Mr_Husband,পর্ব_৩৫

0
3191

#Mr_Husband,পর্ব_৩৫
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন

দেখতে দেখতে অক্টোবর শেষ হয়ে নভেম্বরে পরেছে। শীতের আভাস ভালোই পাওয়া যাচ্ছে এখনই। এই মাসটা মুনের জন্য খুবই স্পেশা। প্রতি বছর অধীর আগ্রহ মুন এই মাস’টার জন্য’ই অপেক্ষা করে। কারণ এই মাসের চার তারিখ শুক্রবার রাতে মুন কবির খান আর তাহমিনা খানের কোল আলো করে এসেছিলো। প্রতিবার সবাই মুনের জন্মদিনের কথা ভুলে যেত শুধু মুন নিজেই মনে রাখতো। কিন্তু এবার মুন ভুলে গেছে বাকি সবার মনে আছে। আঁধার তো এর মধ্যেই সারপ্রাইজ পার্টির এ্যারেঞ্জমেন্ট করা শুরু করে দিয়েছে। ইদানিং মুনের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া ও করছে না। এমনিতে তো করে না এখন আরো কমে গেছে। সবাই ওকে নিয়ে চিন্তিত। মুন যা খেতে পছন্দ করে তাই রান্না করছেন আরিফা রেজওয়ান। কবির খান মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় ব্লাড প্রোশার বারিয়ে ফেলেছেন। আঁধার মুনকে টেস্ট করাতে নিয়ে যেতে চেয়ে ছিলো কিন্তু মুন কোনো মতেই রাজি না। অনেক জোড়াজুড়ি করেও কোনো লাভ হয়নি। পরে আঁধার নিজেই কিছু মেডিসিন দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মুন ওগুলোও নিচ্ছে না। মুনের এত্ত বড় বড় ক্যাপসুল খেতে পারে না গলায় আটকে যায়। এরকম করতে করতেই মুনের সেই কাংক্ষিত দিন ও এসে পরে। আঁধার নয়টা বাজেই মুনকে জোড় করে ঘুমপাড়িয়ে দেয়। তারপর কিচেনে গিয়ে নিজের হাতে মুনের ফেবারিট চকলেট কেক বানায়। আগে থেকেই কেক বানানোর জিনিস পত্র, বেলুন, বাজি আর পার্টি স্প্রে এনে রেখেছিল। আলিয়া ও হেল্প করছে কেক বানাতে। আঁধার ও খুব ভালো রান্না করতে পারে। ইউ.এস.এ থাকতে আঁধার আর আরুশ দুই বন্ধু মিলে রান্না করতো। আঁধারের রান্নার প্রতি অনেক ইন্ট্রেস্ট ছিলো। তাই ওখানের বড় বড় কুকদের কাছে রান্না শিখে। আঁধারের কেক বানাতে দু ঘন্টা লেগে যায়। নিজের প্রিয়তার জন্য প্রথম নিজের হাতে কিছু বানাচ্ছে তাই সেটা একটু স্পেশাল না হলে হয় না। মুন চকলেট ছাড়া অন্য কোনো ফ্লেবার একদম’ই পছন্দ করে না। তাই এই কেকটা শুধু মাত্র চকলেট দিয়েই তৈরী। কেক বানানো শেষ করে সবাই আঁধারের রুমে গেল। আলিয়া মুনকে ভালো করে চেক করলো ঘুমাচ্ছে কি না? তারপর সবাই কাজে লেগে পরলো। রুমটা সুন্দর করে বুলুন দিয়ে সাজালো। সাজাতে সাজেতে ১১:৫৫ বেজে গেছে। আলিয়া দৌড়ে গিয়ে নিচ থেকে কেক নিয়ে এলো। মুন বেডের মাঝ বরাবর শুয়ে ছিলো। সবাই মুনকে ঘিরে বসে। আঁধার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। যখন দেখলো ১২টা বাজতে আর মাত্র দশ সেকেন্ড বাকি তখন সবাই এক সাথে কাউন্ট করতে লাগলো।

—“10,9,8,7,6,5,4,3,2,1,0”

বলেই সবাই চিৎকার করে বলে উঠলো,

—“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ মুন। হ্যাপি, হ্যাপি রিটান্স অফ দ্যা ডে।”

বলেই বাজি টাতে লাগলা আলিয়া। সবার এরকম চিৎকার আর বোম ব্লাস্টের শব্দ শুনে মুন লাফিয়ে উঠলো। সবাইকে এক সাথে নিজেকে ঘেরে থাকতে দেখে মুন অবাক হলো। ঘুম কাতুরে চোখে ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকাচ্ছে মুন। আলিয়া মুনকে জড়িয়ে ধরে ঝুলে ঝুলে বলল,

—“হ্যাপি বার্থডে মিষ্টি। মেনি মেনি হ্যাপি রিটান্স অফ দ্যা ডে।”

মুন অবাক চোখে সবাইকে দেখছে আজ ওর বার্থডে আর ও নিজেই ভুলে গিয়েছে। আঁধার নিজের ল্যাপটপটা মুনের সামনে ধরলো। মুন একবার আঁধারের দিকে তাকিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকালো।

—“হ্যাপি বার্থ ডে আম্মু। কেমন আছো।”

মুন দেখে কবির খান ভিডিও কলে আছে। পাশেই তাহমিনা খান আর রুনু বেগম বসে আছে। কবির খান হেসে বললেন,

—“আমি তোমার বার্থ ডে ভুলে যেতাম এই জন্য তুমি আমায় প্রতিবার বকতে। কিন্তু এবার দেখ ঠিক মনে রেখেছি। তোমার শূন্যতা মনে রাখতে বাধ্য করেছে। এবার খুশি তো?”

মুনের দু চোখ বেয়ে গড় গড় করে পানি গড়িয়ে পরছে। কবির খান ব্যস্ত হয়ে বললেন,

—“আম্মু কাঁদছো কেনো? এই দেখো আমরা তো তোমার সাথেই আছি। আমার সোনা আম্মু কাঁদে না। তুমি তো বড় হয়ে গেছো আর বড়-রা কি কাঁদে? কাঁদলে তো সবাই তোমাকে বাচ্চা বলবে। এবার কান্না বন্ধ করো আমরা কেক কাটবো।”

কবির খার ল্যাপটপটা টি টেবিলের উপর রাখে পাশেই মুনের ফেবারিট চকলেট কেক। কবির খান, তাহমিনা খান আর রুনু বেগম মিলে কেক কাঁটে। প্রথম পিসটা একটা বাটিতে রেখে সবাই একটু একটু করে কেক খায়। মুন হেসে দেয়।

—“কবির খান বললেন তোমার গিফট আঁধারের কাছে আছে। এখন তোমরা কেক কাটো আমি রাখছি।”

মুন ছলছল চোখে বলল,

—“কাল আমার সাথে দেখা করতে আসাবে তো?”

কবির খান হেসে জবাব দিলেন,

—“অবশ্যই আসবো। এবার রাখি।”

মুন মাথা নাড়ে। কবির খান কল কেটে দেয়। আরিফা রেজওয়ান কেকটা বেডে উপরে রাখে। আঁধার বলল,

—“নেও কেক কাটো।”

মুন ছুরিটা হাতে নিলো। আলিয়া বলল,

—“জানো মিষ্টি কেকটা কে বানিয়েছে?”

মুন জিজ্ঞেসু দৃষ্টি তাকালো। আলিয়া মুনের বাহুতে হালকা ধাক্কা মেরে বলল,

—“ভাই বানিয়েছে স্পেশালী তোমার জন্য।”

মুন অবাক দৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকায়। আঁধার ধমক মরে বলল,

—“তাকিয়ে না থেকে জলদি কেক কাটো।”

মুন ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি কেক কাটলো। সবার প্রথমে মুন আরিফা রেজওয়ানকে কেক খাওয়ালো। তারপর আরমান রেজওয়ানকে, তারপর আলিয়াকে। আর সবার শেষে আধারকে কেক খাওয়াতে গেল। আঁধার বলল,

—“আমি চকলেট কেক পছন্দ করি না।”

মুনের কপাল কুচকে এলো। কপাল কুচকানো অবস্থায়’ই বলল,

—“অ্যা লো! চকলেট পছন্দ করে না এমন মানুষ ও আছে দুনিয়াতে?যাই হোক এখন আপনাকে আমার হাতে কেক খেতেই হবে। নিন হা করুণ।”

মুন আঁধারকে কিছুবলার সুযোগ না দিয়ে জোর করে আঁধারের মুখে পুরো কেকটা ঢুকিয়ে দেয়। আঁধারের বমি আসে। আঁধার দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মুনের ভয় হয় এখন যদি আঁধার সবার সামনে আবার ওকে বকা দেয়? মনে মনে’ যা হবে দেখা যাবে’ বলে মুন আরমান রেজওয়ানের সামনে দু হাটুর উপর দাঁড়ায়। তারপর কোমরে হাত দিয়ে বলে,

—“কেক তো কাটা হলো কিন্তু আমার গিফট?”

আরমান রেজওয়ান মুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বসা থেকে উঠে পাশে দাঁড় করানো কাপড় দিয়ে ঢাকা সাইকেলটার উপর থেকে এক টানে কাপড় সরিয়ে নিলো। বেবী পিংক কালারের লেডিস বাই-সাইকেল। মুনের চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠলো। লাফ দিয়ে বেড থেকে নেমে গিয়ে আরমান রেজওয়ানকে জড়িয়ে ধরলো মুন। ছোট থেকেই সাইকেল চালানোর খুব শখ ছিলো মুনের কিন্তু মুন ব্যথা পেতে পারে ভেবে কখনো এ্যালাউ করেন নি কবির খান। মুন আজ সাইকেল পেয়ে খুশি। মুন টুপ করে আরমান রেজওয়ানের গালের চুমু দিয়ে বলল,

—“থ্যাঙ্ক ইউ শশুরবাবা।”

—“ড্যাড তুমি ওকে এটা না দিলেও পারতে। সাইকেল চালাতে গিয়ে দেখবে হাত-পা ভেঙে বসে আছে।”

ওয়াশরুমের দরজায় হেলান দিকে বলল আঁধার। মুন ভ্যাঙ্গালো আঁধারকে।”

আরিফা রেজওয়ান বললেন,

—“কিছু হবে না। মুন এদিকে এসো তো।”

মুন গেল। আরিফা রেজওয়ান পাশ থেকে অনেক গুলো উপন্যাসের বই মুনের হাতে দিয়ে বলল,

—“তোমার পছন্দের উপন্যাস ও গল্পের বই আছে এখানে।”

মুন বই গুলো রেগে আরিফা রেজওয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। আলিয়া বলল,

—“এবার আমার পালা। মিষ্টি এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য ছোট্ট একটি উপহার।”

মুন আলিয়ার দেওয়া গিফট বক্স হাতে নিলো। তারপর কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—“কি আছে এর মধ্যে আলিয়া?”

—“কালার আর ব্রাশের পুরো একটা সেট।”

মুন আলিয়াকেও জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,

—“থ্যাঙ্ক ইউ আলিয়া এটা আমার জন্য অনেক মূল্যবান উপহার।”

ওকে ওকে আর ইমোশনাল হতে হবে না। আমরা এখন যাচ্ছি অলরেডি একটা বেজে গেছে। অনেক ঘুম পেয়েছে। আমি যাচ্ছি। মম, ড্যাড তোমরাও চলো। সবাই একে একে রুম থেকে চলে গেল। আঁধার বইগুলো আর গিফট বক্সটা স্টাডি টেবিলের উপরে রেখে বেড ঝেড়ে শুয়ে পরলো। সোজা হয়ে এক হাত চোখে উপর আরেক হাত পেটে উপর দিয়ে আরামসে শুয়ে আছেন মহারাজ। মুনের খুব রাগ লাগলো। সবাই মুনের জন্য গিফট আনেছে কিন্তু আঁধার কেনো কোনো গিফট আনে নি ওর জন্য? মুন রেগে ধুপ করে আঁধারের পেটের উপর বসে পরলো। আচমকা এমন হওয়ায় আঁধার সামনের দিকে কিছুটা উঠে এলো। আর বলল,

—“আহ! কি করছো মুন? অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে দেও।”

মুন কিছু না বলেই আঁধারের টি শার্টের কর্লার টেনে ধরে রেগে বলল,

—“আমার গিফট কোথায়?”

আঁধার না বোঝার ভান করে বলল,

—“গিফট! কিসের গিফট?

মুন আরো দ্বিগুণ রেগে গেলো আঁধারের কথায়। মুন কটমট করে বলল,

—“বার্থ ডে গিফট।”

—“ওহ! কেনো তোমার জন্য কত কষ্ট করে কেক বানালাম না? আর আমি’ই তো তোমার জীবনের সব থেকে বড় গিফট।”

টেডি স্মাইল দিয়ে বলল আঁধার মুন রেগে আঁধারের বুকে কিল ঘুষি দিতে লাগলো। আঁধার মুনের কান্ডে হাসছে। হাসতে হাসতেই বলল,

—“আচ্ছা, তুমি কি চাও বলো?”

মুন আঁধারের উপর থেকে উঠে বেডে উপরে বসে বলল,

—“যা চাইবো সত্যি দিবেন তো।”

আঁধার এক হাত মাথার নিচে দিয়ে মুনের গিকে ফিরে কাত হয়ে শুয়ে বলল,

—“হ্যাঁ দিবো। তুমি বললো।”

মুন হাত পেতে বলল,

—“আগে প্রমিস করুণ।”

—“ওকে প্রমিস করছি, এবার বলো কি চাও।”

—“আমি যদি কখনো কাঁদি, তাহলে আমার এক ফোঁটা চোখের জলের কারণও যেন আপি না হন।”

করুণ চোখে তাকিয়ে ভাঙা গলায় কথাটা বলল মুন। চোখ দুটোও ছলছল করছে। মুনের কথাগুলো তীরের মতো আঁধারের বুকে এসে লাগে। চিনচিন ব্যথা শুরু হয় জলে ভরা মুনের চোখ দুটো দেখে। মুন আবারো বলল,

—“অনেক বেশী বিশ্বাস করি আপনাকে। নিজের থেকেও বেশী। একটাই অনুরোধ যা’ই হয়ে যাক কখনো আমার বিশ্বাস ভাঙ্গবেন না।”

মুনের এরকম কথা শুনে হঠাৎ করেই আঁধারের ভয় হতে শুরু করলো। মুনকে হারিয়ে ফেলার ভয়। বুকের বাম পাশে কেম খালি খালি লাগতে শুরু করলো। সত্যি হারিয়ে ফেলবে না তো? ভাবতে ভাবতেই মুন আঁধারের বুকে মাথা রেখলো। আঁধারের হাত আপনা আপনি মুনের মাথায় চলে গেল। একটা বদ অভ্যাস হয়ে গেছে দুজনের’ই। বিলি না কাঁটলে কারোই ঘুম আসে না। মুনের মাথায় বিলি কাঁটতে কাঁটতে ঘুমানোর অভ্যাস আঁধারের। আর আঁধার বিলি কেঁটে দিলে ঘুমানোর অভ্যাস মুনের। মুন অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে। মুনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আঁধারও ঘুমিয়ে পরে।

.
সকালে ফোনের রিং টোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় মুনের। কলের পর কল করেই যাচ্ছে। মুন বিরক্তিতে পিলো দিয়ে কান চেপে ধরলো। না পেরে শেষে উঠেই পরলো। হামি দিতে দিতে কল রিসিভ করে কানে ধরলো,

—“হ্যাপি বার্থ ডে সোনা! কেমন আছিস?”

ঊর্মির গলার আওয়াজ পেয়ে বলল,

—“সা’লী এতো দিন পরে মনে পরেছে তোর? কোথায় মরছিলি?”

—“আরে বইন রাগিস কেনো? অনেক বিজি ছিলাম। বুঝিস’ই তো, স্টাডি সাথে মিউজিক প্রগরামস্। সময়ই পাই না। প্লিজ, প্লিজ রাগ করিস না।”

মুন গাল ফুলিয়ে বলল,

—“ওকে।”

—“এবার বল তোদের দুজনের কি অবস্থা? আগের মতোই ঝগড়া করিস নাকি? তোর ওই রাক্ষসটাকে ভালো টালোও বাসিস?”

মুন লাজুক হেসে বলল,

—“একটু একটু বাসি। বেশী না কিন্তু।”

ঊর্মি শব্দ করে হাসলো। দুজনে মিলে সারা বিশ্বের গল্প জুড়ে দিলো। এক ঘন্টার মতো কথাই বলে গেছে দুজনে। কথা শেষ করে মুন উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় খেয়াল করে টেবিল ল্যাম্পের উপর একটা ছোট্ট নীল চিরকুট। মুন চিরকুট’টা হাতে নিলো। চিরকুটে লেখা “গুড মর্নিং। আজ সন্ধ্যায় বার্থ ডে গালের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।তৈরী থেকো।” মুন চিরকুটটা পরে খুশিতে বাকবাকুম করছে সারপ্রাইজের নাম শুনে। মুন চিরকুটটা রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। ফ্রেস হয়ে নিচে চলে গেল ব্রেকফাস্ট করতে। আলিয়া, আরিফা রেজওয়ান, আরমান রেজওয়ান সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। মুন আরিফা রেজওয়ানের পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল,

—“গুড মর্নিং এভরি ওয়ান।”

আলিয়া বলল,

—“মিষ্টি ইউ আর সো লেট। মর্নিং শেষ সেই কখন।”

মুন জিব কেঁটে বলল,

—“ইশশ! খুব লেট করে ফেলেছি তাই না? সাসুমা তুমি আমাকে ডাকলে না কেন?”

আরমান রেজওয়ান বললেন,

—“আজ তোমার দিন মামনি। তোমার যা ইচ্ছে তাই তুমি করতে পারো আজ। তোমাকে কেউ না বাধা দিবে না জোর করবে।”

আরিফা রেজওয়ান বললেন,

—“হ্যাঁ! আজ সব তোমার মন মতোই হবে। আজ সব তোমার পছন্দের খাবার রান্না করা হবে। এখন বলো কি খাবে?”

মুন খুশি হয়ে গেল। বলল,

—“সাসুমা আমার না পায়েশ খেতে খুব ইচ্ছে করছে। বেশি করে বাদাম আর কিসমিস দিয়ে বানানো পায়েশ।”

আরিফা রেজওয়ান মুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

—“ঠিক আছে।”

খাওয়া শেষ করে যে যার কাজে চলে যায়। মুন ও উপরেই যাচ্ছি কিন্তু সে সময়ই কলিংবেল বেজে উঠে। মুন ভাবে, এসময়ে আবার কে এলো? আঁধার আসেনি তো? আশেপাশে কাউকে না দেখে নিজের গিয়ে দরজা খুলে দিলো মুন। সেল্স ম্যান এসেছে। সেল্স ম্যান মুনকে জিজ্ঞেস করলো,

—“মিসেস মুন রেজওয়ান আছেন?”

—“হ্যাঁ, আমিই।”

—“আপনার নামে পার্সেল এসেছে।”

—“এখানে সাইন করুণ।”

একটা কাগজ দেখিয়ে বলল। মুন সাইন কেরে দিলো। সেল্স ম্যান পার্সেল দিয়ে চলে গেল। মুন দরজা লাগিয়ে পার্সেল নিয়ে উপরে চলে গেল। রুমে এসে পার্সেলটা খুলে দেখলো একটা বক্স আর একটা খাম। মুন আগে বক্সটা খুলল। বক্সের ভিতরে খুব সুন্দর একটা পাথরের ব্রসলেট। মুন বক্সটা রেখে খামটা খুলে দেখলো একটা চিঠি। মুন চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

“প্রিয় মুন,
জন্ম দিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। আশা করি, ভালো আছো। তুমিহয় তো ভাবছো আমি কে হতে পারি? তাই আগেই বলে দিচ্ছি, আমি তোমার এক শুভাকাঙ্খী। আশা করি, আমার দেওয়া উপহার তোমার পছন্দ হয়েছে। আজ জন্মদিন উপলক্ষে আমি তোমাকে একটা সারপ্রাই দিতে চাই। অনেক বড় চমক। যেটা তুমি জীবনেও ভুলবে না। নিচে দেওয়া ঠিকানায় ঠিক 12টা বাজে চলে এসো। তোমার জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। ভালো থেকো।

ইতি,
তোমার এক শুভাকাঙ্খী,

মুন চিঠিটা পড়ে ভাবলো হয়তো আঁধার’ই পাঠিয়েছে। কারণ চিরকুটে আঁধারও সারপ্রাইজে কথা বলছিল। মুন তাই একটা সাদা রঙের লং ফ্রোক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। চেন্জ করে এসে। মাথায় কালো রঙের হিজাব বেধে ওড়না একপাশে নিয়ে আর পার্স নিয়ে বেরিয়ে পরলো সেই চিঠির ঠিকানায়।

.
এদিকে AR আর তার দলের লোকেরা গোডাউনের ভেতরে বেআইনি অস্ত্র সাপ্লাই এর প্লান করছিলো। ওদের দলে সব ধরনের অপরাধ হয় শুধু নারী পাচার আর শিশু পাচার ছাড়া। কারণ AR দুটো জিনিস সহ্য করতে পারে না এক নারীদের অসম্মান আর দুই বাচ্চাদের কষ্ট। আর এই কাজ না করার আরো একটা কারণ আছে। AR নিজেও এ কাজ করে না আর অন্যকেও করতে দেয় না। এ কারণেই AR এর এতো বেশী শত্রু। কারণ এই দুটো কাজেই অন্য সব কাজের তুলনায় বেশি টাকা পাওয়া যায়। তাই সবাই চায় AR কে নিজের পথ থেকে সরাতে। AR গোডাউন থেকে বের হতেই হঠাৎ করেই শত্রুরা আক্রমণ করে ওর উপর। আচকাই গুলি চালানো শুরু করে। AR এর বাহুতে গুলি লাগে। সাথে সাথে AR লুকিয়ে পরে গাড়ির পেছনে। গুলির আ্রয়াজ শুনে সবাই দৌড়ে বেরিয়ে আসে। ওরাও শত্রুদের উপর গুলি চালানো শুরু করে। AR নিজে মুখের রুমালটা খুলে বাহুতে শক্ত করে বেধে নিলো। যেন বেশি রক্ত না বের হয়। ভাগ্য ভালো গুলি শুধু ছুয়েই চলে গেছে। AR নিজের গান হাতে নিলো। গাড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে একের পর এক গুলি করতে গেল। এবার খুর রেগে গেছে AR। হিংস্র সিংহকে জাগিয়ে এরা নিজেদের মৃত্যুকে ডেকে এনেছে। ARসমানে শত্রুদের সাথে লড়াই করছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গুলির আওয়াজ এলো। AR কে গুলি করেছিল কিন্তু ওর টিমের একজন গিলিটা AR এর গায়ে লাগার আগে নিজের বুক পেতে দেয়। সেই ব্যক্তিটি সম্ভাবত কোনো মেয়ে। AR দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে ধরলো। মেয়েটির চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে কষ্টে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে। মেয়েটি AR এর গালে হাত দিয়ে বলল,

—“আমি ওর প্রমিজ রেখেছি রোদ। আমি ওর প্রমিজ রেখেছি। ওর বন্ধুকে আমি কিচ্ছু হতে দেইনি।”

AR আটকে আসা গলায় বলল,

—“কিছু হবে না তোর। আমি তার কিছু হতে দেবো না।”

এরই মধ্যে কেউ চিৎকার দিয়ে বলল,

—“রোদ তোর সামনে, রোদ।”

রোদ সামনে তাকিয়ে দেখলো একজন ওর দিকে বন্দুক তাক করে আছে। লোকটা ট্রিগার টেপার আগেই AR তাকে সুট করে দিলো। মেয়েটাকে রেখে রোদ। সবাইকে মারতে লাগলো। একটা লোক সামনের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছিলো রোদ গ্যান তাক করে ট্রিগার চাপতেই ঝড়ের গতিতে বুটটা গিয়ে লোকটার মায় ঢুকে গেল। লোকটি মুখ থুবড়ে পরতেই AR এর চোখে দুটি জ্বলজ্ব করা চোখ ভেসে উঠলো। সাথে সাথে থমকে গেল সব। আশা পাশে কি হচ্ছে নাচ্ছে তার শব্দ যেন AR এর কানে পৌচাচ্ছেই না। সে তো জল টলমলে চোখের গভীরতা মাপতে ব্যস্ত। যে চোখে আজ পর্যন্ত শুধু ভালোবাসা দেখে এসেছে সে চোখে আজ ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে। এতদিন ভালোবাসা বেখা চোখে আজ ঘৃণা কেনো যেন সহ্য হচ্ছে না AR।

সামনে থাকা রমনীটি ভাঙা গলায় বলল,

—“মি.হাসবেন্ড!”

চোখ থেকে অসংখ্য অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পরছে। যেখানে কাল রাতেই প্রমিজ করেছে কখনো তার জন্য এক ফোটা জলও মুনের চোখ দিয়ে পরতে দিবে না। আজ সেখানে অজস্র অশ্রু কনার কারণ হচ্ছে আঁধার। হ্যাঁ আঁধার’ই AR রোদ। আর সেই চারজন টিম মেমবার হলো- ইসি, আপন, অয়ন, আসিক। আর যে মেয়েটি আহত হয়েছে সে ইসি। ইসিকে এখন আপন সামলাচ্ছে। কারণ আপনও একজন ডক্টর। মুন আবারো অস্পস্ট স্বরে বলল,

—“মি.হাসবেন্ডস আপনি’ই AR! একটা ক্রিমিনাল আপনি? আমার স্বামী একজন খুনি?”

মুনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। কষ্টে বুক ফেটে আত্মনাদ বেরিয়ে আসতে চাইছে। আর মুনের চোখের জল দেখে আঁধারের বুক ফেটে যাচ্ছে। মুনের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখে পৃথিবী পুরো ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে। মুন এখানে কিভাবে এলো? মাথা কাজ করছে না আঁধারের। ও মুনকে এখন সব কি করে বুঝাবে? মিথ্যেও বলা যাবে না কারণ মুন নিজের চোখে সব দেখেছে। মুন আবার ওকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? না, না, কখনো না। আঁধার এক পা সামনে এগোতেই মুন হাত উচিয়ে থামিয়ে দিলো। আঁধার কিছু বলতে চাইলো কিন্তু মুন থামিয়ে দিলো।

—“মুন তুমি ভুল……”

—“আমি কিছু শুনতে চাই না Mr.AR অর্ফে আঁধার রেজওয়ান।”

কঠোর গলায় কথাটা বলেই মুন ওখান থেকে দৌড়ে চলে গেল। আঁধার পাশে থাকা গাড়িতে লাথি দিয়ে বলে,

—“ওহ শিট!”

আঁধার চেয়ে ও যেতে পারে না মুনের পেছনে। ওর জীবনর সব থেকে বড় ভুল এটাই ছিলো। আঁধার দেখে ইসির অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপ হচ্ছে। আঁধার তাড়াতাড়ি ইসিকে গাড়িতে তুলতে বলে। আপন পাজা কোলে করে ইসিকে গাড়িতে উঠায়। আঁধার ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। অয়ন আর আসিক এদিকটা সামলায়।

.
মুন একটা ওটো নিয়ে সোজা খাট বাড়িতে চলে যায়। গিয়েই কবির খানের বুকে ঝাপিয়ে পরে। হঠাৎ করে মেয়েকে দেখে অবাক হয় তার থেকেও বেশি অবাক হয় মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনে। কবির খানমেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,

—“কি হয়েছে আম্মু আমাকে বলো? তোমার চোখের জল কে ঝরিয়েছে তাকে আভি কঠিন শাস্তি দিবো।”

মুন একটু আগে দেখা সব ঘটনা খুলে বলে কবির খানকে। সব শুনে কবির খানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। মুনকে বিয়ে করার জন্যও আঁধার কবির খানকে ভয় দেখিয়ে ছিল সে তখনো জানতো না যে আঁধার একজন মাফিয়া। তার কিছু দিন পরই আরমান রেজওয়ান তাহেরার জন্য সমন্ধ নিয়ে আসেন নিজের এক মাত্র ছেলের। কবির খান আঁধারকে বড় হওয়ার পর আর দেখেনি। আর তাহেরাকে দেখতে আসার পরের দিনই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আঁধারকে ভালো করে দেখার সুযোগই হয়নি। কিন্তু বিয়ের দিন যখন তিনি আঁধারকে বর বেশে দেখে তখন প্রচুর অবাক হন। তারপর আবার শোনেন তাহেরা পালিয়ে গেছে। তখনি আঁধার কবির খানকে বলে।

—“শশুরমশাই এখনো সময় আছে আপনার ছোট মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিন। নাহলে আপনার বড় মেয়ে এত রাতে নির্জন রাস্তা দিয়ে একা বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাচ্ছে। যা কি হতে পারে ওর সাথে। এমনও হতে পারে, জীবনে ওর মুখ আর নাও দেখতে পারেন।”

আঁধারের একথা শুনে কবির খান ঘাবড়ে যান। আর মুনের বিয়ে আঁধারের সাথে দিয়ে দেন উনি মনে করেন হয় তো আঁধার মুনকে ভালোবাসে তাই হয়তো এরকম পাগলাপি করছে। কিন্তু উনি ভাবতেও পারেনি আঁধার আসলে কি। কবির খান মেয়েকে পানি খাইয়ে শান্ত গলায় বললেন,

—“এবার তাহলে তুমি কি চাও? আম্মু তুমি যা চাইবে তাই হবে।”

মুন পাথরের মতো বসে আছে। অনেক বড় ঝটকা খেয়েছে। কাদতে কাদতে চোখ দূটো ফুলে গেছে। মুন শক্ত গলায় বলল,

—“আব্বু আমি এদেশ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে চাই। কারণ যদি এদেশে থাকি তাহলে উনি আমাকে যে কোরেই হোক খুজে বের করবে। আমি এদেশ থেকে অন্য কোথাও যেতে চাই। যেখানে উনি আমাকে কখনো খুজে পাবেন না।”

কবির খান দিধা না করে বললেন,

—“কোথায় যেতে চাও?”

মুন না ভেবেই বলল,

—“ইংল্যান্ড, ঊর্মি ও ওখানেই থাকে।”

—“আমি ও যাবো তোমার সাথে। কবে যেতে চাও বলো।”

—“আজ’ই। কিন্তু তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আর আব্বু উনি যেন কোনো ভাবেই যানতে না পারেন যে আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি আর কোথায় যাচ্ছি।”

কবির খান আশ্বাস দিয়ে বললেন,

—“কখনো জানতে পারবে না।”

কবির খান এক ধ্যানে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন হঠাৎ কেই যেন বড় হয়ে গেছে তার পরি। একদিনেই কেমন পাথরে পরিনত হয়েছে। কবির খান মনে মনে প্রতিগ্গা করলেন, আঁধারকে কখনো ক্ষমা করবেন না তার মেয়ের ফুলের মতো জীবনটাকে নষ্ট করার জন্য। সেই ফুল নিয়ে খেলা করার জন্য।

“চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here