#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-৩১,৩২
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩১:
||
পিয়াসা এক দৃষ্টিতে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ফুটে উঠেছে গভীর হতাশা। স্পর্শ পিয়াসার চাহনী দেখে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
“তুমি প্রমাণ চেয়েছিলে, আর আমি তোমাকে প্রমাণ দেখিয়ে দিলাম। এখন বলো, তুমি অতিন্দ্রিয়া নও?”
স্পর্শ সেই চ্যাটের ছবিগুলো ছাপিয়ে এনেছে পিয়াসাকে ভালোভাবে দেখানোর জন্য। পিয়াসা সেই ছাপানো কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। পড়তে লাগলো অতিন্দ্রিয়া নামের আড়ালে তুবা কতো সূক্ষ্মভাবে পিয়াসাকে বাইরের মানুষের চোখে জঘন্য বানিয়ে তুলেছে। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তুবা তারই কাজিন। কেউ তো তার শত্রুর সাথেও এমন করবে না। অথচ পিয়াসা আর তুবার কতো ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো! তুবা কি একবারো এসব ভাবে নি? এমন নোংরা খেলা তুবা কোথা থেকে শিখেছে তা পিয়াসা বুঝতে পারছে না।
চ্যাট দেখে পিয়াসা সংক্ষিপ্তভাবে যা বুঝলো রকি অতিন্দ্রিয়াকেই পিয়াসা ভেবে নিয়েছে। পিয়াসা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায় যা যা করতো সব কথায় রকি জানতো, কারণ তুবাই এসব বলেছিলো। সাথে পিয়াসার বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবি রকিকে পাঠিয়েছে তুবা। এসব দেখে পিয়াসার মনে পড়ে গেলো, তুবা তখন মাঝে মাঝেই তার কাছে এসে হুট করেই বলতো,
“চল না পিয়ু, একটা সেল্ফি উঠায়।”
পিয়াসার ইচ্ছা না থাকলে সে তুবার কারণে একটা দু-টা ছবি উঠাতো। আর এরপর তুবা বলতো,
“এবার আমি তোর একটা ছবি উঠিয়ে দেই।”
পিয়াসার ইচ্ছা না থাকা শর্তেও সে ছবি উঠাতো, কারণ না করলে তুবা মন খারাপ করে ফেলতো। ছবি উঠানোর পর তুবা বলতো,
“তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি এসব ছবি দেখেই তোকে মনে রাখবো। তাই যখন তখন তোর ছবি তুলি। তখন তোর সাথে কাটানো প্রতিটি প্রিয় মুহূর্ত আমার মনে পড়বে।”
পিয়াসার এসব পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতেই তাচ্ছিল্যের সুরে মনে মনে বললো,
“তাহলে এ-ই ছিলো তোর আর আমার প্রিয় মুহূর্ত? এজন্যই তুই আমার ছবি উঠাতি যখন তখন? ছি! তুবা, ছি!।”
শুধু এতেই শেষ হয় নি। সেই সময় স্পর্শের পিয়াসার প্রতি ভালোলাগা, তার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা, সেই কথাগুলোও তুবা রকিকে বলেছিলো আর লিখেছে,
“জানো আমার জন্য সামনের বাসার একটি ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো আমাকে পছন্দ করে। সে আমার পিছুও নেয়। আমাকে মাঝে মাঝে অনেক কিছু গিফট করে। কিন্তু তুমি তো শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারো। আমাকে তো কিছুই কিনে দাও না।”
রকির উত্তর ছিলো,
“তোমার কি লাগবে গো সুন্দরী….”
রকি পাশে আরো বিশ্রী কথাও যুক্ত করেছিলো। যার প্রতিক্রিয়ায় তুবা প্রতিবাদ না করে সম্মতি জানিয়েছে, এমনকি সে রকি থেকে বিভিন্ন সময়ে টাকা নিয়েছিলো। এমনকি সে অনলাইনে পছন্দ করা বিভিন্ন জিনিসপত্রের ছবি তুলে তা গিফট করতে বলতো রকিকে, আর বিভিন্ন ঠিকানা দিয়ে সেখানেই পাঠাতে বলতো।
পরের চ্যাটগুলো পড়তে পড়তেই পিয়াসার গা গুলিয়ে আসতে লাগলো। এতো নোংরা নোংরা কথাবার্তা কেউ হয়তো প্রেমিকের সাথেও বলে না। আর তুবা তো সব সীমায় অতিক্রম করে ফেলেছে।
শেষের চ্যাটগুলো পড়ে পিয়াসা স্পর্শের দিকে এক নজর তাকালো। স্পর্শ কাগজটির দিকে ইঙ্গিত করে বললো,
“ভালোভাবে পড়ো, আর মনে করার চেষ্টা করো।”
পিয়াসা পরের চ্যাটগুলো পড়লো। এই চ্যাট সেইদিন হয়েছিলো যেদিন রকি পিয়াসাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিরক্ত করছিলো, আর পিয়াসা তাকে বখাটে ছেলে বলেছিলো। আর এরপর স্পর্শ আর রকির মধ্যে হাতাহাতিও হয়েছিলো পিয়াসাকে নিয়ে।
রকি মনে করেছিলো, পিয়াসা স্পর্শের জন্য তাকে পাত্তা দিচ্ছিলো না। কারণ কিছুদিন ধরেই তুবা অর্থাৎ অতিন্দ্রিয়া রকিকে বলেই যাচ্ছিলো স্পর্শ অনেক বেশিই স্পেশাল। কারণ সে তাকে অনেক কিছুই দেয়। এর ফলে রকির মনে ক্ষোভ জন্মে যায়। রকি সেদিন মেসেজে লিখেছিলো,
“ওই পোলা কোন সাহসে আমার সুন্দরীরে আমার থেকে কাইরা নে দেখবো আমি। এক্কেবারে রাস্তায় নামায় ছাড়বো। এরপর আর তুমি তার নাম মুখেও আনবা না। তোমার মুখে শুধুই আমার নাম থাকবো।”
তুবা রকির মেসেজের উত্তরে তাকে না থামিয়ে আরো উসকে দিয়ে বলেছিলো,
“দেখি, কিভাবে আমার স্পর্শকে তুমি রাস্তায় নামাও।”
এরপর পরই পিয়াসা বাড়ি চলে গিয়েছিলো। আর তুবাও কয়েক সপ্তাহ রকির সাথে খুব কম কথা বলেছিলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন রকি তুবাকে জানায় সে স্পর্শের বাবাকে খুন করেছে। আর তখন তুবা বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে, কোনো প্রতিবাদ না করে লিখেছিলো,
“এখন যদি কেউ জেনে ফেলে? তোমার ফাঁসি হবে না? আর তুমি আমাকে জানাচ্ছো কেন এসব? আমি এর মধ্যে ছিলাম না। তোমার যা ইচ্ছা করো। কিন্তু আমার সাথে আর কথা বলো না। আমি নিজেকে ফাঁসাতে চাই না।”
এটাই ছিলো তুবার শেষ মেসেজ। এরপর হয়তো তুবাই রকিকে ব্লক করে দিয়েছিলো।
পিয়াসা ধপ করে তার মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে দিলো। স্পর্শ দেয়ালে হাত চেপে পিয়াসার দিকে ঝুঁকে বসে বললো,
“আর কি প্রমাণ লাগবে তোমার? এগুলো কিভাবে মিথ্যে হয়? আমার ভালোবাসা নিয়ে তুমি তামাশা করেছো। তুমি রকিকে বাধ্য করেছো আমার বাবাকে খুন করতে। আর আমি এসব কিভাবে জেনেছি জানো?”
পিয়াসা স্পর্শের চোখে চোখ রাখলো৷
স্পর্শ বললো,
“দুই বছর আমি ভার্সিটিতে ক্লাস না করেই শুধু পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমি কিন্তু তখন জানতাম রকিই আমার বাবার খুনি। কারণ পুলিশ তদন্ত করে বের করে ফেলেছিলো। ওকে গ্রেফতারও করা হয়েছিলো। কিন্তু কোনো শক্ত প্রমাণ ছিলো না, তাই সে ছাড়া পেয়ে যায়। দুই বছর পর রকির সাথেই ওঠাবসা ছিলো এমন একজনের সাথে আমার দেখা হয়। সে আমাকে চিনতো। আর সে-ই আমাকে এই ঘটনাগুলো জানিয়েছিলো। বলেছিলো তুমিই রকিকে বাধ্য করেছিলো এই খুন করতে। কিন্তু জানো, আমি বিশ্বাস করি নি তার কথা। আমি তোমাকেই বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ তোমাকে খুব ভালোবাসতাম আমি। দুই বছর তোমার নাম না জেনেই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমার অনুভূতি মোটেও মিথ্যে ছিলো না। কিন্তু যেদিন এই চ্যাটের স্ক্রিনশট সেই ছেলেটা আমাকে পাঠিয়েছিলো আমি ভাষায় পাচ্ছিলাম না আর। নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি, এসব মিথ্যে। এই চ্যাটগুলোর প্রতিটি লাইন আমি হাজার বার পড়েছিলাম, যাতে কিছু একটা দেখে আমি ভেবে ফেলতে পারি, এই মেয়ে তুমি নও। কিন্তু এই ছবিগুলো কে পাঠিয়েছে? তুমি কি করতে, কি করতে না সব রকি কিভাবে জানবে তুমিই যদি তাকে না বলো? বলো সুচিস্মিতা?.. ওহ সরি তুমি তো অতিন্দ্রিয়া, না না অতিন্দ্রিয়া তো তোমার ছদ্মনাম। তোমার আসল নাম কি জানি বললে? পিয়াসা আজীজ। এখন বলো, পিয়াসা আজীজ কেন করেছো আমার সাথে এমন ছলনা? ভালো না বাসলে আমার দিকে কেন ফিরে তাকিয়েছিলে? কেন ইশারায় বুঝিয়েছিলে তোমার সম্মতি আছে?”
পিয়াসা বললো,
“আমি শুধু একটাই কথা বলতে পারবো, আমি এই মেয়ে নই। আমি সেই এলাকা রকির কারণেই ছেড়েছি, কারণ সে আমার বাবা-মার কাছে বারবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো। প্রত্যাখ্যান করার পর সে আমার নামে বাজে কথা রটানো শুরু করে দেয়।”
স্পর্শ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কেন রটাবে না বাজে কথা? তুমি তো ওর সাথে নষ্টামিই করেছিলে। তোমার বাবা-মা হয়তো জানেই না, তাদের মেয়ে, তাদেরই আড়ালে কি কুর্কম করছিলো। আর এখন তোমার পাপের শাস্তি তোমার বাবা পেয়েছে।”
পিয়াসা অবাক দৃষ্টিতে স্পর্শের দিকে তাকালো। স্পর্শ বললো,
“আমিই তোমার বাবাকে ফাঁসিয়েছিলাম।”
পিয়াসা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
“আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। কারণ আমার বাবার কথা শুনে তুমি একদমই আঘাত পাও নি। বরং তোমার চোখেমুখে উজ্জ্বলতা ছিলো।”
স্পর্শ দাঁড়িয়ে পিয়াসার এক হাত টেনে ধরে তাকে পাশের খাটে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। তারপর বললো,
“আই হেইট ইউ। আমি তোমাকে ধ্বংস করে দেবো।”
পিয়াসা মলিন মুখে বললো,
“আমি সত্যিই কিছু করিনি।”
“তোমাকে কেন বিশ্বাস করবো আমি?”
“আমার মনে হলো তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে। কারণ আমার ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিলো না। তুমি কি আমার মধ্যে এই কয়েক মাসে কোনো ভুল দেখেছো? এমন কি দেখেছো যা দেখে তোমার মনে হতে পারে আমিই সেই অতিন্দ্রিয়া? একবারো কি মনে হয় নি আমার ভালোবাসা সত্য? আমি সত্যিই তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আর আমাকে কেউ ফাঁসিয়েছে। প্রচন্ড বিশ্রীভাবে ফাঁসিয়েছে। আমাকে বিশ্বাস করো। আমি রকিকে শাস্তি দেবো। কিন্তু একটাবার বিশ্বাস করো।”
“কি শাস্তি দেবে তুমি রকিকে?”
“আমি বলবো। এই চ্যাটগুলো দেখাবো।”
স্পর্শ উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
পিয়াসা অবাক হয়ে বললো,
“হাসছো কেন?”
স্পর্শ বললো,
“বোকা মেয়ে, এইগুলো কি কোনো প্রমাণ হলো? এই প্রমাণ দিয়ে কারো ফাঁসির রায় হয় না। আর এই প্রমাণ তো আমিও দেখাতে পারতাম।”
“তাহলে তুমি বলো কিভাবে রকিকে খুনি প্রমাণ করবে?”
“তুমি রকির কাছে যাবে আর ওর স্বীকারোক্তি নেবে।”
“ঠিক আছে। আমি করবো। কিন্তু যদি ও আমার কোনো ক্ষতি করে?”
“আই ডোন্ট কেয়ার। তোমার সাথে যা ইচ্ছে করুক। আমার শুধু প্রমাণ লাগবে। আমার ওর স্বীকারোক্তির প্রয়োজন।”
পিয়াসা মলিন মুখে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে রইলো।
স্পর্শ বাঁকা হেসে বললো,
“এর আগে তোমার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো ছাড়া পেয়ে উড়ালও দিতে পারো।”
পিয়াসা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ক..কি করবে তুমি?”
স্পর্শ বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো। আর পিয়াসা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তুবার নাম কি সে স্পর্শকে বলে দেবে? এখন হুট করে তুবার নাম নিলেও কি স্পর্শ বিশ্বাস করবে? হয়তো বলবে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে সে। পিয়াসা এই মুহূর্তে এমন একটা অবস্থায় আছে, যেখানে তার সত্য-মিথ্যা কোনো কথারই মূল্য নেই। সেই এই মুহূর্তে স্পর্শের দৃষ্টিতে একজন নিকৃষ্টতর মানুষ।
চলবে–
#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩২:
||
পিয়াসার বাসায় এই মুহূর্তে বিরাজ থমথমে পরিবেশ। মিস্টার এন্ড মিসেস আজীজ মুখ ভার করে বসে আছেন। আর তাদের মুখোমুখি বসে আছেন রিয়াদের বাবা-মা। অন্যপাশে রিয়াদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বাসা ভর্তি আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করছে পিয়াসা তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে।
পিয়াসার বাবা-মা এই সত্যটা না মানলেও বাকীরা মেনে নিয়েছে। কিন্তু রিয়াদ এটা মানতে পারছে না। যদিও সে পিয়াসার হাবভাব দেখে বুঝতে পেরেছিলো যে পিয়াসা হয়তো কোনো চাপের মধ্যে আছে। সে ক্ষণিকের জন্য এটাও বিশ্বাস করে নিয়েছে পিয়াসা হয়তোবা অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু সে এটাও জানে পিয়াসা পালিয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। আর সে কারো সাথেই প্রতারণা করতে পারে না।
রিয়াদ হঠাৎ করেই নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো,
“হয়তো ও কোনো বিপদে পড়েছে, আমাদের উচিত থানায় মামলা করা।”
রিয়াদের কথা শেষ হতে না হতেই পিয়াসার এক আত্মীয় হাতে একটা ডায়েরী নিয়ে পিয়াসার বাবা-মার সামনে বসতে বসতে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“পালিয়ে গেছে আপনাদের আদরের মেয়ে। এই দেখুন, এখানে সে তার প্রেমের গল্পও লিখে রেখেছে। হুহ।”
আজীজ সাহেব ডায়েরী নেওয়ার আগেই রিয়াদ ছোঁ মেরে ডায়েরীটা নিয়ে নিলো। তারপর একটার পর একটা পাতা উল্টিয়ে পড়তে লাগলো। ডায়েরীটার কিছু অংশ জুড়েই লেখা রয়েছে স্পর্শের জন্য তার অপেক্ষায় থাকার মুহূর্তগুলো। তারপর হঠাৎ দেখা, প্রেমের শুরু, আর স্পর্শের পরিবর্তন। তবে ডায়েরীর পাতা শেষ হয়ে যাওয়ায় পিয়াসা স্পর্শের প্রতারণার ঘটনাটি আর লিখতে পারে নি। তবে শেষের পাতায় লিখেছে,
“আমি হারিয়ে ফেলছি প্রিয় মানুষটিকে, যুক্ত হচ্ছে অপ্রিয় স্মৃতি।
তার দেওয়া শুকনো গোলাপ আমার অনুভূতির সাক্ষী হবে, গল্পটারও আজই সমাপ্তি।”
রিয়াদ ডায়েরীটা বন্ধ করে মলিন মুখে বললো,
“এখানে এমন কিছুই নেই, যা দেখলে মনে হবে ও পালিয়ে গেছে।”
রিয়াদের মা রাগী কন্ঠে বললেন,
“তুই ওই মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস কেন?”
“কারণ আমি জানি নিঝুম আমার সাথে প্রতারণা করবে না। হয়তো কাউকে ভালোবাসতো। আর ভালোবাসা তো কোনো অন্যায় না। আমি জানি, ও সম্পর্কটা শেষ করেই আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। নয়তো ও অবশ্যই আমাকে জানাতো এই ব্যাপারে।”
রিয়াদের বাবা বললেন,
“অনেক হয়েছে। কে কি জানাতো তা আমাদের ভাবার বিষয় না।”
তারপর তিনি আজীজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আজীজ সাহেব, আপনার নামে এমনিতেই দুর্নীতির মামলা ছিলো। এতোকিছুর পরও শুধু রিয়াদের খুশির জন্য আমরা রাজী হয়েছিলাম এই সম্পর্কে। ভেবেছিলাম, মেয়ে ভালো হবে। কিন্তু এখন তো দেখছি পুরো পরিবারই ধোঁকাবাজ।”
রিয়াদ তার বাবা-মায়ের মুখ দেখে বুঝে ফেলেছে এই মুহূর্তে তার কিছু বলা ঠিক হবে না। তাই সে চুপচাপ বাবা-মার সাথে বাসায় ফিরে এলো। কিন্তু সে মনকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না। বাসায় এসেই অস্থির ভাবে পায়চারী করতে লাগলো। আর মনে মনে বলতে লাগলো,
“তোমাকে খুব ভালোবাসি নিঝুম। আর ভালোবাসার অপর নাম অপেক্ষা। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। তুমি যখনই ফিরে আসবে তখনই আমাকে পাবে।”
এদিকে-
স্পর্শ পিয়াসাকে এক মিনিটের জন্যও একা ছাড়ছে না। স্পর্শকে দেখে কিডন্যাপার কম, বখাটে প্রেমিক বেশি মনে হচ্ছে। পিয়াসা যতোটুকু জানে কিডন্যাপাররা হাত-পা বেঁধে রাখে, খুব অশ্লীল কথাবার্তা বলে, আবার কখনো কখনো ক্ষতি করারও চেষ্টা করে। কিন্তু স্পর্শ তো তাকে অদ্ভুত সব শাস্তি দিচ্ছে।
সকালে-
স্পর্শ পিয়াসাকে মেঝেতে বসিয়ে তার মুখোমুখি বসে রইলো। পিয়াসাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও যেন স্পর্শের স্বাদ মিটছে না।
পিয়াসা রাগী কন্ঠে বললো,
“কি চাও তুমি এখন? আমি তো বলেছি রকির কাছে যাবো আর ওর স্বীকারোক্তি নেবো। তবু্ও……”
স্পর্শ পিয়াসাকে থামিয়ে দিয়ে তার আরো কাছে এসে বসলো। তারপর ঘোর লাগানো কন্ঠে বললো,
“সুচিস্মিতা, আমি আবার তোমার মায়ায় পড়ে যাচ্ছি।”
পিয়াসা অদ্ভুত দৃষ্টিতে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর স্পর্শ পা দুটো ভাঁজ করে পিয়াসাকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে পিয়াসার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করলো। এদিকে পিয়াসা স্পর্শের এমন আচরণে কিছুটা ইতস্ততবোধ করতে লাগলো।
স্পর্শ বললো,
“তুমি এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কি কি খাবে তার লিস্ট আমাকে জানাবে। তোমার জন্য আমি নিজ হাতে রান্না করবো।”
স্পর্শের মুখে এমন কথা শুনে পিয়াসা অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। স্পর্শ মায়া জড়ানো চোখ দুটি নাচিয়ে বললো,
“কি হলো, বলো?”
পিয়াসা নির্বিকার ভাব নিয়ে বললো,
“আমি কিচ্ছু খাবো না।”
স্পর্শ বাঁকা হেসে বললো,
“তুমি সোজাসুজি উত্তর না দিলে আমি কিন্তু ভিন্ন পথ ধরতে পারি।”
“কি করবে তুমি?”
স্পর্শ প্যান্টের পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। তারপর সেখান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তা লাইটার দিয়ে ধরালো। পিয়াসা বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো, স্পর্শ তার সাথে কি করতে চাইছে। সে মনে মনে ভাবছে,
“স্পর্শ কি জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে আমার হাত-পা জ্বালানোর চিন্তা করছে? ও কি সত্যিই আমাকে আঘাত করবে?”
কিন্তু পিয়াসাকে অবাক করে দিয়ে স্পর্শ এসব কিছুই করলো না। সে পিয়াসার সামনে বসেই একের পর এক সিগারেট খেতে লাগলো, আর ধোঁয়া গুলো পিয়াসার মুখের আশেপাশে ছাড়তে লাগলো। পিয়াসা কাশতে কাশতে বললো,
“আমার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে, স্পর্শ।”
স্পর্শ সিগারেট নিভিয়ে পিয়াসার হাত ধরে তাকে জানালার পাশে নিয়ে দাঁড় করালো। তারপর ফিসফিস করে বললো,
“এখন বলো, কি খাবে?”
পিয়াসা স্পর্শকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? কি করতে চাইছো তুমি আমার সাথে?”
স্পর্শ চেঁচিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, হয়ে গেছি। আমি নিজেই বুঝতে পারছি না আমি কি করবো তোমার সাথে। যাকে ভালোবেসেছি, সেই আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। এখন তাকে কিভাবে শাস্তি দেবো আমি?”
পিয়াসা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
“তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসো নি। যা ছিলো সব তোমার আবেগ। আর আবেগ বেশিদিন স্থায়ী হয় না, যেমনটা তোমার হয় নি।”
“কোনটা আবেগ আর কোনটা ভালোবাসা, সেটার দেখছি খুব জ্ঞান আছে তোমার?”
“জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। নিজেকে দেখেই জানা হয়ে গেছে।”
স্পর্শ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
“বাহ বেশ তো। এখন আমি কি জানতে পারি কার ভালোবাসায় তুমি এতো জ্ঞানী হয়ে গেছো? কে সেই ব্যক্তি যে তোমাকে জানিয়েছে ভালোবাসার অর্থ?”
পিয়াসা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
“তোমার সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে।”
স্পর্শ পিয়াসার কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে গেলো। পিয়াসার হাত চেপে ধরে বললো,
“তোমাকে আদর করেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি খেতে চাও। কিন্তু না, তুমি তো সোজাসুজি কথা বলতেও পছন্দ করো না। এতোকিছু আমি কেন সহ্য করছি? শুধু তোমাকে খাওয়ানোর জন্য? দাঁড়াও, খাওয়াচ্ছি তোমাকে।”
স্পর্শ পিয়াসাকে ছেড়ে দিয়ে হন হন করে রুমের বাইরে চলে গেলো। এরপর প্রায় দশ মিনিট পর একটা ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকলো। তারপর টেবিলের উপর ট্রেটা রেখে পিয়াসাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। পিয়াসা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ক…কি করছো তুমি?”
স্পর্শ কোনো উত্তর না দিয়ে পিয়াসার মুখে জোর করে একটা রুটির টুকরা পুরে দিলো। পিয়াসা রুটি মুখে নিয়ে স্পর্শকে সরানোর চেষ্টা করছিলো, কিন্তু স্পর্শ আরো শক্ত করেই পিয়াসাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললো,
“তুমি এখন এইখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবে। একটুও নড়াচড়া করতে পারবে না। এইটা তোমার শাস্তি। আমার কথা সোজাসুজি না শুনে বাঁকা বাঁকা কথা বলার জন্য।”
পিয়াসা আর কিছুই বললো না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সকালের নাস্তাটা করলো। এই অদ্ভুত শাস্তি দেখে পিয়াসা মনে মনে ভাবছে, সে একটা পাগলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যার মাথার স্ক্রু খুলে পড়ে গেছে।
নাস্তা খাওয়ানোর পর থেকেই স্পর্শ এক দৃষ্টিতে পিয়াসার দিকে তাকিয়ে আছে। আর পিয়াসা ইতস্তত ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। শেষমেশ বিরক্ত হয়েই বললো,
“তুমি এভাবে কেন তাকিয়ে আছো? অদ্ভুত!”
স্পর্শ মুখ টিপে হেসে বললো,
“তোমার শাস্তি।”
পিয়াসা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“যখন থেকে এখানে বন্দি করে রেখেছো তখন থেকেই বলছো তোমার শাস্তি, এটা, ওটা। এখন আমার তো মনে হচ্ছে তুমি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছো।”
পিয়াসার কথা শুনে স্পর্শ মুখ ঘুরিয়ে মলিন হাসলো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পিয়াসার এই হাসিটা সহ্য হলো না। সে বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। ভাবতে লাগলো, স্পর্শ কি তার কথায় কষ্ট পেয়েছে? নয়তো হুট করে কেনই বা স্পর্শের মুখের উজ্জ্বলতা হারিয়ে যাবে? এতোক্ষণ তো খুব হাসিখুশি লাগছিলো তাকে।
পিয়াসা সত্যিই খুব কষ্ট পেয়েছে। এই ছেলেটাই তাকে একটার পর একটা আঘাত করে যাচ্ছে। কিন্তু পিয়াসা কোনোভাবেই তাকে ঘৃণা করতে পারছে না। আবার ভালোবাসতেও পারছে না। সে এক মিশ্র অনুভূতির মাঝে অবস্থান করছে। তবে সেই অনুভূতিতে যে স্পর্শ এখনো খুব গাঢ় ভাবে আছে, তার কোনো সন্দেহ নেই।
স্পর্শ হঠাৎ উঠে চলে গেলো। এরপর আর রুমে এলো না। সে ড্রয়িংরুমের সাথে লাগানো একটা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। আর মনটাও খচখচ করছে। গলায় কি যেন আটকে গেছে মনে হচ্ছে, কথা বেরুনোরও উপায় নেই। স্পর্শ ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগলো। তখনই সিয়াম তার পাশে এসে দাঁড়ালো। সিয়ামকে দেখে যেন স্পর্শ আর নিজেকে সামলাতেই পারলো না। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
সিয়াম স্পর্শকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস?”
“আমি ওকে এখনো ভালোবাসি। আমার কোনো ক্ষমতা থাকলে, আমি আজীবন এই ঘরেই ওকে বন্দি করে আমার সামনে বসিয়ে রাখতাম। আমি ওকে বাধ্য করতাম, আমাকে ভালোবাসার জন্য। সিয়াম, আমার না সত্যিই সুচিস্মিতাকে খুব প্রয়োজন। আমি ওকে ছাড়া ভালো থাকবো না। কিন্তু দেখ, ওই মেয়েটা তো আমাকে ভালোই বাসে না। আমার সাথে শুধুই ছলনা করেছে সে।”
“তোর হাতে যেই প্রমাণটি আছে, সেটা বলছে পিয়াসাই অপরাধী, কিন্তু সে নিজে বলছে সে অতিন্দ্রিয়া নয়, সে পিয়াসা, আর এসব সে করে নি। তাহলে তুই বুঝেশুনে দেখ, আসলেই কি কোনো ফাঁক রয়ে গেছে কিনা?”
স্পর্শ শান্ত হয়ে বললো,
“এক মিনিটের জন্য মানলাম পিয়াসা এসব কিছুই জানে না। তাহলে এই অতিন্দ্রিয়াটা কে? কে করেছে এসব? আর কে-ই বা আমাদের সম্পর্কে জানতো, পিয়াসা সম্পর্কে এতো নিখুঁতভাবে অন্য কারো ধারণা কি থাকতে পারে?”
সিয়াম কিছু একটা ভেবে বললো,
“যদি মেয়েটা পিয়াসা না হয়, তাহলে পিয়াসার খুব কাছের কেউ হবে। কিন্তু কে এমন করবে? পিয়াসার তো কোনো বোন নেই। সে একাই থাকে।”
স্পর্শ হঠাৎ করেই জ্বলে উঠলো। সিয়াম তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। স্পর্শ বললো,
“পিয়াসা একা থাকতো না। আগের এলাকায় যখন ছিলো, আমি একটা মেয়েকে মাঝেমধ্যে পিয়াসার সাথে দেখতাম। সেই দিন ঘর দেখার সময়ও সেই মেয়েটা ছিলো। আরেকবার তাকে পিয়াসার সাথে বাইরে দেখেছিলাম। সেদিন পিয়াসার অল্পের জন্য এক্সিডেন্ট হয় নি। অথচ মেয়েটা এতোটাই ফোনে মগ্ন ছিলো যে, তার সেদিকে খেয়ালই নেই।”
“কি নাম মেয়েটার?”
“মনে পড়ছে না। তবে পিয়াসা বলেছিলো আমাকে।”
স্পর্শ দুপুরের খাবার নিয়ে আবার পিয়াসার কাছে এসে বসলো। তারপর নরম কন্ঠে বললো,
“পিয়াসা, খেয়ে নাও।”
স্পর্শের মুখে এই প্রথম নিজের নাম শুনে কেমন যেন লাগলো পিয়াসার। পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। ভালোলাগা ভীড় করতে লাগলো মনে। স্পর্শের মুখে তার নামটা এতো মানাবে সেটা কল্পনায় করে নি পিয়াসা। এরপর করুণ দৃষ্টিতে সে স্পর্শের দিকে তাকালো। স্পর্শ ভাত মেখে পিয়াসার মুখে পুরে দিতে দিতে বললো,
“তোমার সাথে একটা মেয়েকে মাঝে মাঝে দেখতাম। কে সেই মেয়ে? কি নাম তার?”
কথাটি শুনেই পিয়াসার গলায় ভাত আটকে গেলো। চোখ বড়ো বড়ো করে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে পাশে থাকা গ্লাসে পানি ভর্তি করে তা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। স্পর্শ পিয়াসার হাবভাব দেখে বুঝতে পারলো, সে কথাটি শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। স্পর্শ এরপর আর কিছুই বললো না। এদিকে পিয়াসার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। স্পর্শ কেন জিজ্ঞেস করছে তুবার কথা? সে কি তুবাকে সন্দেহ করছে? এখন কি তার মতো তুবাকেও তুলে নিয়ে আসবে?
স্পর্শ আর কি কি করতে পারে সেটাই বসে বসে ভাবতে লাগলো পিয়াসা।
||
চলবে-