অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-১২

0
619

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-১২
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ

||
স্পর্শের জন্মদিন উপলক্ষে তার বন্ধুরা পার্টি রেখেছে। যদিও স্পর্শের কোনো ইচ্ছে ছিলো না, তবুও বন্ধুদের আগ্রহ দেখে আর না করে নি। এমনিতেই তার একটুখানি বিনোদনেরও প্রয়োজন।

সন্ধ্যায় স্পর্শ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিলো। তখনই নিশান একটা চেয়ার টেনে স্পর্শের পাশে বসলো।

মূলত নিশান মনে মনে একটা বদ ফন্দি এঁটেছে। আর এটি স্পর্শকে না জানালে তো হয় না! কারণ এই ফন্দি স্পর্শের সাথেই সংযুক্ত, আর তা বাস্তবায়ন হলে স্পর্শ মানসিক আনন্দ পাবে। আর স্পর্শকে না জানালে এর বাস্তবায়নও সম্ভব না।

নিশান: বন্ধু, আমার মাথায় একটা জবরদস্ত প্ল্যান আছে।

স্পর্শ সিগারেট নিভিয়ে পা দুটি বারান্দার গ্রিলের উপর উঠিয়ে আয়েশ করে বসলো।

নিশান স্পর্শকে পুরো পরিকল্পনাটা খুলে বললো। স্পর্শের ঠোঁটে ফুটে উঠলো শয়তানি হাসি।

স্পর্শ নিশানের কাঁধে হাত রেখে বললো,
স্পর্শ: ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া।

নিশান: এখন সুচিস্মিতা কি রাজি হবে?

স্পর্শ: অবশ্যই। আমার বার্থডে পার্টি আর সে আসবে না?

স্পর্শ দেরী না করে পিয়াসাকে ফোন দিলো। দু’বার রিং হতেই পিয়াসা কল রিসিভ করলো।

স্পর্শ: সুচিস্মিতা! কেমন আছো?

পিয়াসা: জি? আমি আপনার কথা শুনতে পারছি না।

পেছন থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ আসছে।

স্পর্শ: তুমি কোথায় এখন? এখনো বাসায় যাও নি?

পিয়াসা: হ্যালো? হ্যালো……..

স্পর্শ কল কেটে পিয়াসাকে মেসেজ দিলো।

স্পর্শ: কোথায় তুমি?

পিয়াসা: আমি একটু বাইরে আছি।

স্পর্শ: কি করছো?

পিয়াসা: ফুচকা খেতে এসেছি।

মেসেজটি দেখে স্পর্শের মনে পড়ে গেলো সেই অপ্রিয় মুহূর্তের কথা। প্রথম যেদিন সুচিস্মিতাকে দেখেছিলো, সেদিনও সে ফুচকা খাচ্ছিলো ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে। আর স্পর্শ তার টকটকে লাল হয়ে থাকা চোখ আর কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের মায়ায় পড়েছিলো। তাই তো খুব ভালোবাসা দিয়েই নাম রেখেছিলো সুচিস্মিতা। কিন্তু আজ সেই সুচিস্মিতা তার কাছে শুধুই ছলনাময়ী।

শাকিলের বাইকটা ধার নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো স্পর্শ। সন্ধ্যার পর গলির মোড়ে মানুষজন একদম কম থাকে। এই সুযোগে সে পিয়াসাকে উত্যক্ত করে ভালোই মজা পায়।
আজও হেলমেট পড়ে গলির মোড়ে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পিয়াসার অপেক্ষায়। রাত আটটার দিকে পিয়াসা বাসায় ফিরছিলো। তাকে দেখেই স্পর্শ বাইক স্টার্ট দিয়ে তার সামনে বাইকটা থামালো।

হেলমেটের পেছনে থাকা স্পর্শ পিয়াসার কাছে একটা বখাটে ছেলে। তাই পিয়াসা ভয় পেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। স্পর্শ পিয়াসার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো।

কাঁপা কন্ঠে বললো,
পিয়াসা: ক….কে আপনি, হ্যাঁ? প্রতিদিন এভাবে বিরক্ত করার মানে টা কি? দেখুন, আমি কিন্তু…….

স্পর্শ পিয়াসার ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে ধরলো। তারপর পিয়াসার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে একটা বাজে প্রস্তাব দিলো।

একটা বখাটের ছেলের মুখে এমন প্রস্তাব শুনে পিয়াসার পুরো শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো। ছেলেটির কাছ থেকে কোনো ভাবেই নিজেকে ছাড়াতে পারছিলো না পিয়াসা।

স্পর্শ কড়া ভাষায় বললো,
স্পর্শ: কি রাজী তো? আজ রাত শুধু…

পিয়াসা স্পর্শের কথা আর সহ্য করতে না পেরে, ব্যাগ থেকে একটা সার্জিকাল ব্লেড বের করে, সোজা স্পর্শের হাতে ঢুকিয়ে দিলো। স্পর্শ সাথে সাথেই পিয়াসাকে ছেড়ে দেয়, আর তখনই পিয়াসা স্পর্শকে ধাক্কা মেরে বাইক থেকে ফেলে দেয়। স্পর্শ মাটিতে পড়ে গেলে, পিয়াসা বাইকটাও ধাক্কা দিয়ে তাকে বাইকের নিচে চাপা দিতে চায়। স্পর্শ বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু পিয়াসার শরীরে বাইকটা ফেলে দেওয়ার মতো শক্তি ছিলো না, তাই সে স্পর্শ উঠার আগেই সেখান থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে আসে।

দূর থেকে স্পর্শের অবস্থা দেখে আকাশ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো। পিয়াসা চলে যাওয়ার পর আকাশ স্পর্শের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,

আকাশ: সুচিস্মিতা দেখি একেবারে ধরাশায়ী করে দিয়েছে!

স্পর্শ চেঁচিয়ে বললো,
স্পর্শ: আমাকে উঠা। এসব কথা পরে বলিস।

আকাশ হালকা হেসে বললো,
আকাশ: এখনো বলবি সে চরিত্রহীন? এতোই খারাপ হলে তোর বাজে প্রস্তাবে রাজি না হয়ে তোকে এখানে ফেলে দিয়েছে কেন?

স্পর্শ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
স্পর্শ: আমার হাত থেকে রক্ত ঝরছে, আর তুই ওই জঘন্য মেয়েটার উকালতি করছিস?

আকাশ স্পর্শকে ধরে বাসায় নিয়ে এলো। নিশান আর তকির স্পর্শের অবস্থা দেখে পিয়াসাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে লাগলো। স্পর্শও তা চুপচাপ শুনছিলো। কিন্তু এসব বাজে কথাগুলো হাবীব আর আকাশ সহ্য করতে পারছিলো না।
হঠাৎ হাবীব স্পর্শের গালে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিলো। চড় মারার শব্দে পুরো ঘর মুহূর্তেই শান্ত হয়ে গেলো।

স্পর্শ হাবীবের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

হাবীব: এভাবে আমার দিকে না তাকিয়ে আয়নায় একবার নিজের চেহারাটা দেখ। কি বলেছিলি তুই? মেয়েটাকে ভালোবাসিস? অসম্ভব। নিজেকে একবার প্রশ্ন কর। বিন্দুমাত্র ভালোবাসা বেঁচে থাকলে তুই এতো বড়ো জঘন্য প্রস্তাব দিতে পারতি না ওই মেয়েটাকে। আসলে তুই কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখিস না।

নিশান আর তকিরের দিকে আঙ্গুল তাক করে হাবীব বললো,
হাবীব: এই দুইটা ছেলে একটা মেয়ের নামে যা তা বলে যাচ্ছে, আর তুই চুপচাপ শুনছিস? তোর ভালোবাসাটা কখনোই সত্য ছিলো না। যা ছিলো সব ভণ্ডামি।

এদিকে পিয়াসা বাসায় এসে রুমের দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলো। হুট করেই তার জীবনটা এলেমেলো হয়ে গেছে। রকির যন্ত্রণায় পুরোনো এলাকা ছেড়ে নতুন এলাকায় এসেছে। কিন্তু এখানেও আরেকটা বখাটে। এসব বখাটেদের জন্য একটু শান্তিতে রাস্তায় হাঁটতেও পারে না সে।
এখন তো বাবা-মা দুজনই ব্যস্ত থাকে। কাকে বলবে তার এই অশান্তির কথা? এমনিতেই রকি পিয়াসা সম্পর্কে যা আজে বাজে কথা রটিয়েছে তাতে বাবা-মা দুজনই সবার সামনে পিয়াসার পক্ষ নিলেও, চার দেয়ালের আড়ালে অনেক কথা শুনিয়েছে তাকে। এমনকি প্রথম মা তার গায়ে হাত তুলেছিলো। পিয়াসার উড়ুউড়ু ভাব নাকি এর জন্য দায়ী। এলাকায় এতো মেয়ে থাকতে কেনই বা রকি পিয়াসার নামেই এতো কথা ছড়ালো? পিয়াসার কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিলো না সেদিন। এখনো নেই। কিন্তু এর পেছনে যে একটা বড়ো কিন্তু আছে তা পিয়াসা আঁচ করতে পেরেছে।

এদিকে স্পর্শ রাতে পিয়াসাকে একটা মেসেজ দিয়ে ঘুমিয়ে গেলো। পিয়াসা স্পর্শের মেসেজ দেখে মনে মনে অনেক খুশি হলো, কিন্তু মেসেজটা পড়ে তার বুকটা ধক করে উঠলো।

তাড়াতাড়ি স্পর্শকে কল ব্যাক করলো। কিন্তু স্পর্শ আর ফোন ধরলো না। সারা রাত থেমে থেমে স্পর্শকে কল করেছে পিয়াসা। ছটফট করতে করতেই রাতটা পার করেছে সে।

সকালে-
বালিশ থেকে মাথা তুলে আড়মোড়া ভেঙে ফোন হাতে নিলো স্পর্শ। ফোনের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে। বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা নাস্তার টেবিলে বসে পড়লো।

তকির স্পর্শের মুখে প্রফুল্ল ভাব দেখে জিজ্ঞেস করলো,

তকির: সুচিস্মিতা কি তোর হাত ফুঁটো করার পাশাপাশি মাথাটাও ফুঁটো করে দিয়েছে?

স্পর্শ উত্তরে মুচকি হাসলো। স্পর্শের মুখে হাসি দেখে বাকীরাও স্পর্শের দিকে মনোযোগ দিলো। সবার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে আগ্রহ। গতকাল প্রেমিকার আঘাতে হাত থেকে রক্ত ঝরিয়ে এখন কেন হাসছে এই প্রেমিক? তা জানার জন্যই সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পর্শের দিকে।

স্পর্শ: সবাই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

নিশান: তোকে দেখে অবাক না হয়ে পারছি না! রাতারাতি কি এমন হলো যে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেছে? হাতের ব্যথা কি কমে গেছে?

স্পর্শ: আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি তোদের, কোন ব্যথা বেশি যন্ত্রণাদায়ক? শারীরিক নাকি মানসিক?

তকির ভ্রু কুঁচকে বললো,
তকির: বাকীদেরটা জানি না, তবে আমার শরীরে একটু আঘাত লাগলে, আমি জ্ঞান হারাবো, মরে যাবো, বাঁচাতে পারবে না কেউ।

স্পর্শ: বুঝে নিলাম তুই এখনো মানসিক আঘাত পাস নি। পেলে শারীরিক আঘাতটা তোর এতো বেশি যন্ত্রণাদায়ক মনে হতো না।

নিশান: ভাই, তুই হঠাৎ মানসিক আঘাতের কথা বলছিস কেন?

স্পর্শ: সুচিস্মিতা আমায় যে আঘাত দিয়েছে তার চেয়ে বেশি আঘাত আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। গতরাতে ব্যথায় আমি হাতটাও নাড়াতে পারি নি। আর তাকে কিভাবে আমি আয়েশ করে রাতটা পার করতে দেবো?

সিয়াম: আবার কি করেছিস?

স্পর্শ বাঁকা হেসে বললো,
স্পর্শ: গতরাতের ঘটনায় একটু মসলা লাগিয়েছি, ব্যস এইটুকুই। সো ফ্রেন্ডস, সবাইকে জানানো উচিত, আমি সুচিস্মিতার সাথে যোগাযোগটা সাময়িকের জন্য বিচ্ছিন্ন করছি। তবে আমার বার্থডে স্পেশালের আগেই সব ঠিক করে নেবো।

শাকিল: হঠাৎ সাময়িকের জন্য বিচ্ছিন্ন করার কারণ?

স্পর্শ ইশারায় হাতটা দেখিয়ে বললো,
স্পর্শ: যতোদিন এই ক্ষত শুকাবে না, ততোদিন সুচিস্মিতা আমার জন্য ছটফট করবে।

স্পর্শ মনে মনে বললো,
স্পর্শ: এখন তুমি আমাকে এক সেকেন্ডের জন্যও ভুলে থাকতে পারবে না সুচিস্মিতা।

||

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here