রঙিন_রোদ,পর্ব_১১,১২

0
1410

#রঙিন_রোদ,পর্ব_১১,১২
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১১

সিয়া চলে যাওয়ার অনেকদিন পেরিয়ে গিয়েছে। এখনো মৃত্তিকা সিয়াকে প্রচুর মিস করে। কী থেকে কী হয়ে গেল সে এখনো ভেবে উঠতে পারে না।
-‘তোকে বড্ড মিস করি সিয়ু। কেন এভাবে আমাকে একা করে চলে গেলি! যেখানেই থাকিস,ভালো থাকিস সিয়ু।’ বলতে বলতেই মৃত্তিকার দু’চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হলো। এখন কান্না করা সেটা প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

মৃত্তিকা চোখ মুছে ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকলো। পাশেই গুনগুন করে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে একটা মেয়ে পড়ছে। সিয়া চলে যাওয়ার পর হোস্টেলের কর্মরত ম্যামটা অন্য আরেকটা মেয়েকে মৃত্তিকার সাথে শেয়ার দিয়েছে। মেয়েটা মৃত্তিকা থেকে জুনিয়র। সবসময় পড়ার উপর থাকবে। মেয়েটাকে যতবার সিয়ার জায়গায় শুতে দেখবে ততবার তার বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয়। ইচ্ছে করে, সিয়া আসুক- আগের মতো গল্প করুক। মৃত্তিকা যদি একবার সিয়াকে কাছে পেত! জড়িয়ে ধরতে পারতো মেয়েটাকে! তাহলে সব মন খারাপ নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে যেত।

-‘আপু? তোমার শরীর ঠিক আছে? চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে যে!’

মৃত্তিকা একটা মলিন শ্বাস ফেলল।

-‘হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।’ বলেই মৃত্তিকা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল ফ্রেস হতে। সিয়া চলে যাওয়ার পর সম্পূর্ণ দিনটার রুটিন’ই বদলে গিয়েছে। আগে মৃত্তিকা ক্লাস শেষ করে এসে ফ্রেস হতে না গেলে সিয়া রেগে গিয়ে বকা দিতে দিতে মৃত্তিকাকে ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে লক করে দিতো। যাতে মৃত্তিকা ফ্রেস হওয়া ছাড়া বের হতে না পারে। এরপর মৃত্তিকা ফ্রেস হয়ে আসতে আসতে সিয়া রান্নার কাজ শেষ করে খাবার নিয়ে মৃত্তিকার জন্য অপেক্ষা করতো। মৃত্তিকা বের হওয়ার পর একসাথে খেত।

মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই দিনগুলো এখন বড্ড মিস করে। এখন আর কেউ মৃত্তিকাকে নিয়ম-মাফিক চলার জন্য উপদেশ দেয় না। এখন আর কেউ মৃত্তিকা খাবে না বললেও জোর করে টেনে-হিচড়ে তুলে খাইয়ে দেয় না। এখন আর কেউ, মৃত্তিকা ঘুমিয়ে পড়লে পানি ঢেলে দিয়ে ঘুম থেকে তুলে না। মৃত্তিকা ক্লাসে না গেলেও এখন আর কেউ রেগে যায় না। তাকে এখন আর কেউ আগলে রাখে না। কতদিন হয়ে গেল, আজ কারো সাথে মন-খুলে হেসে হেসে আড্ডা দিচ্ছে না মৃত্তিকা। সবকিছুর পেছনে একমাত্র ‘সিয়া’। সিয়া এখন আর তার কাছে আসে না। মৃত্তিকাকে এসে ছুঁয়ে দেয় না। মৃত্তিকা রেগে থাকলেও কেউ এসে হাসাতে চেষ্টা করে না। তার এখনো বিশ্বাস হয় না, মেয়েটা না-কি আর নেই। মৃত্তিকার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গিয়েছে – যেখান থেকে চাইলেও আর ফিরে আসা যায় না। এসব ভাবতেই মৃত্তিকার চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হলো। সে পাশ ফিরে তাকাতেই খেয়াল হলো,ওয়াশরুমে না ঢুকেই মৃত্তিকা ভাবনায় ডুব দিয়েছে। পাশে নিধি মেয়েটা তার পড়া রেখে মৃত্তিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

-‘আপু, তোমার ব্যাচমেট সিয়া আপুকে মিস করছো?’

মৃত্তিকা কন্দন-রত চোখে মলিন হাসলো।
-‘সিয়ুকে কী ভোলা যায়?’ এরপর পরই মৃত্তিকা দ্রুত পদে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ওয়াশরুমে ঢুকতেই কল ছেড়ে দিয়ে সে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। প্রতি পদে পদে সিয়াকে মনে পড়ছে। সে সিয়াকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবে। বাইর থেকে মৃত্তিকা নিজেকে শক্ত রেখে সবার সাথে হেসে হেসে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে তার হৃদয় যে পুড়ে যায়। ক্লাসে, হোস্টেলে সব জায়গায় সে সিয়াকেই কল্পনা করে। মৃত্তিকা কাঁদতে কাঁদতে মাথা চেপে ধরলো। সে যে তার সিয়ুকে ছাড়া নিজের জীবনটা কল্পনা করতে পারছে না। তার কলিজাকে কেউ যেন টেনে-হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে মৃত্তিকার। সিয়ার কথা মনে পড়লেই মৃত্তিকার মাথা ঠিক থাকে না। হঠাৎ মাথা তুলে পানির দিকে তাকিয়ে সে একটা শপথ নিলো।

-‘সিয়া পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার পিছনে যে মানুষটার হাত আছে। তাকে মৃত্তিকা একদিন না একদিন খুঁজে বের করবেই। মৃত্তিকা নিজ হাতে সেই আগন্তুককে খুন করবে। মৃত্তিকার অস্তিত্বের এক অংশকে যে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করেছে। তাকে মৃত্তিকা নিজ হাতে যতদিন পর্যন্ত তাকে খুন করতে না পারবে ততদিন মৃত্তিকার তৃষ্ণা মিটবে না।’

———-

লুৎফর আহমেদ হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় ব্যাডে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় আছেন তিনি। পাশেই বাসার সবাই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। লুৎফর আহমেদের পাশে ঈশানের মা আমেনা রহমান শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরে কিছুক্ষন পর পর কান্নার সুর তুলতেছে। রুমি আহমেদ ভাইয়ের পাশে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের দরজার একপাশে রিনি আর আরেক পাশে মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে আছে।

কাল রাতের দিকে লুৎফর আহমেদ বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পথে তার গাড়িতে কেউ একজন গুলি করে। প্রথম গুলিটা গাড়ির কাঁচ ভেদ করে লুৎফর আহমেদের হাত বরাবর পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আবারও গুলি ছুড়া হলো, সেই গুলিটা একদম টার্গেট করে মারার ফলে লুৎফর আহমেদের মাথায় এসে পড়ে। এরপর একে একে গুলি ছুড়তে লাগলো। ভাগ্য ভালো, ড্রাইভার অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন হওয়ায় পরবর্তী গুলি করার আগেই কোনোমতে গাড়িটা জোরে টান মারে যার ফলে পরপর আর বাকি গুলিগুলো কারো কোনো ক্ষতি করতে পারে নাই। লুৎফর আহমেদ প্রথম গুলিটার আওয়াজ শুনে সরে যেতে চেয়ে গাড়ির সাথে মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এরপর অজ্ঞান অবস্থায় সোজা গুলি এসে মাথায় পড়ে। ড্রাইভার ঐদিকে খেয়াল না দিয়ে গাড়িটা এক টানে বাসায় নিয়ে আসে।

লুৎফর আহমেদকে হাজার চেষ্টা করেও কেউ হাসপাতালে নিতে পারেনি। তার এক কথা, তিনি এই বাসা থেকে নড়বেন না। তবুও বেশি আঘাত পাওয়ায় হাসপাতালের কয়েকজন চেনা-পরিচিত ডাক্তার বাসায় এসে সময়-মতো দেখে যায়। আর দুইজন নার্স লুৎফর আহমেদের দেখা-শোনার জন্য সবসময় বাসায় থাকে। আজ দুইদিন যাবৎ তার অবস্থা এমন। কোনো উন্নতি হচ্ছে না। যতই দিন যাচ্ছে উনার ততই অবনতি হচ্ছে। উনাকে দুর্বলতা আস্তে আস্তে আরো অসুস্থ বানিয়ে ফেলছে। এখন কথা বলে ধীরে ধীরে। বাসার সবাই চিন্তিত। তারা ঈশানকে খবর দিতে চাইলে লুৎফর আহমেদ কড়াভাবে নিষেধ করেন। ঈশান ভুলেও যেন তার এই অবস্থা সম্পর্কে অবগত না হয়। লুৎফর আহমেদের কড়া নিষেধাজ্ঞা শুনে বাসার কেউ আর ঈশানকে খবর দেওয়ার সাহস পায় নাই।
বাসার কেউ ভাবতে পারছে না। হঠাৎ লুৎফর আহমেদের শত্রু কই থেকে আসবে! এতো বছর কঠোর পরিশ্রম করে তিনি আজ বিশাল বড়োলোক। কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি কোনোদিন। সবসময় গরিব-অসহায় মানুষদের দান করতো। হঠাৎ কোথ থেকে আড়ালে এতো শত্রু হয়েছে!
.
.
সেদিনের পর আরো বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো কিন্তু লুৎফর আহমেদের সুস্থ হওয়ার নাম-গন্ধ নেই। তিনি আস্তে আস্তে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন আর শোয়া থেকে উঠতে পারে না। উনার দিন কাটে সারাদিন এক রুমে শুয়েই। এতদিন বুঝা না গেলেও এই কয়েকদিনের উনার চেহারায় বার্ধক্যের চাপ পড়ে গিয়েছে। মৃত্তিকার উনাকে দেখে ভীষণ মায়া হয়। কী মানুষ কেমন হয়ে গেল!

#চলবে ইন শা আল্লাহ

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১২

দিন চলে যায় আপন-গতিতে। দেখতে দেখতে আরও দুইদিন চলে গিয়েছে। আরশির বাবা-মা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরশির কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এরপর আরো একদিন কেটে গেল। এর মাঝেই একদিন শোনা গেলো, লুৎফর আহমেদদের মেডিকেলটা অনেক বড়ো অফিসারদের হাতে করতলগত হয়েছে। বাসার সবার মাথায় চিন্তা ভর করলো। পরিবারে একের পর এক এসব কী নেমে আসছে! মেডিকেল বন্ধ হয়ে গেল। মৃত্তিকাদের ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হলো। লুৎফর আহমেদ এটা শুনে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি কোনোমতেই শুয়ে থাকতে চাইছেন না। লুৎফর আহমেদের বিশ্বস্ত কয়েকজনকে মেডিকেলের ওখানে পাঠিয়েও কোনো লাভ হলো না। পুলিশ মেডিকেলটাকে ঘিরে আছে। এসবের কারণে লুৎফর আহমেদ মানসিক-ভাবে আরো বেশি ভেঙে পড়েছেন। বাসার সবার চোখে চিন্তায় ঘুম নেই। রিনি আর মৃত্তিকা কোনোমতে উনাকে সামলে তারা ওখানকার পরিস্তিতিটা অবলোকন করার জন্য মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

মেডিকেলের ধারে গিয়ে পৌঁছাতেই তারা দুই’জনেই রিকশা’র ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেল।

রিনি আর মৃত্তিকা একটু এগিয়ে গেল। চারপাশে বিভিন্ন মানুষের ছড়াছড়ি। পুলিশ চারদিকে ঘেরাও করে রেখেছে। স্টুডেন্টরা জিনিসপত্র নামিয়ে মাথার উপর এক-বোঝা পরিমান চিন্তা নিয়ে হল ছেড়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। চারদিকে অনেক পরিমান শ্রমিক। মেডিকেলের এক পাশ ভেঙে ফেলেছে। মৃত্তিকা’র এসব দেখে হঠাৎ করে ভীষণ রকম খারাপ লেগে গেল। এই মেডিকেলে কত স্টুডেন্ট কত দূর থেকে স্বপ্ন দেখে পড়তে এসেছে অথচ আজ তারা অসহায়। আজ সব খালি। তার আর সিয়ার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই মেডিকেলে। এই হলটাতে তারা দুইজনে কত হাসি-তামাশা করতো। অথচ তারা মেডিকেলটাকে নিমিষের মধ্যে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে! মৃত্তিকার নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছে না। তার বড়ো মামার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। তিনি কত কষ্ট করে স্বপ্ন দেখে তিল তিল করে এই মেডিকেলটা তুলেছে অথচ এই পাষান লোকগুলো এক নিমিষে চুরমার করে দিচ্ছে। রিনি’র চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হচ্ছে। তার বাবা- ভাইয়ের এতো কষ্টের উপার্জনের টাকা!

মৃত্তিকা রিনিকে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখলো, অদূরে মেডিকেলের প্রবেশ পথের ভেতরে কয়েকজন লোক হাতে কিছু একটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তবা ফাইলের মতো কিছু একটা হবে। তারা কয়েকজন একটা লোককে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে লোকটা এদের ইশারা করে কিছু একটা বলছে। হয়ত দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে, হয়ত কোনো বড়ো অফিসার। মৃত্তিকার কেন জানি মনে হচ্ছে এই লোকটার এরূপ পেছন সাইট সে কোথাও দেখেছে কিন্তু ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না। লোকটা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বলে মৃত্তিকা ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তার মনে হচ্ছে, এই লোকটাকে সে অনেক কাছ থেকে কোথাও দেখেছে কিন্তু যায় হোক, মৃত্তিকাদের যে এই মানুষটার সাথে কথা বলতেই হবে। কেন তারা লুৎফর আহমেদের এতো স্বপ্নের ভবনটা এক নিমিষের মধ্যে ভেঙে ফেলছে! বাইরের মানুষ ওখানে যেতে পারছে না। মৃত্তিকা আর রিনি হাজার চেষ্টা করেও ওখানে যেতে পারলো না। পুলিশ আটকে ধরে ফেলল।

মৃত্তিকা পুলিশকে বুঝিয়ে বলতে লাগলো, যাতে করে ওখানে একটু মৃত্তিকা আর রিমিকে যেন যেতে দেওয়া হয় কিন্তু পুলিশ’রা তা শোনার চেষ্টা করছে না। তাদের এক কথা, তাদের ওই স্যার কাওকে ওখানে যেতে অনুমতি দিবে না। মৃত্তিকা আর রিনি দুইজনেই হতাশ হলো।

মৃত্তিকা আর রিনি নিরাশ হয়ে শেষবারের মতো আবার পুলিশটাকে অনুরোধ করল, শুধুমাত্র একটিবার যেন তারা মানুষটার সাথে দেখা করতে পারে। ওইজায়গার লোকগুলো আস্তে আস্তে সরে গিয়ে ওই অফিসারকে জায়গা দিতেই মৃত্তিকা বুঝতে পারলো হয়ত অফিসারটা চলে যাবে। তার আগেই যেভাবেই হোক, ওই লোকটার সাথে দেখা করতেই হবে। মৃত্তিকা পুলিশকে অনুরোধ করল, একটু করে দেখা হলেই তারা চলে যাবে কিন্তু পুলিশটা তাতেও রাজি না হওয়ায় মৃত্তিকা ওই অফিসারটার উদ্দেশ্যে জোরে ‘স্যার’ বলে চিৎকার দিলো। তার চিৎকার শুনে ওই অফিসারটা হাঁটা থামিয়ে তার দিকে ফিরতেই মৃত্তিকা চমকে স্তব্ধ হয়ে গেল।

এদিকে পুলিশগুলো মৃত্তিকা ঐভাবে এতো জোরে চিৎকার দেওয়ার ফলে তার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আজেবাজে গালি দিয়ে তাকে সরাতে চেষ্টা করেও পারলো না। রিনি পুলিশদের এমন অকত্য ভাষায় গালি শুনে চোখ-মুখ কুঁচকে অপমানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মৃত্তিকার হাত ধরে টানতে লাগলো কিন্তু মৃত্তিকা শক্ত হয়ে এক দৃষ্টিতে ওই অফিসার’টার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে এক-পাও নাড়াচ্ছে না।

অফিসারটা নিজেই রিনি-মৃত্তিকাদের দিকে এগিয়ে আসতেই পুলিশগুলো মাথা নিচু করে সালাম দিয়ে সরে দাঁড়ালো। এতে মৃত্তিকা আরো বেশি চমকে গেল।

তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না। অফিসার’টার গাড়ি এসে দাঁড়াতেই পুলিশ সবাইকে সরিয়ে দিতে লাগলো কিন্তু মৃত্তিকা সরলো না। রিনি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরে টানতে টানতে ব্যর্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

অফিসারটা মৃত্তিকাদের পাশ দিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে মৃত্তিকার দিকে ফিরে আরেকটু এগিয়ে এলো।

-‘আ… আদিব তুমি?’

-‘আদিব নয়। রিফাত চৌধুরী।’

মৃত্তিকা স্তব্ধ দৃষ্টিতে আদিবের দিকে তাকালো। কী বলছে এসব!

-‘এ.. সব কী!’

আদিব চোখ থেকে চশমা খুলে সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে জবাব দিল,

-‘লুৎফর আহমেদ আই মিন তোমার মামা’র এই মেডিকেলটা তার অবৈধ উপার্জনে গড়ে তোলা। সব প্রমান আমাদের হাতে আছে। খুব শীঘ্রই উনাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’ বলেই চশমা পড়ে দ্রুত পদে হেটে গাড়িতে উঠে গেলো। আদিব গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। পেছন থেকে আরও কিছু পুলিশের গাড়ির হর্ন বাজতেই মৃত্তিকার হুশ ফিরলো। রিনি তাড়াতাড়ি মৃত্তিকাকে সাইট করে নিয়ে এলো। পরপর কয়েকটা পুলিশের গাড়ি আদিবের গাড়ির পেছনে অনুসরণ করে চলল। মৃত্তিকা সব দেখে ঘোরে চলে গেল। এসব কী বলছে! এসব কী আধো তার চোখের ভ্রম না-কি সব সত্যি! আদিব এই জায়গায় কীভাবে পৌছালো! আর তার চেয়ে বড়ো কথা, এসব কী বলল সে! তার মামা’র অবৈধ ব্যাবসা মানে!
মৃত্তিকার পাশে রিনিও এসব শুনে থমকে গেল। এই মাত্র লোকটা কী বলে গেল! এটা কী আধো সত্যি!
.
.
সেদিনের পর মৃত্তিকা আরও চুপচাপ হয়ে গেল। একের পর এক ঘটা সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এসবের কারণে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে! একের পর এক চমক নিতে পারছে না আর সে! এসব কী হচ্ছে তার সাথে! মৃত্তিকা মাথাটা চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লো।

রিনি এসে লুৎফর আহমেদকে সব বলতেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
এর একদিন পর মেডিকেলটা সম্পূর্ণ ভাঙার কাজ শেষ হলো। এখন সেখানে আর আগের মতো এতো আকর্ষণীয় লাগে না, শুধুমাত্র একটি খালি জমিই। এসব শুনে লুৎফর আহমেদ একেবারে শুয়ে গেলেন, তিনি এখন আর উঠে বসতেও পারেন না।

হঠাৎ একদিন লুৎফর আহমেদ রুমি আহমেদ’কে আলাদাভাবে ডেকে পাঠালো কিছু একটা বলার উদ্দেশ্যে। তিনি রুম থেকে সবাইকে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললেন। শুধুমাত্র রুমি আহমেদকে থাকতে বলেন। অস্পষ্ট সুরে তিনি রুমি আহমেদের উদ্দেশ্যে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলেন,’বোন আজ তোকে সবচেয়ে সত্য কথা যেটা স্বয়ং তোর থেকেও লুকিয়েছি। সেটাই বলবো। হয়ত আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পুরুষ ভাববি। হয়ত এখন তোর পছন্দের মধ্যে আমি শীর্ষ আছি কিন্তু এই কথা শুনার পর তোর ঘৃণার জায়গায় আমাকে বসাবি কিন্তু কিছুই করার নেই। আমি আর কষ্টের বোঝা সহ্য করতে পারছি না।’

রুমি আহমেদ বুঝতে পারলো না কী এমন বলবে তার ভাই যার ফলে ঘৃণা করবে তাকে! রুমি আহমেদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের দিকে তাকাতেই লুৎফর আহমেদ শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শোয়া অবস্থায় বলে উঠল,

-‘আমি শফিকে খু’ন করেছিলাম। তোর আজ এই দশা’র জন্য আমি’ই দায়ী। একমাত্র তোর বড়ো ভাই লুৎফর দায়ী।’ বলতে বলতেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন কিন্তু এইবার আর রুমি আহমেদ তার ভাইয়ের কান্না দেখে সান্ত্বনা দিতে দৌড়ে আসলো না। সে একজায়গায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

#চলবে ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here