উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ১০

0
3059

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
১২.
কলেজ অফ থাকলে বাসায় ঘুম ভাঙে নয়টা, দশটায়! কিন্তু এই জঙ্গলে বৃষ্টির ঘুম ভাঙে খুব সকালে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে। এখানে প্রতিদিনই সে ভোরের নতুন লাল সূর্য দেখতে পায় আর মিষ্টি রোদ গায়ে মাখে। এখানে সারাজীবন থাকলেও তৃপ্তি মিটবে না তার। এই পরিবেশের সবকিছুই ভালো লাগছে তার কাছে। শুধু মাত্র একটা জিনিস ছাড়া! সেটা হলো টয়লেট! থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু টয়লেটটা নিয়ে যত্তসব সমস্যা! জঙলে খোলামেলা টয়লেট আবার যেখানে ছেলেমেয়ে একসাথে আছে! ছি! ছি! ছি! যদিও তাবুর দু’পাশে পাতলা চট দ্বারা আবদ্ধ দুইটা টয়লেট। একটা ছেলেদের জন্য আরেকটা মেয়েদের জন্য। তবুও একটু অস্বস্তিকর! বৃষ্টি তাবু থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে হাটতে লাগলো। আজ আকাশকে গাছের ডালে ঝুলতে দেখছে না। আকাশ উঠেনি নাকি! একটু সামনে যেতেই দেখলো, আকাশ আর রিজভী আসছে। রিজভীর মুখ নড়ছে খুব আর আকাশ চুপচাপ। হাতে কিছু একটা আছে তাদের। বৃষ্টি হেটে তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। রিজভী বৃষ্টিকে দেখে বললো,
– এতো সকালে ঘুম ভাঙে কেন বৃষ্টির! প্রতিদিনই কি আকাশের কোলে উঠতে মন চায়?
– মন চাওয়ার কি আছে! আকাশের কোল থেকেই তো বৃষ্টি ঝরে। হিহিহি…..
– হাহা… অভ্র কবির কথাই তো সত্য হয়ে যাচ্ছে দেখছি!
আকাশ রেগে তাকালো রিজভীর দিকে। তারপর রিজভীর হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে হনহন করে চলে গেলো তাবুর দিকে। রিজভী আর বৃষ্টি দৃঢ় পায়ে হেটে তাবুর দিকে যাচ্ছে। প্যাকেট দেখে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,
– প্যাকেটে কি আছে?
– প্যাকেটে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ব্যাঙ আছে।
– ব্যাঙ! ব্যাঙ দিয়ে কি করবেন?
– রান্না করে খাওয়াবো তোমাকে। হা হা হা…..
– ওয়াক! থু! ছি! সবসময় এমন বাজে কথা বলেন কেন! এসব খান আপনি!
– এখন থু থু ফেলছো, রান্না করলে আবার খাওয়ার জন্য দৌড়ে এসো না।
– আমি ব্যাঙ খাই না। সাত দিন না খেয়ে থাকতে রাজি তবুও ব্যাঙ খেতে রাজি না।
– তার মানে সাত দিনের পর আট দিনের মাথায় ব্যাঙ খেতে রাজি আছো! হা হা হা….
– ছি! আপনি অনেক বাজে লোক। অনেক খারাপ লোক। আপনি, আপনি গোবরে পোকা।
রিজভী হাহাহোহো করে হাসতে হাসতে তাবুতে চলে এলো। সামনে পড়লো ঝুমুর। রিজভীকে হাসতে দেখে বললো,
– কিরে! এমনভাবে হাসছিস কেন!
– আমাদের পিচ্ছি মেহমান বৃষ্টি ব্যাঙ খেতে চাইছে। সাথে মসলা স্বরূপ গোবরে পোকা দিতে বলছে। ব্যাঙ তো পাওয়া যাবে কিন্তু গোবরে পোকা কোথায় পাই, বলতো।
রিজভীর কথা শুনে ঝুমুরও সকাল সকাল হা হা করে হাসতে লাগলো। বৃষ্টি রেগে ফেটে যাচ্ছে!
– আপু দেখোতো রিজভী ভাইয়া কি বলছে আমাকে! এমনিতে ক্ষুধায় পেটে গুড়ুম গুড়ুম ডাক পরছে তার উপর ভাইয়া এসব বাজে বাজে কথা শোনাচ্ছে! এখন তো বমি আসছে আমার!
– বমি এলে রিজভীর উপর বমি করে দিবে। ব্যাস, সমান সমান।
এবার বৃষ্টি হাসতে লাগলো। অভ্র তাবু থেকে বেরিয়ে বললো,
– বাছা রিজভী, তোর কি নিতুর সাথে ব্রেকাপ হয়েছে! এমন ভাবে এই পিচ্চি মেয়েটার পেছনে পড়লি কেন রে!
– হায়! হায়! এতো বড় কথা! সইতে পারছি না আমি, কবিগুরু! আপনি জানেন না, পিচ্চি মেয়েটা বিশাল আকাশের পেছনে পড়ে আছে। হা হা হা! ভালো কথা মনে করছস দোস্ত, নিতুর সাথে ব্রেকাপ না হলেও আজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাল বলে দিছে আজ সকালে যেন কল করে তার ঘুম ভাঙাই!
ঝুমুর আর অভ্র হাসতে লাগলো। রিজভী দৌড়ে তাবুতে চলে গেলো। পিছু পিছু অভ্রও। বৃষ্টি কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো,
– নিতু কে?
ঝুমুর জবাব দিলো,
– রিজভীর গার্লফ্রেন্ড।
– অহ আচ্ছা। এমন লোকের গার্লফ্রেন্ড কেমন হবে আপু! যে ছেলে এমন বাজে কথা বলে!
ঝুমুর হেসে জবাব দিলো,
– এসব তো বলে আমাদের হাসানোর জন্য। গার্লফ্রেন্ড এর সাথে কি আর এসব বলে! তখন ঠিকই প্রেমালাপ করে।
আকাশ তাবু থেকে বেরিয়ে ঝুমুরকে ডেকে প্যাকেটটা দিলো। বৃষ্টিও গেলো সাথে। প্যাকেট খুলে দেখলো চারটা ব্রয়লার মুরগী! আর রিজভী এটাকে ব্যাঙ বলেছে!
একটু পর মুরগী কেটে রোস্ট রান্না করছিলো। আকাশ আর রওনক খুব ভালো রান্না করতে পারে। বৃষ্টি এখানে আসার পর থেকে দেখছে সব রান্না ছেলেগুলোই করছে। মেয়েরা শুধু কেটেকুটে দিচ্ছে। রিজভী জোকস শুনায় আর অভ্র কবিতা। আর বাকি সবাই শ্রোতা! আকাশটা মেঘলা হয়ে আসছে। তাই তারা তারাতাড়ি রান্নার আয়োজন করলো। পাথর দিয়ে দুইটা চুলা বানিয়ে রান্না বসিয়েছে। ভাত রান্না শেষ রোস্ট রান্না প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় এক ফোটা দু ফোটা করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। বাকি আসবাবপত্র সবাই দ্রুত তাবুতে রাখছে। রিজভী ছাতা এনে চুলার উপর রেখে দাড়িয়েছে। বাকিরা আকাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো বৃষ্টি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা! রিজভী ছাতা ধরে দাড়িয়ে বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারলে না তুমি বৃষ্টি ! অসময়ে তোমার আসা লাগবে!
– আমি আবার কি করলাম!
– এই যে, ঝপাঝপ বৃষ্টি হয়ে আমার ছাতার উপর পড়ছো। রান্নাটাও শেষ করতে দিচ্ছো না!
বৃষ্টি এবার বুঝতে পারলো তার নাম বৃষ্টি হওয়ায় তাকে কথা শোনাচ্ছ। তাই হি হি হি করে হেসে উঠলো। তাদের রান্না শেষ। যার যার খাবার নিয়ে তারা নিজেদের তাবুতে চলে গেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি তীব্র গতিতে ঝরতে লাগলো। খাওয়া শেষ করে কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ তাবু ফাক করে বসে বসে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি তাবুর ফাকে দেখলো আকাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজবে হয়তো! বৃষ্টির ইচ্ছে করছে এখন ভিজতে। না, শুধু শুধু ইচ্ছে দমিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। জুতা খুলে বৃষ্টিও বেরিয়ে গেলো। আকাশ তাবু থেকে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। বৃষ্টিও দৌড়ে আকাশের দিকে গেলো। খালি পায়ে দৌড়াতে ভালোই লাগছে! আকাশ বৃষ্টিকে দেখে বললো,
– তুমি এখানে এসেছো কেন?
– আপনি এসেছেন কেন?
– আমি গোসল করতে এসেছি।
– আমিও গোসল করবো।
– তো আমার সাথে আসছো কেন?
– ইচ্ছে হলো তাই।
আকাশ আর কিছু না বলে সামনে তাকাতেই কিছু একটা দেখে হঠাৎ থেমে গেলো। বৃষ্টিও আকাশের দৃষ্টিকে অবলম্বন করে তাকিয়ে থেমে গেলো। তাদের থেকে কিছুটা দূরে রওনক আর সিমি একসাথে ভিজছে। রোমান্টিক দৃশ্য! সিমি দুহাত মেলে আকাশপানে মুখ করে তাকিয়ে আছে। আর রওনক সিমির হাতগুলো স্পর্শ করে সিমির মতোই আকাশপানে তাকিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সিমির মাথা ঠেকে আছে রওনকের বুকে! দৃশ্যটা দেখতেই বৃষ্টির মাঝে আনন্দের ঢেউ খেলে উঠলো। হয়তো এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দম্পতি!
আকাশ আর সামনে না এগিয়ে তাবুর দিকে ফিরে আসতে চাইলে বৃষ্টি তার হাত ধরে বাধা দিলো। আকাশ তার দিকে তাকাতেই বৃষ্টি বললো,
– যাবেন না প্লিজ। আমারও ইচ্ছে করছে আপনার সাথে ভেজার। প্লিজ…
বৃষ্টির দৃষ্টি অন্যরকম! আকাশকে কেমন যেন মায়ায় ফেলে দেয়। আকাশ এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার সামনে হাটতে লাগলো। বৃষ্টি দৌড়ে আকাশের সামনে দাড়িয়ে পথ আটকালো। আর একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
– আপনাকে মানানোর জন্য এখন কি পায়ে ধরতে হবে?
আকাশ ব্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বললো,
– এসব কি হচ্ছে শুনি!
বৃষ্টি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– আজ তো চলেই যাবো। একটা ইচ্ছে পূরণ করুন। আমরা ওদিকে না গিয়ে এদিকটায় হাটবো। প্লিজ!
আকাশ বৃষ্টির কথামতো তার বলা সেদিকেই আস্তে আস্তে হাটতে লাগলো। বৃষ্টি খুশি হয়ে আকাশের পাশাপাশি হাটতে লাগলো। আলতো আলতো করে স্পর্শ করে আকাশের একটা হাত ধরে ফেললো। হাত ধরায় আকাশ হাতের দিকে তাকিয়ে আবার বৃষ্টির মুখের দিকে তাকালো। আকাশ তাকিয়েছে এটা বুঝতে পেরেও বৃষ্টি সামনে তাকিয়ে হেটে চলেছে। আকাশ হাত ছুটিয়ে নিতে চাইলে বৃষ্টি আরও শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
– প্লিজ, বেশিক্ষণ হাটবো না তো। কয়েক মিনিট।
আকাশ আবার সামনে হাটতে লাগলো। বৃষ্টি দেখতে পেল সামনে কিছু বনফুল! বৃষ্টি আকাশের হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে সেখানে চলে গেলো। পেছন থেকে আকাশ চেচিয়ে বললো,
– সাবধানে! এই ফুলে কাটা আছে।
বৃষ্টি আকাশের কথামতো সাবধানে সেখানে গেলো। আকাশও পিছু পিছু গেলো। সাদা ও গোলাপি রঙের ফুটে থাকা ফুলগুলো দেখতে অনেকটা জবা ফুলের মতো। কিন্তু জবা ফুল না। এই ফুলের আকৃতি আরো বড়। বৃষ্টির পানিতে ভেজায় ফুলগুলোকে আরো বেশি আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। ফুলে হাত দিতে গেলেই বৃষ্টির হাতে কাটা ফুটলো।
– ওফ্ফ!
– বেলেছিলাম না এই ফুলে কাটা আছে!
– নিবো কিভাবে?
– নিতে হবে কেন! দেখে সন্তুষ্ট হওনি!
– নিয়ে দিবেন একটা?
– আমি পারবো না। কাটার আঘাত পাওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই।
– আঘাত পাবেন না। চেষ্টা তো করুন একবার।
– আমার হাত কি লোহা নাকি যে আমার হাতে কাটা ফুটবে না!
– আপনার হাত লোহার চেয়েও বেশি কঠিন।
– হোয়াট! লোহার চেয়েও কঠিন!
– তা নয়তো কি! কতোক্ষন আমি হাত ধরে হাটলাম একবারের জন্যও হাতের মুঠোয় আমার হাতটা ধরেননি! দেন না একটা ফুল ছিড়ে। ছেলেরা গার্লফ্রেন্ড এর জন্য কতকিছু করে আর আপনি কাটার ভয়ে একটা ফুল ছিড়ে দিচ্ছেন না!
– এই মেয়ে, কি যা তা বলছো! তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড হলে কবে!
– ধরে নিন আজ থেকেই।
– এসব আলতু ফালতু কথা বলা বন্ধ করো। আর আমার পিছু নেওয়াও বন্ধ করো।
– এখন কি ফুল ছিড়ে দিবেন কি না? না দিলে কিন্তু চিৎকার করবো….
– চিৎকার করলে কি হবে?
– চিৎকার করলে আপনি বিরক্ত হবেন, আর খুব দ্রুত আমাকে ফুল ছিড়ে দিবেন।
– দিবো না।
– আসলেই একটা পাষাণ!
বৃষ্টি আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুজতে লাগলো। আকাশ জিজ্ঞেস করলো,
– কি খুজো?
– মোটা একটা লাঠি খুজি, আপনার মাথা ফাটানোর জন্য।
আকাশ হাহাহোহো করে হেসে উঠলো। বৃষ্টি আকাশের হাসি দেখে নিজেও মুচকি হাসলো। এই ছেলের হাসি দেখলে সে বারবার প্রেমে পড়ে। ছেলে মানুষ এতো সুন্দর হাসে কিভাবে! আশেপাশে তাকিয়ে সে সেগুন গাছের পাতা পেল। দুইটা পাতা একসাথে নিয়ে ফুল ছিড়তে লাগলো। দুইটা ফুল ছিড়তে পেরেছে। একটা সাদা একটা গোলাপি। বাকি গুলো ঝোপের ভেতরের দিকে। হাত এতোটা লম্বা না। যাক, দুটা পেয়েই সে খুশি। আকাশ তার ফুল নেয়ার কৌশল দেখে মৃদু হাসলো। বুদ্ধি আছে মেয়েটার। বৃষ্টি কমে গেছে। এখন ঝিরিঝিরি পড়ছে। তারা ভিজতে ভিজতে আবার তাবুতে ফিরে এলো। অভ্র অন্য তাবু থেকে তাদের একসাথে দেখে কিছু একটা বলতে চাইছিলো তার আগেই আকাশ কানে আঙুল ঢুকিয়ে তারাতাড়ি তাবুতে চলে গেলো। বৃষ্টি তার কান্ড দেখে হাসলো। সেও বুঝতে পেরেছে অভ্র এখন তাদের দুজনকে নিয়ে তার কবিতা শুনাতো তাই আকাশ কানে আঙুল দিয়েছে। বৃষ্টিও হাসতে হাসতে তাদের তাবুতে চলে গেলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here