উপসংহার #পার্টঃ১

0
1842

#উপসংহার
#পার্টঃ১
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)

পাত্রপক্ষ বাড়ির ছোট মেয়েকে দেখতে এসে পাত্র বাড়ির বড়, বিধবা আর পাত্রের থেকে ৩ বছরের বড় মেয়েকে পছন্দ করায় বাড়িতে একপ্রকার মাতম শুরু হলো। মাতম বললে বোধহয় ভুল হবে না। যেভাবে সবাই হৈ হৈ শুরু করেছে তাতে মনে হচ্ছে কেউ মারা গেছে। এতো বেশি উত্তেজনা আশেপাশের কয়েক বাড়ি পর্যন্ত যে কিভাবে পৌছালো তা পাত্রীর বাড়ির লোকজন বুঝে উঠতে পারলো না। এতসব হৈচৈ চিৎকার চেচামেচি পুরো এলাকাকে নাড়িয়ে দিলেও যাকে নিয়ে ঘটনা সেই বাড়ির বড়, বিধবা, ৩৩ বছর বয়সী মেয়ে শ্রাবণীকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করছে না। শ্রাবনী আপন মনে রান্নাঘরে কাজ করে যাচ্ছে। পাত্রপক্ষ এখনো বসার ঘরে বসে আছে। বাবা মায়ের সাথে তাদের মৃদু বাগবিতন্ডা চলছে। বাড়ির পাঁচিলের আশেপাশে উৎসুক জনতা শেয়ালের মতো উঁকিঝুঁকি মারছে। শ্রাবনী সব দেখেও এড়িয়ে গেলো। চুলায় তরকারি চাপিয়ে পেঁয়াজ কাটায় মন দিলো। বসার ঘর থেকে কথাগুলো তার কান পর্যন্ত এসে পৌছাচ্ছে। শ্রাবনীর মনে হলো “আচ্ছা মানুষ নিজের চোখ যখন ইচ্ছা তখন বন্ধ করতে পারে কিন্তু কানের ক্ষেত্রে এমন কোন উপায় নেই কেন? কোন কিছু না দেখতে চাইলে মানুষ তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলতে পারে কিন্তু কোন কিছু না শুনলে কান কেন বন্ধ করতে পারে না?” কান বন্ধ করার উপায় নেই ভাবনাটা মাথায় আসতেই শ্রাবণীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

বসার ঘরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন তিনজন। শ্রাবণী, শ্রাবণীর ছোট বোন হেমা আর পাত্র সিয়াম। সিয়াম হেমাকে দেখতে এসে শ্রাবণীকে পছন্দ করে নিয়েছে। এটা নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে সমস্যা হচ্ছে। শ্রাবণীর বাবা ক্ষুব্ধ সিয়ামের উপরে হেমাকে পছন্দ না করে শ্রাবণীকে পছন্দ করে অকপটে সবার সামনে বলে দেয়া কারণে। শ্রাবণীর বাবা মাজিদ বললেন,

— দেখো সিয়াম, শ্রাবণীকে তো তুমি বিয়ে করতে পারবে না। ও তোমার থেকে বয়সে বড় আর বিধবাও। তুমি কিভাবে এমন একটা মেয়েকে পছন্দ কর‍তে পারলে?

সিয়াম মাজিদের কথা হতবাক হয়ে গেলো। একজন বাবা তার মেয়েকে নিয়ে এমন কথা বলছে? আচ্ছা শ্রাবণী এদের আপন মেয়ে তো? নিজের মেয়েকে “এমন একটা মেয়ে” বলতে কি বুঝাচ্ছে? সিয়াম নিজেকে সংযত করে বলল,

—আমার থেকে বড় আর বিধবা হয়েছে তো কি হয়েছে? এখন তো উনি বিবাহিত নন। তাহলে অনায়াসে তাকে বিয়ে করা যায়। আমার শ্রাবণীকেই ভালো লেগেছে

সিয়ামের বাবা আকবর বললেন,

— দেখেছেন আজকালকার ছেলেগুলোকে? লেখাপড়া শিখে, দুই পাতা বই পড়ে সমাজের নিয়ম অগ্রাহ্য করছে। আরে বাবা সমাজের নিয়ম বলেও তো কিছু আছে নাকি?

সিয়ামের মা রোজিনা বললেন,

— ছেলেমেয়েগুলো তো এখন বাবা-মায়ের কথা শোনেই না। আরে বাবা, তোদের ভালোর জন্যই তো সব বলি। বাপ মা কি তোদের খারাপ চাইবে?

শ্রাবণীর মা শরিফা,রোজিনার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন। সিয়াম অবাক হয়ে সবার কথা শুনতে থাকলো। একুশ শতকে বসে মানুষ এমন কথাও বলে? মানা যায় তারা আগের আমলের মানুষ। চিন্তা ভাবনা সনাতনী। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কি একটুও পরিবর্তন হবে না? সিয়াম বলল,

— বাবা মা, চাচা চাচী বিয়েটা আপনারা দিচ্ছেন হয়তো। কিন্তু জীবনটা আমার। বিয়েটা আমিই করবো আর আমার স্ত্রীর সাথে সারাজীবন আমিই কাটাবো। আপনারা নিশ্চয়ই আমার হয়ে সংসারটা করে দিবেন না? তাহলে আমার পছন্দটাকে নিয়ে আপনাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত না?

রোজিনা চোখ পাকিয়ে বলল,

— জীবনটা তোমার কিন্তু জীবনে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমরা সেখানে বাধা দিবোই। বয়সে বড় মেয়েকে পছন্দ করেছো। বিয়ের পরে তোমার উপর খবরদারি করবে। দেখা যাবে সে উঠতে বসলে উঠছো বসতে বললে বসছো। এমনটা হবে না। তারপর আবার স্বামী মরা। নিজের দূর্ভাগ্য আবার আমাদের বাড়িতে টেনে আনবে। তাই যে সিদ্ধান্ত নিতে পারো না তা নিয়ে কথা বলো না

সিয়াম মায়ের কথায় অপমানবোধ করলো। মা তার সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেনো সে এখনো বাচ্চা। অথচ সে ৩০ বছর বয়সী একজন মানুষ। সারাদেশে যার বিভিন্ন জিনিসের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে।তাছাড়া মায়ের কথাবার্তার মধ্যে কুফরির প্রভাবও আছে। কারোর দূর্ভাগ্য কেউ টেনে আনে না। মানুষ নিজের ভাগ্য আল্লাহর থেকে নিজেই নিয়ে আসে। সঠিক ধার্মিক শিক্ষার অভাব! সে আড়চোখে শ্রাবণীর বাবা মায়ের দিকে তাকালো। তারা নির্বিকার মুখে বসে আছে। নিজের মেয়ের নামে এতো কথা শুনেও প্রতিবাদ করছে না। সিয়ামের চোখ বসার ঘরের সাথে লাগোয়া জানালার দিকে চলে গেলো। জানালাটা বাড়ির ভিতরের দিকের সাথে যুক্ত। পর্দা নড়ে উঠায় সিয়ামের চোখ চলে গেছে। হয়তো কেউ দাঁড়িয়ে ছিলো। সিয়ামের মনটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেলো। জানালার ওপাশে দাঁড়ানো মেয়েটা হেমা না তো? হেমা কি তার কথায় কষ্ট পেয়েছে? হেমাকে সিয়ামের বিয়ের উপযুক্ত মনে হচ্ছে না। নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। কত বয়স হবে? ২১ বা ২২। সবে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। চোখে মুখে এখনো বাচ্চামী। তার সাথে এমন মেয়ে যায় না।
সিয়ামের ফোন বেজে ওঠায় সে বসার ঘর থেকে উঠে আসলো। ভিতরের দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ফোনটা বের করে দেখলো সার্ভিস সেন্টার থেকে ফোন দিয়েছে। ফোন কেটে দিয়ে সিয়াম বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলো। ঘরের সামনের এই লম্বা বারান্দায় কোমড় পর্যন্ত রেলিং তারপর গ্রিল দেয়া। ওখান থেকে রান্নাঘরের জানালা দেখা যাচ্ছে।
সিয়ামের চোখ সেখানে আটকে গেলো। শ্রাবণীকে দেখা যাচ্ছে। আগুনের লাল আচে গাল লাল হয়ে আছে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কি ভাবছে শ্রাবণী? শ্রাবণীর মনের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখার ইচ্ছা জাগলো তার।আচ্ছা সে যদি এখন শ্রাবণীকে গিয়ে বলে ” চা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব। বানিয়ে দিবেন? আর বানানোর সময় আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন না। আমি আপনার সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করবো” তাহলে শ্রাবণী কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে?
সিয়াম শ্রাবণীর সম্ভাব্য কথাগুলোকে ভাবার চেষ্টা করছে।
এক. শ্রাবণী চোখ মুখ শক্ত করে বলবে আপনি যান আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি হেমার হাতে।
দুই. শ্রাবণী বলবে একবার চা খেয়েছেন আবার চাচ্ছেন? আচ্ছা লোভী লোক তো আপনি!
তিন. হেসে বলবে দাঁড়ান আমি বানিয়ে দিচ্ছি।

বড় বোন হিসেবে এক নম্বরটা করার সম্ভাবনাই বেশি। সিয়াম খেয়াল করলো সে অনেকক্ষন যাবত একটানা শ্রাবণীকে নিয়ে ভেবে যাচ্ছে আর কোন বিরক্তিও আসছে না। বরং দারুণ লাগছে। যখন হেমাকে দেখার জন্য যখন এই বাসায় পা দিলো তখন সে আগে আগে এসেছে। বাবা-মা পিছনে ছিলো। আসার পর বাইরে থেকেই দেখতে পেলো ঘরের ভিতরে শ্রাবণী একজন মহিলার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। এরপর যখন তাকে হুট করে দেখলো তখন চমকে ওঠার পরে জড়তা ছাড়াই বললো “ভিতরে আসুন”। এরপর শ্রাবণী আর তাদের সামনে আসেনি।
মানুষ ঠোঁটে হাসে। কিন্তু চোখে হাসার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই থাকে। শ্রাবণীও তার মধ্যে একজন। যখন হাসছিলো তখন কেবল তার ঠোঁট না চোখও হাসছিলো। কে জানে হয়তো পুরো শরীরই হাসছিলো। সে খেয়াল করেনি। আবার যখন চমকে উঠলো তখন সেটাও চোখেই। মেয়েটার সবকিছুই চোখ কেন্দ্রিক মনে হয়! সেই চোখেই বোধহয় সে আটকে গেছে।
ভিতর থেকে চাপা আওয়াজে শুনতে পেলো বাবা বলছেন,

—মাজিদ ভাই আপনি চিন্তা করবেন না। ছেলের কম বয়স তাই মাথা গরম। কি থেকে কি বলেছে। আমি হাজী মানুষ। আমি নিজের কথার বরখেলাপ করবো না। আপনার বাড়ির মেয়েই আমার বাড়ির বউ হবে।

সিয়াম বুঝলো না তার বাবা কোন কথার বরখেলাপের কথা বলছে? তার বিয়ে নিয়ে কি তার মতামত ছাড়াই কোন কথা দিয়েছে নাকি? কিন্তু এতোদিন তো বাসায় বাবা মা তার বিয়ে নিয়ে কোন কথায় বলেনি! বসার ঘর থেকে সবাইকে বাইরে বের হয়ে আসতে দেখে সিয়াম নিজের বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। বাবা দুই বছর আগে হজ্ব করে এসেছে। হজ্ব করার পরে জীবনযাপনে অত্যন্ত সাবধানও হয়েছেন। কাউকে কোন কথা বলার আগে বা দেয়ার আগে ভেবেচিন্তে দেন আর কথা রাখেনও। তারমানে বিয়ের কথাটাও ভেবে চিন্তেই দেওয়া। সিয়াম ছোট শ্বাস ফেলল। সামনে বাবার সাথে তার বিরোধ দেখা দিতে চলেছে হয়তো। তাকে না জানিয়ে কথা দেয়াটা বাবার উচিত হয়নি একদম।
সবাইকে আসতে দেখে শ্রাবণী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো। কচুপাতা রঙের শাড়ি পরা। কানের কাছের ছোট চুলগুলো মুখের সাথে লেপ্টে আছে। উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটাতে ক্লান্তির ছাপ। সিয়াম লক্ষ্য করলো সে বাদে বাকি সবাই শ্রাবণীর দিকে বিদ্বেষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য শ্রাবণীর কি দোষ? শ্রাবণী তো তাকে পছন্দ করেনি। সে করেছে! সবাই শ্রাবণীর উপর এমন বিতৃষ্ণার নজর কেন দিচ্ছে?
শ্রাবণী সবার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল,

—চাচা চাচি আবার আসবেন

কেউ তার কথার উত্তর দিলো না। সবাই কেমন করে যেনো তাকালো। সিয়াম শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকালো। এবারে আর চোখ হাসছে না। বরং বিষাদের রেখা দেখা যাচ্ছে। সিয়ামের মনটা খারাপ হয়ে গেলো খানিক। আকবর মাজিদের হ্যান্ডশেক করে বলল,

—আজ আসি। ওই কথা থাকলো। বাদ বাকি কথা পরে বলবো ইনশা আল্লাহ

—জ্বি ইনশা আল্লাহ।

সিয়ামের পরিবার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে শরিফা শ্রাবণীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—বাড়িতে লোক আসলেই তাদের সামনে যেতে হবে কেন? নিজেকে সবার সামনে না দেখালে তো ভালো লাগে না! তোমার নিজের জীবন না থাকুক হেমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে! এভাবে সবার সামনে নিজেকে দেখিয়ে বেড়াবে না একদম! ছি ছি কি ঘটনা। পাড়া পড়শিরা তো সব জেনে গেছে। এবার কাদা ছোড়াছুড়ির পালা। মনে রেখো তোমার কাদা গায়ে নেয়ার অভ্যাস থাকলেও হেমার নেই।

শ্রাবণী মায়ের চোখের দিকে তাকালো। এবং কিছুক্ষণ তাকিয়েই থাকলো এক দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টিতে কি ছিলো সেটা শরিফার জানা নেই। কিন্তু তিনি শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। নজর সরিয়ে নিলেন। শ্রাবণীও চোখ সরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here