পদ্মপুকুর
পর্ব: ১৭ (শেষপর্ব)
লিখা: বর্ণালি সোহানা
.
রাত আনুমানিক তিনটা বাজে পদ্মপুকুরে পৌঁছে যায় তারা। অদৃশ্য আওয়াজটা পুকুরের ওপারে ঠিক ডানপাশে সিন্দুক আছে বলেছিল। সময় নষ্ট না করে পুকুরের ওপারে চলে যায় দু’জন। মনিরকে উপরে রেখে তারা মিয়া পুকুরের ডান দিকে নেমে পড়ে। ঠাণ্ডা পানিতে শরীর জমে যাওয়ার জোগাড়। ডুব দিতে যাবে সেই মুহুর্তে একটা সাপ ফণা তোলে তার সম্মুখে দাঁড়ায়। মনির ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বাড়িতে যে সাপকে মেরে কবর দিয়েছিল এই সাপটাও অবিকল সেদিনের সাপের মতোই। তারা মিয়া পানি থেকে উঠে আসতে চাইলেই সাপ তার ফণা নামিয়ে পানির নিচে চলে যায়। মনির তারা মিয়াকে দ্রুত উঠে আসতে বলে। সাপকে দেখে যেন মুহুর্তেই চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখতে পেল। তার কাছে প্রানের মায়াটাই এখন বড়। বেঁচে থাকলে এমন ধনরত্ন না পেলেও কোনোরকম খেয়ে-পরে তো যেতে পারবে। তারা মিয়াও পানি থেকে উঠে আসে। ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে। যখনই ফিরে যাবে তখন তারা সামনে নিজেদের ছায়া দেখতে পায়। পেছনে কিসের আলো? পেছন থেকে কিছু একটার আলো তাদের উপর এসে পড়েছে যার দরুন তারা নিজেদের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। তারা মিয়া আর মনির একে অপরের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে। সামনে যা দেখছে তা দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে। অবিকল সেদিনের মতোই হলুদ গালিচার উপর লাল রঙের সিন্দুক। আর সিন্দুকের উপর ফণা তুলে একটা সাপ বসে আছে। সিন্দুকটা শূন্যে ভাসমান। মনির ও তারা মিয়া ধীরপায়ে সিন্দুকের দিকে এগিয়ে যায়। দেখতে দেখতেই সিন্দুক পানির উপরে থেকে মাঠির উপর নেমে আসে। সাপ তার ফণা নামিয়ে ধীরে ধীরে পানিতে নেমে যায়। সাপ নামার সাথে সাথে আলোটাও মুহুর্তের মধ্যেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মনির হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দেয়। তারা মিয়া আর মনিরের ঠোঁটে মুখে প্রশস্ত হাসি ফুটে ওঠেছে। দ্রুত পায়ে সিন্দুকের কাছে যায় দু’জনে। ভালো করে সিন্দুকের উপর হাত বুলিয়ে দেখে আসলেই কী এটা সত্যি? হ্যাঁ সত্যি! এটা কোনো স্বপ্ন নয়। এখানে আর এক মুহুর্তও থাকা তাদের জন্য মোনাসিব মনে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে ফজরের আজান পড়বে। আজানের আগেই রাতের আঁধারে তাদের সিন্দুক নিয়ে ফিরে যেতে হবে।
দু’জন দু’পাশে ধরে সিন্দুকটা কাঁধে করে মনিরের বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। দরজা বন্ধ করেই সিন্দুক খুলতে লেগে যায়। কিন্তু মাথায় তখনই বাজ পড়ে যখন সিন্দুকের চাবি খুঁজে পায় না। চাবি না পেলে এই তালা কীভাবে খুলবে? অনেকভাবেই তালা খোলার চেষ্টা করে অসফল হয় দু’জনে। শেষ পর্যন্ত তালা ভেঙে ফেলতে চায় কিন্তু তাও ভাঙতে পারে না। নিরাশার মেঘ যেন জমেছে আকাশে। এই তালাটা ভাঙতে না পারলে তাদের ধনরত্ন পাওয়া হবে না। অনেকবার চেষ্টা করে কিন্তু তালা ভাঙার মতো কোনো উপায় খুঁজে পায় না দু’জনে। তারা মিয়া সিন্দুকের উপর হাত রেখে ক্লান্ত হয়ে বসে আছে। সারা রাতে অনেক ধকল গেছে। মনির চুপচাপ বিছানার কোণে বসে আছে। তাদের মাথায় এখন একটাই ভাবনা খেলা করছে, সব স্বপ্ন, আশা কী মিথ্যে হয়ে যাবে?
এই সময় আর ঘরে ফিরে যায় না তারা মিয়া। মনিরের কাপড় পরেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সকালে ঘুম ভাঙে মানুষের হইচই শুনে। মনির এখনও গভীর ঘুমে সেজন্য তাকে আর ডাকে না৷ ঘুমে রেখেই সে হাত মুখ না ধুয়ে আগে ঘরে যাওয়ার জন্য বের হয়।
ঘরের সামনে এত মানুষের ভিড় কেন? কী হয়েছে তার বাড়িতে? সবকিছু ঠিক আছে তো? রাবিয়ার কান্নার শব্দ দূর থেকেই শুনতে পাচ্ছে তারা মিয়া। মানুষের ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই রাবিয়াকে “নূর, নূর” বলে কান্নারত অবস্থায় দেখতে পায়। কী হলো তার নূরের? নূরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না কেন? আশেপাশে তাকিয়ে রাবিয়ার কাছে গিয়ে বারবার নূরের কথা জিজ্ঞেস করে তারা মিয়া।
“ওই আমার পোলা কই? নূর কই গেছে? কথা কস না ক্যান?” তারা মিয়া একনাগাড়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
রাবিয়ার দেয়া উত্তর শুনে তারা মিয়া মাটিতে ধপাস করে বসে পড়ে। চারদিক যেন থমকে গেছে। নীরবতার চাদর গায়ে দিয়েছে প্রকৃতি। তার চারপাশে চাপা নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। মুখ ফুটে কোনো কথা বের হচ্ছে না।
মনির ঘুম থেকে উঠে বাইরে মানুষের হৈ হুল্লোড় শুনতে পায়। ঘরের ভেতর খানিকটা আলো ঢুকেছে। দরজা খুলে দিতেই সম্পূর্ণ ঘরময় প্রখর সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে৷ বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল তারা মিয়ার ঘরের সামনে অনেক মানুষ ভিড় করেছে৷ লুঙ্গি ঠিক করতে করতে আবার ঘরের ভেতর আসে সে। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার চোখে পড়ে। ঘরের ভেতর কোথাও সিন্দুক দেখতে পাচ্ছে না সে। হন্তদন্ত হয়ে চারপাশে খুঁজতে লাগে কিন্তু কোথাও নেই। তবে কি তার ভাই সিন্দুক একাই ভোগ করার জন্য নিয়ে গেল? না এটা কখনোই করবে না সে। যতই হোক ভাই বলে কথা৷ হঠাৎ খেয়াল করে দেখল, যে জায়গায় সিন্দুক রেখেছিল সেই জায়গা খানিকটা ধসে পড়েছে। কাছে গিয়ে মাটিতে হাত দিতেই হাত ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মাটিটা অনেক নরম, ঠিক বালুর মত। তাহলে কী সিন্দুকটা মাটির নিচেই গায়েব হয়ে গেল! প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর নেই একটাও। প্রশ্নকে মাথায় রেখে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে মনির। বাড়ি থেকেই রাস্তা দেখা যায়। লোকজন এভাবে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছে? আবছা কিছু কথা মনিরের কানে আসে। আশেপাশের মানুষ বলাবলি করছে পদ্মপুকুরে নাকি কারও লাশ ভেসে উঠেছে। সবাই সেই দিকে দৌড়াচ্ছে।
ক্ষুধার্ত লেবু মিয়া তাদের দৌড়ানো দেখে একা একাই হাসছে। আপন মনে কীসব বলে রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে চলেছে। পদ্মপুকুরের কাছে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তাঁরা মিয়া পাগলের মতো প্রলাপ করে কাঁদছে। রাবিয়া বারবার পুকুরে ঝাপ দিতে চাচ্ছে। অনেক মহিলা তাকে ধরে রেখেছে। মহাজন বাজারে যাচ্ছিল সবার ভিড় দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। তারা মিয়ার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। এক সপ্তাহ ফুরাতে আর তিনদিন বাকি। তার ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে।
“আর কত খাবি?” লেবু খান এক পলক মহাজনের দিকে তাকিয়ে আবার পদ্মপুকুরের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বিড়বিড় করে কথাটা বলল।
একজন মায়ের অবাধ চোখের জল হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তার হাহাকারের শব্দেরা আকাশের বুক কাঁপাচ্ছে। আকাশেরও মুখ ভার, বৃষ্টি নামবে তার বুক চিড়েও। ঘনঘোর মেঘের আর্তনাদের কেবল শুরু, প্রতীক্ষা ফুরিয়ে আসবে অতিসত্বর। আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে পদ্মপুকুরের পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে লেবু খান। বুক পকেটে থাকা অমূল্য জিনিস, রাস্তার ধার থেকে কুড়ানো সেই সাদা পাথরটা বের করে দেখে আবার যত্নসহকারে ঢুকিয়ে রাখে। গুটিগুটি পায়ে সরু পথ ধরে এগিয়ে চলেছে সে। তাকে অনেক দূর অবধি চলতে হবে। এ যেন গন্তব্যহীন নিরন্তর এক পথচলা…!
***সমাপ্ত***