উপসংহার #পার্টঃ২

0
1102

#উপসংহার
#পার্টঃ২
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)

পিছন থেকে শ্রাবণীর কোমড় কেউ জাপটে ধরায় সে বেশ ভড়কে গেলো। বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠলো। পিছনের মানুষটার গায়ের গন্ধ নাকে আসতেই শ্রাবণী স্বাভাবিক হয়ে গেলো। কাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,

— খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি?

হেমা আহ্লাদী স্বরে বলল,

—ঘুম আসছে আপা। ঘুমাবো তোমার কোলে মাথা রেখে।

— আমার হাতে অনেক কাজ যে এখন। মায়ের কাছে যা। মাকে বললে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।

হেমা রান্নাঘরে পিড়ের উপর বসতে বসতে বলল,

— মায়ের কাছে যেতে হলে সোজা মায়ের কাছেই যেতাম। তোমার কাছে আসতাম না। তোমার কাছে যে শান্তি খুঁজে পাই সেটা কি মায়ের কাছে পাওয়া সম্ভব?

কড়াইয়ে ডাল দিয়ে শ্রাবণী হেমার মুখোমুখি বসলো। বোঝার চেষ্টা করলো হেমা কি চুপিসারে কান্না করেছে? সিয়ামের কথাগুলো হেমার কানেও নিশ্চয় গিয়েছে? যেকোন মেয়ের জন্যই এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর তাকে দেখতে এসে তার বড় বোনকে পছন্দ করে নিয়েছে। অনেকটা কষ্টকর। আর আজ থেকে চারবছর আগে যখন হেমা আর সিয়ামের বিয়েটা ঠিক হয় তখন থেকেই সিয়ামের প্রতি হেমার আবেগ কাজ করে। সেই আবেগের গভীরতা কতটা সেটা শ্রাবণী ঠাওর করতে পারেনা। হেমা নিশ্চয়ই চার বছরে অনেক স্বপ্ন বুনেছে। এই স্বপ্ন গুলো যখন ভেঙে যাওয়ার পথে তখন হেমা কিভাবে এই কষ্টের মুখোমুখি হচ্ছে সেটাই শ্রাবণী বোঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটা আজকাল কান্না লুকানো শিখে গেছে। শ্রাবণী জিজ্ঞেস করলো,

— মায়ের উপর তোর এতো ক্ষোভ কেন বলতো?

— তুমি ভালো করেই জানো আপা কেন মায়ের উপর আমার এমন বিতৃষ্ণা।

— মা তো মা-ই হয়। তুই মায়ের সম্পর্কে এমন ধারনা মনের মধ্যে পুষে রেখে ঠিক করছিস না।

হেমা হাই তুলতে তুলতে বলল,

— মা মা-ই হয়। ঠিকই বলেছো। মাকে আসলে মায়ের মতোই থাকা উচিত। কিন্তু মা যদি…

হেমা কথাটা শেষ করলো না। শ্রাবণী হেমার গা ঘেষে বসলো। হেমার এখন একটা শক্ত কাঁধের প্রয়োজন। যে কাঁধে মাথা রেখে কান্না করতে পাবে। কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারবে। হেমা শ্রাবণীর হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। বেশ কিছু সময় পরে বলল,

—চিন্তা করিস না। মানুষের সাময়িক আবেগের স্থায়িত্ব খুব বেশি না। বড়রা সবাই আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি তোর অন্য কাউকে পছন্দ থাকে আমাকে বল। আমি নিজে তার হাতে তোকে তুলে দিয়ে আসবো।

হেমা কোন উত্তর দিলো না। সে জানে আপা তার জন্য যতটা সম্ভব ততটাই করবে। দরকার হলে পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করবে তবুও তার গায়ে একটা আচড় লাগতে দিবে না। আপাকে “মা” বলে ডাকলেও কিছু ক্ষতি হবে না। হেমার সবসময় মনে হতো ইশ! যদি সে আপার জন্য কিছু করতে পারতো! ঋণের একাংশও শোধ করতে পারতো? সেই সুযোগ হয়তো আসছে ক্ষীণ পায়ে। আপা এতোদিন তার জন্য করে গেছে। এখন যদি দরকার হয় সে লড়াই করবে। হেমা বলল,

— তোমার প্রাইভেটের সময় হয়ে যাচ্ছে না? যাবা না? এখনও রান্নাঘরে বসে আছো?

শ্রাবণী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বলল,

— রান্নাটা শেষ করে নিই

— আপা তুমি যাও। গোসল করে নাও। আমি বাকিটুকু গুছিয়ে নিচ্ছি। কয়েকটা ব্যাচ পড়াতে হবে তো তোমাকে!

শ্রাবণী হেসে বলল,

— বাহ মেয়ে তো বড় হয়ে গেছে। ভালোই। এরপর বিয়ে হয়ে গেলে সব সামলাতে সুবিধা হবে।

হেমা ডাল নাড়তে নাড়তে বলল,

— একটা কাজ করলে কেমন হয় আপা? আমি আর তুমি দুজনই সিয়াম সাহেবের সাথে বিয়ে করে নিই কেমন? তাহলে ভালোই হবে। সবার মনঃষ্কামনাই পূর্ণ হবে। যে যাকে চায় তাকে পাবে। আর আমি তোমার চোখের সামনে না থাকলে তুমি অস্থির হয়ে যাও। একই সাথে বিয়ে হলে আমাকে চোখের সামনে পাবে। আমিও তোমাকে কাছে পাবো। সব দিক একদম পারফেক্ট।

হেমা গা দুলিয়ে হাসতে থাকলো। শ্রাবণীর কাছে এই হাসি অপ্রকৃতস্থর মতো ঠেকলো। হেমা কি খুব গভীর ভাবে আঘাত পেয়েছে? নাহলে এমন অদ্ভুত কথা বলছে কেন আর এমন ভাবে হাসছেই বা কেন? শ্রাবণীর বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। সে বলল,

— কি যা-তা বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর? বুঝেছি তোকে শশুরবাড়িতে পাঠাতে হবে।

হেমা মুচকি হেসে বলল,

— খারাপ হবে না কিন্তু। ভেবে দেখতে পারো এটা।

শ্রাবণী পলকহীন চোখে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। নিজের স্বামীর ভাগ দেয়ার কথা এতো অবলীলায় কিভাবে বলছে হেমা? নাকি ওর জীবনে অন্য কারোর আগমন ঘটেছে? শ্রাবণী ভেবেও কোন কূল কিনারা করতে পারলো না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকার ফুসরত পেলো না। শ্রাবণী রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় পিছন থেকে হেমা জিজ্ঞেস করলো,

—তুমি কিভাবে পারো বলো তো আপা? আমাকে একটু শিখিয়ে দাও। কিভাবে মায়ের সাথে এতো সাবলীল ভাবে দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছো একই ছাদের নিচে? আমার পক্ষে তো কখনো সম্ভব হতো না।

শ্রাবণী কোন উত্তর দিলো না। পিছনে ঘুরে দেখলো হেমা উত্তরের অপেক্ষা না করে কাজে মগ্ন। হয়তো হেমা জানে এই প্রশ্নের উত্তর সে কখনোই পাবে না।
,
,
,
?
গোসল শেষে বকুল ফুলের গন্ধ নাকে আসতেই শ্রাবণী ঘরের সাথে লাগানো এক চিলতে বারান্দায় চলে আসলো। বারান্দার সাথে লাগোয়া গাছটার নিচে ফুল ঝরে পড়ে আছে। হেমা আজ কুড়ায়নি। শ্রাবণী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জীবনে নতুন কোন ঝড় আসতে চলেছে বুঝতে পারছে না। তবে সেই ঝড়ে যে তার কলিজার টুকরা বোনটার জীবনটা উল্টে পাল্টে যাবে সেটা আঁচ করতে পারছে। তবে মনে মনে ঠিক করে নিলো তার নিজের জীবনটার তো ঠিক নেই। কিন্তু বোনের জীবনটা কোন ভাবেই নষ্ট হতে দিবে না।
ঘরে আসতেই বিছানার উপরে হেমার ডায়েরীটার উপরে চোখ গেলো। খুলে দেখবে কি একবার? ঠিক হবে? শ্রাবণী দোটানায় পড়লো। প্রায়ই হেমাকে এই ডায়েরীটাতে কিছু লিখতে দেখে। কখনো জিজ্ঞেস করেনি কি লিখছে। সবারই একান্তই নিজের বলে কিছু জিনিস থাকে। সেখানে বাইরে কারোর প্রবেশাধিকার থাকে না। তবে শ্রাবণী ঠিকই বুঝতে পারে হেমার সেই একান্তই ব্যক্তিগত জীবনে তার প্রবেশাধিকার হেমা নিজেই দিয়ে রেখেছে। ডায়েরীটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবনার পরে রেখে দিলো। তাকে টিউশানি পড়াতে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি গায়ে বোরখাটা চড়িয়ে বের হওয়ার সময় বাড়ির উঠানের অপর পাশ থেকে গানের আওয়াজ পেলো।

“…তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
আমার সাধ্য কিবা তোমারে-
দয়া না করিলে কে পারে-
তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে”

শ্রাবণী দাঁড়িয়ে থেকে হেমার কথাগুলোর মর্ম উপলব্ধি করতে। হেমা তার উপস্থিতি টের পায়নি। শালিক পাখিকে পুরানো ভাত দিতে দিতে গান গাইছে। হঠাৎ গান থামিয়ে বলতে শুরু করলো,

— পাখি মহাশয়েরা কি খবর? আশা করি সবাই ভালোই আছেন;

একটু থেমে আবার বলল,

—সবসময় মানুষের জন্য ভালো কাজ করার চেষ্টা করবেন বুঝলেন? না না মানুষের জন্য না। আপনারা পক্ষীকূলের। তাই পাখিদের জন্য ভালো কাজ করার চেষ্টা করবেন। সবাইকে ভালোবাসার চেষ্টা করবেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— বিশেষ করে তাদেরকে যারা আপনাকে অনেক ভালোবাসে। ভালোবাসার মূল্য দিবেন। মূল্যহীন ভালোবাসার থেকে যন্ত্রণাদায়ক আর কিছুই হয়না। যে আপনাকে চায়না তাকে কি কোন ভাবে নিজের পিঞ্জরে আনা যায়? তাই যে সবটুকু উজার করে দিতে রাজী তার হাতটা শক্ত করে ধরবেন। আচ্ছা আপনারা তো আবার হাত ধরতে পারবেন না। তাহলে তার ডানা শক্ত করে ধরবেন। ডানা ধরে আমার কাছে আসবেন আমি আপনাদের বিয়ে দিয়ে দিবো। বুঝলেন পাখি মহাশয়েরা?

শ্রাবণী বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। হেমার কথাটা তার মাথায় ঘুরতে থাকলো। “যে আপনাকে চায়না তাকে কি কোন ভাবে নিজের পিঞ্জরে আনা যায়? যে সবটুকু উজার করে দিতে রাজী তার হাতটা শক্ত করে ধরবেন।”
সিয়াম এই সমাজের সব সমস্যা জেনেও তার মতো বেশি বয়সের বিধবা মেয়ের হাতটা ধরতে চাচ্ছে তাতে কি তার সায় দেয়া উচিত? হেমার কথা অনুযায়ী যে সবটা উজার করে দিতে রাজী তার সঙ্গী কি হওয়া যায়?
শ্রাবণী এক চক্রের মধ্যে পথ হারানোর পথিকের ন্যায় ঘুরতে থাকলো।
,
,
,
?
টাকার একটা হিসাব অনেকক্ষণ ধরে মেলানোর চেষ্টা করেও সিয়াম মেলাতে পারছে না। কোথায় যে গড়বড় হয়েছে সেটা ধরতে পারছে না। রোজিনা এক কাপ চা সিয়ামের সামনে রাখতে রাখতে বললেন,

—তোর সাথে আমার কথা আছে সিয়াম

কাজ করতে করতেই সিয়াম বলল,

—আমি এখন কাজে ব্যস্ত মা। খুব জরুরি কিছু না হলে পরে শুনবো।

রোজিনা পাশে বসে খানিক উঁচু স্বরে বলল,

—কথাটা জরুরি। কাজ পরেও করা যাবে। এখন আমার কথা শোন।

—রাগ করছো কেন মা? বলো কি বলবে?

—তুই কি শুরু করেছিস এসব?

—কোনসব?

রোজিনা ফোস করে শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,

—হেমা আর শ্রাবণীকে নিয়ে। তুই হেমাকে ছেড়ে শ্রাবণীকে পছন্দ করলি কেন? তোর বাবা এই বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু তুই তো রাজীই না। শ্রাবণীর মতো বুড়ি একটা মেয়েকে তোর কি দেখে ভালো লাগলো?

সিয়ামের ভ্রু কুচকে গেলো। বলল,

—শ্রাবণীর বয়স তোমার থেকে অনেক কম। তোমার মেয়ের বয়সী। তাহলে তুমি কি হিসাবে ওকে বুড়ি বলছো? আর হেমা নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। আমার সাথে ওর যায় না। শ্রাবণী সবদিক দিয়ে আমার জন্য ঠিক। ওর মধ্যে এমন কিছু আছে যেটা আমি চাইছি বা চাইবো আমার বউয়ের ভিতরে।

রোজিনা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,

—তুই আমাকে বুড়ি বললি ঐ মেয়েটার জন্য? যে বুড়ি তাকে বুড়ি বলবো না তো কি বলবো? ওর বয়স তোর থেকে বেশি। আর হেমাকে দেখেছিস? মেয়েটার বয়স কম। চঞ্চল, প্রাণ আছে মেয়েটার মধ্যে। এরকম মেয়েই তো ছেলের বউ হিসেবে চাই। আমার নিজের কোন মেয়ে নেই। এরকম অল্পবয়স্ক, চঞ্চল, হাসিখুশি মেয়েই বউ করে আনবো আমি।

সিয়াম হিসাবের খাতার দিকে তাকাতে তাকাতে বলল,

—এখন বিয়ের আগে বলছো অল্পবয়সী, চঞ্চল মেয়ে বউ হিসেবে লাগবে। বিয়ের পরে তখন এই মেয়ের মধ্যে মানিয়ে নেয়া, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যজ্ঞান খুঁজবা। সংসারের ভার চাপিয়ে দিবা। আর যখন সে এগুলো নিতে পারবে না তখন বলবা “কি মেয়েকে বউ করে আনলাম! কোন গুণ নেই। একটা কিছু করতে পারে না। সব আমাকে কর‍তে হয়। মেয়ে তো খালি বসে বসে খায়।” তখন ছেলের বউকে আর মেয়ে হিসেবে দেখবা না। দেখবা অকর্ম বউ হিসেবে।

সিয়াম কাজে মনোযোগ দিলো। মাকে আর কিছু বলার নেই। মানুষগুলো পারেও বটে। মা তার সাথে কথা বলতে আসলেও সিয়াম জানে এর পিছনে আসল কলকাঠি তার বাবা নাড়ছে। সে বাবার সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না বলে বাবা মাকে পাঠিয়েছে কথা বলার জন্য।এবং সিয়ামের ধারনা বাবা তার ঘরের আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আর রোজিনা কথায় সিয়ামের কাছে হেরে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর চা-ভর্তি চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেলো যেটা সিয়ামের জন্য এনেছিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here