পদ্মপুকুর পর্ব: ১২

0
361

পদ্মপুকুর
পর্ব: ১২

১২.

চেয়ারম্যান বাড়িতে মানুষের ঢল। সকাল থেকে দুইবার পুলিশ এসেছে বাড়িতে। ফরিদা বানুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না গতকাল বিকেল থেকেই। সবাই ভেবেছিল ঘুমিয়ে আছেন তিনি কিন্তু রাতে যখন খাবার খেতে ডাকতে যাওয়া হয় তখন থেকেই বোঝা যায় ফরিদা বানু গায়েব। রাতে আর কোনো কিছুতে না গিয়ে সকালেই পুলিশকে টেলিফোন করেন চেয়ারম্যান। গ্রামে একমাত্র চেয়ারম্যান বাড়িতে টেলিফোন আছে আর বাজারে মহাজনের দোকানে একটা টেলিফোন। কথা বলতে হলে মহাজনের দোকানেই সবাই যায়। মিসড কল দিতেও সাত টাকা দেওয়া লাগে আর কল দিয়ে যত মিনিট কথা বলবে তত মিনিট হিসাব করে টাকা দিতে হয়। প্রতি মিনিট হিসাব একুশ টাকা করে।

গ্রামে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। হাশিম চেয়ারম্যান বারান্দায় বসে একের পর এক নাম্বারে ফোন করেই যাচ্ছেন। কোনো জায়গা থেকেই খবর পাচ্ছেন না। মায়ের জন্য তার সবসময়ই আলাদা টান কাজ করে। যে-কোনো কাজে যাবার আগের রাতে তিনি তার মায়ের ঘরে যেতেন। মায়ের কোলে মাথা রেখে বলতেন, “আম্মা আমার মাথায় দোয়া পইড়া একটা ফুঁ দিয়া দেও৷ দেখবা কাইল আমার সব ঠিকমতো হইয়া যাইবো।”

ফরিদা বানু হেসে ছেলের মাথায় হাত রেখে বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতেন। আল্লাহর কী অসীম লীলা মায়ের দোয়া বিফলে যেত না। হাশিম আহমেদ তার কাজে সফল হয়ে যেতেন। মায়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে বারবার কান্না করছেন তিনি। অথচ ছেলের বউ একফোঁটা চোখের জলও ফেলছে না। নাতিটা বারবার দাদু কোথায় জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু কোনো উত্তর নেই। একদিকে ফরিদা বানুর ছেলে পেরেশান হয়ে যাচ্ছেন অন্যদিকে ফরিদা বানু আনমনে বসে আছেন বাসস্ট্যান্ডে। গতকাল রাতে আব্দুল্লাহ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। বাসের টিকেট কেটেছে দু’জনের। সকাল দশটায় বাস আসবে৷ ছোট ছেলের কাছে চলে যাবেন তিনি। ফরিদা বানুর চশমা ঝাপসা হয়ে এসেছে। গাল বেয়ে অজস্র অশ্রু ঝরছে তার। জীবন ঘড়ির কাটা যে কখনো এভাবে মোড় নিবে ভাবতেও পারেননি তিনি৷ আজ ছেলে-মেয়ে মানুষ করে কারও কাছে ঠাঁই হচ্ছে না তাঁর। ছেলের বউয়ের চোখের বিষ হয়ে গেছেন। সন্ধ্যায় যখন হালেমা রাগের বশে গলা চেপে ধরল মনে হচ্ছিল ফরিদা বানু তখনই মারা যাবেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ হুট করে ঘরে আসায় তাঁর প্রাণ রক্ষা পায়। সে সম্পূর্ণ সন্ধ্যা ফরিদা বানুর পায়ের কাছে বসে কান্না করছিল। সবকিছু হাশিম চেয়ারম্যানকে বলে দিতে চাচ্ছিল। ফরিদা বানু বলতে দেননি। তার ছেলের সংসার ভেঙে যাক তিনি চান না। আব্দুল্লাহ ফরিদা বানুর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে৷ বাস আসলে চড়ে যাবে দু’জন। তাঁকে ছোট ছেলের কাছে দিয়ে আব্দুল্লাহ আবার গ্রামে ফিরে আসবে। কিছুক্ষণ পরই বাস চলে আসে। ফরিদা বানু জানালার পাশের সিটে বসে আছেন। ঢাকাগামী বাসটা দ্রুত চলতে শুরু করেছে। পেছনে চলে যাওয়া গাছপালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখের পাতা এক করলেই আটকে রাখা জল বাঁধাহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। আলতো করে চোখ বন্ধ করতেই কুচকে যাওয়া গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

হারুন জানেও না তারা যে ঢাকা আসছে। স্ট্যান্ডে নেমে আব্দুল্লাহ একটা রিকশাওয়ালাকে ডেকে ঠিকানা দেখালেই সে তাদের নিয়ে পৌঁছে যায় বাসায়। হারুন তখন অফিসে। ছোট ছেলে মুরাদ যখন দরজা খুলে দাদিকে দেখে তখন যেন তার খুশির সীমা থাকে না। মাকে রান্নাঘর থেকে টেনে আনে। জেসমিন শাশুড়ীকে দেখে পা ধরে সালাম করে ঘরে নিয়ে যায়। পুরো একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে তারা। হারুনের অফিস থেকে দিয়েছে এই ফ্ল্যাট। তাদের ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে হারুনের অফিসে টেলিফোন করে সবকিছু বলতেই সে দ্রুত ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। মাকে দেখামাত্রই কেঁদে দেয়। তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেন ফরিদা বানু। কতদিন পর ছেলেটাকে চোখের সামনে দেখছেন। প্রথম থেকেই হারুন তার মাকে সাথে রাখতে চেয়েছিল। বড় ভাইয়ের মুখের কথায় গ্রামে রেখে আসে মাকে। দুপুরে হয়তো তারা কিছুই খেতে পারেননি সেটা ভেবে জেসমিন খাবারের জন্য এটা-ওটা ব্যবস্থা করতে লেগে যায়। এতদিন পর তার শাশুড়ী এসেছেন। নিজের মাকে খুব বেশিদিন পায়নি জেসমিন। শাশুড়ীকে মায়ের চোখে দেখে সে। হারুনের চাকুরির জন্য গ্রাম ছেড়ে এসেছিল নয়তো সে গ্রামেই থাকত শাশুড়ীর সাথে। ঘরে একজন মুরব্বি থাকা অর্থ মাথার উপর একটা আশীর্বাদ থাকা। মুরব্বিরা ছায়া হয়ে থাকেন পাশে। শেষ জীবনে এদের দোয়াই সবসময় কাজে লাগে। হারুন বড় ভাইকে টেলিফোন করে জানায়। হাশিম অবাক হয়ে যায় তার মা তাকে না বলেই ঢাকা চলে গেলেন?

টেলিফোনের লাইন কাটার পর হারুন মাকে জিজ্ঞেস করল, “মা, তুমি বড় ভাইজানরে বইলা আসো নাই?”

ফরিদা বানু কোনো উত্তর দেন না। নাতি আর ছেলের বউ জেসমিনের সাথে গল্প করতে বসে যান। হারুন বুঝতে পারে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। আব্দুল্লাহকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে। আব্দুল্লাহ সবকিছু খুলে বলে। এসব শুনে তার রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। ভাবি, যাকে বড় বোনের মতো সম্মান দিত সেই কি-না আজ তারই মাকে মারতে চেষ্টা করেছে। বড় ভাইকে ফোন দিয়ে সবকিছু বলে দেয় সে। হাশিম বাইরে পায়চারী করছিল। সবকিছু শুনে রেগেমেগে ঘরে যায়। হালেমাকে চুল ধরে টেনে দরজা বন্ধ করে ইচ্ছেমত মারধর করে। মন চাইছিল পুলিশের কাছে দিয়ে দিতে। কিন্তু নিজের সন্তানগুলোকে মা হারা করতে চায় না বলেই পুলিশে দেয় না। পরদিন আব্দুল্লাহ গ্রামে ফিরে এসে আবার কাজে যেতে শুরু করে। কিন্তু মাসুম আর আগের মতো তার কাছে খেলতে আসে না। খুব কমই আসে। আব্দুল্লাহ বুঝে যায় যে, হয়তো তার মা না করেছে। অন্যদিকে ফরিদা বানুর কথাগুলো গ্রামে ধীরে ধীরে রটে যায়। সবাই এসব কথা নিয়ে কানাঘুষা শুরু করে দেয়।

মসজিদে নতুন ইমাম ও মুয়াজ্জিন হিসেবে করিম মিয়াকে রাখা হয়েছে। হাশিম চেয়ারম্যান নিজেই রেখেছেন হুজুরকে। করিম মিয়ার চেহারায় কেমন খারাপ খারাপ একটা ভাব আছে। কিছু মানুষকে দেখলেই কোনো কারণ ছাড়াই তাদের প্রতি ভিন্ন ধারণা আসে আমাদের। তেমনটা করিম মিয়ার বেলাতেও। কখনো কখনো এই ধারণা সত্যি হয় আবার কখনো মিথ্যে। কিন্তু করিম মিয়ার বেলায় ধারণাটা সত্যি হয়ে আসে আজ সকালে। বাচ্চারা যখন মসজিদে পড়ছিল তখন হঠাৎ করেই তিনি একটা বাচ্চা মেয়েকে ডাক দিলেন।

“আফিয়া এইদিক দিয়া আহো তো। ঘাড়ডা একটু টিইপ্যা দেও।”

ঘাড় টিপে দেওয়ার কথা বলতে আফিয়া টিপে দেয়। টিপতে টিপতে একসময় তার হাত ব্যথা হয়ে আসে। যখন পারছিল না তখনও করিম মিয়া বারবার জোরে টিপে দেওয়ার জন্য বলছিলেন। আফিয়া না পেরে ভয়ে কান্না করে দেয়। তিনি রেগে গিয়ে বেত দিয়ে তার হাতে কয়েকটা বাড়ি মেরে দেন। সে বাড়িতে গিয়ে কান্না করতে করতে সবকিছু তার বাবাকে বলে দেয়। মুহুর্তের মধ্যেই পুরো গ্রামে কথাটা রটে যায়। সকালে নাকি হুজুর বাচ্চা মেয়েকে দিয়ে তার ঘাড় টিপিয়েছেন। চেয়ারম্যানের কাছে বিচার যেতেই তিনি এই বিষয়টা দেখবেন বলেন। সন্ধ্যায় মেয়ের বাবা আর চাচা আসে চেয়ারম্যান বাড়িতে। করিম মিয়াকেও ডাকা হয় তাঁর কথা শোনার জন্য। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় তখন তিনি এসব কিছুই মিথ্যা বলে দাবি করলেও, হাশিম চেয়ারম্যান সবকিছু ভালোই আঁচ করতে পারেন। কারণ বাচ্চা মেয়ে তো আর মিথ্যা বলবে না। চেয়ারম্যানের কথায় করিম মিয়া ক্ষমা চেয়ে বলেছেন আর কোনোদিন এমন কথা আসবে না। গ্রামের মানুষের মতে, হয়তো কিছু কথা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যানের কথার উপর কারো কিছু বলার মত সাহস নেই। এমনিতেও এই মসজিদের আগের ইমাম ফরুক মোল্লা মারা যাওয়ার পর কেউ আসতে চায় না। অনেক কষ্টে একজন জোগাড় করেছেন চেয়ারম্যান। কথা এখানেই শেষ করা হয়। আফিয়া মসজিদে যেতে চাইলেও তার বাবা তার যাওয়া বন্ধ করে দেন। মসজিদের পড়ালেখা তো হয়ই না, স্কুলের পড়ালেখাও হয় না। এখন আফিয়ার বয়স সাত পেরোচ্ছে, কয়দিন পর তাকে বিয়ে দিতে হবে তখন আবার এসব কথা আসলে বিয়েতে সমস্যা হতে পারে। পড়ালেখা শিখে যেখানে ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিল একটি কচি প্রাণ সেখানে কিছু মানুষ ও সমাজব্যবস্থার কারণে তার সদ্য জন্মানো ডানাটাকে কেটে দেওয়া হয়।
.
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here