অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২৯,৩০

0
634

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২৯,৩০
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২৯:

||

পিয়াসার বাবা কয়েক মাসের মধ্যেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান। বাবাকে পেয়ে পিয়াসার জীবনে একটু হলেও আনন্দ ফিরে এসেছে। তবে মিস্টার আজীজের ব্যবসায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। নতুন করেই আবার ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করছেন তিনি। এদিকে মিসেস আজীজ চাকরী ছেড়ে দিয়ে সাংসারিক হওয়ার চিন্তাভাবনা করে ফেলেছেন। এখন তার প্রধান দায়িত্ব স্বামী আর মেয়ের যত্ন নেওয়া। স্বামী-স্ত্রী মিলে জীবনে অনেক টাকা আয় করে ফেলেছেন। কিন্তু এই টাকা যথাসময়ে তার স্বামীকে নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণ করতে পারে নি। উলটো তাদের সৎ পথে উপার্জিত সব সঞ্চয়, দুর্নীতি আর অবৈধ উপার্জন হিসেবে বিবেচিত হয়ে পড়েছে। আর বিনিময়ে তারা পেয়েছেন অসম্মান আর একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতের উপর পড়েছে বিশাল বড় দাগ।

আজ পিয়াসা নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এসেছে। পরের মাস থেকেই ক্লাস শুরু। এখন থেকে সে জীবনটা নতুনভাবে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। স্পর্শের দেওয়া সব স্মৃতিই পেছনে ফেলে দিতে চায় পিয়াসা।

হঠাৎ মেঘের গর্জন শুনে পিয়াসা হালকা কেঁপে উঠলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে আকাশের মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে মেঘের ছুটোছুটি দেখতে লাগলো। তার চোখ আটকে গেলো সামনের বিল্ডিংয়ের বারান্দায়। তুবা বলেছিলো, স্পর্শ এই এলাকায় থাকে তার বন্ধুদের সাথে। তবে এবার তুবা মিথ্যে বলেনি। পিয়াসাও এর প্রমাণ পেয়েছে। পিয়াসা স্পর্শকে অনেকবার দেখেছিলো বিল্ডিংয়ের নিচে, এমনকি মাঝে মাঝে সেই বিল্ডিংয়ের ছয়তলার বারান্দায়ও স্পর্শকে দেখা গিয়েছিলো। তবে তা সম্পর্ক ভাঙার পর, এর আগ পর্যন্ত সে কখনোই স্পর্শকে দেখে নি।

পিয়াসা ভাবছে,
“তবে কি এতোদিন আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম? ভালোবাসা কি আমায় অন্ধ করে দিয়েছিলো? নাকি এতোদিন স্পর্শই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো?”

স্পর্শের কথা মনে পড়লেই খুব কষ্ট হয় তার। স্পর্শকে ভুলে থাকার জন্য সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখে। এমনকি রিয়াদের সাথেও এখন খুব কথা বলে পিয়াসা। তবে রিয়াদ পিয়াসার খাপছাড়া কথা বলার ধরণ দেখেই বুঝে ফেলেছিলো, কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু আর জিজ্ঞেস করে নি।

দুই সপ্তাহ হচ্ছে স্পর্শ ও তার বন্ধুরা বাসা ছেড়ে আরেকটা এলাকায় উঠেছে। তবে এলাকাটি অনেকটা নির্জন। এখানে শুধু কয়েকটা বাসা আছে। আর সব বাসাগুলো ব্যাচেলরদের থাকার জন্য। তবে একটা গার্মেন্টস কারখানা আর একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলও আছে।

বাসাটি দুই রুমের। আর সেখানে একটা মাত্র ওয়াশরুম আছে। তাই স্পর্শের সাথে নিশান, তকির আর সিয়ামই সেই বাসায় উঠেছিলো। তবে পিয়াল মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে এই পরিকল্পনায় হয়। আর বাকীরা স্পর্শের সাথে থেকে নিজেদের কোনো বিপদে জড়াতে চায় না। তাই স্পর্শের সঙ্গ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কারণ পিয়াসার জীবনকে নরক বানিয়ে দেওয়ার একটা সুন্দর পরিকল্পনা করে ফেলেছে নিশান আর তকির। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই স্পর্শকে তারা চাপ দিচ্ছে।

স্পর্শের প্রথমেই ইচ্ছে ছিলো পিয়াসাকে বিয়ে করে ছেড়ে দেবে। কিন্তু এখন সবকিছু আর এতো সহজ হবে না। আর জোর করে পিয়াসাকে বিয়ে করেও বা কি লাভ হবে? তাই বিয়ের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেয় স্পর্শ। এমনকি পিয়াসাকে মাথা থেকে ফেলে দিয়ে, শুধুমাত্র রকিকে যেকোনো মূল্য শাস্তি দেওয়ার চিন্তা করছিলো সে। কিন্তু এখন নিশান আর তকিরের প্ররোচনায় স্পর্শের দমে যাওয়া প্রতিশোধ আবার জ্বলে উঠে। তাদের কারণেই স্পর্শের চাপা ক্ষোভটা তীব্রভাবে বেড়ে উঠে।

সে এবার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো, অতিন্দ্রিয়া নামের সেই অপ্রিয় অতিথিকে সে শাস্তি দিয়েই ছাড়বে। তবে এবার আর কোনো লুকোচুরি থাকবে না। প্রকাশ্যে সে এই প্রতিশোধ নেবে।

||

এতোটুকু পড়েই অস্ফুটস্বরে বর্ণের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,
“প্রতিশোধ!”

এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো বর্ণ। বাইরে আজ প্রচন্ড রোদ। এই রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচতে ঘর থেকে বের হয় নি সে। কিন্তু সে বিশ্রাম নিলেও তার ফোন বিন্দুমাত্র বিশ্রাম নেয় নি। একের পর এক কল আসছে। সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ কল। কিন্তু এই মুহূর্তে বর্ণের কাছে ভাবনাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বিছানায় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের একেকটি সংখ্যা। আর প্রতিটি পাতায় ছাপা হয়ে আছে তার অপ্রিয় মানুষটির লেখা গল্প “অপ্রিয় মুহূর্ত ও শুকনো একটি গোলাপ।” অনেক দিন আদির লেখালেখি বন্ধ ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই আবার আদি লিখতে বসেছে। সে ভেবেছিলো আর কখনোই এই গল্পটা পড়া হবে না। তাই যখন জানতে পারলো আদি আবার লেখা শুরু করেছে, তখন লাইব্রেরিতে গিয়ে সবগুলো সংখ্যা একসাথে কিনে আনলো। তারপর থেকেই পড়া শুরু করলো, যদিও এখনো আরো কিছু সংখ্যা বাকী।

যেদিন প্রথম আদির কাছে স্পর্শ আর পিয়াসার গল্প শুনেছিলো সেদিন থেকেই স্পর্শের স্থানটিতে সে আদিকে কল্পনা করতো। কিন্তু আজ শুধু স্পর্শই নয়, আদিও তার জন্য এক অপ্রিয় অতিথি। যে হুট করে তার জীবনে এসেছিলো শরতের শুভ্র মেঘের মতো, আর অবশেষে হয়ে পড়েছে এক ভয়ংকর ঝড়।

আজকাল আবহাওয়ার খুব পরিবর্তন হচ্ছে। হুট করে বৃষ্টি হয়, আবার হুট করেই গরম। তেমনি বর্ণ আদিকে দেখেছে নরম মনের মানুষ থেকে কঠোর হৃদয়ের মানুষ হতে।

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো বর্ণ। মনে পড়ে গেলো আদির সাথে তার প্রথম বন্ধুত্ব হওয়ার স্মৃতি। ক্যাম্পাস থেকে পিকনিকে যাওয়ার বাহানা দিয়ে দিনাজপুর ঘুরতে গিয়েছিলো তারা, আর সেখানেই আরো ভালোভাবে আদির প্রেমে পড়ে এসেছিলো। তারপর একদিন হুট করেই আদির পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। আর সেই অপ্রিয় মুহূর্তের কথা যেদিন ক্যাম্পাসে সবার সামনে আদি তার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। শুধুমাত্র সে অন্য মেয়েদের মতো সুন্দরী আর পাতলা গড়নের নয় তাই। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো বর্ণের বুক চিরে। অবাক লাগছে তার প্রিয় লেখক সাহেবকে এখন নিজের স্বামী হিসেবে ভাবতে।

বর্ণ বিছানায় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকা ম্যাগাজিনগুলো হাতে নিয়ে ড্রয়ারে গুছিয়ে রাখলো। তারপর বিছানায় শুয়ে ঘড়ির দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো। কারণ এখন তার ঘুমানোর প্রয়োজন।

চোখ বন্ধ করতেই পিয়াসার এক অস্পষ্ট চিত্র তার কল্পনায় ভেসে উঠলো।

পিয়াসা কাঁদছে, খুব কাঁদছে। আর স্পর্শকে বলছে,
“আমাকে আর কষ্ট দিও না। আমি আর নিতে পারছি না এই মানসিক যন্ত্রণা। আমার কি অপরাধ ছিলো, স্পর্শ? আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।”

হঠাৎ এক অন্ধকার রুম থেকে স্পর্শ বেরিয়ে এলো। দেখতে একদম আদির মতো। তার হাতে ধারালো ছুরি। সে ধীর পায়ে পিয়াসার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আর পিয়াসা স্পর্শকে দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুহূর্তেই স্পর্শ পিয়াসার বুকে ছুরিকাঘাত করলো। আর তখনই ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো বর্ণ। সে মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তারপর জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে গটগট করে খেয়ে নিলো। বিড়বিড় করে বললো,
“স্পর্শ তো একটি কাল্পনিক চরিত্র মাত্র। সে পিয়াসাকে যেই আঘাত দিয়েছে তার চেয়েও তোমার দেওয়া আঘাত কয়েকগুণ বেশি।”

||

হলুদ রঙের সেলোয়ার-কামিজ পড়ে বসে আছে পিয়াসা। আজ তাকে দেখতে এসেছে রিয়াদের পক্ষ থেকে। বাসার সবাই ভীষণ খুশি।

দেখতে আসার যদিও কোনো প্রয়োজন ছিলো না। কারণ ফোনে ফোনেই কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে। তবুও আজ ঘটা করেই দেখতে এসেছে তাকে। রিয়াদের মা পিয়াসার হাতে রিং পরিয়ে দিলেন। এদিকে সবার সামনে ঝুঁকে বসে থাকতে থাকতে পিয়াসার পিট ব্যথা হয়ে গেছে। সে তার পাশে বসা রিয়াদকে ফিসফিস করে বললো,
“আমি কি রুমে চলে যাবো?”

রিয়াদ বললো,
“হ্যাঁ, যাও।”

রিয়াদের হ্যাঁ বলতেই দেরী ছিলো পিয়াসা তাড়াতাড়ি উঠে রুমে চলে গেলো। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। চোখে অশ্রু নেই, কিন্তু বুকটা কাঁপছে। সে কোনোকিছুই মানতে পারছে না। হঠাৎ স্পর্শকে হারিয়ে ফেলা, আবার হঠাৎই রিয়াদের সাথে সম্বন্ধ ঠিক হওয়া। এই মুহূর্তে নিজেকে মানসিক রোগী মনে হচ্ছে তার।

আয়নার দিকে চোখ পড়তেই পিয়াসা অবাক হয়ে বলল,
“ভালোবাসা আমায় কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে! এখন আমার কোনো পিছুটান নেই। তবুও সেই মুহূর্তগুলো কি এতো সহজে ভুলে যাওয়া যায়, যেই মুহূর্তে স্পর্শ আমার ছিলো? আমি ভুলতে চাই সেই স্মৃতিগুলো, কিন্তু ভাগ্যটা বড়োই নিষ্ঠুর! নিজের জন্য এখানে কোনো সময় নেই। এই ভাগ্য আমাকে নিজেকে ভালোবাসার কোনো সুযোগ দেয় নি। এমনকি অতীতটা ভুলার আগেই একটা নতুন অধ্যায় সামনে এনে দিয়েছে। এই ভাগ্য শুধুই অন্যের জন্য লিখিত। অন্যের সুখের জন্য, অন্যের ইচ্ছে পূরণের জন্য শুধুই ত্যাগ করাটাই যেখানে উপযুক্ত। আমি তো একজন অনুভূতিহীন মানুষ। আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই। কেউ জিজ্ঞেস করে নি আমি কি চাই! শুধু জানিয়েছে।”

চলবে-

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩০:

||

উন্মুক্ত মাঠে এসে দাঁড়ালো আদি। হাতে একটা খাতা আরেকটি কলম। চোখে চশমা লাগিয়েছে। ইদানীং আদির চোখে মোটা ফ্রেমের এই চশমাটা লক্ষ্য করা যায়। তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। মুখে বিষণ্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে। আদি প্রায়ই খোলা মাঠে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকে। আজও এর ব্যতিক্রম হয় নি।
অনেকেই তার এমন কান্ড দেখে অবাক হয়। কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করতে আসে নি, তার এমনটা করার কারণ কি? আর মানুষের এসব প্রশ্ন করার মতো সময়ও নেই। তারা শুধু দেখে দেখেই চলে যায়।

শরতের সকাল। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। আর আশপাশ ছেয়ে আছে কাশফুলে। আদি প্রতিদিনের মতো দুই চোখ বন্ধ করে, দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে। আর হারিয়ে যাচ্ছে তার প্রিয় সেই মুখটিতে।

বর্ণালী মির্জা, হঠাৎ যার সাথে ক্যাম্পাসেই দেখা হয়েছিলো, যার অনেকগুলো গুণের মধ্যে একটি ছিলো সে ভালো ছবি আঁকতে পারতো আর যার হাসিটা খুবই আকর্ষণ করতো আদিকে। এই হঠাৎ আসা মেয়েটিকেই আদি ভালোবেসে ফেলেছিলো। কিন্তু মেয়েটিকে কখনোই বলতে পারে নি। কারণ বলার আগেই যে মেয়েটি তার কাছে ঘৃণ্যতম নারীতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো! যদিও সেটা ছিলো ভুলবোঝাবুঝি। সে বর্ণালীকে ভুল বুঝেই ঘৃণা করে ফেলেছে। যেমনটা স্পর্শ পিয়াসাকে ভুল বুঝে প্রতিশোধ নিতে চাইছে।

বাবার ইচ্ছায় বর্ণালীকে বিয়ে করেছিলো আদি। কিন্তু কখনো এতোটুকুও সম্মান করে নি। সবসময় শুধু অপমান করে গেছে। ভালোবেসে বর্ণ যেমন তাকে লেখক সাহেব বলে ডাকতো। আদি তেমনি বর্ণকে শিল্পী বলেই ডাকতো। কিন্তু একটা ঝড় এসে সেই নামটি মুছে দিয়েছে আদির স্মৃতি থেকে। তাই সেই নামের পরিবর্তে বর্ণালীকে সে নতুন নাম দিয়েছিলো। আর সেটা ছিলো মিনি এলিফ্যান্ট। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেতো এই নামটি শুনে। কিন্তু তবুও আদি এই নামটিতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো।

আদি একটা গাছের নিচে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর লিখতে বসলো পিয়াসার জীবনে আসা নতুন ঝড়টি নিয়ে।

||

আগামীকাল পিয়াসা আর রিয়াদের আক্দ। বাসায় মেহমান গিজগিজ করছে। পিয়াসার এমন বিশৃঙ্খলা ভালো লাগছিলো না। তাই সে বারান্দায় এসে বসলো। তার হাতে একটি ডায়েরী।

পিয়াসা দিনলিপি লিখতে পছন্দ করে। যখন সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো, তখনই সে এই ডায়েরীটি কিনেছিলো। এরপর তার জীবনে ঘটা বিশেষ দিনগুলো এই ডায়েরীতেই লিপিবদ্ধ করেছে।

স্পর্শের সাথে প্রথম দেখা, স্পর্শের স্মৃতি, স্পর্শকে হারিয়ে ফেলা আর দুই বছর পর তাকে আবার ফিরে পেয়ে তার সাথে সম্পর্কে জড়ানো, এসব প্রিয় মুহূর্তগুলো এই ডায়েরীতেই সে লিখে রেখেছে। কিন্তু ডায়েরীটাতে আরেকটুখানি খালি জায়গা আছে। তাই সে একটি বাক্য লিখে ডায়েরীটা বন্ধ করলো। এরপর স্পর্শের দেওয়া চারাগাছের শুকনো ফুলগুলো প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে দিয়ে ডায়েরীটা ড্রয়ারে তুলে রাখলো।

পরের দিন-

পিয়াসার কলেজের বান্ধবী নীলিমার শরীর ভালো নেই। তাই সে নীলিমাকে দেখতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে কাউকে না বলে বেরিয়ে পড়লো। নীলিমার বাসা ওতো দূরে নয়। পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায়।
তাদের গলির দুই গলি পর একটা ছোট রাস্তা, সেটি পার করেই মেইন রোড। আর মেইন রোড পার করেই আরেকটা গলি। আর সেখানেই দ্বিতীয় বিল্ডিংটাতেই নীলিমা থাকে তার বাবা-মা আর ভাই-বোনদের নিয়ে।

পিয়াসা তাদের গলি থেকে বের হওয়ার পরই একটা জিনিস লক্ষ্য করলো, একটা কালো গাড়ি ধীরে ধীরে চলছে। ব্যাপারটা পিয়াসার খটকা লাগলো। গাড়িটা ধীরে ধীরেই বা কেন চলবে?
পিয়াসা দুই গলি অতিক্রম করার পর দেখলো গাড়িটা তার পিছু পিছুই আসছে।

এদিকে আবাসিকে থাকায় রাস্তায় মানুষজন একদমই নেই। আর সে বোকার মতো ফোনটাও বাসায় রেখে এসেছে। তাই কাউকে ফোনও দিতে পারছে না।

আজকেই আসরের পর আক্দ আর সে কাউকে না বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে বান্ধবীকে দেখতে। এখন বাসায় ফিরলে নিশ্চিত তাকে চড় খেতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই পা একটু জোরে চালিয়ে সে ছোট রাস্তায় ঢুকতে যাবেই ওমনি কালো গাড়িটি থেকে একজন মুখোশধারী মানুষ বের হয়েই তাকে ঝাপটে ধরলো। পিয়াসা চেঁচাতে যাবে তখনই তার মুখটা চেপে ধরে তাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে উঠালো।

পিয়াসা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। কিন্তু কোনোভাবেই পেরে উঠছে না। গাড়িতে উঠানোর পর আরেকটি মুখোশধারী মানুষ পিয়াসার মুখে একটা স্কচটেপ লাগিয়ে দিলো। আর যেই অজ্ঞাত মানুষটি তাকে তুলে গাড়িতে এনেছিলো সে পেছন থেকে মোটা মোটা রশি টেনে আনতে লাগলো। পিয়াসা এতোক্ষণে বুঝে ফেলেছে তাকে অপহরণ করা হচ্ছে। আশেভাবে চোখ বুলিয়ে দেখলো গাড়িতে মোট চারজন। একজন গাড়ি চালাচ্ছে। আর তার পাশে আরেকজন বসে আছে। আর পেছনে পিয়াসার দুই পাশে দুইজন।

পিয়াসা নিজেকে শক্ত করে তার পাশে থাকা আগন্তুকটিকে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিলো। যেই ধাক্কা খেয়ে মুখোশধারী আগন্তুকটি বুকে প্রচন্ড ব্যথা পেলো সাথে পিয়াসাও কাঁধে ব্যথা পেলো। ব্যথা পেয়ে আগন্তুকটি আরো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলো। সে পিয়াসার চুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে তাকে এক ঝটকায় তার কোলের উপর ফেলে দিলো। এরপর পাশে থাকা দ্বিতীয় আগন্তুকটি তার হাতে রশি পেঁচাতে লাগলো। রশিটা শক্ত করে বাঁধতেই পিয়াসার হাতটা অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে। তাই সে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। কিন্তু স্কচটেপের কারণে কোনো শব্দ বের হলো না। শব্দগুলো দুই ঠোঁটের ভেতরেই আটকে রইলো। তবে তার ভয় আর ব্যথাকে সঙ্গ দিলো তার অশ্রুগুলো। দরদর করে চোখ বেয়ে জলগুলো গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

পিয়াসাকে পুরোপুরি বেঁধে ফেলার পর তার পাশে থাকা আগন্তুকটি তার দিকে তাকালো। পিয়াসাও সেই আগন্তুকের চোখের দিকে তাকালো। চোখগুলো খুব পরিচিত মনে হচ্ছে তার কাছে। সে ভালোভাবেই আগন্তুকটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

এদিকে অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করতে করতে পিয়াসা ক্লান্ত হয়ে পড়লো। সে চুপচাপ বসে রইলো আর এদিক ওদিক তাকিয়ে গাড়িটা কোথায় যাচ্ছে সেটি দেখতে লাগলো। রাস্তাগুলো তার অপরিচিত মনে হচ্ছে। তবে গাড়িতে বসেই সে নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। এই মুখোশধারী লোকগুলো তার সাথে কি কি করতে পারে তা ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে পিয়াসার। চোখ বন্ধ করতেই মা-বাবার চেহারাটা ভেসে উঠলো। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার।

জ্ঞান ফিরতেই একটা রুমে নিজেকে আবিষ্কার করলো পিয়াসা। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠতেই খেয়াল করলো তার হাতের বাঁধন খোলা। আশেপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো রুমটি অনেক এলোমেলো। দুই পাশে দুটি পড়ার টেবিল আর মাঝখানে একটি ডাবল বেড। পাশে একটা আলমারী। আর তার পাশেই আলনা, যেখানে সব ছেলেদের জামা-কাপড় ঝুলানো। সে দরজার কাছে দাঁড়াতেই দেখলো দরজাটি বাইরে থেকে লক করে রাখা হয়েছে। কি ভেবে তাড়াতাড়ি জানালার কাছে এলো। জানালার পর্দা সরাতেই দেখলো সামনে বিশাল বড় মাঠ। আর মাঠটি প্রচন্ড নোংরা। মনে হচ্ছে সবাই এই মাঠটিকেই আবর্জনা ফেলার স্থান বানিয়েছে। অনেকটা দূরেই একটা বড় বিল্ডিং।

পিয়াসা মনে মনে ভাবছে,
“এটা হয়তো কোনো কারখানা হবে। আমি যদি এখান থেকে চেঁচামেচি করি, তাহলে কি ওখানের কেউ শুনতে পারবে? আর মাঠটিও যা নোংরা, এর আশেপাশে তো কেউ দাঁড়াবেই না। এখন আমি এখান থেকে কিভাবে বের হবো?”

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ শুনেই পিয়াসা এক কোণে গিয়ে চুপ করে বসে পড়লো। এরপর দেখলো মুখোশধারী একজন আগন্তুক রুমে প্রবেশ করেছে। পিয়াসা চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকছে আর মনে মনে বললো,
“আমাকে বরং তুমি এখানেই মৃত্যু দাও, তবুও আমার মান-সম্মানটা রক্ষা করো আল্লাহ।”

আগন্তুকটি পিয়াসার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পিয়াসা আরেকটু পেছাতেই দেয়ালের সাথে আটকে গেলো। এরপর আগন্তুকটি একটা বাঁকা হাসি দিয়ে পিয়াসার মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসলো।

পিয়াসা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আ…আমাকে যেতে দিন ভাইয়া। আমি তো আপনাকে চিনি না। আমি কাউকে কিছুই বলবো না। আজ আমার বিয়ে। আমাকে যেতে দিন। তার পরিবর্তে আপনার যতো টাকা লাগে নিয়ে নিন। আমার বাবার নম্বর দেবো আপনাকে? বাবা আপনাকে টাকা পাঠিয়ে দেবে। তবুও আমাকে যেতে দিন, প্লিজ।”

আগন্তুকটি পিয়াসার কথায় উচ্চস্বরে হেসে দিলো। হাসির শব্দশুনে পিয়াসা স্তব্ধ হয়ে গেলো। আগন্তুকটি বললো,
“এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তো তোমাকে তুলে নিয়ে আসি নি, সুচিস্মিতা।”

পিয়াসা অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “স্পর্শ!”

স্পর্শ তার মুখের কালো মাস্কটি খুলে ফেললো। আর পিয়াসা চোখ বড় বড় করে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে রইলো। স্পর্শ পিয়াসার মুখের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
“ইশ, সুচিস্মিতা! তোমাকে আজ এতো ক্লান্ত মনে হচ্ছে কেন? ও… বুঝেছি। অনেক পরিশ্রম করেছো তো আমার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য, তাই হয়তো। কিন্তু এতো সহজে তো তুমি ছাড়া পাবে না। তুমি এখানে এই মুহূর্তে আমার সাথেই আছো এটা কেউই জানে না। ও, ইয়েস, আজ তো তোমার বিয়ে! কিন্তু এখন বিয়েটা যে আর হলো না। বিকেলেই আক্দ হওয়ার কথা ছিল, তাই না?”

স্পর্শ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এখন তো বিকেলেই। তোমার বাসায় হয়তো এতোক্ষণে জানাজানি হয়ে গেছে তুমি নেই। লোকে বলাবলি করবে মেয়ে পালিয়েছে তার প্রেমিকের সাথে। আর তোমার বাবা-মা মনে করবে তোমাকে অপহরণ করা হয়েছে। সুন্দর না? তুমি কারো স্পর্শ না পেয়েই কলঙ্কিত হয়ে গেছো। এখন কে বিয়ে করবে তোমাকে?”

রাগে পিয়াসার মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো। সে স্পর্শের গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে তার চুলগুলো টেনে ধরে চেঁচিয়ে বলল,
“আমি কি অপরাধ করেছিলাম? কেন করেছো আমার সাথে এমন? আই হেইট ইউ, স্পর্শ চৌধুরী। আমি তোমাকে পুলিশে দেবো।”

স্পর্শ পিয়াসার চুলের মুঠি ধরে তাকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে তার উপর চড়ে বসলো। তারপর তার গলা চেপে ধরে বললো,
“আমি তোমাকে একটুও স্পর্শ করবো না। তোমার মতো চরিত্রহীন মেয়েকে স্পর্শ করলে আমি নিজেই নোংরা হয়ে যাবো। হুম, তবে তুমি যদি বাড়াবাড়ি করো, তাহলে অনেক খারাপ হবে কিন্তু। তাই একটু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। চুপচাপ এখানে বসে থাকবে। আর একটুও কথা বলবে না। আমি নিজের হাতে তোমার জন্য স্পেশাল স্যুপ বানিয়েছি। তুমি বসো, আমি নিয়ে আসছি।”

স্পর্শ চলে যাওয়ার পর পিয়াসা মেঝেতে শুয়েই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। উড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে সোজা হয়ে বসলো। মনে মনে ভাবলো,
“হয়তো স্পর্শ আমাকে অপহরণ করেছে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। ও ভাবছে আমি অতিন্দ্রিয়া, আর আমিই রকিকে সাহায্য করেছি। কিন্তু এটা তো মিথ্যে। আমি ওকে সব সত্য জানিয়ে দেবো। বলবো, আমাকেই ফাঁসানো হয়েছে। আর…. কিন্তু তখন যদি জিজ্ঞেস করে কে ফাঁসিয়েছে? আমি তুবার নাম কিভাবে বলবো? আমি যদি তুবার কথা বলি, তখন ওরা তুবাকেও এভাবেই তুলে নিয়ে আসবে। আর আমার কাছে তো কোনো প্রমাণও নেই।”

পিয়াসা এসব ভাবতে ভাবতেই কেঁদে উঠলো। তারপর বিড়বিড় করে বললো,
“তুবা, তুই আমার কতো বড় ক্ষতি করে ফেলেছিস! তোর কয়েকদিনের বিলাসিতা আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

স্পর্শ রুম থেকে বের হয়েই সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। নিশান আর তকির স্পর্শের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আর সিয়াম চুপ করে বসে আছে।

নিশান স্পর্শকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আগে কি করবি ভেবেছিস?”

স্পর্শ বললো,
“রকি কিভাবে আমার বাবাকে মেরেছে সবকিছুই ও জানে। আর আজই আমি তা জেনে নেবো।”

তকির বললো,
“আর যদি অস্বীকার করে?”

স্পর্শ রাগী কন্ঠে বললো,
“বাধ্য করবো।”

সিয়াম বললো,
“তারপরও যদি কিছুই না বলে।”

স্পর্শ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুই কি শুনতে চাইছিস?”

“আমি তোকে শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি, যে একটু সাবধানে থাকিস। তোর একটা সিদ্ধান্ত আমাদের বাকী তিনজনের উপরও প্রভাব ফেলবে।”

স্পর্শ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললো,
“আমার জন্য তোদের কোনো ক্ষতি হবে না। আর তোরা ওই রুমে না গেলেই ভালো হবে। ও যাতে তোদের কারো চেহারায় দেখতে না পায়।”

স্পর্শ কিচেনে গিয়ে পিয়াসার জন্য স্যুপ বানিয়ে আনলো। এরপর পিয়াসার মুখোমুখি স্যুপের বাটিটা ধরে বললো,
“আমি প্রথম তোমার জন্য কিছু বানিয়েছি, খাবে না?”

পিয়াসা রাগী কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে এখানে কেন তুলে এনেছো?”

“আগে খেয়ে নাও। তারপর বলছি।”

“কিন্তু আমি জানি তুমি আমাকে কেন তুলে এনেছো।”

স্পর্শ স্যুপের বাটিটা পাশে রেখে দিয়ে কপাল ভাঁজ করে বললো,
“বেশ তো! তাহলে আমি কষ্ট করে আর প্রশ্ন না করি। তুমি আমাকে সব উত্তর নিজ থেকেই দিয়ে দাও।”

“আমার একটাই উত্তর, সেটা হলো আমি অতিন্দ্রিয়া নই। তুমি যাকে অতিন্দ্রিয়া ভাবছো, আমি সেই মেয়ে নই। আমার নাম পিয়াসা আজীজ। আমার বাবার নাম মো. আজীজ। বিশ্বাস না হলে আমি তোমাকে আমার জন্ম নিবন্ধনের সনদ দেখাতে পারবো। এর চেয়ে সহজ উপায় হবে, তুমি আমার কলেজে গিয়ে আমার পরিচয় জেনে এলে।”

স্পর্শ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। পিয়াসা বললো,
“আমি তোমাকে অনেক আগেই আমার নামটা জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি জানতেই চাও নি।”

স্পর্শ এবার বললো,
“তাহলে তুমি অতিন্দ্রিয়া সেজে এসব নষ্টামি করেছিলে?”

“না, হয়তো কেউ আমার ছবি নিয়ে অতিন্দ্রিয়া সেজেছিলো? তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে যে এই অতিন্দ্রিয়া মেয়েটা আমিই?”

স্পর্শ মাথা নেড়ে বললো,
“প্রমাণ আছে।”

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here