অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-১৫,১৬

0
560

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-১৫,১৬
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৫:

||
স্পর্শ অনেকক্ষণ ধরেই পিয়াসার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু পিয়াসার চোখ আটকে আছে তার নষ্ট হয়ে যাওয়া আইসক্রিমটার দিকে। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আইসক্রিমটা দেখছে আর তার প্রিয় চকোলেটের আস্তরণটা স্পর্শের শার্টে লেগে গেছে তাই আফসোস করছে।

স্পর্শ বিরক্ত হয়ে গেলো পিয়াসার হাবভাব দেখে। রাগী কন্ঠে বললো,
স্পর্শ: তুমি কি এখনো বাচ্চা? বাচ্চারা মুখ ফুলিয়ে রাখে আইসক্রিমের জন্য। কিন্তু তুমি কেন মুখ ফুলিয়ে রেখেছো? আশ্চর্য!

পিয়াসা: আপনি আমার অনুভূতি বুঝবেন না। আমার বোন আমার জন্য তার জমানো টাকা খরচ করে এই আইসক্রিম কিনেছে, শুধুমাত্র আমার মন ভালো করার জন্য। আর আপনার কাছে এসব বাচ্চামো? আর হ্যাঁ, মানলাম আমি বাচ্চামো করছি। এতে আপনার সমস্যা কি?

স্পর্শ আরো ক্ষেপে গেলো। তবুও রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
স্পর্শ: আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। ওই ছেলেটাই কি তোমার সেই নতুন প্রেমিক?

পিয়াসা: মানে?

স্পর্শ: কিছুক্ষণ আগে একটা ছেলে তোমার পাশে বসলো, তার কথা বলছি।

পিয়াসা: তো?

স্পর্শ: তো! এখানে তো বলার কি আছে? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

পিয়াসা: আপনি কি কখনো বাসে চড়েছেন?

স্পর্শ: এইটা আবার কেমন প্রশ্ন?

পিয়াসা: আগে উত্তর দিন।

স্পর্শ হাত মুঠো করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
স্পর্শ: হ্যাঁ, চড়েছি। এখন?

পিয়াসা: আপনার পাশে কখনো কি মেয়ে বসে নি? বা কখনো একটা মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে যান নি?

স্পর্শ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিয়াসার দিকে তাকিয়ে রইলো।

পিয়াসা: আচ্ছা, তখন মেয়েটা কি আপনার প্রেমিকা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যায়? এখন আমার পাশে কেউ বসলেই যদি সে আমার প্রেমিক হয়, তবে তো মানতেই হয় আমার শত শত প্রেমিক আছে। এখন এতোগুলো প্রেমিক আমি কোথায় রাখি, ভাবার বিষয় না?

স্পর্শ: শাট আপ। এসব পেঁচালো কথাবার্তা বলে তুমি সত্যটা লুকাতে পারবে না। আমি নিজ চোখে দেখেছি তোমাকে সেই হেলমেট পড়া ছেলেটার সাথে।

পিয়াসা: আপনি কিভাবে বুঝলেন হেলমেট পড়া বাইকারটি একজন ছেলে? পুরুষও হতে পারে। বুড়োও হতে পারে। কোনো আংকেলও হতে পারে।

স্পর্শ পিয়াসার কথায় ঘাবড়ে গেলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো তার কথায় পিয়াসা সন্দেহ করে ফেলে নি তো!
যদিও সেই বাইকারটি স্পর্শ হতে পারে তা পিয়াসার ভাবনারও বাইরে। তবুও কথায় আছে না চোরের মন পুলিশ পুলিশ। তাই অনর্থকই স্পর্শের মনে আতংক ভীড় করছে।

পিয়াসা: কি হলো! চুপ করে আছেন যে!

স্পর্শ: কিছু না।

পিয়াসা: আপনি কি একটাবার আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দিয়েছেন? সেই বাইকারটাকে আমি চিনি না। বাইকারটা মাঝে মাঝে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাকে বিরক্ত করে। আর আপনি ভাবলেন আমি অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক রেখেছি? ওয়েট আমি আপনার দেওয়া মেসেজটা পড়ে শুনাচ্ছি।

পিয়াসা ফোন বের করে স্পর্শের দেওয়া শেষ মেসেজটি তাকে পড়ে শুনালো।

স্পর্শ লিখেছে,
তোমাকে বিশ্বাস করে আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি মনে হচ্ছে। তুমি আমার আড়ালে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখছো? আজ নিজ চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস হতো না। তোমার মতো মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব না।

পিয়াসা মেসেজটি পড়ে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বললো,
পিয়াসা: আমার মতো মেয়ে বলতে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন আপনি?

স্পর্শ: সরি, সুচিস্মিতা। আমি বুঝতে পারি নি।

পিয়াসা: এখন সরি বললে কি সব সমস্যার সমাধান হবে? আপনার বলা কথাগুলো কি ফিরিয়ে নিতে পারবেন?

স্পর্শ: আচ্ছা কি করবো আমি আমার সুচিস্মিতার রাগ ভাঙানোর জন্য?

পিয়াসা মুখ ফিরিয়ে নিলো। স্পর্শ আবার মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
স্পর্শ: আমার দিকে তাকাও সুচিস্মিতা।

পিয়াসা: আপনি চলে যান এখন। আমি আমার বোনের সাথে ঘুরতে এসেছি।

স্পর্শ: তো! আমি আমার সুচিস্মিতার সাথে ঘুরতে চাই। এই সুচিস্মিতা, চলো না আমার সাথে। একটু হাঁটবো হাত ধরে। একটু গল্প করবো মন ভরে।

পিয়াসা: হয়েছে। চুপ করেন। অন্যকিছু বলেন।

স্পর্শ: অন্যকিছু কি বলবো?

পিয়াসা মনে মনে বললো,
পিয়াসা: এতো সুন্দর করে শাড়ি পড়েছি, তার কি চোখে পড়ছে না? একটু প্রশংসা করাও কি নিষেধ?

স্পর্শ মুচকি হেসে বললো,
স্পর্শ: আইসক্রিম খাবে?

পিয়াসা আড়চোখে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। স্পর্শ আরেকটা আইসক্রিম পিয়াসার জন্য নিয়ে এলো। ততোক্ষণে তুবাও চলে এসেছে। পিয়াসার পাশে স্পর্শকে দেখে তুবা অবাক হয়ে গেলো।

পিয়াসার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
তুবা: কে উনি?

পিয়াসা: স্পর্শ।

তুবা স্পর্শের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবছে,
তুবা: এই ছেলেটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে! কোথাও তো দেখেছি। হয়তো পিয়ুদের আগের এলাকায় দেখেছি। না, না, মনে হচ্ছে রিসেন্টলি দেখেছি। কিন্তু কোথায়?

স্পর্শ তুবার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। কিন্তু মুখে হাসিখুশি ভাব রেখে বললো,
স্পর্শ: এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে?

পিয়াসা তুবার হাত ধরে বললো,
পিয়াসা: চল, ফুচকা খাওয়া যাক।

স্পর্শ: তোমরা তাহলে ঘুরো। আমি যাই।

তুবা: আপনিও আমাদের সাথে চলেন।

স্পর্শ: আমি কি করবো? সুচিস্মিতা বললো, আজ দিনটা শুধু তার বোনের জন্য। আমি শুধু শুধু তোমাদের কেন বিরক্ত করবো?

তুবা পিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো,
তুবা: সত্যি, তুই এই কথা বলেছিস ভাইয়াকে?

তুবা কিছুক্ষণ হাসলো। স্পর্শ তুবার হাসির কারণটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে তাকালো পিয়াসার দিকে।

পিয়াসা তুবাকে চিমটি কেটে বললো,
পিয়াসা: এভাবে হাসছিস কেন?

তুবা হাসি থামিয়ে বললো,
তুবা: ভাইয়া, এই মেয়েটা কয়েকদিন ধরে আপনার কারণেই মন খারাপ করে বসে আছে। আপনাদের ঝগড়া হয়েছিলো তাই না?

স্পর্শ আমতা আমতা করে বললো,
স্পর্শ: তে..তেমন কিছু না।

তুবা: তেমন কিছু না বললে তো হবে না। অনেক কিছুই আছে। আমার বোন আপনার কারণে সারাদিন মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। এইটা তো আমি মানতে পারি না। তাই ওর মন ভালো করার জন্য এখানে নিয়ে এলাম।

স্পর্শ পিয়াসার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তুবা পিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো,
তুবা: চল, আইসক্রিম খাওয়া শেষ। এখন ফুচকা খাওয়া যাক।

এরপর স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বললো,
তুবা: আপনি অপেক্ষায় থাকেন। আমি পিয়াসাকে ছেড়ে দেবো কিছুক্ষণ পর।

পিয়াসা: তুই কোথায় যাবি?

তুবা: একটা কাজ আছে। ভাইয়া যেহেতু আছে তুই উনার সাথে সময় কাটা কিছুক্ষণ।

পিয়াসা আর তুবা রাস্তার ওপাড়ে যাওয়ার জন্য দাঁড়ালো। কারণ ওপাড়েই ফুচকার ভ্যান। এদিকে হুট করে তুবার ফোনে কল আসায় সে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর পিয়াসাও খেয়াল না করে রাস্তার মধ্যে চলে আসার পর দেখলো তুবা ওর পাশে নেই। তুবাকে না দেখে পিয়াসা অনেক নার্ভাস হয়ে গেলো। কারণ পিয়াসা ব্যস্ত রাস্তা পার করতে পারে না। আর এটিকে সাধারণত অ্যাগ্রোফোবিয়া বলে থাকে।

পিয়াসা আশেপাশে গাড়ির হর্ণ আর গাড়ির ছুটে আসা দেখে পাথর হয়ে যায়। সে চাইলে তাড়াতাড়ি রাস্তাটা পার করতে পারতো, কিন্তু সামনে যাবে নাকি পেছনে যাবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই একটা গাড়ি একদম তার দিকেই ছুটে আসছিলো।

স্পর্শ পিয়াসাকে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি ছুটে আসলো। কিন্তু স্পর্শ পিয়াসার কাছে আসার আগেই গাড়িটি পিয়াসার একদম সামনে এসে ব্রেক করলো। গাড়ির ড্রাইভার প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে পিয়াসার দিকে তাকালো। আশেপাশে মোটামুটি সবাই পিয়াসার বোকামির জন্য তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছিলো। কিন্তু স্পর্শ এক মিনিটও অপেক্ষা না করে পিয়াসার হাত ধরে তাকে রাস্তা পার করিয়ে দিলো।

স্পর্শ চেঁচিয়ে বললো,
স্পর্শ: তুমি কি পাগল? রাস্তার মাঝখানে এসে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে?

পিয়াসা আমতা আমতা করে বললো,
পিয়াসা: আ..আমি রাস্তা পার… হতে প..পারি না।

স্পর্শ: সেটা তো জানি। তাই বলে এইভাবে একদম রাস্তার মাঝখানে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে?

পিয়াসা স্পর্শের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
পিয়াসা: আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। তুবা কোথায়?

এদিক-সেদিক তুবাকে খুঁজতে লাগলো পিয়াসা। স্পর্শ খেয়াল করলো এখনো রাস্তার ওপাড়ে দাঁড়িয়ে তুবা ফোনে কথা বলছে।

স্পর্শ তুবাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো,
স্পর্শ: ওই দেখো, তোমার আদরের বোনু।

পিয়াসা মন খারাপ করে তুবার দিকে তাকিয়ে ছিলো।

স্পর্শ পিয়াসার মন শান্ত করার জন্য, তার হাত চেপে ধরে বললো,
স্পর্শ: ভালোবাসি সুচিস্মিতাকে।

পিয়াসা স্পর্শের মুখের দিকে তাকালো।

স্পর্শ: আজ কি সুচিস্মিতা স্পর্শের হাত ধরে ফুচকা খাবে?

পিয়াসা মুচকি হেসে মাথা নাড়লো।

পিয়াসা: স্পর্শ কি সবসময় তার সুচিস্মিতার হাত ধরে থাকবে?

স্পর্শ: হুম।

পিয়াসা হাসলো, আর ফুচকা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কিন্তু স্পর্শ মনে মনে বললো,
স্পর্শ: এই হাত ততোদিন আমার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ থাকবে, যতোদিন আমার প্রতিশোধ সম্পূর্ণ হবে না। আর মাত্র অল্প কয়েক মাস। তারপরই আমার প্রতিশোধের বিষ ধীরে ধীরে তোমার মাঝে প্রবাহিত হতে থাকবে। আর তুমি সেই যন্ত্রণায় রাত-দিন ছটফট করবে।
||

চলবে–

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৬:

||
জন্মদিনের দুই সপ্তাহ পর স্পর্শের বন্ধুরা স্পর্শের জন্য পার্টি রেখেছে। যদিও এটি শুধুই তাদের ছাত্রজীবনের নীরসতা কাটানোর মোক্ষম বিনোদন মাধ্যম। পাশাপাশি স্পর্শের পারিবারিক সমস্যার কারণে তাকে কিছুটা ভালো সময় দেওয়ার জন্যই এই আয়োজন। সেই উপলক্ষে আজ বিশেষভাবে পিয়াসাকে অনবগত নিমন্ত্রণ করেছে স্পর্শের বন্ধুরা। এই নিমন্ত্রণকে অনবগত নিমন্ত্রণ বলার কারণ পিয়াসাকে এখনো কিছুই জানায় নি স্পর্শ। তার বিশেষ একটা কারণও আছে।
পিয়াসা শুধু এইটুকুই জানে, আজ কলেজ ছুটির পর স্পর্শের সাথে দেখা করবে সে। আসলে স্পর্শ ও তার বন্ধুদের প্রধান উদ্দেশ্য পিয়াসাকে হেনস্থা করা। তাই পিয়াসাকে আগেভাগে কিছুই জানায় নি। আর আজকের এই দিনটির জন্য স্পর্শ এতোদিন অপেক্ষায় ছিলো।

পিয়াসা যদিও সেজেগুজে বাইরে বের হতে পছন্দ করে, কিন্তু আজ স্পর্শের অনুরোধে সে সাধারণ পোশাকেই বাসা থেকে বের হয়েছে। হালকা আকাশী-নীল রংয়ের একটা জামা পড়েছে। চুলগুলো খোঁপা করে রেখেছে। পাঁচটা ক্লাসের চাপ পিয়াসার মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। পিয়াসাকে অনেকটা ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে।
কলেজ শেষে স্পর্শের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো পিয়াসা। হঠাৎ একটা গাড়ি থেকে স্পর্শকে নামতে দেখে অনেক অবাক হলো সে।
অফ হোয়াট ব্লেজার পড়েছে স্পর্শ, ভেতরে হোয়াট শার্ট, আর হোয়াইট প্যান্ট। আজ প্রথম স্পর্শকে ফরমাল পোশাকে দেখছে পিয়াসা। তাই রীতিমতো সে স্পর্শকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
স্পর্শ পিয়াসার সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর পিয়াসার মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বললো,

স্পর্শ: কোথায় হারিয়ে গেলে সুচিস্মিতা?

পিয়াসা: আপনি হঠাৎ এভাবে?

স্পর্শ: কেন ভালো লাগছে না?

পিয়াসা মনে মনে বললো,
পিয়াসা: ভালো! অসম্ভব ভালো লাগছে তোমাকে। আমার এলেমেলো স্পর্শ চৌধুরী এতোটা স্মার্ট তা আমার জানাই ছিলো না।

স্পর্শ: কি ভাবছো?

পিয়াসা: না তো, কিছু ভাবছি না। আপনাকে ভালো লাগছে। কিন্তু আপনি এভাবে সেজেগুজে আমার কলেজের সামনে কেন এসেছেন?

স্পর্শ: সেজেগুজে!

স্পর্শ পিয়াসার কথা শুনে শব্দ করে হাসলো।

পিয়াসা ভ্রু কুঁচকে বললো,
পিয়াসা: আজ কি কোনো স্পেশাল প্রোগ্রাম আছে?

স্পর্শ: হ্যাঁ, আছে।

পিয়াসা: তাহলে আমার সাথে কেন দেখা করতে চেয়েছেন? কমপ্লিমেন্ট নেওয়ার জন্য?

স্পর্শ বাঁকা হেসে মনে মনে বললো,
স্পর্শ: তোমাকে ক্রিটিসাইজ করার জন্য, আমাকে একটু কমপ্লিমেন্ট তো আজ নিতেই হবে সুচিস্মিতা।

পিয়াসা: কি হলো! কি ভাবছেন?

স্পর্শ: আজ তুমি আমার সাথে যাবে। তাই নিতে এসেছি তোমাকে। আজ আমার বন্ধুরা একটা পার্টির আয়োজন করেছে।

পিয়াসা: আর আমি এইভাবে আপনার সাথে যাবো?

স্পর্শ: সরি, সুচিস্মিতা। হুট করেই সব হয়ে গেছে। দেখো আমি নিজেও এতো কিছু জানতাম না। আমি তো ভেবেছি আজ তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরবো। কিন্তু হঠাৎ সবাই সারপ্রাইজ দিয়ে দিলো। আর এখন আমি তোমাকে নিতে এসেছি। তোমাকে ছাড়া আমার স্পেশাল দিন কি স্পেশাল হবে?

পিয়াসা: কিন্তু আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে। পার্টিতে যাওয়ার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত না।

স্পর্শ: সময় একদম কম। প্লিজ চলো।

পিয়াসাকে জোর করে গাড়িতে উঠালো স্পর্শ। পিয়াসা গাড়ির সিটে মাথাটা ফেলে দিলো।

পিয়াসা: এই গাড়িটা কার?

স্পর্শ: আমার।

পিয়াসা: আপনার গাড়িও আছে?

স্পর্শ: কেন থাকতে পারে না?

পিয়াসা: ও, থাকতেও পারে!

পিয়াসার কেমন যেন উদ্ভট লাগছে সবকিছু। আজ হঠাৎ স্পর্শ এতোটা ফরমাল হয়ে তার সামনে এলো, আবার এমন একটা ভাব নিয়েছে যেন সে এক রাতেই বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে গেছে। পিয়াসার কাছে স্পর্শের হাবভাব মারাত্মক বিরক্ত লাগছে। কারণ সে এলেমেলো স্পর্শের সাথেই ঘুরতে পছন্দ করে, আর তার সাথে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাই ফর্মাল স্পর্শটাকে হজম করতে পারছে না সে, যদিও তাকে দেখতে স্মার্ট লাগছে।

কল্পনায় স্পর্শকে সে টাক পড়া, বয়স্ক হিসেবেই দেখছে। কারণ অতিরিক্ত টাকা রোজগার করতে করতে বেশিরভাগ পুরুষ তার চুল হারিয়ে ফেলে, আর বার্ধক্যে পৌঁছে যায়।

চোখ খুলেই বিস্ফোরিত চোখে স্পর্শের দিকে তাকালো পিয়াসা। তার পাশে বসে থাকা স্মার্ট স্পর্শকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে৷

মনে মনে বললো,
পিয়াসা: না, আমি এমন বড়লোক বয়ফ্রেন্ড চাই না। আমার বয়ফ্রেন্ড আমার মতোই হবে। এতো ক্লাসি হলে আমার এডজাস্ট করতে সমস্যা হবে। আমি এতো ফর্মালি চলাফেরা করতে পারবো না।

স্পর্শ পিয়াসাকে বিড়বিড় করতে দেখে বললো,
স্পর্শ: ব্যাপার কি?

পিয়াসা: আচ্ছা, সত্যিই এই গাড়িটা আপনার? একরাতে আপনি হঠাৎ গাড়ির মালিক হয়ে গেলেন কিভাবে?

স্পর্শ হেসে বললো,
স্পর্শ: আরেহ বাবা, এইটা আমার মামার গাড়ি। রেস্টুরেন্টটা শহর থেকে বড্ড দূরে আছে, তাই গাড়িটা নিলাম একদিনের জন্য।

পিয়াসা: কতোদূর?

স্পর্শ: মোটামুটি অনেক দূর। দুইঘন্টা লাগবে।

পিয়াসা: আমি বাসায় কবে ফিরবো?

স্পর্শ: ডোন্ট ওয়ারি। আমি আছি না?

পিয়াসা বাকী রাস্তা নিরবে পার করলো। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে তার। এর কারণ পিয়াসা এখনো পুরোপুরি স্পর্শের কাছাকাছি আসতে পারি নি। তাই স্পর্শের সামনে অল্প একটু জড়তা কাজ করছে। আর পিয়াসা ছেলেদের সাথে অনেক কম মেলামেশা করে, তাই হুট করে স্পর্শের বন্ধুদের সামনে কি করবে, কি বলবে, এসবই ভাবছে। তুবা সাথে থাকলে এতোটা ভীতি কাজ করতো না মনে।

পিয়াসার পরিবার উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজের। কিন্তু বিলাসিতার সাথে পিয়াসার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বিলাসবহুল জীবনটা তার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। নিজের চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের কারো চলাফেরা দেখলে পিয়াসার কাছে তা লোকদেখানো মনে হয়। এমনকি বড়লোক বাবার ছেলে-মেয়েদের হাবভাব তার মোটেও পছন্দ না। সে ভাবে যাদের চাহিদা বেশি তারাই বড়লোক ছেলেদের সাথে সম্পর্ক রাখে। যদিও এটি পিয়াসার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ সে এমন একজনকে চায়, যে তার সাথে রাস্তার ফুটপাতে হাত ধরে হাঁটবে। রেস্টুরেন্টের পরিবর্তে তাদের জায়গা হবে অরণ্য বা খোলা আকাশের নিচে। গাড়ির পরিবর্তে তার প্রিয় মানুষটি তার হাত ধরে তাকে রিকশায় উঠতে সাহায্য করবে, বা বাসের ঝাঁকুনি খেয়ে তাকে আড়াল করবে বাইরের স্পর্শ থেকে।

এদিকে প্রায় দেড় ঘন্টার মধ্যেই তারা রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো। গাড়ি থেকে নেমেই পিয়াসা বুঝতে পারলো, এটি কোনো ভিআইপি রেস্টুরেন্ট। গাড়ির গ্লাসে নিজেকে একবার দেখে নিলো সে। অসম্ভব ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে। অন্তত এই পরিবেশের সাথে তার গেটআপ মিলছে না।

স্পর্শ: দাঁড়িয়ে থাকবে? চলো।

পিয়াসা চুপচাপ স্পর্শের পেছন পেছন রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। পিয়াসাকে দেখে স্পর্শের বন্ধু তকির আর নিশান এগিয়ে এলো হাসতে হাসতে। তাদের চোখে মুখে যুদ্ধে বিজয় লাভ করার মতো আনন্দ। কিন্তু সিয়াম, পিয়াল আর শাকিল তাদের দুজনের পেছনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে শুধু। কারণ আজ পিয়াসার সাথে যা ঘটবে তার জন্য তাদের মনটা একটু ভারী হয়ে আছে। যদিও পিয়াসা তাদের কোনো আত্মীয় নয়, আজ প্রথম হয়তো তাকে সামনা-সামনি দেখেছে। কিন্তু কাউকে বিশেষত কোনো মেয়েকে হেনস্তা হতে দেখবে, এই ব্যপারে তারা মোটেও অভ্যস্ত নয়। যদিও অনিচ্ছাকৃত ভাবে বা দুর্ঘটনাবশত অনেকেই হেনস্তার স্বীকার হয়, কিন্তু পরিকল্পনা করে কাউকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলা, আর সেই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকায় কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করছে তাদের মাঝে।

অন্যদিকে তাদের পরিকল্পনা জেনে আকাশ আর হাবীব পার্টিতেই আসেনি। কিন্তু তাদের দুইজনের পরিবর্তে তাদের ভার্সিটির চারজন মেয়েকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সূচিও ছিলো, যাকে এই মুহূর্তে কোনো অংশে কম লাগছে না। বরং পিয়াসা ছাড়া সবাইকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো। এমন নয় যে পিয়াসা অসুন্দরী। কিন্তু বেশভূষা আর সাজগোজ মেয়েদের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

স্পর্শ পিয়াসাকে অপমান করার প্রথম তীর ছুঁড়ে দিয়েছে। তাদের পরিকল্পনার প্রথম ধাপই ছিলো পিয়াসার কনফিডেন্স কমিয়ে দেওয়া, আর সে নিজেকে যাতে স্পর্শের অনুপযোগী ভাবা শুরু করে।

এদিকে পিয়াসাকে দেখে স্পর্শের ক্লাসমেট মেয়েগুলো জিজ্ঞেস করলো।

-কে সে?

স্পর্শ: আমার কাজিন।

স্পর্শের উত্তর শুনে পিয়াসার চোখ কপালে উঠলো। উত্তরটা একদমই মেনে নিতে পারে নি সে। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে স্পর্শের দিকে তাকালো পিয়াসা।

স্পর্শ: ওরা আমার ক্লাসমেট। তোমার ব্যাপারে ক্লোজ ফ্রেন্ডরা ছাড়া তেমন কেউ জানে না।

পিয়াসা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
পিয়াসা: যতোটুকু জানি পার্টি ক্লোজ ফ্রেন্ডদের নিয়ে করে, আর ক্লোজ ফ্রেন্ডদের বাইরে কাউকে দাওয়াত করলে, আমাকে না আনলেও পারতেন।

স্পর্শ: সরি, সুচিস্মিতা। বন্ধুরা দাওয়াত দিয়েছে। আমি এসব জানতাম না।

পিয়াসা মুখ ফুলিয়ে রাখলো। এখনই কাঁদতে মন চাইছে তার। কার সাথে সম্পর্ক রাখছে সে? সবসময় তাকে অপমান করে, আর দিনশেষে সরি বলে পার পেয়ে যায়।
||

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here