পড়ো তারাতাড়ি বৃষ্টির মধ্যে অটো পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া বৃষ্টি শেষ হতেও অনেক দেড়ি।
মেঘ বাজারের ব্যাগ অটোতে তুলে দিলো। নাফিসাও উঠে পড়লো।
– আপনিও চলুন।
– না, আমি বৃষ্টিতে হাটতে হাটতে ভিজবো। তুমি যাও।
অটো চলতে লাগলে মেঘও হাটতে লাগলো। নাফিসা একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেঘ রাস্তায় জমে থাকা বৃষ্টির পানির সাথে খেলা করছে আর হাটছে। মুচকি একটা হাসি দিয়ে আবার সামনে তাকালো। বাসায় ফিরে মনে হলো বাজারের ব্যাগে তো মেঘের ফোন আর ওয়ালেট আছে! ওফ্ফ! একটুও খেয়াল ছিলো না! তাছাড়া মেঘ তো হেটে আসছিলো, এগুলো সাথে থাকলে ভিজেই যেতো! যাক, বিকেলে পাহাড়ে এলে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে।
নাফিসা বাজারের ব্যাগ থেকে ফোন আর ওয়ালেট বের করে লুকিয়ে রাখলো। ভিজে আসার কারণে আম্মির কাছে বকা শুনতে হলো। এদিকে রিসোর্টে ফিরে মেঘেরও মনে হলো ফোন আর ওয়ালেট মেঘার কাছে রয়ে গেছে। যাক, পরে নেয়া যাবে। আর কেউ কল করলে মেঘা রিসিভ না করলেই হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here