অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-১৮,১৯

0
558

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-১৮,১৯
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৮

||
রাত আটটায় পিয়াসা ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে এলো। ঘরে ঢুকে তার মনে পড়লো তুবাকে সে মেসেজে বলেছিলো সেই রেস্টুরেন্টটিতে যেতে, যেই রেস্টুরেন্টে স্পর্শ আজ তাকে নিয়ে গিয়েছিলো। মাথায় হাত দিয়ে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো পিয়াসা।

মনে মনে বললো,
“তুবাকে তো আর জানানো হয় নি যে আমি বাসায় চলে আসছি। ফোনটাও পানিতে পড়ে গেছে!”

রুনা পিয়াসার পাশে এসে বললো,
“আপা, আপনের কাপড়ের এই অবস্থা কেমনে হইলো? আপনারে এমন দেখাইতেছে কেন?”

“কিছু হয় নি। আচ্ছা, তুবা কবে বের হয়েছিলো?”

“তুবা আপা তো আপনে যাওয়ার পরই বের হইয়া গেছে। এরপর তো আর আসে নাই।”

পিয়াসা ভ্রূ কুঁচকে রুনার দিকে তাকালো। মনে মনে বললো,
“আমি যাওয়ার পর পরই বের হয়ে গেছে? কিন্তু কলেজে যাওয়ার আগেই তুবা বলেছিলো যে, সে সারাদিন বাসায় থাকবে।”

রুনা পিয়াসার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বললো,
“একখান কথা কমু আপা। কিছু মনে কইরো না।”

“হ্যাঁ, বলো।”

“তুবা আপা তোমার বোন লাগে না?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“আপা, আমার না তোমার ওই বোনটারে সুবিধার মনে হই না। তুমি যহন কলেজে যাও, তহন একটা পোলার লগে বইয়া বইয়া রংবেরঙের কথা কয়।”

“মানে?”

“আজে বাজে কথা কয়। আমি শুনছি আপা।”

“কি আজে বাজে কথা বলে? কি শুনেছো তুমি?”

“দেখা করবো, ঘুরবো, টাকা দিবো। আরো বাজে বাজে কথা কয়। কমু না আমি। শরম করে আমার। এসব কথা মুখে আনলেই আমার পাপ হইবো। আপনে বুইঝা নেন।”

পিয়াসা রুনার কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। রুনার কথাগুলো কি আদৌ সত্য? নাকি সে ভুল ভাবছে? হয়তো কারো সাথে ভালোবাসার কথা বলছিলো, আর রুনাই ভুল বুঝে ফেলেছে।

আর আজকাল সম্পর্কগুলো অনেকটাই অশ্লীল হয়ে পড়েছে। ইদানীং প্রেমিক-প্রেমিকা ভালোবাসার নামে আজেবাজে কথা বলে একে অপরকে। তাদের কাছে হয়তো এইটাই প্রেমালাপ। কিন্তু বাস্তবে ভালোবাসা এতোটাও নোংরা হয় না। পার্থক্য শুধুই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা ভিন্ন চোখে ভালোবাসা খুঁজে সমাজকে কলুষিত করে।

পিয়াসা ভাবছে,
“তুবার তো রাতুলের সাথে ব্রেকাপ হয়ে গেছে। তাহলে কার সাথে কথা বলে ও? আর সম্পর্ক থাকলেও এসব কি ধরণের কথাবার্তা? না, না, আমি হয়তো তুবাকে ভুল ভাবছি। এমনও তো হতে পারে তুবা অল্প একটু প্রেমালাপ করেছে, আর রুনার কাছে তা অস্বাভাবিক লাগছে! আর অস্বাভাবিক লাগতেই পারে, রুনা তো গ্রামেই বড়ো হয়েছে। ওর আশপাশের পরিবেশ আর সমাজ তো তাকে এমন কিছু দেখায় নি। তাই হয়তো তুবার কথাগুলো রুনার কাছে পাপ মনে হচ্ছে।”

রুনা পিয়াসাকে বললো,
“আপা, কি ভাবতাছো?”

“না, কিছু না। আচ্ছা, তুমি যাও, রাতের খাবার তৈরি করে ফেলো । আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। অনেক ক্ষুধা লেগেছে আমার।”

“আচ্ছা, আপা।”

রুনা চলে যাওয়ার পর পিয়াসা কাপড় পালটে বাসার ফোন থেকে তুবাকে কল করলো। তুবা সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো।

পিয়াসা বললো,
“তুবা, আমি বাসায় এসেছি কিছুক্ষণ আগে।”

“বাসায়? আরেহ, আমাকে জানাবি না? আমি তোকে কতোবার ফোন করেছি, জানিস? কিন্তু তোর ফোন বন্ধ বলছিলো।”

“আচ্ছা, তুই এখন কথা না বাড়িয়ে বাসায় আয়।”

পিয়াসা কল কেটে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আজকের পুরো দিনটার কথা ভাবছে সে।
স্পর্শের এমন রূপ দেখে পিয়াসার মনে প্রশ্ন জেগে উঠছে,
“স্পর্শ কি সত্যিই আমায় ভালোবাসে? নাকি আমার অনুভূতিগুলো সব মিথ্যে হয়ে যাবে?”
এসব ভাবতে ভাবতেই পিয়াসার চোখের কোণা ভিজে গেলো।

এদিকে তুবার বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে গেলো। বাসায় এসে পিয়াসার মুখোমুখি হওয়ার পর পিয়াসা তুবাকে জিজ্ঞেস করলো,

“কোথায় গিয়েছিলি তুই? এতোক্ষণ লাগলো ফিরতে?”

তুবা আমতা আমতা করে বললো,
“ও…ওই একটু জ্যাম ছিলো রাস্তায়।”

পিয়াসা আর প্রশ্ন করলো না। কিন্তু তার মাথায় যেই সন্দেহ ঢুকেছে তা দূর না করেও সে শান্তি পাবে না। তুবা ফ্রেশ হওয়ার পর পিয়াসার কাছ থেকে আজ কি হয়েছিল, তা জানতে চাইলো। পিয়াসাও একে একে সব ঘটনা তুবাকে জানালো। সব শুনে তুবার মাথাটা প্রচন্ড গরম হয়ে যায়।

রাগী কন্ঠে তুবা বললো,
“তুই ব্রেকাপ করিস নি?”

“না, সম্পর্ক ভাঙা কি এতো সহজ?”

“আরেহ পাগল, বিয়ে করেছিস নাকি যে জটিল হবে? মুখের উপর বলে দিবি, ব্রেকাপ। ব্যস সম্পর্ক শেষ।”

“তোর কাছে এসব সম্পর্কের হয়তো কোনো মূল্য নেই, কিন্তু আমার কাছে আছে। আমি স্পর্শকে ভালোবাসি। হ্যাঁ, তবে আমি এতো সহজে তাকে ক্ষমা করতে পারবো না।”

“ক্ষমার তো প্রশ্নই আসে না।”

তুবা হাত দুটি উপরে উঠিয়ে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বললো,
“আল্লাহ, এই মেয়েকে সৎ বুদ্ধি দাও। এতো বোকা মেয়েকে আমার বোন বলতেই লজ্জা লাগছে।”

পিয়াসা কিছু না বলে উঠে বারান্দায় চলে গেলো। স্পর্শের দেওয়া চারাটির শুকনো মাটিতে হাত বুলিয়ে মনে মনে বললো,
“বোকারাই ভালোবাসে, আবার তারাই ঠকে যায়। অতি চালাকের ভালোবাসা তাকে ডুবিয়ে দেয়, দিনশেষে আক্ষেপ রেখে যায়। আমি দিনশেষে শক্ত হয়ে দাঁড়াবো। কারণ আমি কাউকে ঠকাচ্ছি না। আর আমার বিশ্বাস, আমার ভালোবাসা আমাকে ঠকিয়ে যাবে না।”

তুবা পিয়াসার পাশে বসে বললো,
“সরি, মন খারাপ করেছিস?”

“না, কিন্তু স্পর্শকে বুঝতে না পারাটাই আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। স্পর্শকে বুঝে উঠতে পারছি না। ওর ব্যবহার খুবই ভিন্ন। এর আগে আমি কখনো প্রেম করি নি, তাই জানি না সম্পর্কটা আসলে কিভাবে চালাতে হয়। কিন্তু সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, স্পর্শকে আদৌ কেউ বুঝতে পারে কি? সে মিনিটের মধ্যেই পালটে যায়। কখনো শক্ত, কখনো নরম। কিন্তু একটাও মিথ্যে মনে হয় না। মনে হয় কিছু একটা চেপে রেখেছে সে নিজের মাঝে। যার কারণেই সে নিজেকে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছে না।”

পিয়াসার কথা শুনে তুবা ঘাবড়ে যায়। কোণা চোখে পিয়াসার দিকে তাকিয়ে হাতে হাত ঘষতে থাকে।

মনে মনে ভাবতে থাকে,
“অতীতটা কি আবার বর্তমানে আসতে যাচ্ছে?”

পিয়াসার সকালে ঘুম ভাঙলো রিংটোনের শব্দে। ঘুম ঘুম চোখে শব্দ অনুসরণ করে মোবাইলটা হাতে নিলো। দেখলো তুবার ফোনে কল এসেছে। কোনো কিছু না ভেবে হুট করেই কলটা রিসিভ করে ফেললো পিয়াসা। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসলো রাতুলের ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর।

সে বললো,
“তুমি কি ভেবেছিলে এতো সহজে সব শেষ হয়ে যাবে? তুমিই এই নোংরা খেলা শুরু করেছিলে। আর এর শেষটা তো আমি করবো। খুব শীঘ্রই তোমার পরিবারের লোকেদের কাছে তোমার আসল রূপটা প্রকাশ পাবে। তুমি লোভের ফাঁদে পড়ে এতোটাই নোংরা হয়ে পড়েছো যে, তোমার বোনকেও ছাড়লে না? তুমি নিজেও বুঝতে পারছো না তুমি এখনো পিয়াসাকে ব্যবহার করছো।…..”

কারো পায়ের আওয়াজ শুনে পিয়াসা সাথে সাথেই কলটা কেটে ফোনটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর আবার ঘুমের ভান ধরে শুয়ে পড়লো। তুবা রুমে এসে বিছানায় ফোন হাতড়াতে লাগলো। পিয়াসা চোখ বন্ধ রেখেই বুঝতে পারলো তুবা কি খুঁজছে।

হঠাৎ রুনা তাদের ঘরে এসে তুবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তুবা আপা, আপনের নাস্তা টেবিলে সাজাইয়া দিসি। খাইয়া লন।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি বরং একটা কাজ করো। আমার ফোনটা খুঁজে টেবিলে নিয়ে আসো। কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না।”

“আচ্ছা আপা।”

তুবা রুম থেকে বের হওয়ার পর পিয়াসা আড়মোড়া ভাঙার অভিনয় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। রুনাকে রুম থেকে বের করে দিয়ে তুবার ফোনটা আবার হাতে নিলো পিয়াসা। কিন্তু ফোনে লক থাকায় নম্বরটা আর ডিলিট করতে পারলো না।

পিয়াসা মনে মনে ভাবছে,
“রাতুল কেন বললো তুবা আমাকে ব্যবহার করছে? তুবা কি কোনো গন্ডগোল বাঁধাচ্ছে? কি এমন নোংরা খেলায় মেতেছে তুবা? তাহলে কি রুনা আমায় যা বলেছে, তা সত্য? মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না তো? আমার উচিত রাতুলের সাথেই কথা বলে বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া। তুবাকে জিজ্ঞেস করলে সে কখনোই আমাকে সত্য কথা বলবে না।”
||

চলবে-

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৯:

||
পিয়াসা ফ্রেশ হয়ে ডায়নিংয়ে বসে পড়লো। আর তুবা ভ্রূ কুঁচকে ফোন ঘাঁটছে। কিছুক্ষণ পর তুবা বললো,

“পিয়ু, তুই কি আমার কোনো কল রিসিভ করেছিস?”

পিয়াসা কথাটি শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না। সে অবাক চোখে তুবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি আবার কখন রিসিভ করলাম?”

“এই যে সকালে একটা কল এসেছিলো ফোনে। সেইটা কি তুই রিসিভ করেছিস?”

“আজ সকালে? সেটা তোর ফোন ছিলো?”

তুবা কিছুটা বিচলিত কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ। তোকে কিছু বলেছে?”

“আমাকে আবার কি বলবে? আমি তো জানিও না কার কল এসেছে। ঘুমের ঘোরে কলটা কাটতে গিয়ে হয়তো রিসিভ করে ফেলেছিলাম।”

তুবা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“ওহ, আচ্ছা।”

পিয়াসা বললো,
“কোনো গুরুত্বপূর্ণ কল ছিলো?”

“না, না ওতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না।”

“আচ্ছা, আমি তাহলে কলেজে যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।”

পিয়াসা ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ তার মনে হলো অনেকক্ষণ ধরেই কেউ তার পেছন পেছন হাঁটছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে স্পর্শকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আবার সামনে ঘুরে জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলো। স্পর্শও পিয়াসার পেছন পেছন আসছে। পিয়াসা আরো জোরে পা চালাতে লাগলো। স্পর্শ পেছন থেকে সামনে এসে পিয়াসার হাত দুটো শক্ত করে ধরলো।

পিয়াসা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল। স্পর্শ করুণ কন্ঠে বললো,
“আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? ভুল হয়ে গেছে আমার। আমি মানছি আমি ভুল করেছি। প্লিজ এভাবে রাগ করে থেকো না। আমার তোমাকে ছাড়া চলবে না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি সুচিস্মিতা। আমার ফ্রেন্ডরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলো, তাই একটু রাগ দেখিয়ে ফেলেছিলাম। তুমি যদি বলো, এখনই আমি কান ধরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো। তুমি যা বলবে, আমি তা-ই করবো। তবুও আমাকে আরেকবার সুযোগ দাও। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমার কেউ নেই, আমি অনেক একা। তুমিও আমায় ছেড়ে চলে গেলে আমার কি হবে? সুচিস্মিতা প্লিজ…. ”

পিয়াসা স্পর্শকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আমি না ঠিক আপনাকে বুঝতে পারছি না। এসব ন্যাকামো বন্ধ করুন, প্লিজ।”

“আমার ভালোবাসা তোমার কাছে ন্যাকামো মনে হচ্ছে?”

পিয়াসা স্পর্শকে ব্যাঙ্গ করে বললো,
“তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না, আমি অনেক ভালবাসি তোমাকে, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো। এসব কথাবার্তায় প্রমাণ করে দিচ্ছে আপনি ন্যাকামো করছেন। আমার সাথে অভিনয় করবেন না দয়া করে৷ আমি যা বোঝার বুঝে ফেলেছি। এন্ড থ্যাংকস টু ইউ, আপনি আমায় ওদিন রেস্টুরেন্টটিতে নিয়ে না গেলে হয়তো আপনাকে এতোটা ভালোভাবে চিনতে পারতাম না। এখন হয়তো আর কিছুই সম্ভব না।”

স্পর্শ পিয়াসার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। তারপর পিয়াসার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

পিয়াসা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“দয়া করে আমাকে লজ্জিত করবেন না। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।”

“তোমাকে ভালোবাসি, সুচিস্মিতা।”

“আপনি দাঁড়িয়ে কথা বলেন, প্লিজ। এসব কি ধরণের মানসিক অত্যাচার?”

“আমি মানসিক অত্যাচার করছি?”

“হ্যাঁ।”

“আমার ভালোবাসা, আমার অনুভূতি তোমার কাছে অত্যাচার মনে হচ্ছে?”

“অবশ্যই। এগুলো একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? সবার সামনে সিনক্রিয়েট করছেন আপনি। মানুষজন কি ভাবছে বলুন তো? এগুলো অত্যাচার নয়তো কি?”

স্পর্শ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর পিয়াসার কাছে এসে বললো,
“কিছু সময় দাও। আমি তোমার সাথে কথা বলবো।”

“ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমার ক্লাস আছে। আমার এখন সময় হবে না।”

“আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।”

পিয়াসা এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। এদিকে স্পর্শ পিয়াসার পেছন পেছন তার কলেজের সামনে এসে দাঁড়ালো।
এরপর পিয়াসা ক্লাস শেষ করে কলেজ থেকে বের হয়ে দেখলো স্পর্শ দাঁড়িয়ে আছে। পিয়াসা স্পর্শের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। পরেরদিন আবার কলেজের সামনে এসে দেখলো স্পর্শ এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। পিয়াসা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এখনো সেই একই পোশাকে, একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শ। পিয়াসা এবারও চোখ ফাঁকি দিয়ে কলেজে ঢুকে পড়লো। কিন্তু কলেজ থেকে বের হয়েও স্পর্শকে দেখলো সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে।

তখন পিয়াসা কলেজ গেইটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা, চাচা ওই কালো শার্ট পড়া ছেলেটা সকাল থেকে দাঁড়িয়ে ছিলো?”

“আরেহ না, পোলাডা তো আগের দিন থ্যাইকা দাঁড়াইয়া আছে।”

পিয়াসা অবাক হয়ে বললো,
“আগের দিন থেকে? বাসায় যায় নি?”

“আমি যতোক্ষণ ডিউটিতে ছিলাম ততোক্ষণ তো এখানেই দেখছিলাম। কেন? তুমি চেনো পোলাডারে?”

“না, এমনি।”

পিয়াসা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেলো। একটু দূরে দাঁড়িয়ে স্পর্শকে দেখতে লাগলো। স্পর্শকে দেখতে কেমন যেন ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ফোনটা বন্ধ রাখায় স্পর্শ ফোন করেছিলো কিনা তাও বুঝতে পারছে না।

পিয়াসা ফোনটা অন করে স্পর্শকে ফোন করলো। স্পর্শ সাথে সাথেই ফোনটা রিসিভ করলো।

উদগ্রীব কন্ঠে স্পর্শ বললো,
“সুচিস্মিতা, কোথায় তুমি হ্যাঁ? আমি তোমাকে দেখছি না কেন? এই সুচিস্মিতা…. ”

“আমি আপনার পেছনে একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছি।”

স্পর্শ এদিক-ওদিক এলেমেলো ভাবে তাকিয়ে পিয়াসাকে দেখে ক্লান্ত শরীরে দ্রুত পা চালিয়ে চলে এলো।

পিয়াসার কাছে এসে স্পর্শ বললো,
“কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? আমি তোমার অপেক্ষায় কতোটা সময় পার করেছি জানো? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছি আবার হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে।”

“আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো আমি। চলুন কোথাও বসা যাক।”

পিয়াসা স্পর্শের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছুই ভাবছে। কিন্তু স্পর্শের মুখে বাঁকা হাসি। ঘাড় ঘুরিয়ে এক দৃষ্টিতে কোথাও তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর আবার পিয়াসার দিকে তাকালো।

মনে মনে বললো,
“ডিয়ার সুচিস্মিতা, তোমাকে যে এবার আমার কাছে ফিরে আসতেই হবে। এবার শুধু তোমার বিশ্বাসটা অর্জন করতে পারলেই হলো। আর দেরী করবো না আমি। খুব শীঘ্রই তুমি আমার জালে আটকা পড়বে।”

এদিকে নিশান দারোয়ানের কাছে গিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ চাচা, মেয়েটাকে আমার শিখিয়ে দেওয়া কথাটি বলার জন্য। এই নাও তোমার টাকা।”

দারোয়ান খুশি মনে বললো,
“বাবা, মিছা কথা কইতে কেন বললা? মেয়েটা কি লাগে তোমার?”

“কথাটা ভালোর জন্য বলতে বলেছি চাচা। ওই যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিলো, তার সাথে রাগ করেছিলো মেয়েটা। সম্পর্কটা শেষ হয়ে যেতো তুমি এই মিথ্যা কথা না বললে। সম্পর্ক বাঁচানোর জন্য ছোটখাটো মিথ্যা বললে পাপ হয় না।”

দারোয়ান চাচাকে ভুলভাল বুঝিয়ে নিশান চলে গেলো। আসলে সবকিছুই তাদের পরিকল্পনায় চলছিলো। স্পর্শ পিয়াসার কলেজের সামনে গিয়েছিলো পিয়াসার সামনে নিজেকে দ্বিতীয়বার নিরীহ প্রেমিক হিসেবে প্রমাণ করতে। পিয়াসা যখন কলেজ থেকে বের হচ্ছিলো তা স্পর্শ দেখে ফেলেছিলো। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই পিয়াসাকে আটকায় নি। এরপর সে পিয়াসার পিছু পিছু বাসায় চলে আসে। আর পর্যায় ভাবে তার বন্ধুরা মিলে পিয়াসা বাসা থেকে কখন বের হয় তা লক্ষ্য রাখে। পিয়াসা বের হওয়ার সাথে সাথেই বাইকে চেপে পিয়াসার আগেই কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় স্পর্শ। এই পুরো ঘটনার প্রধান পরিচালক ছিলো নিশান। আর এর ফলাফল হলো, পিয়াসার কাছে প্রমাণ করা স্পর্শ কতোই না ভালোবাসে পিয়াসাকে।

||

কিছু মানুষ খুব সহজেই ভালোবাসায় জয়ী হয়ে যায়। কারণ তাদের প্রেমে ফেলার ফাঁদটা খুবই শক্ত। এই শক্ত ফাঁদে আবেগী মেয়েদের পা দিতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না।

তাই জোডি ফ্লেনের কথাটি সত্য,
“বিশ্বাস করতে হলে এমন কাউকে বিশ্বাস করো, যার মধ্যে নীতি আছে, যার মুখের কথা ও হাতের কাজ এক”।

হাতের কলম রেখে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলো আদি। আরো একটা উক্তি মনে পড়ে গেলো তার। কিন্তু ঠিক কোথায় পড়েছে তা মনে পড়ছে না। উক্তিটি ছিলো,
“কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করার পর যদি সরাসরি দোষ স্বীকার না করে অজুহাত দেখায় – তবে সেই মানুষকে আর কখনও বিশ্বাস করো না।”

হ্যাঁ, পিয়াসা নীতিহীন স্পর্শকে বারবার বিশ্বাস করছে। বারবার স্পর্শের অজুহাতের কাছে হেরে যাচ্ছে। তবে এভাবেই কি মেয়েরা নিজেদের বোকা হিসেবে প্রমাণ করে? আসলেই মেয়েরা ভালোবাসার ক্ষেত্রে অনেকটা বোকা। তারা যখন বুঝতে শুরু করে তাদের ভালোবাসার মানুষটির মাঝে কোথাও না কোথাও একটা ত্রুটি আছে, তখন সব ত্রুটি চোখের ভুল বলেই মেনে নেয়। কিন্তু সেই ছেলেরাই একটা ভুলও মাটিতে পড়তে দেয় না। এটাই হয়তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা নীতি।

চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here