অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-০৪,০৫

0
811

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-০৪,০৫
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৪:

||
ইদানীং স্পর্শের পাগলামোগুলো পিয়াসার চোখ এড়ায় না। পিয়াসা খেয়াল করেছে সে বারান্দায় গেলে সামনের বিল্ডিংয়ের একটা ছেলে বারান্দায় এসে বসে থাকে। আর তার চোখ দুটি একেবারে পিয়াসার দিকে নিবদ্ধ রাখে।

পিয়াসা রুমে ঢুকে জানালার পর্দা হালকা সরিয়ে দেখলো ছেলেটা কাউকে খুঁজছে। অস্থির ভাবে পায়চারী করছে। পিয়াসা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে স্পর্শ একদম শান্ত হয়ে গেলো। এখন স্পর্শের শান্ত মুখটা দেখলে মনে হবে না কিছুক্ষণ আগে কেমন অস্থিরতার মাঝে জড়িয়ে ছিলো সে।

পিয়াসা মনে মনে ভাবছে,
পিয়াসা: এই ছেলেটাকে কোথায় দেখেছি আমি? কোথাও তো দেখেছি। অনেক পরিচিত লাগছে। রাস্তায় দেখেছি?

পিয়াসা সেইদিন বৃষ্টিসিক্ত দুপুরে রেইনকোটের ভেতরে থাকা মানুষটি আর সামনে থাকা মানুষটিকে কোনোভাবেই মেলাতে পারছে না। পিয়াসা হয়তো সেই মুহূর্তটা ভুলে গেছে সহজেই। কিন্তু স্পর্শের কাছে সেই মুহূর্তটা ছিলো সবচেয়ে প্রিয় একটা মুহূর্ত।

স্পর্শ ঘরের ভেতরে ঢুকে তার বোন ঝিমকে কোলে নিয়ে বারান্দায় এলো। যদিও বোনদের আহ্লাদ সে একদমই করে না। কিন্তু পিয়াসার কাছ থেকে এটেনশন নেওয়ার ইচ্ছায় সে ঝিমের উপর আদর-সোহাগ উজাড় করে দিচ্ছে। পিয়াসা বারান্দায় বসে আছে একটি বই কোলে নিয়ে। যদিও বইয়ের পাতায় তার কোনো মনোযোগ নেই। সব মনোযোগ সামনের বারান্দায়।

ঝিম ভাইয়ের কোলে চড়ে এদিক ওদিক দেখছে উৎসুক দৃষ্টিতে। কথা বলতে পারে না এখনো। তবুও ‘এ্যা, ও’ শব্দ বের করে অনেক কিছুই বলার চেষ্টা করে।
স্পর্শ ঝিমের কানের কাছে ফিসফিস করছে। আর ঝিম ভাইয়ার কথাগুলো বুঝে ও ও করছে। পিয়াসা ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। স্পর্শও মনে মনে পিয়াসার এটেনশন নিতে পেরে খুশি।

বিকেলটা ছাদে ঘুরে ফিরে পার করে পিয়াসা। আজ সাথে তুবাও আছে। দুজন মিলে হাঁটছে আর গল্প করছে।
এদিকে স্পর্শ পিয়াসাকে বারান্দায় না দেখে মন খারাপ করে বসে আছে পিয়াসার বারান্দার দিকে তাকিয়ে। ছাদ থেকে বিষয়টা লক্ষ্য করলো পিয়াসা।

তুবাকে ডেকে বললো,
পিয়াসা: দেখ, ছেলেটা আমার বারান্দায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

তুবা: সত্যি?

পিয়াসা: হ্যাঁ। আমার প্রেমে পড়ে যায় নি তো?

তুবা: কি বলিস? মারাত্মক হবে পিয়ু।

পিয়াসা: আচ্ছা, ছেলেটাই যদি সেই চিঠির মালিক হয়!

তুবা: তুই খেয়াল করিস নি আগে?

পিয়াসা: চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছি একদমই মনে পড়ছে না।

তুবা: আচ্ছা, ছেলেটা তোকেই দেখছে। সিউর? আশেপাশে অন্য কোনো মেয়ে নেই তো?

পিয়াসা চোখ ছোট করে বললো,
পিয়াসা: কেন আমার প্রেমে কি কেউ পড়তে পারে না?

তুবা হেসে বললো,
তুবা: বাঁধা তো নেই। কিন্তু যদি মন অন্য স্থানে বেঁধে যায়, তখন আশেপাশের সবকিছুই মরীচিকা মনে হয়। তুই সামনের ঘরে ঘর বেঁধে ভুলভাল দেখছিস না তো? ডেলিউশনে থাকাটা মানসিক রোগ।

পিয়াসা তুবার হাতে একটা চিমটি কেটে বললো,
পিয়াসা: ডেলিউশন যখন আত্মিক প্রশান্তি দেয়, তখন সেই ডেলিউশন রোগ না, ঔষধ। বাবা-মা সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে৷ আর আমি বাসায় সারাদিন একা। সামনের প্রতিবেশী যদি আমাকে একটু বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে ক্ষতি কি?

তুবা: ক্ষতি তুমি এখন বুঝতে পারছো না বাবু। পরে বুঝবে। মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? মায়ার বাঁধন যদি ছিন্ন হয়ে যায়, বিচ্ছেদের ক্ষতটা অনেক ভারী হয়। এই আনন্দ যতোটা না ভালো রাখছে, সেই ক্ষতটা ততোটাই যন্ত্রণা দেবে।

পিয়াসা: ওকে ওকে। কুল ডিয়ার। তুই তো আমাকে পুরো প্রেম বিশেষজ্ঞ বানিয়ে ফেলছিস। আমি এসব প্রেম ভালোবাসার ধারেও যাবো না।

তুবা: কথাটা মাথায় রাখিস বোনু।

তুবার কথাগুলো ছিলো উলুবনে মুক্তো ছড়ানো। পিয়াসা সেই কথার কোনো মর্মই বুঝে নি। সে ভালোই আছে। স্পর্শের পাগলামো দেখে তার দিন শুরু, বিকেলটাও স্পর্শের আহ্লাদ দেখে কাটায়, রাত শেষ হয় স্পর্শের উঁকিঝুঁকি দেওয়া দেখে।

একদিন-

স্কুল থেকে বাসায় ফিরার পথে রকি আর তার চ্যালাপেলার দল পিয়াসাকে ঘিরে ধরে। তারপর রকি পিয়াসার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। পিয়াসা পা জোরে চালিয়ে আসতে গেলেই রকি শিষ বাজিয়ে লাফিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।

রকি: শুনো সুন্দরী, আমার তোমারে ভালোই পছন্দ হইছে। আমার লগে প্রেম করলে তুমি ফ্রিতে চলাফেরা করবা।

পিয়াসা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
পিয়াসা: কেন মিয়া, তুমি কি পুরো বাংলাদেশ কিনে ফেলছো?

রকি: আরেহ, সেইরকম ফ্রি না। এইটা স্পেশাল ফ্রি। বুঝছো নি! রকি’স অফার। নো টেনশন সুন্দরী। এই দেখছো বাইক। এইটাতে বসবা তুমি, আর আমি তোমারে পুরা শহরে ঘুরাইয়া আনবো।

পিয়াসা: দেখেন মিয়া, এসব সার্ভিস আমার লাগবে না। যত্তসব ছ্যাচড়া।

রকি শেষ কথাটা একদমই হজম করতে পারে নি। তার রাগে শরীর জ্বলছে। কিন্তু পিয়াসাকে কিছু বলার আগেই স্পর্শ রকির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। পিয়াসা পেছন ফিরে আর দেখে নি। সে সোজা বাসায় চলে আসে। তাই তার চোখে পড়ে নি স্পর্শ নামের একটি ছেলে তার জন্য নিজের আজ কতো বড় ক্ষতি করে ফেলছে।

স্পর্শ রকিকে আটকাতে গেলে রকি স্পর্শের কলার ধরে ঝাঁকুনি দেয়। স্পর্শও রাগ সামলাতে না পেরে রকির কলার ধরে তাকে শাসায়। এরই মধ্যে দু পক্ষে বাগবিতণ্ডা লেগে যায়, আর ফলাফল মারামারিতে রূপ নেয়।
কোথায় স্পর্শ একজন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছেলে আর কোথায় রকি তেইশ-চব্বিশ বছরের বিশাল দেহী মানব।

নাক ফাটিয়ে, মুখে কালো দাগ তুলে বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই মায়ের হাজারটা প্রশ্ন তীরের মতো ছুটে আসে স্পর্শের কাছে।

মাকে সম্পূর্ণ কথা বলে নি সে। একটা ভুলভাল বুঝিয়ে শান্ত করিয়েছে। কিন্তু বাবাকে কিভাবে মিথ্যে বুঝাবে? পুরুষ মানুষের এলাকার দশজনের সাথে পরিচয় থাকেই থাকে। সেই সূত্রে স্পর্শের বাবার কানে চলে আসে, তার একমাত্র ছেলে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে, এলাকার ছেলেদের সাথে মারপিট করেছে।
যদিও এইটা সত্য যে পিয়াসার জন্যই সে রকির উপর ক্ষেপেছিল। কিন্তু আজ ভালোবাসার মানুষটির জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে এমন উত্যক্তের শিকার হলে স্পর্শ কখনোই গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে যেতো না। তবুও সে বাবাকে বুঝায়, সেই ছেলেগুলো একটি মেয়েকে বিরক্ত করছিলো, আর সে মেয়েটিকে সেইভ করতে গিয়েই এই বিপদ হয়েছে।

বাবা ছেলের উপর তবুও অনেক রাগারাগি করেন। আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিকও হয়ে যান। বরং মনে মনে নিজের ছেলেকে সাহসী ভেবে খুশি হোন।

সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায় কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু স্বাভাবিক হয় নি রকি। পিয়াসার প্রত্যাখ্যান, আর স্পর্শের দেওয়া অপমান দুইটাই মনের মধ্যে পুষে ফেলে সে। সুযোগ বুঝে কখন কোথায় তান্ডব চালাবে সেই পরিকল্পনা করছে এখন।
ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন নিরব আর শান্ত মনে হয়। ঠিক তেমনি রকিকেও এখন কোথাও দেখা যায় না, রাস্তাটা ঝিমিয়ে পড়েছে রকির অবর্তমানে। এলাকায় দু একটা বখাটে না দাঁড়ালে রাস্তায় প্রাণ থাকে না। কারণ সভ্য ছেলেদের ঘরের বাইরে বসে চেঁচামেচি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার সময় নেই, এসব বখাটেদের দ্বারাই সম্ভব।

এরই মধ্যে নিরব ভাষায় চলছে স্পর্শ-পিয়াসার প্রেম। স্পর্শ যদিও এখন আর চিঠি দিতে পারে না পিয়াসাকে। কারণ সেই দিনের ঘটনার পর স্পর্শকে এলাকার অনেকে চিনে ফেলেছে। পিয়াসার বাসায় এসে চিঠি দেওয়া মানে পিয়াসা আর নিজের সমস্যা বাড়ানো। আর পিয়াসাও মনে মনে ধরে নেয় চিঠির মালিক স্পর্শ, অর্থাৎ সামনের বাসার ছেলেটি। যদিও সে নিশ্চিত হতে পারে নি এখনো।

এদিকে স্পর্শ পিয়াসাকে চুপচাপ দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারে না। ইশারা করার মতো সাহস তার এখনো হয় নি। যদি হাত নাড়িয়ে পিয়াসাকে কিছু বলতে যায়, তখন আশেপাশের দূরবীনগুলো কামানের গোলা হয়ে বাসার দিকে ছুটে আসবে।

আজ পিয়াসার স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রোগ্রামটা স্কুলের পাশের সেই মাঠে হচ্ছে৷ কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে স্পর্শ মাঠে প্যান্ডেল বাঁধতে দেখে একজনকে জিজ্ঞেস করলো,

স্পর্শ: কোনো অনুষ্ঠান হবে এখানে?

-হ্যাঁ, পাশের এই স্কুলটার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।

স্পর্শ কথাটি শুনে মনে মনে ভাবলো,
স্পর্শ: সুচিস্মিতার স্কুলের প্রোগ্রাম! তাও আবার পাবলিক প্লেইসে? এখন সুচিস্মিতাকে হয়তো আরো জানার সুযোগ পাবো।
||

ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে পাশে রাখলো বর্ণ। চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তুবার বলা কথাগুলো ভাবছে। বর্ণের মনে আদির জন্য ভিন্ন একটা অনুভূতি আছে। এই অনুভূতিটা সবকিছুর চেয়ে আলাদা। বর্ণের ধারণা আদির মনেও হয়তো কোনো ভালো লাগা থাকতে পারে। এইটা কি নিতান্তই ভ্রান্তি, নাকি আসলেই সত্য! যদি ভ্রম হয়, তখন পিয়াসার মনে কতোখানি ক্ষত সৃষ্টি হবে তা হয়তো জানা নেই, কিন্তু বর্ণ একেবারেই ছাই হয়ে যাবে।
কারণ যার জন্য কারো মনে জায়গা নেই, সেই মানুষটির মনে জায়গা পাওয়া মানে বিশাল বড় জায়গা নিয়ে ফেলা। আদিও সেই মনে বিশাল জায়গা নিয়ে ফেলেছে।
বর্ণও পিয়াসার মতো একাকী। পিয়াসার বাবা-মা হয়তো ব্যস্ততার ভীড়ে হারিয়ে গেছে। কিন্তু বর্ণ তার বাবা-মার কাছে বোঝা, কারণ তার সৌন্দর্যের ঘাটতি আছে। তার অপূর্ণতা তার শরীরের অতিরিক্ত মেদ। পিয়াসা হয়তো সময় কাটাতে চাই স্পর্শের মাঝে ডুবে। কিন্তু বর্ণ আদির মাঝে ডুব দিতে চাই শুধু ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষায়।

চলবে-

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৫: (নতুন মোড়)

||
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুলে মুছছে পিয়াসা। আজ গরম একটু বেশি, তাই ভোরে উঠেই মাথায় কয়েক মগ পানি ঢেলে দিলো। আর গরমের দিনে বেশিক্ষণ বেডে শুয়ে থাকাও যায় না।

এদিকে-

ফজরের নামাজ পড়ে স্পর্শ বারান্দায় বসে ছিলো। সূর্য উঠার আগ মুহূর্তটা স্পর্শের কাছে খুবই প্রিয়। প্রায় প্রতিদিন নামাজ পড়ে সূর্যোদয় দেখে আবার ঘুমোতে যায়। কিন্তু আজ সেই ভোরের সূর্যটা ম্লান লাগছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা তার সুচিস্মিতাকে দেখে। সদ্যস্নাত সুচিস্মিতা তার এলোমেলো চুলগুলোতে আঙ্গুল চালাচ্ছে। স্পর্শ আশেপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো, কেউ নেই। আর এতো ভোরে কেউ থাকার কথাও না। তাই মনে সাহস রেখে হাত উঠিয়ে ইশারা করলো।
পিয়াসার হঠাৎ চোখ পড়লো স্পর্শের দিকে। স্পর্শের ইশারা করা দেখে তার পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো। ভয়ে এদিক ওদিক তাকালো।

স্পর্শ ইশারায় বুঝালো,
স্পর্শ: আমি আসছি। একটু বারান্দায় দাঁড়াও। প্লিজ।

পিয়াসা ইশারা ভালোভাবে বুঝতে পারলো না। তবে অপেক্ষা করতে বলছে এইটুকু বুঝেছে।
এদিকে স্পর্শ ইশারা দিয়ে হুট করে হাওয়া হয়ে গেলো।

পিয়াসাও ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকলো। বাবা-মার ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে আসলো একবার। তারপর আবার লাফিয়ে লাফিয়ে বারান্দায় চলে এলো। আশেপাশে তাকিয়ে স্পর্শকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও নেই স্পর্শ।
হঠাৎ খেয়াল করলো বারান্দার নিচে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে দেখে হাঁ হয়ে গেলো পিয়াসা। ছেলেটার হাতে একটা গোলাপ। গোলাপটা শুকিয়ে গেছে অনেকটা।

স্পর্শ এদিকে সেদিক তাকিয়ে একটি খাতা তাক করে ধরলো উপরে।
পিয়াসা দেখলো খাতায় মোটা কালির দাগে লেখা আছে।

-আমার নাম স্পর্শ চৌধুরী। আমি তোমাকে চিঠি দিয়েছিলাম অনেকবার। কি নাম তোমার?

পিয়াসা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। গলা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে৷ লজ্জা আর ভীতি একসাথে মিলেমিশে তাকে ভিন্ন জগতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানে পিয়াসার সবকিছুই ভাসা ভাসা লাগছে। মনে হচ্ছে সে নিজেও কোথাও ভাসছে।

স্পর্শের হাসিটা মারাত্মক সুন্দর। এতো সুন্দর একটা ছেলে তাকে পছন্দ করে এইটা ভাবতেও ভালো লাগছে পিয়াসার। স্পর্শ খাতাটা নামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর মাথা উঠিয়ে পিয়াসাকে দেখছে। পিয়াসা চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেলো।
সে ঘরে এসে কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসলো। তারপর চুল আঁচড়ে নিলো। গায়ে একটা সুন্দর উড়না পেঁচালো। বারান্দায় আবার যাওয়ার আগে মনে হলো, কাজল পড়লে ভালো লাগবে। তাই তাড়াতাড়ি ড্রয়ার খুলে কাজল খুঁজে নিলো। তারপর ধীরে ধীরে কাজলটা চোখে পড়লো। এরপর ভাবলো ঠোঁটটা খুব শুকনো লাগছে। তাই হালকা গোলাপী রঙ মেখে নিলো।
বাবা-মার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে এসে একটি খাতা বের করে লিখলো,

-আমার নাম পিয়াসা আজিজ। আমি ক্লাস টেনে পড়ি।

লেখার পাশে একটা সুন্দর করে হাসির ইমোজি এঁকে দিলো। তারপর শেষবার আয়না দেখে বারান্দায় গিয়ে নিচে তাকালো। কিন্তু পিয়াসার হাসি মাখা মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো। কারণ স্পর্শ কোথাও নেই। সামনের বারান্দায়ও নেই। মুখ ভেংচি দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো পিয়াসা।

বিকেলের দিকে পিয়াসা প্যাকিং করা শুরু করে দেয়। তার ছোট চাচ্চুর বিয়ে সামনে। আর বিয়ের অনুষ্ঠান গ্রামের বাড়িতে হবে। পিয়াসা ও তার কাজিনরা আগেভাগে গ্রামে চলে যাচ্ছে। মোটামুটি তিন সপ্তাহ বাড়িতেই থাকবে পিয়াসা। সন্ধ্যায় গাড়িতে উঠবে।

বাসা থেকে বের হওয়ার আগে একবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। স্পর্শ জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। পিয়াসাকে দেখে সেও বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। পিয়াসা স্পর্শকে দেখে শক্ত করে বারান্দার রেলিংয়ে হাত রাখলো। স্পর্শ চুপচাপ তাকিয়ে আছে।

সকালে পিয়াসা আসছে না দেখে বাসায় চলে গিয়েছিলো সে। আর এদিকে রাস্তায় মানুষজনও বেড়ে যাচ্ছিলো। তাই পিয়াসার উত্তরের অপেক্ষায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি। তবে স্পর্শ জানতো না পিয়াসা আবার ফিরে আসবে তার জন্য। সে ভেবেছে পিয়াসা আর আসবে না। হয়তো লজ্জা পেয়ে ঘরে লুকিয়ে পড়েছে। কিন্তু স্পর্শের অজানা রয়ে গেলো যে তার জন্য খুব সুন্দর করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলো তার সুচিস্মিতা। একটা সুন্দর চিরকুট লিখেছিলো যেখানে ফুটে উঠেছিলো পিয়াসার পরোক্ষ সম্মতি। স্পর্শকে নিজের সাথে জড়ানোর সম্মতি।

স্পর্শকে দেখে সাহস করে হাত উঠিয়ে বিদায় জানালো পিয়াসা। স্পর্শ পিয়াসার ইশারা পেয়ে বুকে হাত রাখলো। পিয়াসা তো লজ্জায় আর দাঁড়াতেই পারছে না। ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ খুশিতে বিছানায় গড়াগড়ি দিলো সে।

পিয়াসার মা মেয়েকে দেখে বললেন,
পিয়াসার মা: কি করছিস? এখন গাড়ি আসবে। এভাবে বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছিস কেন? পাগল হয়ে গেলি?

পিয়াসা লজ্জা পেলো কিছুটা। তারপর নিজেকে সামলে বললো,
পিয়াসা: আরেহ না মা, আলসে ছাড়ছিলাম।

গাড়ি আসার পর পিয়াসা শেষবার জানালার পর্দা সরিয়ে স্পর্শকে দেখে নিলো। ছেলেটা এখনো তার বারান্দার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

পিয়াসা বিড়বিড় করে বললো,
পিয়াসা: মিস্টার স্পর্শ চৌধুরী, আমার অপেক্ষায় থেকো। আমি ছুটি থেকে ফিরে এসে তোমার সাথে ইচ্ছেমতো প্রেম করবো। ঠিক আছে?

পিয়াসা চলে গেলো। একদিন, দুইদিন, এভাবে কেটে গেলো অনেকদিন। একটি বারান্দায় বিরাজ করছে শূন্যতা, অপর একটি বারান্দায় বিরাজ করছে অপেক্ষারত একটি মানুষের মনের বিষন্নতা। সারাদিন স্পর্শ পিয়াসার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু পিয়াসার দেখা আর পায় না। কেমন যেন ছন্নছাড়া লাগছে নিজেকে। ইচ্ছে করছে পাখি হয়ে উড়ে সেই বারান্দায় বসতে৷ ইচ্ছে করছে পিয়াসাকে একটিবার দেখতে। কিন্তু আর হয় নি। শেষ দেখাটাও দেওয়া যায় নি।

শেষ বার প্রতিদিন বারান্দায় দাঁড়ানো সেই ছেলেটিকে দেখা গিয়েছিলো একটি শুকনো ফুল হাতে। সে একবার ফুলটির দিকে তাকায়, আরেকবার পিয়াসার বারান্দার দিকে। পিয়াসার বাগানে আরো গোলাপ ফুটেছে। আবার শুকিয়েও গেছে। অনেকদিন পানি দেওয়া হয় নি সেই গাছে। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে এখন ছুটে গিয়ে সেই ভালোবাসায় একটু প্রাণ দেবে৷ ছলছল করছে ছেলেটির চোখ দুটি।

শেষবার একটি কথায় বললো সে,
স্পর্শ: ভালোবেসে ফেলেছি সুচিস্মিতা। কাউকে না জেনেও যে ভালোবাসা যায়, তা আজ প্রথম বুঝলাম। তোমায় না জেনে এই মনে জায়গা দিয়েছি। জানলে হয়তো আসক্ত হয়ে যেতাম তোমাতে। তবুও তোমাকে কখনো ভুলবো না। তুমি আমার জীবনের একটি অপ্রিয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে, যেই মুহূর্তটা আমায় শুধু যন্ত্রণা দেবে। তোমায় ভালোবেসে কিছুই পাই নি আমি, শুধু এই শুকনো গোলাপটি আমার অপ্রিয় মুহূর্তের স্মৃতি হয়ে থাকবে। সুচিস্মিতা, আবার যদি হুট করে এই চোখে এসে ধরা দাও, তবে সত্যি আর হারিয়ে যেতে দেবো না। কারণ তোমাকে হারিয়ে ফেলাটা কেন যেন সহ্য করতে পারছি না আমি। জীবনটা তুমিহীনা আরো শূণ্য লাগছে। আমার আজ তোমাকে খুব প্রয়োজন। কিন্তু তুমি কোথাও নেই। শেষবার নয়, বার বার বলবো, ভালোবাসি সুচিস্মিতা তোমায়। অনেক বেশি।

কিছু মুহূর্ত জীবনে আসে। বেরঙিন জীবনটাকে রঙিন করে দেয়। সেই রঙের মাঝে মানুষ এতোটা ডুবে যায় যে তার নেশা কাটাতে অনেক সময় লাগে। ঠিক সেই সময়টা স্পর্শ আজো স্মৃতিতে গেঁথে রেখেছে। মাঝরাতে চোখ বন্ধ করে মনে মনে আঁকার চেষ্টা করে পিয়াসাকে। খুব ভয় হয় তার, যদি মুখটা মুছে যায় স্মৃতি থেকে? কিসের আশায় থাকবে তখন?

দুইটা বছর চলে গেলো। আজো সন্ধ্যার পর বারান্দায় বসলে স্পর্শের দেওয়া চারাটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পিয়াসা। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে সেই বারান্দায় স্পর্শকে খুঁজে পায় না আর। সেই বারান্দায় এখন নতুন মানুষের বিচরণ হয়।

দুই বছর আগে, চাচ্চুর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাসায় এসে স্পর্শকে আর খুঁজে পায় নি পিয়াসা। বারান্দাটি খালি পড়ে আছে। আশেপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নি কখনো। তবে একদিন বাবার মুখে শুনেছে, সেই বিল্ডিংয়ের একটি ভাড়াটিয়া লোককে খুন করা হয়েছে। তার লাশ পাওয়া গেছে রাস্তায়। মধ্য রাতেই এই খুন করা হয়। লোকটি জরুরী কাজ সেরে বাসায় ফিরছিলো তখনই কয়েকজন মুখোশধারী লোক তার গলায়, পেটে, পিঠে ছুরিকাঘাত করে। হাস্পাতালে নেওয়ার আগেই তিনি মারা যান।

পিয়াসার বুকটা ধক করে উঠেছিলো সেই কথা শুনে। স্পর্শ কোথায় গেছে? সেই ভাড়াটিয়ার সাথে স্পর্শের কোনো সম্পর্ক নেই তো?
||

বর্ণ আদির হাত ধরে বললো,
বর্ণ: তুমি অনেক নিষ্ঠুর আদি।

আদি: আমি আবার কি করলাম?

বর্ণ: ওদের এভাবে আলাদা করে দিয়েছো কেন?

আদি: আলাদা না হলে ভালোবাসা জমে না। দূরত্ব মাঝে মাঝে অনুভূতিটা গাঢ় করে তুলে।

বর্ণ: আর কে সেই লোকটা? স্পর্শের বাবা নয়তো? কে মেরেছে তাকে?

আদি: অপেক্ষায় থাকো। ধীরে ধীরে সব জানতে পারবে।

আদির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বর্ণ। কেমন ঘোলা ঘোলা লাগছে আদির চোখ দুটি। তবে কি আদিরও খারাপ লাগছে স্পর্শ-পিয়াসাকে আলাদা করে? লেখকদের মনেও কি তবে কাল্পনিক চরিত্রের প্রতি মায়া জন্মে যায়? কেন জমবে না! বর্ণ নিজেও তো আদির লেখা চরিত্র স্পর্শকে একটা জায়গা দিয়ে ফেলেছে মনে। আর স্পর্শের মাঝেই সে আদিকে খুঁজে পায়।

আদির মনোযোগ আকর্ষণ করে বললো,
বর্ণ: আমি যদি কখনো হারিয়ে যায়, তোমার কষ্ট হবে?

আদি বর্ণের কথা শুনে বললো,
আদি: বন্ধু হারিয়ে যায় না। প্রেমিকা হারিয়ে যায়। আমি তোমাকে ভালো বন্ধুর জায়গা দিয়েছি। এতো সহজে হারিয়ে যাবে না তুমি।

বর্ণ মনে মনে বললো,
বর্ণ: আমি তোমার দুটোই হতে চাই আদি। আমিও ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। শেষবার নয়, বারবার বলবো, ভালোবাসি লেখক সাহেব। অনেক বেশি। আমি তো জেনে তোমায় ভালোবেসেছি। তবে আমার ভালোবাসা কতোটা গভীর তুমি বুঝতে পারছো ন, লেখক সাহেব?

আদি বর্ণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

আদি: চলো। এখন প্রকৃতি বিলাস করার সময়। এই সকালটা বারবার আসবে না।

শূণ্য পিচ ঢালা রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে আদি আর বর্ণ। অচেনা এক শহরে এসেছে প্রকৃতি বিলাসের জন্য। ভালোই আছে তারা।

||
কিন্তু ভালো নেই স্পর্শ-পিয়াসা। স্পর্শ আজো শূণ্য রাস্তায় ছাতা হাতে নিয়ে হাঁটে বৃষ্টির দিনে। হয়তো তার সুচিস্মিতা কোনো এক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তাকে কাছে ডাকবে আর একটি গোলাপ ধরিয়ে ধন্যবাদ জানাবে।
পিয়াসা আজো হুটহাট বারান্দায় গিয়ে রাস্তার আশেপাশে স্পর্শ নামের ছেলেটিকে খুঁজে। সব সোশাল একাউন্টে স্পর্শ চৌধুরী নামটা লিখে স্পর্শকে খুঁজেছে সে। কিন্তু পায় নি সেই প্রিয় মুখটি খুঁজে। রাস্তায় চোখ বুলিয়ে যায় হাঁটতে হাঁটতে, হয়তো কোনো এক গলির মোড়ে দেখা যাবে তাকে। কিন্তু আর দেখা হয় না।তাদের।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here