রঙিন_রোদ,পর্ব_১৩,১৪

0
1293

#রঙিন_রোদ,পর্ব_১৩,১৪
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৩

রাতে মৃত্তিকা তার মা’কে খাওয়ার উদ্দেশ্যে ডাকতে রুমের সামনে গিয়েই দেখল ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। মৃত্তিকা কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মা তো দরজা বন্ধ করেন না, আজ হঠাৎ কী হলো! সে দুয়েকবার ডাকলো কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেল না। হঠাৎ মনের ভেতর ভয় এসে বাধা বাঁধলো। মৃত্তিকা কাঁপা কাঁপা সরে ডেকে আবার দরজা ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে ভরাট কণ্ঠে আওয়াজ আসলো,
-‘খাবো না।’

মৃত্তিকা কিছুক্ষন দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মা হঠাৎ এমন ভরাট কণ্ঠে কেন কথা বলছে! মনে হচ্ছে যেন কান্না করছে কিন্তু কেনই বা কান্না করবে। মৃত্তিকা আরও কয়েকবার ডেকে কোনো সাড়া না পেয়ে রুমে এসে গেল। তার মায়ের মাঝে মাঝেই এমন হয় আবার সকালে ঠিক হয়ে যায়। হয়ত বাবার কথা ভীষণ মনে পড়েছে তাই আর না ডাকা-ই শ্রেয় মনে করে সে ফিরে আসলো।

মৃত্তিকা রুমে এসে খাটে শোবার পরেও অনেকক্ষন ঘুম এলো না মায়ের চিন্তায়। ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।
হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই তার মনে হলো, কেউ একজন খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার চোখে-মুখে উপচে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো খুব যত্ন সহকারে কানের পিছনে গুঁজে দিচ্ছে।
মৃত্তিকা অনেকক্ষণ চোখ খুলতে চেয়েও ঘুমের জন্য পারলো না। এক পর্যায়ে জোর করে চোখ গুলো টেনে খুলতেই দেখলো সারারুম জুড়ে রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে। তাহলে এতক্ষন এটা কী ভ্রম ছিল!
হঠাৎ ব্যালকনির দিকে চোখ যেতেই দেখলো পর্দার উপারে কেউ একজনের আবছা ছায়া। মৃত্তিকা প্রথমে ভয়ে গুটিয়ে গেলেও পরে ভয়কে আড়ালে ঢেকে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো। ততক্ষনে ছায়াটা মিলিয়ে গিয়েছে। ব্যালকনির ওখানে গিয়ে ভয়ে ভয়ে পর্দা সরাতেই কাওকে দেখল না। মাত্রই তো মনে হয়েছিল কেউ একজন এখানে আছে কিন্তু এসেই কেউ নেই! এটা কিভাবে সম্ভব! হঠাৎ ব্যালকনিতে চোখ যেতেই দেখলো, ব্যালকনির কাঁচটা খোলা। এটা কে খুলবে! মৃত্তিকা প্রাচীর দিয়ে নিচের দিকে তাকানোর পরও কাউকে দেখতে না পেয়ে রুমে এসে গেল।

খাটে এসে শুতেই আর ঘুম এলো না। সে কিছুক্ষন হাটাহাটি করতেই রুমের দরজায় আওয়াজ হলো। এতো রাতে কেই বা দরজা ধাক্কাবে! বাসার কারো কিছু হলো না তো! মৃত্তিকা দরজা খুলতেই সামনের আগন্তুকটাকে দেখে থমকে গেল। এটা কী আধো ভ্রম না-কি সত্যি! কতদিন পর মানুষটাকে দেখলো। মানুষটার দৃষ্টি অগোছালো। তার দৃষ্টিতে কী যেন একটা ছিল! অস্তিরতায় ভরা সেই দৃষ্টি। মৃত্তিকা আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। সে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেলল। এই চোখের দিকে তাকালে তার দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে যায়। মৃত্তিকার বক্ষপিঞ্জরের হৃদপিন্ডটা ধপধপ করছে।

-‘কেমন আছিস মৃত্তি?’

মানুষটার শীতল দৃষ্টি দিয়ে এক বাক্যের কথাটা কানে যেতেই মৃত্তিকার মন শীতলতায় ছেয়ে গেল। সে তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিতে পারলো না।

-‘বলছিস না যে!’

-‘আপনি…? কোথায় ছিলেন এতদিন!’ কথাটা বলতে গিয়ে মৃত্তিকার ঠোঁট কেঁপে উঠল। বুঝতে পারলো, মানুষটার উপর ভীষণ-রকম অভিমান জন্মেছে। দূরে থেকেও বুঝি ভালোবাসা হয়!

মৃত্তিকার এমন অভিমান-ভরা কণ্ঠস্বর শুনে ঈশানের অস্থির দৃষ্টি’গুলো হঠাৎ করে হাসি হাসি হয়ে ঠোঁটের কোনায় আপনা-আপনি মুচকি হাসি এসে ভর করলো। সে হেসে এগিয়ে মৃত্তিকার গালে হাত রাখতেই মৃত্তিকা উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশান তা দেখে তার প্রিয়তমাকে এক হাতে জড়িয়ে নিল। মৃত্তিকাও বিড়াল ছানার মতো একদম গুটিসুটি হয়ে ঈশানের বক্ষপিঞ্জরে গুঁজে রইল।

————

আজ অনেকদিন পর রুমি আহমেদের মনে আগের স্মৃতিগুলো হানা দিচ্ছে। তার সাথে শফিকের প্রথম থেকে শুরু সবকিছুই আবার নতুন করে মনে পড়ছে। তার সাথে শফিকের প্রথম দেখা এরপর প্রণয়, লজ্জা পাওয়া সব মিলিয়ে কী রঙিন স্মৃতি! কিভাবে ভুলবে সে মানুষটাকে!
রুমি আহমেদের চোখের সামনেই হানা দিল সেই বিশ বছর আগের ডাইরির রঙিন পাতাগুলো।
.
.
তখন সবে মাত্র সদ্য কিশোরীতে পা দিয়েছে রুমি আহমেদ। ফুটফুটে মেয়ে ছিল। সম্পূর্ণ বাসা মাথায় তুলতো তার চঞ্চলতায়। বাবা ছিল না। দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে কোনোমতেই টানাপোড়োনে সংসারটা চালিয়ে নিতো তাদের মা রাশিদা বেগম। একমাত্র মা’টার উপরও একদিন অসুস্থতা ভর করলো। বাসায় যা অর্থ ছিল সব শেষের পথে। দিন যতই যায় ততই অসহায় হয়ে পড়ে তারা। সাহায্য চেয়েও ব্যর্থ হয়। কেউই এগিয়ে আসে না। একদিন লুৎফর আহমেদ মাঝপথে পড়াশোনা রেখে সম্পূর্ণ বাসার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নেয়। কেমন করে সে সংসার চালাতো বলা যায় না। আস্তে আস্তে সুখের সংসার গড়ে উঠছিল। সদ্য কিশোরী বয়সে পা রাখা চঞ্চল রুমি সংসারের কাজ’গুলো এক হাতে সামলে নিয়েছিল। মা সারাদিন বিছানায় শুয়ে-বসে দিন কাটাতো। লুৎফর আহমেদ খুব সুন্দরভাবে সংসারটা সাজিয়ে তুলেছিল। এর কয়েকমাসের মধ্যে হঠাৎ করেই তাদের সংসারটা আরও সুন্দর হয়ে উঠল। কোনো কিছুর কমতি নেই। বিরাট বিরাট দালান বানালো লুৎফর আহমেদ। ছোট দুই ভাই-বোনকে খুব ভালোভাবেই পড়াশোনা করিয়ে বড়ো করে তুলছিল। আগে লুৎফর আহমেদের কাছ থেকে ছোট দুই ভাই-বোন কোনো আবদার ধরলে তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠতো অথচ এখন আর চিন্তার রেখা ফুটে উঠে না। ওরা খোঁজার আগেই সব হাসিমুখে তাদের সামনে এনে দিতো লুৎফর আহমেদ। আস্তে আস্তে গাড়ি-বাড়ি সব হলো। তার ভাইয়ের অনেক বড়ো ব্যবসা হলো। তার সামনে পিছে অনেক মানুষ ঘুরে। তেমনি একদিন ভাইয়ের সুবাদে দেখা হয়ে গেল শফিকের সাথে। সেদিন চঞ্চল কিশোরী গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। সেসময় শফি লুৎফর আহমেদের অপেক্ষায় সোফায় বসেছিল। দু’জনের প্রথমবারের মতো দেখা। লুৎফর আহমদের সাথে কাজের সুবাদে শফিক আহমেদ সবসময় রুমিদের বাসায় আসা-যাওয়া করতো। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে দৃষ্টি বিনিময় তারপর প্রণয়। সব মিলিয়ে দিন ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন শফিক আহমেদের আসা বন্ধ হয়ে যায় কারণ হচ্ছে লুৎফর আহমেদ রুমি-শফির বিষয়টা খেয়াল করতে পেরেছিল যার ফলে তিনি শফিককে বাসায় আসতে নিষেধ করেন কিন্তু চঞ্চল রুমি তো তা মানতে চায় না। লুৎফর আহমেদের এমন কড়া নিষেধাজ্ঞা শুনে শফি আর বাসায় আসার সাহস পায় না আর তাদের এমন প্রণয়ে লুৎফর আহমেদের এমন চিন্তা-ধারা দেখে ভবিষ্যতের কথা ভেবে সম্পর্কটা শেষ করে দেয়। তারপর চঞ্চল রুমি একদিন হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। লুৎফর আহমেদ তার একমাত্র বোনকে এমন রূপে দেখতে পারেনি। তিনি খেয়াল করলো তার বোন আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে যাচ্ছে, এক রুমে নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছে। এসবকিছুর পেছনে কী আছে তা লুৎফর আহমেদ খেয়াল করে শফিককে একদিন হুট্ করে বাসায় ডেকে এনে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এরপর পরই রুমি আহমেদের মুখে হাসি ফুটে উঠে।
মূলত শফিক আহমেদ ছিল একজন এতিম তাই লুৎফর আহমেদ তার আদরের বোনটাকে এর হাতে তুলে দিতে চায়নি কিন্তু শেষপর্যন্ত বোনের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো।

এরপর পরই তাদের বিয়ে। সুখেই চলছিল সব। মৃত্তিকা হওয়ার দুইমাসের মাথায় শফিক আহমেদকে সবসময় চিন্তাগ্রস্থ দেখা যেত, রুমি আহমেদ কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলতো না। হঠাৎ মৃত্তিকার তিন মাসের মাথায় খবর এলো শফি খুন হয়েছে। খবরটা তার একমাত্র আদরের বড়ো ভাই’ই এনেছিল তার সাথে শফিকের হাতের রক্তমাখা ঘড়ি আরও অন্যান্য জিনিস। এতে রুমি আহমেদের বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। এরপর রুমি আহমেদ একমাত্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আর শফিকের স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়।
তিনি ভেবেছিলেন, তার সাথে আর কেউ না থাকলেও তার একমাত্র বড়ো ভাই লুৎফর আহমেদ আছে কিন্তু এতদিন পর সে এটা কী শুনলো! তাও বা তার বড়ো ভাই! কীভাবে করতে পারলো তার ভাই এই কাজটা! সে তো জানতো, রুমি আহমেদ শফিকে কতটা ভালোবাসে! কীভাবে পারলো খুন করতে! রুমি আহমেদ যেন পাথর হয়ে গিয়েছেন।

রুমি আহমেদ তখন লুৎফর আহমেদের কাছ থেকে বাকি কথাগুলো না শুনে রুম থেকে দ্রুতপদে বেরিয়ে এসেছিল যার ফলে পেছনে লুৎফর আহমেদ অস্পষ্ট সুরে রুমি আহমেদকে আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন সেগুলো আর শুনেননি। তিনি তার একমাত্র বোনকে হয়ত বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন ভেবে বোনকে সামলাতে শোয়া থেকে উঠার চেষ্টা করতেই মেঝেতে পড়ে গেলেন। রুমি আহমেদ অতদিকে খেয়াল না দিয়ে সোজা রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেনই বা খুন করলো সেটাই আর শোনা হয়নি। কাল সকালেই তিনি তার ভাইয়ের কাছ থেকে সব শুনবে। কেন তার প্রাণ প্ৰিয় স্বামীকে সে খুন করেছে! তার কী হাতও কাঁপলো না! এতদিন এই ভাইকে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে ভেবে এসেছিল অথচ আজ সব মিথ্যে! তার ভাই একটা খুনি!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৪

সকাল হতেই আহমেদ বাড়িতে শোকের ছায়া পড়লো। লুৎফর আহমেদ মাঝরাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটা আশেপাশের মানুষে ভরে গেল। সবাই মুখ চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। রুমি আহমেদ যেন পাথরে রূপ নিয়েছে। কথায় বলে না? অতি শোকে পাথর। তার সাথেও এমন হচ্ছে। কাল রাতে এক সত্যি জানার পড়ে এক রাশ ঘৃণা এসে জন্ম নিয়েছিল ভাইয়ের প্রতি অথচ এখন! তার এই পৃথিবীতে দুইজন আপনজন ছিল। শফি আর তার ভাই। যখন শফি খুন হয়েছিল মনে করেছিল এই পৃথিবীতে তার শ্রেষ্ঠ ভাই তার সাথে আছে অথচ কাল শুনল সেই প্রিয়জনকে না কি আরেক প্রিয়জন খুন করেছে। তাও বা পাপের রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল বলে! আর এখন সেই ভাইটাও বিদায় নিল! রুমি আহমেদের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটাও তাকে ছেড়ে বহুদূর চলে গেছে। কীভাবে বাঁচবে সে! সে যেন পাথর হয়ে আছে। চোখ দিয়ে কোনো অশ্রুই বের হচ্ছে না। শোয়া অবস্থায় নিশ্চুপ শান্ত ভাইকে সে এভাবে মানতে পারছে না। এতদিন তাকে আগলে রাখা ভাইটাও অনেক দূরে পাড়ি জমিয়েছে।
রুমি আহমেদ মেঝেতে তার ঘুমন্ত নিশ্চুপ ভাইটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাথাটা হঠাৎ করে ভীষণ যন্ত্রনা করছে, চোখগুলো আর খুলে রাখতে পারছে না। বসা থেকে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো ঝাঁপসা দৃষ্টিতে ভাইয়ের মুখখানা দেখে নিল এরপর চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এল।

————

মৃত্তিকা তার বড়ো মামী আর রিনিকে কোনোমতে অল্প কিছু খাইয়ে দিয়ে এসে মা’য়ের রুমে গেল। বড়ো মামার মৃত্যু যেন মা মেনে নিতে পারছে না।
মৃত্তিকা স্যুপের বাটি নিয়ে মায়ের রুমে ঢুকতেই নার্সটা তার কাছ থেকে বাটি নিতে চাইলে মৃত্তিকা নিজে খাওয়াতে পারবে বলে ইশারা করলো।

মায়ের পাশে এগিয়ে যেতেই মৃত্তিকার চোখ ফেটে অশ্রু ঝরে পড়লো। তার মা কী নিশ্চুপ হয়ে পুবের জানালাটার বাইরের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! এক ঝটকায় রুমি আহমেদ একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার মায়ের এই পৃথিবীতে একমাত্র আপনজন বলতে এই ভাই-টাই ছিল। সেই ভাইয়ের এতো অল্প বয়সে বিদায় মেনে নিতে পারেননি তিনি যার ফলে একেবারে শুয়ে গিয়েছেন। ভাইকে শেষবারের মতো দেখতেও পেল না। ডাক্তার বলেছে, তিনি মানসিকভাবে একদম ভেঙে পড়েছেন। সুস্থ হওয়ার আশংকা একদম কম। তার পাশে সবসময় একটা নার্স থাকা জরুরি। নাহলে যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে।

মৃত্তিকা চোখ মুছে মা’য়ের পাশে বসলো। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে মা’কে ডাকলো।

রুমি আহমেদ মেয়ের ডাক শুনে জানালা থেকে আস্তে আস্তে দৃষ্টি সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। ডাক্তার বলেছে, তিনি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি হয়তো বেঁচে থাকার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছেন।

মৃত্তিকা মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেও ভালো নেই। একের পর এক ঘটনা তার মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সিয়ার মৃত্যু এখনো তাকে বারেবারে কাঁপিয়ে তুলে। এরপর পড়াশোনা স্থগিত। আদিবের এমন পরিবর্তন। এখন আবার বড়ো মামার বিদায়, যার মুখ দেখে এতদিন মৃত্তিকা তার বাবার কথা ভুলতো সেই মানুষটার এভাবে বিদায়টা মৃত্তিকা মেনে নিতে পারছে না তবুও উপরে সবার ভালোর জন্য নিজেকে শক্ত রাখতে হচ্ছে কিন্তু প্রতিনিয়ত সে কী পারবে!

মৃত্তিকা মা’কে খাইয়ে দিয়ে মাথার উপর হাত বুলিয়ে দিল। রুমি আহমেদ মলিন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালে মৃত্তিকা তার মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
এরপর খাবারের আরেকটা প্লেট নিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।
রুমে গিয়েই দেখলো ঈশান খাটের সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। হাঁটুর উপর এক হাত রেখে মাথা নিচু করে আছে।
মৃত্তিকা নিজেকে সামলে চোখ মুছে ঈশানের দিকে এগিয়ে গেল।

-‘ঈশান ভাই?’

মৃত্তিকার ডাকে ঈশান তার দিকে মাথা তুলে তাকাল। চোখদুটো ভীষণ লাল হয়ত কেঁদেছে। মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল। এই মানুষটাকে কষ্ট পেতে দেখলে তার নিজেরই যে ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যায়।

-‘সেই সকাল থেকে তো কিছুই খাননি। অল্প কিছু খেয়ে নিন।’

-‘বাবা’কে ছাড়া আমি নিজেকে এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। কেন এতো তাড়া ছিল উনার!’

মৃত্তিকা কিছু বলতে পারলো না। তার নিজেরও যে প্রচন্ড খারাপ লাগছে, কাকে বুঝাবে সে! একের পর এক তার প্ৰিয় দুইটা মানুষ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ভেতরটা তার ফেটে যাচ্ছে কিন্তু কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। এই মুহূর্তে ঈশান ভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা সে পাচ্ছে না। সে একটা মলিন শ্বাস ফেলে ঈশান ভাইয়ের কাঁধে আলতো করে ডান হাতটা রাখতেই ঈশান মৃত্তিকাকে ঝাপ্টে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
ঈশান মৃত্তিকার কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। মৃত্তিকারও এতক্ষন যে কান্নাগুলো আটকে রেখেছিল তা সব বেরিয়ে এলো। এই বাসাটা হয়ত কেউ বড়ো মামাকে ছাড়া কল্পনাও করেনি অথচ আজ সেই দিন দেখতে হচ্ছে। বাসাটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহের ভেতর।

————–
দেখতে দেখতে আরও কয়েকদিন কেটে গেল। মেডিকেলটা আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ’ভাবে উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাদের হাতে করতলগত হয়েছে। ঈশান সেদিকে আর খেয়াল দেয়নি।
মৃত্তিকা’র কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই। ঈশান হয়ত কিছুটা হলেও জানে কিন্তু বলছে না। নাহলে এতো বড়ো মেডিকেলটা অন্যরা ভেঙে জায়গা দখলে নিয়ে নিয়েছে তবুও ঈশান সেদিকে কেন ভাবনা দিল না! এই ব্যাপারটা মৃত্তিকাকে বারেবারে ভাবাই কিন্তু তবুও সে মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করে না। মানুষটা সবে মাত্র একটা শোক কাটিয়ে উঠেছে তার উপর এই কয়েকদিনে মৃত্তিকা মানুষটাকে প্রচন্ড-রকম ভালোবেসে ফেলেছে।

আস্তে আস্তে রুমি আহমেদের শরীরের অবনতি হচ্ছে। শহরের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারকে দেখিয়েও লাভ হলো না। ডাক্তার’রা বলল,’যদিও আশা করা যায় না তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা শারীরিক-ভাবে উনাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করছি কিন্তু উনি মানসিক-ভাবে ভেঙে পড়েছেন অনেক আগেই। উনি উনার মনের কষ্টগুলো কাউকে বলতে না পেরে চিন্তায় আরও ভেঙে পড়ছেন। উনি বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে। যার ফলে উনাকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে তবুও আমরা চেষ্টা করছি। এইবার বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’
মৃত্তিকা ভীষণ করে ভেঙে পড়েছে। সে এসব আর মানতে পারছে না। এই পৃথিবীতে তার ভালোবাসার মানুষ খুব সীমিত। সেই সীমিত থেকেও বারেবারে সবার বিদায় নেওয়া সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। এই মা চলে গেলে সে কীই-বা নিয়ে বাঁচবে!

রিনির অনেক আগে থেকে দেশের বাইরে পড়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পরিবারের এই পরিস্তিতিতে সে ইচ্ছে-টাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল। ঠিক সেসময় ঈশান রিনিকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিল রিনিকে। সে চায়না, তার জন্য তার একমাত্র আদরের বোনটার ইচ্ছেটা পূরণ না হোক। রিনিকে একা যাওয়ার অনুমতি দিলেন না আমেনা রহমান। তার এক কথা, সে এই মেয়েটাকে একা ছাড়বে না। যেতে হলে সেও মেয়ের সাথে চলে যাবে। ঈশানও রিনির সাথে মায়ের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।রিনিও বাধ্য মেয়ের মতো সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মা’কে নিয়ে সুদূর বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। ঈশান’ও চায় সে এদেশ খুব তাড়াতাড়ি ছাড়বে। মৃত্তিকাকে নিয়ে বহুদূর পাড়ি দিবে। যেখানে সে আর মৃত্তিকা ছাড়া আর কেউ থাকবে না।

মৃত্তিকা এখন সারাদিন মায়ের পাশে বসে মায়ের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাতে ঘুমায়ও না। খাবারের ঠিক নেই। ঈশান সময়ে সময়ে গিয়ে কোনোমতে জোর করে অল্প কিছু খাইয়ে দেয়। তারও মাথার উপর ভারী চিন্তা। মেয়েটার চোখ-মুখ দুইদিনের ভেতর কোটরে ঢুকে গিয়েছে। চেহারা শুকিয়ে কাঠ। চোখের নিচে কালো দাগ বসে গেছে। ঠিকমত চুল আচড়ায় না। ঈশান সারাদিন এখানে ওখানে দৌড়ে রাতে বাসায় ফিরে। ক্রান্তিতে চোখ বুজে যায় তবুও সে মুখের উপর পানির ঝাপটা দিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা টেনে মৃত্তিকার চুল আচড়িয়ে দেয়, তার যত্ন করে। মৃত্তিকা মলিন চোখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে হাসে। সারাদিন ঈশান এতো ব্যস্ততা শেষে রাতে যখন মৃত্তিকাকে কাছে টেনে বুঁকের ভেতর জড়িয়ে ধরে তখন তার সব ক্রান্তি মুহূতের মধ্যে উবে যায়। এটাই তো তার প্রশান্তি! এই মেয়েটার মধ্যেই তার সব শান্তি নিহিত। ঈশানের ভীষণ খারাপ লাগে। কেন এতো পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে পরিবারটা!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here