রঙিন_রোদ,পর্ব_৪,৫

0
1088

#রঙিন_রোদ,পর্ব_৪,৫
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৪

সেদিনের পর কেটে গেল আরো কয়েকদিন। সেদিন মৃত্তিকা ক্লাস করে এসে শুতেই ঘুমিয়ে পড়লো। সন্ধ্যার দিকে কারো ধাক্কায় আধো আধো চোখ খুলে দেখলো তার রুমমেট সিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্তিকা চোখ-মুখ কুঁচকে কিছু গালি দিয়ে আবারো শুতে গিয়ে সিয়া বাধা দিতেই মৃত্তিকা উঠে বসলো।

-‘কী? এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আমার ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছিস ক্যান?’

-‘সেটা তোর মোবাইল দেখলেই বুঝতে পারবি। বাইরে ঈশান স্যার অপেক্ষা করছে,গিয়ে দেখ।’

মৃত্তিকা চমকে তাকালো শিয়ার দিকে। ঈশান ভাই এখানে কেন আসবে! বিছানার এক কোন থেকে মোবাইলটা হাতড়িয়ে দেখল গুটি গুটি অক্ষরে একটা মেসেজে লেখা,’ নিচে আয় দ্রুত।’ ব্যাস, মৃত্তিকার জন্য এই একটা মেসেজই যথেষ্ট। ঈশান ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে সবাই অবগত। তাই মৃত্তিকা আর কোনো বাক্য বিনিময় না করে ওয়াশরুম থেকে মুখে পানির ঝাপ্টা মেরে আলসেমি ভাবটা দূরে রেখে কোনোমতেই উড়না পেঁচিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো গেটের বাইরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টি ঈশান ভাইয়ের। কালো শার্ট পরিহিত ঈশান ভাইকে আজ যেন অন্যদিনের তুলনায় সৌন্দর্য আরো বেশি ফুটে উঠেছে। মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে ঈশানের সামনে এগিয়ে মাথা নিচু করে বলে উঠল,’ ঈশান ভাই?’

ঈশান ফোন থেকে মাথা তুলে মৃত্তিকার দিকে এক পলক তাকিয়ে মোবাইলটা পকেটে পুরে নিল।

-‘ গাড়িতে উঠ।’

ঈশানের কণ্ঠস্বরটা কানে আসতেই মৃত্তিকা বলে উঠল,
-‘আমাকে বলছেন?’

ঈশান গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে পেছন ফিরে মৃত্তিকার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘তোর আশেপাশে আর কাউকে দেখতে পারছিস?’

মৃত্তিকা ‘না’ বোধক মাথা নাড়তেই ঈশান ইশারা করলো গাড়িতে উঠতে।

মৃত্তিকা বুঝতে পারলো না। এই ভর সন্ধ্যায় কই যাবে। ঈশান মৃত্তিকাকে আর কিছু ভাবতে না দিয়ে হাত ধরে ঠেনে গাড়ির ভেতর সিটে বসিয়ে সিট্বেল্ট বেঁধে দিল।

গাড়ি চলছে আপনগতিতে। ধরণীর বুকে সূর্য ডুবে গিয়েছে পুরোপুরি। আস্তে আস্তে রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরছে চারদিক থেকে। গাড়ি চলছে এক নীরব- শান্ত রাস্তা দিয়ে। ঈশান আপন মনেই সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। মৃত্তিকা হঠাৎ করে সাহস জুগিয়ে বলে উঠল,
-‘আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত ঈশান ভাই। এই বিয়েটা তো ভিত্তিহীন।’
জানালা দিয়ে ক্ষনে ক্ষনে বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মৃত্তিকাকে। ঈশান মৃত্তিকার কথাটির কোনো জবাব না দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসার ব্যাপারটা খেয়াল করে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উঠল,
-‘জানালাটা বন্ধ করে দেয়।’
মৃত্তিকা জানালাটি বন্ধ করে দিল। সে হতাশ হলো ঈশানের পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে। এরপর আর কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি। ঈশান গাড়ি থামিয়েছিল এক নিস্তব্ধ শান্ত নদীর তীরে। এরপর মৃত্তিকাকে বের হতে বলল। মৃত্তিকা বের হতেই অনেকক্ষন সেই নদীর তীরে নীরবভাবেই কাটিয়ে দিল দুইজনে।

-‘আমি কাল চলে যাবো।’ সামনের শান্ত নদীর পানির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শান্তকণ্ঠে বলে উঠল ঈশান।

মৃত্তিকা কিছু না বলে নীরব ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তার কীই বা বলার আছে!

-‘তুই সামনে থেকে যা দেখছিস তা হয়ত নাও হতে পারে। আমাকে একা রেখে কোনোদিন চলে যাস না মৃত্তি। আমার জীবনের বড়ো প্রাপ্তি হলো ‘তুই’। তুই ছাড়া এই ঈশানের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। কোনোদিন যদি কোনো সত্যি জানতে পারিস তাহলে ছেড়ে যাবি না তো! আর সবকিছু মিথ্যে হলেও অন্তত তোকে মনেপ্রাণে চাওয়াটা সত্যি থাকবে চিরদিন।’

মৃত্তিকা অবাক দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশানের এই কথাগুলো থেকে একটি কথাও তার মাথায় ঢুকছে না। কেমন জানি রহস্যময় মনে হচ্ছে ঈশান ভাইকে। কী বলতে চাচ্ছে উনি!

-‘ঈশান ভাই, এসব কী বলছেন আপনি?’

-‘সময় হোক, বুঝবি।’ বলেই ঈশান মৃত্তিকার দিকে ফিরে তার হাতটা মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
-‘কথা দেয়। এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বড়ো নিকৃষ্ট সত্যি তোর সামনে আসলেও আমায় ছেড়ে যাবি না মৃত্তিপাখি!’

মৃত্তিকা পলকহীন চোখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশান এখনো তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। মৃত্তিকার কাছ থেকে কোনো প্রতিত্তর না পেয়ে ঈশান তার হাত ফিরিয়ে নিলো। এরপর কী বুঝে গাড়িতে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে মৃত্তিকার উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

-‘গাড়িতে উঠ।’

মৃত্তিকা এখনো ঘোরের মাঝে আছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। ঈশানের গম্ভীর স্বরে গাড়িতে উঠতে বলাটা কানে আসতেই সে গাড়ির সিটে বসে পড়তেই ঈশান আর কিছু না বলে ড্রাইভ করা শুরু করলো। একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে মৃত্তিকাকে হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘আমি কাল সকাল সকাল দেশের বাইরে চলে যাবো। ছয়মাস সেখানেই কাটাবো। এর ভেতর কোনো দেখা বা কথা তোর সাথে হবে না। তাই ভাবলাম, যাওয়ার আগের সময়টা তোকে দিয়ে যায়। আলাদা হওয়ার কথা ভুলেও মাথায় আনবি না। ওই বাসায় যাস না আমি বলার আগে। আমার একটামাত্র অনুরোধ – হোস্টেল থেকে ক্লাস বাদে বের হবি না। ভালো থাকিস, নিজের খেয়াল রাখিস আর পড়াশোনা মন দিয়ে করিস।’ বলেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মৃত্তিকার চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। মৃত্তিকা কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলো না। সন্ধ্যা থেকে রাতের সময়টা ঈশান তার সাথে কাটিয়েছিল ঠিক কিন্তু অপ্রয়োজনীয় একটা কথাও বলেনি তাহলে শুধু শুধু ঈশানের এতো ব্যস্ত সময় থেকে এই সময়গুলো মৃত্তিকাকে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। কালকে চলে যাবে, নিশ্চই আজকের এই রাতটা তার অনেক কাজের রাত ছিল। ঈশান চলে যাবে ভাবতেই বুঁকের কোথাও জানি খুব চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো মৃত্তিকা। হয়ত এতদিনের মায়া। মৃত্তিকা আর কিছু না ভেবে হোস্টেলে এসে ফ্রেস হয়ে নিলো। আজকে ঈশান মৃত্তিকাকে নদীর তীরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে নিশ্চই কোনো কারণ ছিল। সে হয়ত মৃত্তিকাকে আরো অনেক কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলতে পারেনি। ঈশান অনেকবার হয়ত কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতে চেয়েছিল কিন্তু জড়তায় বলতে পারেনি। মৃত্তিকা বিষয়টি খেয়াল করেছিল, সে মনে করেছিল ঈশান হয়ত গাড়িতে হলেও বলবে। কিন্তু বলেনি। মৃত্তিকা ভাবতে পারছে না, কী এমন সত্যি যেটা সামনে আসলে মৃত্তিকা ঈশানকে ছেড়ে চলে যাবে এমন ভয় পাচ্ছে ঈশান!
মৃত্তিকার সেদিন রাত আর ঘুম এলো না। ঈশান ভাইয়ের জন্য কোথাও একটা সূক্ষ্ম ব্যথার অনুভূতির অনুভব হচ্ছিলো। তাই সে সেদিন সকাল সকাল নিজের বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে হাজির। ঈশান ভাইদের গাড়ি এয়ারপোর্ট যাওয়ার উদ্দেশ্যে গেট দিয়ে বের হতেই মৃত্তিকা অনুসরণ করে পেছন পেছন গেল। এয়ারপোর্ট যেতেই ঈশান ভাই যখন সবার সাথে কথা-বাত্রার প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে এয়ারপোর্টে ঢুকে যাচ্ছিল তখন দূর থেকেই মৃত্তিকা তাকিয়ে রইল। ঈশান ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৃত্তিকার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তার চোখ থেকে টুপ্ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে জানে না, ঈশান ভাই আর তার বন্ধনটা আর এগোবে কিনা কিন্তু তবুও কেন জানি কবুল বলার পর থেকেই মানুষটাকে অনেক আপন মনে হয়। দেখতে দেখতেই ঈশান মৃত্তিকার চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। মৃত্তিকা চোখ মুছে লুকিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো হোস্টেলের উদ্দেশ্যে।

———-

কেটে গেল কয়েকদিন। এর ভেতর মৃত্তিকা আর বাইরের কোনো কিছুতে খেয়াল না দিয়ে পড়াশোনায় মন দিল। রিনি জানিয়েছে, ঈশান ভাই সহি-সালামতেই দেশের বাইরে পৌঁছে গিয়েছে। তবে মাঝখানে ভীষণ খারাপ লাগে আদিবের জন্য। আদিব সেদিনের পর থেকে আর আসেনি। মৃত্তিকা শুনেছে, আদিব এখান থেকে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। এই মেডিকেলেও সে আর পড়বে না। এতদিন একসাথে পথ চলা যার ফলে মৃত্তিকার হুট্ করে ভীষণ খারাপ লাগে আদিবের জন্য। সে তো এটা চায়নি। ঈশান ভাইয়ের সাথে হুট্ করে এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে সেটা মৃত্তিকা কল্পনায়ও আনেনি। মৃত্তিকা মনে করেছিল, ঈশান ভাইকে সুযোগ বুঝে ডিভোর্সের কথা জানাবে কিন্তু সেদিনের পর থেকে মনে হচ্ছে না এমন কিছু হবে। তবুও সে চেষ্টা করবে।আদিবের সাথে যদি আরেকবার দেখা হতো তাহলে মৃত্তিকা বুঝিয়ে বলতো। কিন্তু আদিব যে এভাবে চোখের পলকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে তা ভাবেনি মৃত্তিকা। কোথায় খুজবে সে আদিবকে! হয়ত আছে কোথাও লুকিয়ে, মৃত্তিকাকে ধরা দিতে চাচ্ছে না। কালই মৃত্তিকা ঢাকার বাইরে আদিবের গ্রামের বাড়ির খোঁজ নিবে। যেমন করেই হোক, আদিবের সাথে দেখা করবেই মৃত্তিকা।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৫

মৃত্তিকা সিদ্ধান্ত নিলো আজ আদিবের গ্রামের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিবে। তার আশা, আদিবকে সে সেখানে পাবে। আদিব তার নিজের পরিচয় ভালোমতো মৃত্তিকাকে কোনোদিন বলেনি। মৃত্তিকা জোর করলেও বলতো না। এমনকি তার বাবা সম্পর্কেও আদিব তেমন কোনো কথা বলতো না। মৃত্তিকার বেশি জোরাজোরির ফলে একদিন বলেছিল ‘তার বাবা মারা গিয়েছে আর তার গ্রামের বাড়ি ঢাকার বাইরে কুমিল্লায়।’ মৃত্তিকা মাঝে মাঝে আদিবকে বুঝতে পারতো না কারণ আদিব স্বয়ং মৃত্তিকাকেও তার পরিবার সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চায়তো না, পরিবার সম্পর্কে মৃত্তিকা কিছু জিজ্ঞেস করলেই আদিব কথাটা এড়িয়ে অন্য বিষয়ে কথা বলতো। তবুও একদিন মৃত্তিকা সন্দেহের চোখে চেয়েছিলো বিধায় আদিব তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা মৃত্তিকাকে দিয়েছিল। আদিবের সাথে অনেক বুঝাপড়া বাকি আছে মৃত্তিকার। আদিব এতো ছোট বিষয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার মতো ছেলে নয়। আর যদি আদিবের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে মৃত্তিকা’ই দায়ী থাকে তাহলে মৃত্তিকা আদিবকে বুঝিয়ে বলবে। মৃত্তিকার কারণে আদিবের এতো সুন্দর ভবিষ্যত নস্ট করার কোনো মানেই হয় না। যদি আদিব তাতেও না মানে তাহলে মৃত্তিকা নিজ থেকেই সরে যাবে। তাই মৃত্তিকা যথারীতি ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে এসে ফ্রেস হয়ে নিলো। এতো কিছুর মাঝে মৃত্তিকা তার একটা ক্লাসও মিস দেয়নি। ঈশান আশেপাশে না থাকলেও ঈশানের কথা মৃত্তিকা প্রতি হাড়ে হাড়ে মেনে চলার চেষ্টা করে। নিয়ম অনুসারে প্রতিদিন পড়াশোনা ঠিকঠাক করে। তার মন না মানলেও সে এখন অন্যজনের অর্ধাঙ্গিনী, কোনো ঘরের বউ।
বিকেলের দিকে মৃত্তিকা হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়লো আদিবের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

মৃত্তিকা হোস্টেল থেকে বেরিয়েই কুমিল্লার বাসে উঠলো। উঠার আগে রিনিকে জানিয়ে দিল কিছু কারণে সে বাইরে যাচ্ছে-পরে এসে সব বলবে। বাসায় কাউকে কিছু না জানাতে।

স্টেশনে এসে মৃত্তিকা বাস ছাড়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়ালো।মৃত্তিকা বাস ছাড়ার অনেক আগেই স্টেশনে এসে পড়েছে যার ফলে আরো অনেকক্ষন বাসে বসে থাকতে হবে। এখনো যাত্রী তেমন আসে নাই মাত্র দুয়েকজন যাত্রী এসে বসেছে। মৃত্তিকা আর কিছু না ভেবে বাসে উঠে বসলো। তার সিট্ জানালার পাশে যার ফলে বাইরের সবকিছুই দেখতে পারছে। মৃত্তিকা সিটে বসে চারদিকে তাকিয়ে এতক্ষন কীভাবে বসে থাকবে ভেবে ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন নিতে নিতে আনমনে জানালার বাইরে চোখ যেতেই থমকে গেল। তার মনে হলো বাইরে এই মাত্র ঈশান ভাইয়ের মতোই কাউকে জানি দেখেছে মাস্ক পরিহিত। কিন্তু ঈশান ভাই তো দেশের বাইরে, উনি এখানে কীভাবে আসবে! সে আবারো বাইরে দূরের ওই দোকানটার দিকে তাকালো কিন্তু এখন খালি! মৃত্তিকা নিজের চোখের ভ্রম ভেবে সিটে বসলো। সারাদিন ঈশান ভাইকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার মাথাটাই বোধহয় শেষ! সে মুচকি হেসে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো বাস ছাড়তে আরো অনেকক্ষন আছে। এখনো যাত্রী পুরোপুরি উঠেনি তাই মোবাইলে প্ৰিয় একটি গান ছেড়ে সিটে হেলান দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে ফেলল। গান শুনতে শুনতে ঝিমুচ্ছে মৃত্তিকা। হঠাৎ মনে হলো তার পাশের সিটে কেউ একজন বসেছে। হয়ত যাত্রী ভেবে সে পাত্তা না দিয়ে গান উপভোগ করতে রইল। বাস বোধহয় ছেড়ে দিয়েছে। চলন্ত বাসে জানালার পাশের সিটে বসে চোখ বন্ধ করে গান শোনার মজায় আলাদা। অনেকক্ষন পরে মনে হলো, কেউ একজন পুরুষালি কণ্ঠে মৃত্তিকার কানের পাশে কথা বলছে। পরপর আওয়াজটা আসতেই মৃত্তিকা বুঝতে পারলো হয়ত কাউকে ডাকছে। কিন্তু আওয়াজটা তার গানের সুর ভেদ করে আরো তীব্র হতেই বুঝতে পারলো পাশের সিটের মানুষটা হয়ত মৃত্তিকাকেই ডাকছে । মৃত্তিকা গান শুনতে গিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেল। নতুন নতুন গানের তালে তার সুন্দর কল্পনার মাঝে কারো এভাবে ডাকাতে সে বিরক্তবোধ হলো। তার এই মুহূর্তে মোটেও চোখ খুলে দেখার ইচ্ছে নেই। কিন্তু পাশের জন দমে যাওয়ার প্রার্থী নয়। সে এক নাগাড়ে ডেকেই চলছে। আশ্চর্য! কারো কাঁচা ঘুমের মধ্যে এভাবে ডাকার কোনো মানেই হয় না! মৃত্তিকা চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নড়েচড়ে বসতেই পাশ থেকে লোকটা আবারো ডেকে উঠল,

-‘হ্যালো মিস!’

মৃত্তিকা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আধো আধো চোখ খুলে পাশের জনের দিকে তাকাতেই দেখলো আগন্তুকটি দাঁত বের করে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তা দেখে মৃত্তিকার রাগ যেন তড়তর করে বেড়ে গেল। সে বিরক্তিতে ‘চ’-সূচক শব্দ করলো। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে আগন্তুকটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আগন্তুকটি মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল,

-‘মিস,আসলে এই প্রথমবারের মতো কোথাও এতো দূরের জার্নিতে যাচ্ছি। এতো বড়ো রাত জার্নি কাটাতে গিয়ে খারাপ লাগবে ভেবে আপনার সাথে পরিচয় হতে চাচ্ছি।’

মৃত্তিকা আপনমনে বিড়বিড় করে কিছু গালি দিতেই আগন্তুকটি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘মিস, কিছু বললেন?’

ছেলেটির মুখ থেকে ‘মিস’ শোনার পড় মৃত্তিকার রাগ আরো বেশি বেড়ে গেল। সে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কোনোরকম নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দিল,
-‘আমি মিস নয়, মিসেস।’

-‘ওঃ, আপনি বোধহয় বিরক্তবোধ হচ্ছেন?’

ছেলেটির এমন কথা শুনে মৃত্তিকার খারাপ লাগলো। আসলেই তো, বিনা কারণে ছেলেটির উপর রেগে আছে মৃত্তিকা। তার কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ছেলেটির উপর রাগ দেখাচ্ছে কিন্তু এছাড়া ছেলেটির উপর রাগার মতো আর কিছুই তো সে করেনি। হয়ত বাঁচাল টাইপ ছেলে তাই কথা বলা ছাড়া থাকতে পারছে না। মৃত্তিকারও আর কিছু সময় পেরোলে হয়ত একঘেয়েমি চলে আসতো। থাক, একটাকে অন্তত পেলো। গল্প করে কাটানো যাবে। এই ভেবেই মৃত্তিকা হাসিমুখে ছেলেটির জবাব দিতেই ছেলেটি খুশিতে মৃত্তিকার সাথে গল্প জুড়ে দিল।

-‘কোথায় যাবেন মিস? উপস, মিসেস!’

-‘কুমিল্লা।’

-‘আরে! আমিও।’
ছেলেটি উৎফুল্ল হয়ে একটার পর একটা গল্প জুড়ে দিচ্ছে মৃত্তিকার সাথে। এটা-ওটা বলে হাসাতে চেষ্টা করছে মৃত্তিকাকে। ছেলেটির এমন বাচ্চাপনা দেখে মৃত্তিকা আপনমনেই মুচকি হাসলো। এই ছেলেকে দেখতে খারাপ লাগছে না, ভরসা করা-ই যাই। প্রথমে মৃত্তিকা মনে করেছিল হয়ত ছেলেটা খারাপ হতে পারে। আজকাল-কার যুগে তো কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু এই ছেলেটার এমন বাচ্চাপনা গল্প শুনে মনে হচ্ছে না ছেলেটা খারাপ হবে। তাই মৃত্তিকাও ছেলেটার কথার এটা-ওটা উত্তর দিলো। কিন্তু মৃত্তিকা বুঝতে পারলো না আর কিছু সময় পরেই তার কপালে কত বড়ো বিপদ অপেক্ষা করছে! আসলেই কী তার ভাবনা অনুসারে ছেলেটা ভরসাযোগ্য!

গল্প করতে করতে মৃত্তিকা ঘুম ঘুম ভাব আসতেই ছেলেটি তা বুঝতে পেরে মৃত্তিকাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে বলল। এরপর নিজের মোবাইল বের করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসলো। মৃত্তিকাও জানালাটা খুলে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিতে দিতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
.
.
মৃত্তিকা চোখ খুলতেই নিজেকে বদ্ধ অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করলো। সে ভ্রু কুঁচকে উঠে বসতেই খেয়াল করলো তার হাত-পা শক্ত কিছুর সাথে বাধা। সে এখানে কীভাবে এলো তা ভাবতে পারলো না। হিসেব মোতাবেক এখন তো তার স্টেশনে থাকার কথা ছিল তাহলে এখানে কীভাবে আসলো সে! কাল রাত ছেলেটার সাথে গল্প করে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিল তা খেয়াল করতে পারেনি। এরপর তো আর কিছুই হয়নি। ঘুমানোর পরও তার তো বাসেই থাকার কথা ছিল। এখানে কীভাবে আসলো সে! ঘুমানোর পর কী হয়েছিল মৃত্তিকার সাথে! তার মানে কী তার পাশের মিষ্টবাসি ছেলেটাই এসবের কারণ! মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়েও কোনো আলোর হদিস পেলো না। সে চিৎকার করতে গিয়েই খেয়াল করলো তার চিৎকার বেরোচ্ছে না, তার মুখে কিছু একটা আটকানো। মৃত্তিকা কোনো আওয়াজ বের করতে গিয়েই গোঙানীর আওয়াজ হলো। তাকে কোনো একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলা হয়েছে। ঘাড়টা ভীষণ ব্যথা করছে, হয়ত এভাবে একপাশ হয়ে ঘুমানোর ফলে। মৃত্তিকা পেছনের হাতের বাঁধনটা খুলতে চেয়েও খুলতে পারলো না। অনেক শক্ত করে দুইহাত একসাথে বাধা হয়েছে। মৃত্তিকা হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে করতে একসময় দুর্বল হয়ে পড়লো। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ঈশান ভাইয়ের চেহারাটা চোখের উপর ভাসছে।আস্তে আস্তে দুর্বলতা গ্রাস করছে। কী করবে সে এখন! কে এখানে মৃত্তিকাকে বাঁচাতে আসবে! কেউই তো জানে না মৃত্তিকার ঢাকার বাইরে আসার ব্যাপারটা! তাহলে কী এভাবেই কাটাতে হবে! এরপর তার সাথে কী হবে ভাবতেই মৃত্তিকার চোখ গড়িয়ে দু’ফোটা অশ্রু বেরিয়ে এলো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here