অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-০২,০৩

0
1146

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-০২,০৩
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০২:

||
মায়ের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো স্পর্শের। চোখ খুলে দেখলো দুপুর ১২টা। বিছানা ছেড়ে উঠে, সাথে সাথেই জানালার পর্দা সরিয়ে সামনের বিল্ডিংয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো। কিন্তু পিয়াসার বারান্দার দরজা-জানালা বন্ধ দেখে মন খারাপ করে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

নাস্তা খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো স্পর্শ। আজ যেহেতু কলেজে যায় নি, তাই ভাবলো পিয়াসার স্কুলের সামনে গেলে মন্দ হয় না।
হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো সেই মাঠে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখলো পিয়াসা ও তার সাথে চার-পাঁচজন মেয়ে স্কুল গেইট দিয়ে বের হচ্ছে।
পিয়াসাকে দেখেই স্পর্শের মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ সৃষ্টি হয়েছে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়েকে দেখার জন্য সে এতোটা উতলা হয়ে যাচ্ছে। গলার পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে স্পর্শের।

পিয়াসা আজও ফুচকাওয়ালা মামার কাছ থেকে দু প্লেট ফুচকা নিয়ে খেতে লাগলো।
স্পর্শ একটু দূরে দাঁড়িয়ে একনজরে তাকে দেখে যাচ্ছে। আজ সে পিয়াসার মাঝে নতুন কিছু লক্ষ্য করেছে।
মেয়েটির হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। আড়চোখে যদি কারো দিকে তাকায়, তবে সেই চাহনি কোনো ঋতুর অপেক্ষা করবে না। হঠাৎ এসেই ছুঁয়ে দেবে। ব্যাখ্যা করার ভাষাও পাবে না সেই মানুষটি।

তবে কি সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা হয় না?
টি. সি হেনলির একটি উক্তি মনে পড়ে গেছে।

‘সৌন্দর্য দৃশ্যমান সঙ্গীত।’

কথাটি আসলে অনেকটা সত্য।
সঙ্গীত আমরা শুধুই অনুভব করি। এটি মোহ সৃষ্টি করে মনে। আবার সঙ্গীত ভেদে তারতম্যও আছে। কারো ঝাঁঝালো গান পছন্দ, যেখানে বাদ্যযন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়। কারো আবার শুধুই বাঁশির সুরের মাঝে গেঁথে যাওয়া গান পছন্দ। কারো আবার বিরোহের গান।
ঠিক তেমনি স্পর্শের কাছে পিয়াসার সৌন্দর্য যতোটা আকর্ষণীয়, বাকীদের কাছে হয়তো কিছুই না। তাই অন্য পুরুষের ব্যাখ্যায় পিয়াসাকে ফুটিয়ে তুলা যাবে না। শুধুই স্পর্শের মন সেই সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিতে পারবে।

ফুচকা খাওয়া শেষে বান্ধবীদের সাথে দল বেঁধে হাটতে লাগলো পিয়াসা। স্পর্শ আসছে তার পিছু পিছু। নিরবে হাঁটছে আর পিয়াসার কথাগুলো শুনছে। আর মনে মনে হাসছে। পিয়াসার কন্ঠটাও দারুণ মিষ্টি। তার তো ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলতে। এই কন্ঠে সুর দিলে স্পর্শ হারিয়ে যাবে হয়তো কোনো এক অজানা দেশে।

স্পর্শ মনে মনে ভাবছে,
স্পর্শ: মায়াবিনীর নামটা তো জানাই হলো না! তবে মায়াবিনীর অনেক নাম দেওয়া যায়। সুচিস্মিতা, প্রিয়ংবদা, এণাক্ষী। মায়াবিনী কোন নামটি নিজের করে নেবে? আমার তো সুচিস্মিতায় উপযুক্ত মনে হচ্ছে।

পিয়াসা তার বান্ধবীদের সাথে প্রতিদিন আড্ডা দিতে দিতেই বাসায় যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে তার বাসায় যাওয়ার পথে একটা মেইন রোড পড়ে। যা পার করা পিয়াসার কাছে বাঘের খাঁচায় ঢুকার মতো। এই রাস্তাটা পার হতে তার এক বান্ধবী সাহায্য করে। কারণ তার বাসা এই রাস্তার পরেই। বাকীদের বাসা আরো আগে থাকে। এখন সমস্যা হলো, আজ তো পিয়াসার সেই বান্ধবী স্কুলেই আসে নি। তাই পিয়াসা রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ৷ গাড়ি আসছে, আর যাচ্ছে। থামা থামির কোনো নামই নিচ্ছে না। স্পর্শ পিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পেরেছে পিয়াসা রাস্তা পার হতে পারে না। পিয়াসাও বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।

স্পর্শ পিয়াসার কাছাকাছি আসলো। পিয়াসার সাথে কথা বলার জন্য তার মনটা উতলা হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিভাবে এই কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না।

পিয়াসা স্পর্শকে দেখে মনে সাহস নিয়ে বললো,
পিয়াসা: ভাইয়া! আপনি কি আমায় সাহায্য করতে পারবেন?

স্পর্শ পিয়াসার মুখের দিকে তাকালো।
পিয়াসা স্পর্শের দিকে না তাকিয়েই বললো,
পিয়াসা: আমার রাস্তা পার হতে একটু সমস্যা হয়! আপনি কি একটু সাহায্য করবেন?

স্পর্শ: আচ্ছা, চলুন।

স্পর্শ হাত দেখিয়ে অর্ধেক রাস্তা পার করে দেখলো পিয়াসা এখনো সেই আগের জায়গায় আটকে আছে।

স্পর্শ আবার পেছনে এসে বললো,
স্পর্শ: ভয় পাবেন না। আমার সাথে সাথে আসুন।

পিয়াসা স্পর্শের সাথে তাল মিলাতে না পেরে আবার পেছনেই র‍য়ে গেলো। এবার স্পর্শ এসে পিয়াসার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। পিয়াসা স্পর্শের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হাত ধরবে কি ধরবে না এ নিয়েই ভাবছে এখন।

হঠাৎ পিয়াসা স্পর্শের শার্টের কোণা ধরে বললো,
পিয়াসা: সরি, আপনাকে বিরক্ত করছি। এভাবে আমার কোনো সমস্যা হবে না।

স্পর্শ মুচকি হেসে পিয়াসাকে রাস্তা পার করিয়ে দিলো।

তারপর পিয়াসা ধন্যবাদ দিয়ে আবার হাঁটতে লাগলো। আর স্পর্শ পিয়াসার পিছু পিছু আসছে।

স্পর্শ মনে মনে ভাবছে,
স্পর্শ: একটাবার তাকালোও না আমার দিকে?

পিয়াসা বাসায় এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বিকেলে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো ফোন নিয়ে। জানালায় উঁকিঝুকি দিয়ে পিয়াসাকে দেখেই স্পর্শ একটা চেয়ার টেনে জানালার সামনে এসে বসলো।

পিয়াসা গান শুনছে। পা দুটি বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বের করে রেখেছে।

হঠাৎ তুবা এসে বললো,
তুবা: এই মুভি দেখবো চল।

পিয়াসা: কোন মুভি?

তুবা: হঠাৎ বৃষ্টি মুভিটা দেখবি? আমার ভালো লাগে ওইটা। ইচ্ছে হয় বারবার দেখতে।

পিয়াসা রুম থেকে ল্যাপটপটা বারান্দায় নিয়ে আসলো। তারপর দুজন মিলে মুভিটা দেখা শুরু করলো। পিয়াসা মুভি দেখতে দেখতে কান্না করছে।

তুবা: এভাবে কাঁদছিস কেন?

পিয়াসা: অনেক কষ্ট লাগছে রে!

তুবা: এসব মুভিতে হয়। বাস্তবে কি সম্ভব?

পিয়াসা: আমার জীবনে যদি এতো কষ্ট আসে, আমি সহ্য করতে পারবো না। এতো ধৈর্য ধরে কাউকে খুঁজে নেওয়া সম্ভব না।

তুবা: প্রেমে পড়লে ধৈর্য আপনাপনি চলে আসবে।

স্পর্শ এতোক্ষণ পিয়াসার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। পিয়াসার চোখে পানি দেখে খুব অবাক হলো।

স্পর্শ: কেন কাঁদছে ও? কি দেখে কাঁদছে? অকারণেও কি কেউ কাঁদে? নাকি কোনো কারণ আছে। আমার তো জানতে ইচ্ছে করছে সুচিস্মিতা কেন মলিন মুখে বসে আছে?

এখন অনেক রাত। হয়তো রাত বারোটা কি সাড়ে বারোটা। আজ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো এলাকা। স্পর্শ বারান্দায় বসে আছে। পিয়াসাকে দেখার পর থেকে ঘরে একটা মিনিটও শান্তিতে থাকতে পারে না সে। মনটা বার বার বারান্দায় পড়ে থাকে। আর চোখ দুটি ব্যস্ত থাকে জানালার ফাঁকে।

পিয়াসার ঘরে আলো জ্বলছে। হয়তো আলাদা ব্যবস্থা আছে বিদ্যুৎ সরবরাহের। তাই হয়তো আজ স্পর্শের সঙ্গী হলো না পিয়াসা।

আরো কিছুক্ষণ পর পিয়াসার ঘরের আলো নিভে যায়। সে তুবাকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। হঠাৎ স্পর্শের কানে এলো গুনগুন করে কেউ গান গাইছে। স্পর্শ কান পেতে শুনে রইলো।

পিয়াসা শীতল হাওয়ার মাঝে উন্মুক্ত করে দিয়েছে তার সুর।

একদিন স্বপ্নের দিন, বেদনায় বর্ণ বিহীন
এ জীবন নেই যেন আসে এমনই স্বপ্নের দিন।
.
সেই ভাবনায়, ভাবি মনে হয়
দু’টি নয়নেতে ঘোর বর্ষা নামে,
.
আসে না ফাগুন, মনেতে আগুন
আসে না ফাগুন, মনেতে আগুন।
এমন বিরহ জ্বালায়, স্মৃতির মেলায়
কাটেনা আর দিন।
.
একদিন হঠাৎ হাওয়া,
থামিয়ে আসা যাওয়া,
প্রশ্নের জাল বুনে,
শুরু হয় চাওয়া-পাওয়া।
.
আজ শুধু পথ চাওয়া
বিরহের গান গাওয়া
ভাবনার নদী বুকে
উজানেতে তরী বাওয়া।
.
শুধু সেই গান ভোলে অভিমান
চোখে অকারণ, ঘোর বর্ষা নামে
.
আসে না ফাগুন, মনেতে আগুন
আসে না ফাগুন, মনেতে আগুন
এমন বিরহ জ্বালায়, স্মৃতির মেলায়
কাটেনা আর দিন
.
যদি এ পথ ধরে
আমার এই মনের ঘরে
চিঠি হয়ে অগোচরে
আসে কেউ চুপিসারে।
.
চাঁদের ঐ আলো হয়ে
আসো মোর ভাঙা ঘরে
দেখা যায়, যায়না ছোঁয়া
যেন গান চাপা স্বরে।
.
শুধু সেই গান ভোলে অভিমান
চোখে অকারণ, ঘোর বর্ষা নামে
.
আসে না ফাগুন, মনেতে আগুন
আসে না ফাগুন, মনেতে আগুন
এমন বিরহ জ্বালায়, স্মৃতির মেলায়
কাটেনা আর দিন।

স্পর্শ ভাবলো,
স্পর্শ: মায়াবিনী তুমি তো আমায় তোমার মায়ার জলে একেবারেই ডুবিয়ে দেবে।

এভাবেই কেটে যায় অনেক দিন। স্পর্শের দিন শুরু হয় পিয়াসার বারান্দার দিকে তাকিয়ে, রাত শেষ হয় ঠিক ওভাবেই। কলেজ ছুটির পর পিয়াসার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। ক্লান্ত শরীরে, ঘামে ভেজা কড়া রোদের ভীড়ে, বৃষ্টিসিক্ত অবেলায় স্পর্শের ঘোর পিয়াসাতেই আবদ্ধ। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন? এবার না হয় মায়াবিনীকে মনের কথাটা বলেই দেবে সে।

স্পর্শ এতোদিনে বুঝতে পেরেছে পিয়াসা ছেলেদের মুখের দিকে তাকায় না। অনেক লাজুকলতা আছে ওর মাঝে। তাই সরাসরি ভালোলাগার কথাটি জানানো সম্ভব না। হ্যাঁ, সে প্রেমপত্র লিখতে পারবে। প্রেম পত্র লিখে আগে প্রেয়সীর মনে জায়গা করে নেবে। তারপর না হয় আসবে সামনে।

একদিন বিকেলে বারান্দায় কারো ঢিল মারার শব্দ শুনে পিয়াসা ছুটে গেলো।

চেঁচিয়ে বললো,
পিয়াসা: কোন ছ্যাঁচোড় রে!

বারান্দার মেঝেতে একটা পাথরে মোড়ানো চিরকুট। হাতে নিয়ে বেশ অবাক হলো পিয়াসা। মনে মনে খুশিও হলো। জীবনে প্রথম চিরকুট পেয়েছে তাই।

চিরকুটটিতে লেখা আছে,

প্রথম তোমারে দেখিয়াছি,
গভীর জলের চোখে ডুব দিয়াছি,
আমি হতে চাই তোমার মনের মাঝি,
তুমি কি দেবে ঠাঁই আমায়, ওগো প্রেয়সী?

পিয়াসা আশেপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। চিরকুট হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো কে হতে পারে এই চিরকুটের মালিক?

পরক্ষনেই মনে পড়লো, এই কাজ ওই রকির নয় তো?
পিয়াসা ধরেই নেয় এই চিরকুট রকি দিয়েছে। কারণ এই এলাকায় একমাত্র রকি পিয়াসাকে উত্যক্ত করে। শুধু পিয়াসাকে নয়, রাস্তায় যতো মেয়ে যায় আর আসে, সবাইকেই সে বিরক্ত করবে।
রকি এই চিরকুট দিয়েছে ভেবেই রাগে পুরো শরীরটা ঘিনঘিন করে উঠলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিরকুটটা কুঁচিকুঁচি করে ফেলে দিলো নিচে।

জানালার ফাঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে স্পর্শ সবকিছুই দেখছিলো। পিয়াসার এভাবে চিরকুটটা ফেলে দেওয়ায় সে খুব কষ্ট পেলো।

তার সারারাত কেটে গেলো পিয়াসার কাছে নিজেকে কিভাবে প্রকাশ করবে সেই ভাবনায়।
||

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের কলমটি টেবিলে রাখলো আদি।
মনে মনে বললো,
আদি: নারীরা বুঝে না চোখের ভাষা, বুঝে না সহজ প্রেম। তারা জটিলতা সৃষ্টি করে, প্রেম গল্পের সমাপ্তি তাই অনেক দেরীতে আসে।

চলবে—-

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৩:

||
স্পর্শ বিকেলে হাঁটতে বের হয়েছে৷ হঠাৎ পিয়াসাকে দেখে থমকে গেলো। পিয়াসা এলাকার মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে, আর ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের খেলা দেখছে। পিয়াসাকে দেখে স্পর্শ একটু নড়েচড়ে উঠলো। ধীরে ধীরে মাঠের ভেতরে ঢুকে একটি গাছের নিচে দাঁড়ালো। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে পিয়াসাকে দেখতে লাগলো।

ব্লু স্টার ফুলের মতো লাগছে পিয়াসাকে। পেছনে সবুজ বাগান, আর পরনে নীল রঙের জামা যেখানে সাদা ফুলের হালকা কাজ আছে। চোখে একটা চশমাও লাগিয়েছে। আইসক্রিমের কিছু অংশ চশমার গ্লাসে লেগে গেছে। পিয়াসাকে বাচ্চাদের মতো আইসক্রিম খেতে দেখে স্পর্শের খুব মজা লাগছিলো।

আইসক্রিম খাওয়া শেষে পিয়াসা বাচ্চাগুলোর সাথে অনেকক্ষণ ব্যাডমিন্টন খেললো। ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে অনেকক্ষণ বসে গল্পগুজব করলো। অনেক প্রশ্ন করলো তাদের। পিয়াসার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বাচ্চাগুলো ক্লান্ত। কিন্তু পিয়াসা আর ক্লান্ত হয় না।
স্পর্শ একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে যে পিয়াসা বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু স্পর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত। ও বাচ্চাদের ধারের কাছেও যায় না।

মাগরিবের আযানের আগে পিয়াসা বাসায় ফিরলো।

এদিকে স্পর্শ পিয়াসার পেছন পেছন মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলো। আর যতোক্ষণ পিয়াসা মাঠে ছিলো ততক্ষণ স্পর্শও সেখানে ছিলো যা রকিকে তার চ্যালাপেলারা জানিয়ে দেয়।

-ভাইজান, ভাবী রে তো ওই নতুন একটা পোলা আইছে না? ওইটা বিরক্ত করে। হাঁ কইরা ভাবীর দিকে তাকায় থাকে।

রকি: ব্যাটা নতুন আইসা রকির প্রেমিকার দিকে নজর দেয়। ব্যাটার দিকে নজর রাখ। তেড়িমেড়ি করলে হাত-পা ভাইঙা দিবি। কেমন?

-আইচ্ছা ভাইজান।

এদিকে কয়েক সপ্তাহ পর-

একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে স্পর্শ দেখলো পিয়াসা ফুলের চারা বিক্রি করছে এমন একটি ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

পিয়াসা: মামা, এই গোলাপের চারার দাম কতো?

-দুইশো।

পিয়াসা: মজা করো? এতো দাম হয়?

-দুইশোর নিচে হইবো না।

পিয়াসা: লাগবো না তোমার চারা। সাজায় রাখো তুমি তোমার এই ভ্যানে।

পিয়াসা দাম শুনেই মন খারাপ করে চলে গেলো। বাসায় এসে মাত্র ঘরে ঢুকেছে সাথে সাথেই বেল বেজে উঠলো।

পিয়াসার বাবা-মা দুজনই চাকরি করে। ঘরে পিয়াসা একাই থাকে। আর পিয়াসা বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। তাই সে যথেষ্ট স্বাধীনতা পায়।

পিয়াসা দরজা খুলে দেখলো কেউ নেই। কিন্তু নিচে সেই গোলাপের চারাটা রাখা আছে যেটি আজ ভ্যানগাড়িতে দেখেছিলো। পিয়াসা অবাক হয়ে চারাটা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ভালোভাবে চারাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। একটি চিরকুট পেলো চারাটির মাটির ভেতরে।

চিরকুট বের করে দেখলো।

আমার পক্ষ থেকে দেওয়া প্রথম উপহার। একটি তাজা গোলাপের চারা। ফুল শুকিয়ে যাবে, হয়তো ঝরেও যাবে একদিন। কিন্তু এই মনে তুমি গেঁথে থাকবে চিরদিন। তোমায় খুব ভালো লাগে সুচিস্মিতা। এটি আমার দ্বিতীয় চিঠি। এটি ফেলে দিয়ে আমায় কষ্ট দিও না। যত্নে রেখো।

পিয়াসা মিনিট কয়েক চিঠির দিকে তাকিয়ে বারান্দায় এলো। চিঠির মালিক রকি তো কখনোই হবে না, যা এই চিঠি পড়ে সে বুঝেছে। কারণ রকির বাসা অন্য এলাকায়। তবে সে রাস্তায় তার চ্যালাপেলাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাই পিয়াসা ভেবেছে হয়তো নিচ থেকে ছুঁড়ে দিয়েছিলো রকি। কিন্তু পিয়াসা চিঠি ফেলে দিয়েছে তা কিভাবে জানবে? কারণ চিঠি ফেলার সময় রকিকে সে নিচে দেখে নি। আর রকি এতোটা সুন্দর ভাষায় কখনো চিঠি লিখবে না। তার চিঠি লেখার ধরণ অনেক জঘন্য হবে। কারণ রকির চিন্তাধারা অনেকটা নোংরা। বাজে ভাষায় কথা বলে মেয়েদের সাথে। কিন্তু এই চিঠিতে পিয়াসা পবিত্রতা খুঁজে পাচ্ছে। মিষ্টি ভাষী একজন মানুষকে কল্পনায় আনতে চাইছে তার মন।

ফ্রেশ হয়ে গোলাপ গাছটি টবে লাগালো পিয়াসা। সেটিতে অল্প পানি দিলো।

এভাবে মাঝে মাঝেই চিঠি আসে পিয়াসার কাছে। কখনো লাইব্রেরি থেকে বই কিনে ফিরলে দেখে বইয়ের ফাঁকে চিঠি। কখনো হঠাৎ বেল বেজে উঠে, আর কোনো এক আগন্তুক দিয়ে যায় পিয়াসাকে একটা খোলা চিঠি।

যদিও পিয়াসা উত্তর দিতে পারে না। কারণ উত্তর পাঠানোর ঠিকানা তার অজানা।

স্পর্শ দিন দিন পিয়াসার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। রাত দিন জানালার পাশে বসে থাকে পিয়াসাকে একনজর দেখার জন্য। একবার দেখলেও মন ভরে না তার। বারবার দেখতে ইচ্ছে হয়।

নতুন বর্ষার মাস এলো। এই মাসটি স্পর্শের বড়োই প্রিয় ঋতু। ছাতা হাতে শূণ্য রাস্তায় হাঁটতে বের হয় সে। পিয়াসার কাছে এই ঋতু অপছন্দের তখন, যখন স্কুলে যেতে হয়। এটি স্কুলের শেষ বছর। তাই স্কুলে এক্সট্রা ক্লাস হয়, পাশাপাশি পরীক্ষাও থাকে।

আজও পিয়াসার ক্লাস টেস্ট আছে। আর সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে তো বাড়ছেই। থামার নাম নিচ্ছে না। সকালে উঠেই বাবা-মা অফিসে চলে যাওয়ার পর পিয়াসাকেও স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায়। পরীক্ষা সকাল দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। এরপর এক্সট্রা ক্লাস করতে করতে বেজে গেলো দুপুর দুইটা। স্কুল থেকে বের হওয়ার সময় খেয়াল করলো তার কাছে ছাতা নেই। এমনকি টাকার ব্যাগটাও বাসায় ফেলে এসেছে। এখন কিভাবে যাবে? হেঁটে যাওয়া তো একেবারেই অসম্ভব। এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরও বৃষ্টি কমে নি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছেই। তবে বেগটা আগের চেয়ে অল্প একটু কমেছে। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে চোখ বন্ধ করেই নেমে পড়লো রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে অর্ধেক এসে বুঝতে পারলো সামনে মারাত্মক পানি। এই পানির মধ্যে সে একেবারেই ডুবে যাবে।
জলাবদ্ধতা তার শহরের একটি মারাত্মক অসুখ। এই অসুখের জন্যই বৃষ্টির দিনটা পিয়াসার কাছে বিরক্তিকর।
এদিকে রিক্সার চাকা দেখা যাচ্ছে না, সিট পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। পিয়াসা পানিতে পা রাখবে কি রাখবে না ভাবছে। এই মুহূর্তে বাসায় যাওয়া খুব দরকার। আর স্কুলে ফোন নেওয়ার অনুমতি নেই, তাই তার ফোনটা বাসায় রেখে এসেছে।

এদিকে-
স্পর্শের ছোট বোনের প্রচন্ড জ্বর এসেছে। আর স্পর্শের বাবাও বাসায় নেই। পরিচিত এক ডক্টরকে ফোন দিয়ে ওষুধ নিলো স্পর্শের মা।

স্পর্শের মা: যা তো বাবা। এই ওষুধ গুলো নিয়ে আয়।

স্পর্শ বোনের রোগা মুখটা দেখে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় পানির মধ্যে সাঁতরে গিয়ে দেখলো আশেপাশের সব ফার্মেসি বন্ধ। বাধ্য হয়ে তাকে বাসা থেকে আরো দূরে গিয়ে ওষুধ কিনতে হলো।

ফেরার পথে তার চোখ আটকে গেলো। পানির মধ্যে সাঁতরে সাঁতরে পিয়াসা এদিকে আসছে। কোমড় সমান পানিতে হাঁটতে পিয়াসার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ব্যাগটা মাথার উপর তুলে ধীরে ধীরে হাঁটছে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে কান্না করছে। স্পর্শ পিয়াসার কাছে যাওয়ার আগেই পায়ের সাথে কিছু একটা আটকে যাওয়ায় পিয়াসা রাস্তায় খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠলো।

পিয়াসা: আহ! আম্মু……..

স্পর্শ তাড়াতাড়ি পিয়াসার কাছে গিয়ে পিয়াসার হাতটা ধরে পিয়াসাকে সোজা ভাবে দাঁড় করালো। কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পিয়াসা মুখ তুলে তাকালো স্পর্শের দিকে। এই প্রথম স্পর্শ-পিয়াসা পরস্পরের মুখোমুখি হলো। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাওয়া পিয়াসা শান্ত দৃষ্টিতে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পর্শের রেইনকোটের ফাঁকে জমে থাকা পানিগুলো পিয়াসার গায়ে এসে পড়ছে।

স্পর্শ: ঠিক আছো?

স্পর্শের কথা শুনে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
পিয়াসা: না, পায়ে ব্যথা করছে আমার। হয়তো সাপে কামড় দিয়েছে।

স্পর্শের মাথায় প্রথমে এলো পিয়াসাকে কোলে নিয়ে রাস্তাটা পার করিয়ে দেবে। কিন্তু এই শহরে এভাবে একটি অপরিচিত ছেলে আরেকটি অপরিচিত মেয়েকে কোলে নিয়ে রাস্তা পার করাবে এটা নিতান্তই পরিহাসের। যতোই ভালোবাসুক পিয়াসাকে, কিন্তু সেই ভালোবাসা তো পিয়াসারও অজানা। আর পিয়াসা তার খুব কাছের হলেও এমন একটা কাজ করলে রাস্তার মানুষজন তাদের চিড়িয়াখানার প্রানীকে যেভাবে দেখে সেভাবেই দেখবে। তাই শুধু পিয়াসার হাতটা ধরে হাঁটতে লাগলো। যদিও পিয়াসার খুব কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু মুখ বুজে সব সহ্য করছে সে।

স্পর্শ পিয়াসাকে একটি উঁচু রাস্তায় এনে হালকা উঁচু একটা দেয়ালে বসিয়ে পিয়াসার পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
স্পর্শ: তোমার জুতো কয়?

পিয়াসা: ছিঁড়ে গেছে। ফেলে দিয়েছি।

স্পর্শ পিয়াসার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো লালচে দাগ হয়ে গেছে। হয়তো পায়ের তলায় কিছু একটা বিঁধেছিলো। ছোট পাথরের অংশও হতে পারে।

একটা রিক্সা দেখার পর স্পর্শ পিয়াসাকে সেই রিক্সায় উঠিয়ে দিলো।

পিয়াসা: আমি রিক্সায় যাবো না।

স্পর্শ: সামনে আরো পানি।

পিয়াসা: টাকা নেই আমার হাতে।

স্পর্শ পিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে রিক্সাওয়ালাকে টাকাটা দিয়ে দিলো।

পিয়াসা: আমি কিভাবে ফেরত দেবো! আমি তো আপনাকে চিনি না।

স্পর্শ: সমস্যা নেই। তোমার নাম কি?

পিয়াসা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ব্যাগ থেকে একটা গোলাপ ফুল বের করে দিলো। স্পর্শ ফুলটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।

পিয়াসা: আমার গাছে কাল এই ফুলটা ধরেছে। একদম তাজা। আমার হাতে টাকা নেই, আপনি এটা নিন। আর ফুল বন্ধুর মতো, তারা পৃথিবীতে রঙ ছড়ায়। বানিয়ে বলছি না। রালফ আল্ডোর উক্তি এটি। আপনি বন্ধুর মতো সাহায্য করেছেন আমাকে। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে কিছুই নেই দেওয়ার মতো, তাই এই ফুলটা দিলাম।

স্পর্শ মুচকি হেসে ফুলটা নিয়ে বললো,
স্পর্শ: তাজা ফুল গাছে থাকলে আরো সুন্দর দেখায়।

পিয়াসা: জানি। কিন্তু বান্ধবীদের দেখানোর জন্য ছিঁড়ে ফেলেছি। আমার বাগানের প্রথম ফুল এটি।

স্পর্শ: ধন্যবাদ।

পিয়াসা বিদায় নিয়ে চলে গেলো। স্পর্শ পিয়াসার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মায়াবিনীর হাত থেকে সে একটি গোলাপ পেয়েছে। এর চেয়ে ভালো কি আর কোনো উপহার থাকতে পারে? এই প্রিয় মুহূর্তটি সারাজীবন স্পর্শের স্মৃতিতে থাকবে। এই তাজা গোলাপের প্রতিটি পাপড়িতে তার সুচিস্মিতাকে খুঁজে নেবে সে।
||

আদির মুখের দিকে তাকিয়ে বর্ণ এতোক্ষণ শুনছিলো স্পর্শ-পিয়াসার ভালোবাসার গল্প।

বর্ণ: পিয়াসা নাম বলে নি কেন স্পর্শকে?

আদি: মেয়েরা সবকিছু জটিল করে দেয়। নাম বলে দিলে পিয়াসাকে জানা শেষ হয়ে যাবে। স্পর্শ তো এতো সহজে পিয়াসাকে জানবে না।

বর্ণ: কেন জানবে না?

আদি: বেশি জেনে গেলে আগ্রহ কমে যায়। তাই কম জানা ভালো।

বর্ণ মনে মনে হাসলো। কারণ আদি কখনোই বর্ণ সম্পর্কে কিছুই জানতে চাই নি। কেন চাই নি? তবে কি আদি চাই না বর্ণের ব্যাপারে আগ্রহ হারাতে? সে কি চাই বর্ণকে ধীরে ধীরে জানতে?

ঘোরের মাঝেই বর্ণ ভাবছে,
এক বৃষ্টি ভেজা সকালে আদি তার ছাতা এগিয়ে দিয়ে বর্ণকে ধারালো বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। বর্ণ বিনিময়ে কিছুই দেয় নি। আদি কি তাহলে একটা ফুল আশা করেছিলো? যেই ফুল তাদের বন্ধুত্ব শুরুর সেতু হয়ে থাকবে!
হয়তো সেদিন আর ফুল দেওয়া হয় নি। তবে এখন আদি আর বর্ণ ভালো বন্ধু হতে পেরেছে। একই ভার্সিটির পথে তাদের রোজ দেখা হয়। এক নিরব লাইব্রেরী তাদের গল্পে ভাষা যোগ করে, আর একটি ক্যানভাস সেই গল্প ফুটিয়ে তুলে।
একজন লেখে, আরেকজন আঁকে,
তারা এখন ধীরে ধীরে আসছে মনের কাছে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here