পদ্মপুকুর পর্ব: ১০,১১

0
369

পদ্মপুকুর
পর্ব: ১০,১১
লিখা: বর্ণালি সোহানা
পর্ব: ১০

খানিকক্ষণ পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ওই পুষ্করিণীতে তো দেও আছে তারা মিয়া।”

প্রথমে কথাটা বোধগম্য হয় না তাদের। ফরুক মোল্লা তাদের সবকিছু বুঝিয়ে বললেন। তাঁর সম্পূর্ণ কথা শুনে বোঝা গেল যে অদৃশ্য কোনো শক্তি আছে ওই পুকুরে। পদ্মপুকুরের উত্তর পাশে বিশাল এক খালি মাঠের পর একটা শ্মশান ঘাট রয়েছে। সেই খালি মাঠে প্রতিবছর চড়ক পূজা হয়। চড়ক পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি লোকোৎসব। চৈত্র মাসের ঠিক শেষ দিন অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। পূজাটা অনেক বড় একটা চড়কগাছকে কেন্দ্র করে হয়। প্রত্যেক গ্রামে বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চললেও কুমুদবহুলা গ্রামে এই পূজা কেবল একদিনই হয়। এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। এইদিন চড়ক সংক্রান্তির মেলা বসে। কথিত আছে, এই দিনে শিব-উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মহাদেবের প্রীতি উৎপাদন করে অমরত্ব লাভের জন্য ভক্তিসূচক নৃত্যগীতাদি ও নিজ গাত্ররক্ত দ্বারা শিবকে তুষ্ট করে অভীষ্ট সিদ্ধ করেন। সেই স্মৃতিতে শৈব সম্প্রদায় এই দিনে শিবপ্রীতির জন্য উৎসব করে থাকেন। পূজার বিশেষ একটি অঙ্গের নাম নীলপূজা। অন্যান্য জায়গায় পূজার ঠিক আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু কুমুদবহুলা গ্রামে পূজার আগের রাতে পদ্মপুকুর থেকে গায়েবি চড়কগাছ উঠে আসে। আর পূজা শেষ হবার পর রাতেই চড়কগাছটি আবার সেই পুকুরেই গায়েব হয়ে যায়। আগের সে জায়গায় আর চড়কগাছ খুঁজে পাওয়া যায় না। পূজার সম্পূর্ণ সামগ্রী পদ্মপুকুর থেকেই গায়েবীভাবে উঠে আসে। পূজা শেষে আবার সেসব সামগ্রী হিসেব করে পুকুরের পাশে রেখে আসতে হয়। একটা জিনিস কম হলে জিনিসগুলো ফিরে যায় না বরং ওখানেই পড়ে থাকে। সব জিনিস ঠিকমতো হলেই তবে তা পুকুরের তলে মিলিয়ে যায়।

একবার এক মহিলা লোভ করে একটা থালা চুরি করেছিল। সেদিন কোনো জিনিস আর পুকুরের তলে ফিরে যায়নি। কতবার পুকুরে জিনিস ডুবিয়ে দেওয়া হলো তবুও আবার ভেসে ওঠে। সবাইকে জিজ্ঞেস করা হলেও কেউ স্বীকার করল না যে কোনো জিনিস নিয়েছে। চড়ক পূজা শেষ হওয়ার তিনদিন পর ওই মহিলার লাশ পুকুরে ভাসতে দেখা যায়। সেদিন সে মহিলার মৃত্যু হওয়ায় সন্দেহজনক তার ঘর তল্লাশি করার পর থালাটা খুঁজে পাওয়া যায়। তারপর যখন সব জিনিস একত্রে পুকুরে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তখন তা তলে মিলিয়ে যায়, আর ভেসে আসে না। এই উড়ো কথা গ্রামের সবাই জানে এবং বিশ্বাসও করে। হাজার বছর ধরেই এসব চলে আসছে।

গায়েবী চড়কগাছ উঠে আসার পর এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এই পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির উপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারনো বা হাজরা পূজা করা। এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের উপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তারা স্বেচ্ছায় ঝুলে পড়ে। শিকলে ঝুলার আগে নেশাদ্রব্য পান করানো হয় যাতে কোন হুঁশ না থাকে। তাদের পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনও কখনও জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। এই নিয়ম পালন করা যদিও আইনানুসারে অপরাধ কেননা এই নিয়ম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবুও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনও তা প্রচলিত আছে। বিশেষত যারা এসব সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না তারা এটা পালন করে প্রতি বছর। হঠাৎ করেই এমন অবিশ্বাস্য একটা বিষয় সামনে এসেছে। তারা মিয়া একদম চুপসে গেছে। মনিরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

ফরুক মোল্লাকে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “এত মাইনষের মইধ্যে আমারেই ক্যান বাইছা নিলো হুজুর?”

চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে উপরের তাক হতে পুরনো ছেঁড়া একটা বই বের করে আরবীতে কিছু পড়লেন। তারপর তিনি জবাব দিলেন, “তোমাকে বেছে নেয়ার একমাত্র কারণ নূর।”

তারা মিয়া স্তব্ধ হয়ে আছে। নূরের কারণে কেন তাকে বেছে নিয়েছে সেই অদৃশ্য শক্তি? হুজুর এরপর যা বললেন তা শুনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মূলত তারা মিয়া এক সন্তানের বাবা। অনেক দোয়া ও মানত করার ফলে নূর তাদের ঘর আলোকিত করে এসেছে। কোন সন্তান ছিল না তাদের। তার উপর নূর তার নামের মতোই সুন্দর। ওই অদৃশ্য শক্তি নূরের দিকে নজর দেওয়ার কারণ নূর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। দেখতে ঠিক চাঁদের মতোই সুন্দর! যেমন সেই দেওটা চায়। একবার যখন নজর দিয়েছে তখন নূরকে না নিয়ে ক্ষান্ত হবে না৷ তারা মিয়া ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। মনির তার কাঁধে হাত রেখে ভরসা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। সে নিজেও তার জায়গায় যে কেউ হলেও এমন ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। কোনো পিতাই চাইবে না তার একমাত্র সন্তানকে হারাতে। এসব কিছুই ভাবনার বাইরে ছিল তারা মিয়ার কাছে। তার একমাত্র সন্তানকে সে হারাতে চায় না। ফরুক মোল্লার কাছ থেকে তাবিজ, পানি পড়া, তেল পড়া এসব নিয়ে গভীর রাত করে বাড়ি ফিরে আসে দু’জন। মনির তাকে ঘরের সামনে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়৷ চাঁদের মতো ছেলেটার জন্য চিন্তা তারও হচ্ছে। রাবিয়া আর নূর তখন গভীর ঘুমে ছিল৷ তারা মিয়ার ডাকে রাবিয়া দরজা খুলে দেয়। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে সে।

রাবিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কী হইছে আপনার? এমন করতাছেন ক্যান? আর আইজ এত রাইত হইলো যে? মাছ ধরতেও তো যান নাই আইজকা৷”

রাবিয়ার কোনো কথার উত্তর দেয় না তারা মিয়া। নূরের গলায় আর হাতে দুইটা তাবিজ বেঁধে দেয়। একটু তেল পড়া নূরের কপালে, গলায় ও বুকে লাগিয়ে দেয়। রাবিয়া তার এসব কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে চুপচাপ। কেননা সে জানে এই মুহুর্তে কিছু বললেও তারা মিয়া শুনবে না। তার চেয়ে সে যা ভালো বুঝে তাই করুক। কোনো কাজে যদি কারো মানসিক প্রশান্তি আসে তাহলে তাকে তা করতে দেওয়া উচিত। রাবিয়া খাবার বেড়ে দিয়ে অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। তারা মিয়া খাবার না খেয়েই নূরের পাশে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। খাবার যেভাবে ঢাকা ছিল সেভাবেই ঢাকা থাকে।

১০.

তারা মিয়া আর মনির যাওয়ার পর থেকেই ফরুক মোল্লা কেমন অস্বস্তি অনুভব করছেন। মনে হচ্ছে যেন তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্রতি রাতেই, গভীর রাত পর্যন্ত তেলাওয়াত করেন তিনি। কিন্তু আজকে তাঁর প্রচণ্ড ঘুম আসছে, তেলাওয়াত করতেই পারছেন না। আচমকা তিনি প্রস্রাবের চাপ অনুভব করলেন। কোরআন শরীফ বন্ধ করে বাইরে যান প্রস্রাব করতে। প্রস্রাব করতে বসলেই সামনে যেন অজগর সাপের মত বড় সাপের ছায়া দেখতে পান। তখনই ধপ করে পেছন দিকে পড়ে যান ফরুক মোল্লা। হৃদপিণ্ডের ধুকধুকানি বেড়ে যায়। ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছেন। কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে উঠে আসেন। গায়ে কাঁদা লেগে কাপড়চোপড় নোংরা হয়ে গেছে। অপবিত্র হয়ে গেছেন তিনি। এই মুহুর্তে গোসল করতে হবে তাঁর। ঘরের ভেতর থেকে কাপড় নিয়ে এসে পুকুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ফরুক মোল্লা। তার মাথায় এখন একটাই কথা তিনি অপবিত্র। পেছন পেছন যেন কোনো একটা ছায়া তেড়ে আসছে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলেন। ছায়ার গতিও যেন বেড়ে গেল। হুট করেই থমকে পেছন ফিরে তাকালেন তিনি। কিন্তু কোথাও কেউ নেই৷ আশেপাশে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে এগিয়ে যান। পুকুর পাড়ে এসে কাপড় রেখে গোসল করার জন্য অজু করতে পানিতে হাত দিলেই অজানা শক্তি তার ঘাড় চেপে ধরে পুকুরের পানিতে৷ ফরুক মোল্লা প্রাণপণে চেষ্টা করছেন পানি থেকে উঠে আসার কিন্তু পারছেন না। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর৷ দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। পানির নিচে চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। চোখের সামনে সেই সাপটা ফণা তুলে আছে। নাকে-মুখে পানি ঢুকে যাচ্ছে। হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলেন। পানিতে দাবড়ানো শুরু করে দেন তিনি৷ নাক, মুখ আর চোখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে শুরু হয়। পুকুরের পানির রঙ লাল হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ফরুক মোল্লার দাবড়ানো কমে যায়৷ তার শরীর একদম শান্ত হয়ে আসে। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

আজকে আর মসজিদে ফজরের আজান দেওয়া হয়নি। ফজরের নামাজ পড়তে এসে গ্রামের লোকজন ফরুক মোল্লার লাশটা পানিতে ভাসমান অবস্থায় দেখতে পায়। সকলে ধরাধরি করে উপরে তোলে। পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে। তারা মিয়া আর মনিরকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। এশার নামাজ পড়তে যারা এসেছিল তারা জবানবন্দি দেয় যে, সবার শেষে তাদের দু’জনকেই হুজুরের সাথে দেখা গিয়েছিল। মনির আর তারা মিয়া যেন বিষয়টা বিশ্বাসই করতে পারছে না। সন্ধ্যাতেই তারা দু’জন গিয়ে দেখা করে এসেছিল আর আজ ভোর হতেই কী হয়ে গেল! পুলিশকে সম্পূর্ণ বিষয় খুলে বলেনি তারা। শুধু বলল ছেলের জন্য পানি পড়া আর তেল পড়া নিতে এসেছিল। লাশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায় পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে তার। ফরুক মোল্লার পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। বয়স খুব বেশি ছিল না ফরুক মোল্লার। চল্লিশ ছাড়িয়েছে প্রায়। এই অকাল মৃত্যু অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মৃত্যুতে একটা পরিবারের জীবন থমকে গেল। থমকে যাওয়ার কারণ একমাত্র আয়ের মাধ্যম ছিলেন ফরুক মোল্লা। মসজিদের এই চাকুরির টাকা দিয়েই চলত তাঁর সংসার। গ্রামের সবাই আফসোস করে কিছুদিন, আবার সবার চলাফেরা স্বাভাবিক হয়ে আসে। জীবনটা বড়ই অদ্ভুত রঙ দেখায়। যতক্ষণ আমাদের প্রিয় মানুগুলো সামনে থাকে ততক্ষণ আমরা তাদের ভালোবাসি, ঘৃণা করি বিভিন্ন অনুভূতি থাকে তাদের প্রতি যা প্রকাশ করি কিন্তু যখন তারা পৃথিবী থেকে আড়াল হয়ে যায় তখন আমরা তাদের ধীরে ধীরে ভুলতে শুরু করি। কিছু স্মৃতি কেবল রয়ে যায় মনের গহীনে, যদিও তাদের প্রতি জমানো অনুভূতিগুলোতে জং ধরে যায় দিনকে দিন। কখনো মনে করলেও তার প্রতি তেমন কোনো অনুভূতি কাজ করে না, শুধু থাকে একবুক দীর্ঘশ্বাস।
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

❝পদ্মপুকুর❞
পর্ব: ১১
.
সবকিছু স্বাভাবিক হলেও, স্বাভাবিকভাবে চলছে না তারা মিয়ার জীবন। প্রতিনিয়ত একটা অজানা ভয় কাজ করছে তার মাঝে৷ ফরুক হুজুরের আচমকা মৃত্যুটা যেন মেনে নিতে পারছে না সে৷ রাত জেগে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে তার। কখন ভোর হবে সেই অপেক্ষায় থাকে। এই রাতটা যেন ভয়ংকরভাবে নিঃসঙ্গ করে তুলে তারা মিয়াকে। ভোরের সূর্যোদয়ের সাথেই এই নিঃসঙ্গতা ও নীরবতার অন্ত হয়।

নূর আজকে প্রথম স্কুলে যাচ্ছে। রুমেল, সবুজ আর পলি অপেক্ষা করছে তার জন্য। তারা মিয়া আজ তাকে ভর্তি করে দিবে গ্রামের সরকারি স্কুলে। স্কুলে যাওয়ার জন্য নূর অনেক পাগল ছিল। কারণ একমাত্র স্কুলেই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এক। কেউ বড়-ছোট নয়। নেই কোনো ভেদাভেদ, সবাই সমান। নূরকে তার মা রাবিয়া বলেছে সব জায়গায় ধনী-গরিবের পার্থক্য হলেও একমাত্র ব্যতিক্রম স্কুল যেখানে কোনো ধনী-গরিবের পার্থক্য হয় না, সেখানে শুধু জ্ঞানের পার্থক্য চলে। কার জ্ঞান কত বেশি আর কার কম। সেদিন থেকেই নূর অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করবে বলে পণ করেছে। সে চায় অধিক জ্ঞানের অধিকারী হতে। যাতে ধনী ও গরীবের পার্থক্যটা থাকে না। সবসময়ই দেখছে চেয়ারম্যান বাড়িতে সবাই সাহায্য চাইতে আসে।

সে যখনই তার মাকে জিজ্ঞেস করত, “সবাই ক্যান ওই বাড়িত সাইয্য চাইতে যায়?”

রাবিয়া বেগম তখন বলত, “হেতেরা বেজায় বড়লোক। তাগোর অনেক টেকা-পয়সা আছে। তাই সবাই তাগোর বাড়িত যায়।”

নূর চেয়ারম্যানের মতো বড়লোক হতে চায়। কিন্তু সে তো জানে না চেয়ারম্যান সবচেয়ে বড় গরীব। সে গরীবের টাকা দিয়েই চলে। যারা গরীবের টাকা খেয়ে চলে তাদের চেয়ে গরীব আর কেউ হতে পারে না।

স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তারা মিয়া। এত তাড়াতাড়ি স্কুলে এসেছে যে দপ্তরি ছাড়া তেমন কেউই আসেনি। স্যার আসতেই নূরকে ভর্তি করে দিয়ে তাকে ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসিয়ে দিল। বাবা-ছেলে দু’জনই খুব খুশি। দুই টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে কাজের জন্য চলে গেল সে। নূরের ঠোঁটের মাঝে প্রশস্ত হাসি লেগেই আছে। ক্লাসে শিক্ষিকা এসে সব ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি নেন। সবার শেষে নূরের নাম ডাকা হয়। প্রথমে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। তার পাশের ছেলেটা তাকে শিখিয়ে দেয়। চারপাশের সবকিছু অচেনা ও নতুন। বারবার তাকাচ্ছে সবার দিকে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল প্রায় সবার জামার রঙ এক। সবুজ, রুমেল আর পলিকেও সে এমন জামা পরতে দেখেছে। নিজের দিকে একবার তাকাল নূর। নিজের দিকে তাকিয়ে কিছুটা চুপসে যায় সে। হলুদ আর সবুজ রঙে মিশ্রিত একটা শার্ট পরে এসেছে। কিন্তু কয়েকবার খেয়াল করার পর দেখল শার্টের রঙটা মলিন হয়ে গেছে। এটা রাবিয়া বেগমকে ফরিদা বানু দিয়েছিলেন, তার নাতির শার্ট ছিল। নূরের ভয় ভয় লাগছে৷ মনের ভেতর এখন একটাই প্রশ্ন, তাকে কেন এমন জামা দেওয়া হল না? সবাই শিক্ষিকাকে আপামনি ডাকছে। নূর তাকে জিজ্ঞেস করবে কি করবে না সে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে আছে। ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে যায় নূর।

“আফামনি আমারে কী এমন জামা দিবেন না? সবার ব্যাগ আছে আমারে দিবেন না?” কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল নূর।

ক্লাসে বাচ্চাদের মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। শিক্ষিকা টেবিলে ডাস্টার দিয়ে বাড়ি মেরে সবাইকে শান্ত করেন।

বসা থেকে উঠে নূরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “বাবা, আমরা তো এমন জামা আর ব্যাগ দিই না। এটা তোমার আব্বু বানিয়ে দিতে হবে। আমরা তো শুধু এই যে, এই বইগুলো দিই।”

নূর সবার দিকে তাকিয়ে দেখে সবাই মুখ টিপে হাসছে। ভয়ে তার হৃদপিণ্ডটা ধুপধাপ আওয়াজ করছে। কখন জানি কান্না করে দেয়। চুপসে গেছে একদম। স্কুল ছুটির পর বাড়িতে এসেই বইগুলো পাটিতে রেখে মায়ের কোলে চড়ে বসে।

রাবিয়া ছেলের মুখে চুমু খেয়ে বলল, “বাজান, ইশকুল ভাল্লাগছে? ম্যাডাম-স্যারগুলান আদর করছে আব্বা? তুমি অ-আ লেইখ্যা দেখাইছিলা? কী হইলো কতা কও বাজান।”

নূর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আম্মা, আমার ইশকুলের জামা লাগবো। মাছওলা ব্যাগ লাগবো।”

রাবিয়া ছেলের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নূর আবার বলল, “আম্মা দিবা না?”

রাবিয়া ছেলের মুখ আঁচল দিয়ে মুছে বলল, “তোমার আব্বায় আইনা দিবো বাজান। এখন চাইড্ডা ভাত খাইয়া লও। সেই সক্কালে খাইছো আর খাও নাই। আহো আম্মায় খাওয়াই দিই তোমারে।”

রাবিয়া একটা থালায় ভাত আর ডাল মেখে ছেলের মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। নূর পা দুলাতে দুলাতে মায়ের কানের দুল নাড়াচাড়া করছে আর ভাত চিবাচ্ছে। তার স্বাদ লাগে না এসব খেতে। মুখে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে চিবায় তারপর গিলে।

১১.

নূর স্কুলের সদর দরজায় এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করছে না স্কুলে যেতে। মায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ছে। সব জায়গায় ধনী-গরিবের ভেদাভেদ হলেও একমাত্র স্কুল, যেখানে কোনো ধনী-গরিবের ভেদাভেদ হয় না। সেখানে শুধু জ্ঞানের ভেদাভেদ চলে। মায়ের বলা এই কথাগুলো মিথ্যে ছিল। স্কুলেও কিছু কিছু ধনী-গরিবের ভেদাভেদ চলে। যারা সুন্দর পোশাক পরে আসে তাদের আর ধনীর ঘরের সন্তানদের একজন শিক্ষক আলাদাভাবে আদর করেন। একদিন পড়া না পারলেও তিনি তাদের মারেন না। তারা সবসময় প্রথম বেঞ্চে বসে৷ অথচ নূরের মত যারা, তারা পড়া না পারলে মাইর খায়। বাবা-মা তুলে গালাগাল শুনতে হয়। শুধু পড়ার জন্য নয় এখন প্রতিদিন তাকে স্কুলের ড্রেস না পরে আসার জন্য গালাগাল শুনতে হয়। কিন্তু তার তো স্কুল ড্রেস নেই।

মাকে গিয়ে কতদিন বলল, “আম্মা ইশকুলের স্যার পত্যেকদিন কয় আমার ইশকুলের শার্ট নিয়া যাইতে। আব্বারে কও না বানাই দিতে। সবাইর ইশকুলের শার্ট আছে আমারই নাই।”

প্রত্যেকবার রাবিয়া তাকে এটা-ওটা বলে ভুলিয়ে নেয়। দিবে বলেও দেয় না। বগলে করে হাত দিয়ে ধরে বই নিয়ে যায়। একটা স্কুলের ব্যাগও নেই তার। নূর স্কুলের ভেতর যাচ্ছে না দেখে তারা মিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে বাজান? যাইবা না?”

নূর না সূচক মাথা নাড়ে৷ তারা মিয়া সাইকেল দেয়ালে ঠেকিয়ে রেখে নূরের পাশে এসে জিজ্ঞেস করল, “ক্যান যাইবা না বাজান?”

“আব্বা সবার ইশকুলের শার্ট আছে আমার নাই। স্যার পইত্যেকদিন কয় শার্ট নিয়া যাওনের লাইগা। আমারে শার্ট না দিলে আমি আর যামু না।”

তারা মিয়া স্কুলের ভেতর একবার তাকায়। তারপর নূরকে বলল, “বাজান আইজকা যাও। কাইল আব্বায় তোমারে ইশকুলের শার্ট আইনা দিমু।”

নূরের চোখ-মুখ মুহুর্তেই হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। খুশি তার মুখে উপচে পড়ছে।

“হাছা কইতাছো আব্বা?”

“হো বাজান তোমার আব্বা মিছা কথা কয় নাকি? কাইলই তোমারে শার্ট আইনা দিমু।”

নূর তারা মিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে স্কুলের ভেতরে চলে যায়। কালকেই তার স্কুল ড্রেস আসবে। স্কুলের বাংলা ম্যাডাম তার খুব প্রিয়। একমাত্র তিনি সবার থেকে আলাদা। তিনি সবাইকে আদর করেন, নূরকে একটু বেশিই আদর করেন। তাকে দেখলে মনে হয় যে, সব স্যার ম্যাডাম এক রকম নয়। ক্লাসের ফাঁকে বাচ্চাদের সাথে খেলেন তিনি। যদিও অন্যান্য শিক্ষক এটা নিয়ে তার পেছনে বেশ সমালোচনা করে। কিন্তু প্রধান শিক্ষজ এতে ভীষণ খুশি কারণ বাচ্চাদের শুধু ধমক দিয়ে পড়া আদায় করলে হয় না, আদর দিয়েও পড়া আদায় করা যায়।

নূরকে স্কুলে দিয়ে তারা মিয়া চেয়ারম্যান বাড়িতে যায়। চেয়ারম্যান উঠোনের এক মাথায় চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন। আব্দুল্লাহ পাশে দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে তাকে।

তারা মিয়া চেয়ারম্যানের পাশে দাঁড়িয়ে মিনমিন করে বলল, “ভাইজান আমার পোলাডারে ইশকুলে দিছি। এহন পোলাডার একটা ইশকুলের শার্ট নাই। আপনার মাসুম বাবার পুরান একটা শার্ট থাকলে যদি দিতেন তাইলে আমার নূর ইশকুলে শার্ট পইরা যাইতে পারতো৷ আমার তো ভাইজান নতুন শার্ট বানাই দেওনের ক্ষেমতা আল্লা দেন নাই।”

চেয়ারম্যান বাকি কথা শুনার আগেই বললেন, “আরে ঠিকাছে এতকিছু কইতে হয় নাকি? তোমার পোলা তো আমার পোলার মতোই।”

চেয়ারম্যান তার স্ত্রী হালেমাকে ডেকে মাসুমের পুরনো স্কুলের শার্টটা খুঁজে দিতে বললেন। হালেমা শার্ট আর প্যান্ট বের করে একটা ব্যাগে ভরে দিল। তারা মিয়া চেয়ারম্যানকে সালাম জানিয়ে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। রাবিয়ার ঠোঁটের কোণে কাপড়গুলো দেখে প্রাপ্তির এক হাসি ফুটে ওঠে। কাপড়গুলো নিয়ে ভালো করে ধুয়ে রোদে দেয়। কাল তার ছেলে স্কুলের শার্ট পরে যাবে। শার্ট দেখে নূরের খুশি কে দেখে! এখন থেকে সে প্রতিদিন স্কুলের শার্ট পরে যাবে। কতবার যে পরে দেখেছে তার কোনো ঠিক নেই। এখন শুধু স্কুলের ব্যাগটা বাকি।

স্কুলে নূরের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। রাবিয়া সন্ধ্যায় অনেক পড়িয়েছে তাকে৷ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নূর পড়তে বসেছিল। সব একদম গড়গড় করে বলতে পারে, লিখতেও পারে। তারা মিয়া নূরকে নিয়ে স্কুলে যায়। তার জায়গায় বসিয়ে দিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিল। অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের মা-বাবাও এসেছে। ক্লাসে বেঞ্চগুলো তিন সারিতে ভাগ করে বসানো হয়েছে। নূর তৃতীয় সারির প্রথম বেঞ্চে বসেছে। একদম দরজার পাশে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ঢোকার আগে অনেক বাচ্চার মা-বাবা বারবার বলছেন যে, তাদের ছেলেমেয়ের দিকে একটু খেয়াল রাখতে। শিক্ষক সবাইকে হাসিমুখে বললেন, তিনি খেয়াল রাখবেন, কোনো সমস্যা নেই।

তারা মিয়া ভয়ে ভয়ে শিক্ষকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “স্যার আমার নূর সব পারে। তারে একটু বোঝাই দিয়েন।”

তারা মিয়ার কথায় শিক্ষক অনেক ক্ষেপে যান। কর্কশ গলায় বললেন, “সব যখন পারেই তাইলে বোঝাই দিতে হইবো ক্যান? এখান থেকে যান। ভিড় জমাইয়েন না।”

নূর তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। শিক্ষক তার বাবাকে ধমক দিলেন কেন সে বুঝল না! অনেকের সাথেই তো ভালোভাবে কথা বললেন। কিন্তু তার বাবার সাথেই কেন এমন ব্যবহার?

নূর স্কুল হতে আসার পর থেকেই মন খারাপ। পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে। কিন্তু সকালে তার বাবার সাথে হয়ে যাওয়া ঘটনা ভুলতে পারছে না। তার ছোট্ট মাথায় যেন ঘটনাটা বসে গেছে। আজকাল প্রতিদিন নূর তারা মিয়ার কাছে পঞ্চাশ টাকা চায়। সে প্রতিদিন বলে দেবে কিন্তু দিতে পারে না। দিবে কীভাবে? কাজ নেই কোনো। কাজ না থাকলে টাকা আসবে কোথা থেকে। কাজের জন্য লোকে এখন তাকে নেয় না। রোগা শরীর দেখলে চলে যায়। আর নিলেও দিন হিসেবে মাত্র একশত বিশ টাকা দেয়। এই টাকা দিয়ে ঘরের খরচ করবে নাকি ছেলেকে দিবে? কাজের সন্ধানে মনিরকে লাগিয়েছে। মনির কাজ পেলেই জানাবে তাকে। তারা মিয়া উঠানে বসে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছে।

নূর গিয়ে পাশে বসে ফিসফিস করে বলল, “আব্বা পইঞ্চাশ টেহা দিবা না?”

নূরের এই ফিসফিস করে বলার কারণ মা শুনলে তাকে বকবে। তারা মিয়া ছেলের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে আছে। আজ তাকে টাকা দিবে বলে কথা দিয়েছিল অথচ দিতে পারল না। তার এই অপারগতার পেছনে একটাই কারণ এখন কোনো কাজ নেই। নূরের মাথায় হাত দিয়ে কিছু না বলেই মুখ ধুতে চলে গেল।

কাজের সন্ধানে আজও বের হয়েছে তারা মিয়া। যাওয়ার সময় নূরকে বলে গেছে পঞ্চাশ টাকা দিবে। নূর তখন থেকেই মহাখুশি। কিন্তু কাউকে কিছু বলছে না। কথাটা নিজের ভেতরেই রেখেছে। মনের মাঝে তার এখন হাজারও ভাবনা। টাকা পেলেই বাবার সাথে বাজারে যাবে। সেই টাকা দিয়ে সে সম্মান কিনে আনবে।

একবার বাবার মুখে শুনেছিল, “যাগোর টেহা আছে তাগোরই সম্মান মেলে এই দুনিয়ায়।”

স্কুলে সবার বাবা-মা সম্মান পায়। শুধু তার বাবাই পায়নি। তার বাবা পেয়েছিল ধমক। কারণ তাদের টাকা নেই। যাদের টাকা আছে তাদের সবাই সম্মান দেয়। ভয় পায়। কথা বললেও আদবের সাথে বলে। আর গরিবের সাথে কেউ আদবের সহিত কথা বলে না, ধমকের স্বরে বলে। যার যত টাকা তারই তত সম্মান। টাকায় যোগ্যতা আনে। টাকা না থাকলে শুধু জ্ঞান দিয়ে যোগ্যতা অর্জন করা আমাদের বর্তমান সমাজে অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। টাকা থাকলেই সবকিছু সহজতর হয়। একমাত্র টাকাই পারে মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহার পরিবর্তন করে দিতে।
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here