#আয়নামতী
#পর্ব_১৭,১৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
পর্ব_১৭
বাচ্চা কোলে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসলো নামিরা। সায়ান কাঁদছে। নামিরার সেদিকে হেলদোল নেই। সে কালো রঙের গাড়িটার পিছু ছুটতে ব্যস্ত। গাড়িটার নাম্বার ঝাপসা দেখাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না।
আয়না ফার্মেসী থেকে এসে নামিরাকে কোথাও দেখতে পেল না। পাগলের মত হন্য হয়ে দৌড়াল পুরো করিডোর। তারপর নাওয়াজ শেখ যখন আসলেন তখন উনাকে নিয়ে বের হলেন হসপিটাল থেকে। তখনি নামিরাকে চোখে পড়লো। আশপাশ না তাকিয়ে হাঁটছে নামিরা। সায়ান ভীষণ রকম কাঁদছে। আয়না ছুটে গেল। নামিরার কোল থেকে সায়ানকে কেড়ে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ ভাবি কি করছ তুমি? সব ধুলোবালি বাতাস ওর নাকে গিয়ে লাগছে আবার। ছেলেটাকে কি তুমি বাঁচতে দেবে না? ভাবি?
নামিরার কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ওই চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল
‘ আয়ান? ওই তো আয়ান, চলে যাচ্ছে কেন?
আয়না গর্জে বলল
‘ মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? ভাবি চলো।
নামিরা হাত ছাড়িয়ে নিল। নাওয়াজ শেখকে দেখে দৌড়ে গেল। হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল
‘ বাবা আয়ান। বাবা ও বাবুকে কোলে নিয়েছে। আমি সত্যি বলছি।
নাওয়াজ শেখ কিছু বলেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন। দিনদিন মেয়েটার পাগলামো বাড়ছে বৈকি কমছে না।
আয়না বলল
‘ আঙ্কেল বাবুর ক্ষতি হবে। গাড়ি ডাকুন তাড়াতাড়ি।
নামিরা এলোমেলো কেঁদে বলল
‘ আয়না আমি যাব না তো। তোমরা চলে যাও। আমি যাব না। বাবুকে তুমি দেখে রেখো। আমি আয়ানের কাছে যাই।
আয়না চোখের পলক চেপে রাখলো। বিরক্তি নিয়ে খুলে বলল
‘ যা ইচ্ছা করো, কিন্তু আপাতত বাড়ি ফিরতে দাও। তোমার সন্তানের শরীর খারাপ। আর তুমি এখনো পাগলামি করছো? কেন সত্যিটা মেনে নিচ্ছ না?
নামিরা চুপসে গেল। ভেজাগলায় বলল
‘ তুমিই তো আমাকে বলেছিলে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বলোনি? তাহলে এখন এমন বলো কেন? আয়ান থাকলে এভাবে কথা বলতে পারতে? ও নেই তাই এভাবে বলছো। ও ছাড়া কেউ আমায় বুঝে না। আমাকে ভীষণ রকম বুঝার মানুষটাকেই কেন হারিয়ে যেতে হলো? আমি কখনো কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি।
নাওয়াজ শেখ মেয়েকে বুকে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন
‘ এভাবে কাঁদলে লোকে কি ভাববে? দেখ আশেপাশের মানুষ কিভাবে তাকিয়ে আছে। ধৈর্য ধর মা। তোর সন্তানের কথা ভাব। ও তোর একটা পৃথিবী।
নামিরা বাচ্চার দিকে তাকায়। আয়নার বুকে গুঁজে রয়েছে সায়ান। লাল জিহ্বাটা বের করছে, আবার ভেতর নিয়ে নিচ্ছে। বড় বড় চোখদুটো দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে নামিরাকে। নামিরা কোলে নিয়ে নিল বাচ্চাকে। শান্ত চুপচাপ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁট ছুঁয়ালো ছেলের কপালে। এখানেই আয়ান ছুঁয়েছিল। এখনো স্পর্শ লেগে আছে। সেই চিরপরিচিত স্পর্শ। সেই ঘ্রাণ।
__________
আয়শা বেগম নাতি আর ছেলের বউকে ফিরতে দেখে খুশি হয়ে গেলেন। নাতিকে ঝাপটি মেরে নিয়ে নিলেন আয়নার কোল থেকে। সারামুখে অজস্র আদর দিতে দিতে বললেন
‘ ভাই তুই ছাড়া ঘরবাড়ি আন্ধার। কেন এত অসুখে পড়িস? আল্লাহ ভালা রাইখো আমার ভাইরে।
সায়ান দন্তহীন গাল এলিয়ে হাসে। ছোট্ট হাতের তালু লাগায় আয়শা বেগমের মুখে। খুশিতে আনন্দে চোখে জল আসে তার। মনে হয় একদম তার ছেলে হাসছে।
নামিরাকে মলিন চেহারায় দেখে আয়শা বেগম বিভ্রান্ত হলেন। বললেন
‘ কি হইছে বউ? মন খারাপ করে রাখছো ক্যান? তোমার বাবু ভালা হয়ে যাইবো। আল্লাহ আমার ভাইরে ভালা কইরা দিবো। মন খারাপ কইরোনা। আসো, কিছু খাও আগে।
নামিরা ছলছল চোখে আয়শা বেগমের দিকে তাকালো। আয়না চলে যাওয়ায় ফিসফিসিয়ে বলল
‘ আম্মা আমি আয়ানের কাছে যাব। আমাকে যেতে দিবে?
আয়শা বেগম হতাশ গলায় বললেন
‘ বউ, তোমারে কইছি না তোমার বাবুর দিকে মনোযোগ দিতে। তার কথা বারবার কেন মনে করো? সে তো তোমার চিন্তা করে নাই। উলটপালট চিন্তা কইরোনা বউ।
নামিরা কেঁদে দিল এবার। বলল
‘ আমাকে একটু বিশ্বাস করো আম্মা। আমি আয়ানকে দেখেছি। ও বাবুকে কোলে নিয়েছে। আদর করেছে। তুমি জানো বাবু একদম শান্ত হয়ে গিয়েছে। আমি যাই আম্মা? আয়না তো ধমকায়। তুমি যেতে দাও আম্মা।
আয়শা বেগম নাতিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখেন। আয়না আসতেই নামিরা চুপসে যাওয়া চোখে তাকালো। আয়না বলল
‘ কোথায় যাবে তুমি? কার কাছে যাবে? আমি নিয়ে যাব তোমায়? কোথায় যাবে?
নামিরা বলল
‘ সত্যি?
আয়না মাথা নাড়ালো।
নামিরা ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আওয়াজ করে কাঁদলো। আয়না চোখ চেপে ধরলো তার কাঁধে। বলল
‘ পাগলামির একটা সীমা থাকে ভাবি। তোমার মনে হচ্ছেনা তুমি অতিরিক্ত করছ?
নামিরা ছাড়লো না তাকে। শক্ত করে ধরে রেখে অনুরোধ করে বলল
‘ আমাকে একটু বুঝো। একটুখানি।
আয়শা বেগম চোখ মুছতে মুছতে নাতিকে নিয়ে চলে গেলেন৷
____________
থানায় নাওয়াজ শেখের নাম বলতেই পুলিশ নামিরার দেওয়া নাম্বারটা নিল। কার গাড়ি, এবং সেই মালিকের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে এনে দেবে বললো। নামিরা ততক্ষণ থানায় বসেছিল। আয়না চুপচাপ পাশে বসে আছে। নামিরা কি করছে সে বুঝতে পারছেনা। পুলিশ প্রায় আধঘন্টা পর সমস্ত ডকুমেন্ট নিয়ে হাজির হলো। গাড়ির মালিকের ঠিকানা দিল নামিরাকে। আয়না দেখে বলল
‘ এখন শহরে কিভাবে যাবে ভাবি? বাবুর গাড়ির বাতাস লাগলে ক্ষতি হবে। আর চেনা নেই, জানা নেই কার না কার বাড়ি। জানিনা কি করছ তুমি।
নামিরা হাত ধরলো আয়নার। বলল
‘ তুমি চিন্তা করো না। আমি যেতে পারব। আব্বা তো আছে।
আয়না বলল
‘ আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারব না।
নামিরার মুখ অন্ধকার হয়ে এল।
নাহ, আয়নাকে যেতে দেওয়া যাবে না। সে একা যাবে। আয়না তাকে কোনোকিছু করতে দেবে না। তাছাড়া তার মনের ভুল ও হতে পারে।
আয়না বলল
‘ ঠিকানা দাও আমি গিয়ে দেখে আসি ওই বাড়িতে কে কে থাকে।
নামিরা দিল না কাগজটা। বলল
‘ থাক লাগবে না। যাব না আমি। আমার কোথাও ভুল হচ্ছে বোধহয়।
আয়না স্বস্তি পেল। যাক ভাবির পাগলামি অন্তত কমেছে।
কিন্তু আয়নাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নামিরা তারপরের দিন ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে আয়নার পাশ থেকে উঠে ভোররাতে বের হয়ে গেল ছেলেকে নিয়ে। নাওয়াজ শেখ মেয়ের আবদার ফেলতে পারেননি। তাই গাড়ি এনে রেখেছেন আয়নাদের বাড়ির কিছুটা দূরে। নামিরা আয়শা বেগমের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে গেল। আয়শা বেগম তখন ও ঘুম। আয়না ও কিছু জানেনা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে যখন নাতিকে দেখতে গেলেন আয়শা বেগম তখন দেখলেন পুরো ঘর খালি। নেই নাতি, নেই ছেলের বউ। হায়হায় করে কেঁদে উঠলেন তিনি। আয়না চমকে গেল। অজানা আশঙ্কায় বুক ভার হয়ে এল। রাগ হলো নামিরার উপর। বাবুর শরীরটা খারাপ। ঠান্ডা সইতে পারছেনা ছেলেটা। গাড়ির বাতাস লাগলেই ক্ষতি। ভাবি কি যে করছে।
আয়না সান্ত্বনা দিল মাকে। বলল
‘ ভাবিকে আমি নিয়ে আসব।
কিন্তু ওই বাড়িতে পুলিশের সাহায্যে খবর নিয়ে জানা গেল নামিরা নামের কেউ যায়নি ওই বাড়িতে। আয়না চিন্তায় ফেটে পড়লো। আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়বে এসব শুনলে। তাকে কে এই বিপদে সাহায্য করতে পারে?
নামিরা বলায় নাওয়াজ শেখ কাউকে কিছু বললেন না। নামিরা সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি শহরে তার বড় খালামণির বাসায় ছিল। তারপর বের হলো ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে তার ছোট খালাতো ভাইকে নিয়ে। তখন ঝড়ের প্রকোপ বেড়েছে। শাঁ শাঁ বাতাসে ভারী পরিবেশ। গম্ভীর, থমথমে চারপাশটা। নামিরা তার খালাতো ভাইকে চলে যেতে বলল। তাহিম যেতে চাইলো না। বলল
‘ আপু ওই বাড়ির গেইটে গাড়ি ঢুকলে সমস্যা হবে না। নইলে বাবুর গায়ে বৃষ্টি পড়তে পারে।
নামিরা ঢেকে নিল সায়ানকে ভারী পাতলা নকশা করা কাঁথা দিয়ে। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ গাড়ি গেইটের কাছে থামুক। আমি নেমে যাই। তুই গাড়ি নিয়ে চলে যাহ।
তাহিম যেতে চাইলো না। পরক্ষণে যেতেই হলো। নামিরা গাড়ি থেকে নেমে গেল বৃষ্টি মাথায়। দাঁড়োয়ান বলল
‘ কোথায় যাবেন?
নামিরা বলল
‘ আমি এই বাড়িতে যাব। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে দিন। আমার বাচ্চার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে।
দারোয়ান যেতে দিল। ছাতা বাড়িয়ে দিল। বলল
‘ দিনের বেলা আসতে পারেন নাই? এমন সন্ধ্যায় কেউ বাচ্চা নিয়ে বের হয়?
নামিরা কিছু বললো না। দুরুদুরু বুক নিয়ে, একবুক আশা নিয়ে পা দিল শেখওয়াত বাড়ির বারান্দায়। দারোয়ান দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। গেল যে গেল, আর আসার নাম নেই। নামিরা দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে। ভেতরে উঁকি দিল না। সায়ানের কান্না শুরু হয়েছে। ছেলেটা একদম বাবার মতো পাজি হয়েছে। অন্ধকার পছন্দ করে না। তাছাড়া বৃষ্টির ফোটা ও পড়েছে। নামিরা মুছতে লাগলো। নিজের মুখ থেকে সরাতে লাগলো বৃষ্টির পানি।
ছেলেকে দুলাতে দুলাতে বললা
‘ এই তো এখনি আলো আসবে। এখুনি আসবে আব্বা। সারাক্ষণ কান্না।
বলতে না বলতেই কেউ দরজা খুলে দিল। নামিরা সায়ানের মুখ থেকে চোখ তুলে তাকালো। আলো আধারিতে দেখলো সৌষ্ঠব একটি পুরুষ অবয়ব। মুখ ভেজা থাকায় চোখের পানি টের করা গেল না নামিরার। সায়ান আর ও জোরে কাঁদছে। লোকটি দরজার হাতল ছেড়ে দিল। নামিরার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডাকলো
‘ মিরাহ!!!!
টপটপ করে নামিরার কপোল বেয়ে জল গড়ালো। থুতনি বেয়ে চোখের জল পড়ে ভিজে গেল সায়ানের মুখ। ঠান্ডা পানি মুখে পড়ায় হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো সায়ান। নামিরা আরও একবার নিজের নামটা শোনার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। অতিআগ্রহে চেয়ে রইলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে।
চলবে,,
#আয়নামতী
#পর্ব_১৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দারোয়ানের ডাকে হুশ ফিরলো হীরার। মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টে কাল তার রিসার্চ করা ফাইলটা জমা দিতে হবে। খুব ব্যস্ততায় সময় কাটছে তার। সারাদিনে অর্কের ঘরের দিকে ও যাওয়া হয়নি। এমন সময় দারোয়ানের ডাক শুনে ঘর থেকে বের হয়ে এল হীরা। দারোয়ান কিছু বলার আগেই মিরা ডাকটি ভেসে এল বসার ঘর থেকে। দারোয়ানের দিকে তাকালো হীরা। বলল
‘ অর্ক কোথায়?
‘ নিচে ম্যাডাম।
হীরা চলে এল নিচে। অর্ক আবার মিরা ডাকছে কাকে?
কৌতূহল নিয়ে এগোতেই অর্কের মুখোমুখি হীরা।
‘ আপনাকে আমি ডাকছিলাম মিরা।
হাসলো হীরা। বলল
‘ মিরা ডাকলে কি করে বুঝব? আমাকে তো হীরা নামেই ডাকতে হবে।
অন্য কিছু বলল না অর্ক। হীরা বলল
‘ কেন ডাকছিলেন?
‘ বাইরে কে যেন এসেছে। একটা বাচ্চার মা।
দরজার কাছে তাকালো হীরা। এগিয়ে গেল। নামিরাকে দেখতে পেল অতঃপর। আধভেজা এই নারী প্রতিমূর্তি দেখে কিঞ্চিৎ ভুরু কুঁচকালো হীরার। শুধালো
‘ কে আপনি? কাঁদছেন কেন? আপনার বাচ্চা ও তো কাঁদছে।
নামিরা আবার ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল। হীরা বলল
‘ ভেতরে আসুন। কাকে চান? বিপদে পড়েছেন?
নামিরা উপরনিচ মাথা নাড়ালো। হীরা বলল
‘ নাম কি আপনার?
‘ নামিরা।
কপালে আবার ভাঁজ পড়লো হীরার। বলল
‘ আচ্ছা ভেতরে আসুন না। আপনার বাচ্চাকে আমাকে দিন। ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে তো। আপনি হসপিটালের খবর রাখেন?
কত বাচ্চা নিউমোনিয়ায় ভুগছে এখন। এদিকে দিন তো। ভেতরে আসুন। কাঁদবেন না। বিপদে যখন পড়েছে তখন উদ্ধার ও হবেন। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন।
দারোয়ান কিছু বলতে চাইলো। নামিরার কান্না দেখে কিছু বলতে পারলো না। তবে হীরার বাবা মা এসে উপস্থিত হলো যখন তখন জানতে চাইলো
‘ কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই তো মেয়ে?
নামিরা হীরার দিকে তাকালো। হীরা বলল
‘ আহা মা কি বলছ এসব? ওনি বিপদে পড়েছেন।
নামিরা তাকালো অর্ক নামক লোকটার দিকে। আবার ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে সবাই তাকালো তার দিকে। সেলিনা বেগম বলল
‘ কি রে মেয়ে? ওমা কে গালি দিয়েছে তোমায়? কাঁদছ কেন মেয়ে?
হীরা এগিয়ে গেল। বলল
‘ আমার ঘরে আসুন। আচ্ছা আমার ঘরে ও যেতে হবেনা। আমার পাশের রুমটাতে চলে আসুন। ওখানে থাকতে পারবেন। বাকি কথা ওখানে বলব। আসুন। কাঁদবেন না।
নামিরা যেতে চাইলো না। বলল
‘ আমি ফিরে যাব আম্মার কাছে,গ্রামে। থাকব না এখানে।
হীরা বিস্ময় নিয়ে বলল
‘ এখন কিভাবে গ্রামে যাওয়া যাবে? আজ রাতটা তো থেকে যেতে হবে। একটু বুঝার চেষ্টা করুন৷ আপনার বাচ্চার কথা ভেবে থেকে যান।
নামিরা কাঁদতেই লাগলো। হীরা সায়ানের দিকে তাকালো। ঘুমে ঢুলুঢুলু তার চোখ। ঠোঁট গোল করে কি কি আবোলতাবোল বলছে। হীরা আদর করলো। হৃষ্টপুষ্ট শরীরের বাচ্চাটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ আপনার বাচ্চা তো একদম বিড়ালের মতো। ম্যাওম্যাও করে। কি আদুরে। কার মতো হয়েছে? আপনার রঙ শ্যামা। ও তো ধলা বিলাই।
নামিরা চোখ মুছলো। তাকালো অর্ক নামক লোকটার দিকে। অর্ক অন্যদিকে তাকালো৷
নামিরা কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল
‘ ওর আব্বার মতো হয়েছে। ও এমনই ছিল।
চোখ তুললো হীরা।
‘ ছিল?
উপরনিচ মাথা নাড়ালো নামিরা। ঠোঁট টেনে কেঁদে বলল
‘ এখন নেই। হারিয়ে গেছে।
ভাবনায় পড়লো হীরা। বলল
‘ আচ্ছা ঘরে আসুন। আপনার বোরকা ভিজে গেছে। আসুন। চিন্তা করবেন না। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।
সায়ান হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে উঠলো। হীরা হেসে ফেলল। শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল
‘ কি দুষ্টু ছেলে? দেখো তোমার মা কিভাবে কাঁদছে। দুষ্টু বিড়াল। মাছ খাবে? নাকি মাছের কাঁটা খাবে।
হীরা হাত ধরলো নামিরার। নামিরা যেতে চাইলো না। হীরা টেনে নিয়ে গেল তাকে। যেতে যেতে বারবার অর্কের দিকে ফিরে তাকালো নামিরা। অর্ক তাকে তাকাতে দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিল। সেলিনা বেগম লক্ষ করলেন ব্যাপারটা। অর্কের কাছে গিয়ে বললেন
‘ চেনো মেয়েটাকে?
অর্ক মাথা নাড়ালো দু পাশে। সেলিনা বেগম হাত বুলিয়ে দিল তার মাথায়। মৃদু হাসলো অর্ক।
সেলিনা বেগম বললেন
‘ হীরা টা কি যে করে। চেনেনা জানেনা কোন একটা মেয়েকে ঘরে নিয়ে গেল। খারাপ মতলব নেই কে বলতে পারে?
আমিন সাহেব খবরের কাগজ মুখ থেকে সরিয়ে বললেন
‘ সবকিছুতেই তোমার খারাপ মন্তব্য করা লাগবেই।
চুপ হয়ে গেল সেলিনা বেগম।
___________
ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই অনুরাগের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো শায়খ চৌধুরী। অনুরাগ চোখ তুলে বাবার দিকে চাইলো। বলল
‘ কি সমস্যা বাবা?
শায়খ চৌধুরীর পেছনে আনহিতা এসে দাঁড়ালো। শায়খ চৌধুরী বললেন
‘ কোথায় যাচ্ছ তুমি? তুমি কি ভুলে যাচ্ছ তোমার লড়াইটা কার সাথে হতে যাচ্ছে। সামনেই তোমার একটা প্রোগ্রাম।
অনুরাগ বলল
‘ আশ্চর্য তো? আমি তো সবটা জানি। কিন্তু এখন আমার পথ আটকানো হচ্ছে কেন বাবা?
আনহিতা বলে উঠলো।
‘ তুমি একা একা কোথায় যাচ্ছ সোহাগ? দেখো তোমার একা একা কোথাও যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
অনুরাগ হতাশ হলো। বলল
‘ আমি ছোট নই মা। বড় হয়েছি। আরেক কি আশ্চর্য!
শায়খ চৌধুরী বলল
‘ ওই পেঁয়াজ ব্যবসায়ীর মেয়ের সাথে তোমার কি?
অনুরাগ অদ্ভুত চোখে চাইলো। বলল
‘ মানে?
‘ আমি অনেকদিন ধরে অনেককিছু শুনছি। তুমি ওই মেয়ের বাগানের দিকে কি করতে যাও? ওই মেয়ের সাথে তোমার কিসের এত লেনদেন?
অনুরাগের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। সে বলল
‘ আপনারা আমাকে ছোট্ট বাচ্চার মতো জেরা করছেন বাবা। যা অনুচিত। ভালোমন্দ বাছবিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে। এবং আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। আমাকে নিজের মত করে থাকতে দিন। অনেক তো শুনেছি আপনাদের কথা। ভালো কিছু তো হলো না।
শায়খ চৌধুরী বড় গলায় অনুরাগের নাম ধরে ডেকে উঠলেন
‘ অনুরাগ?
অনুরাগ সামান্য ঠললো না এই ধমকে। বরঞ্চ সেই ধমককে ঠেলে দিয়ে বললো
‘ আপনাদের কারণে আমার মানসম্মান ডুবেছে, নিশ্চিন্তে থাকুন আমি আপনাদের মানসম্মান ডুবাবো না।
শায়খ চৌধুরী সরে পড়লেন। অনুরাগ বের হয়ে গেল হনহনিয়ে।
শায়খ চৌধুরী গর্জে আনহিতাকে বললেন
‘ তোমার ছেলে দিনদিন অবাধ্য হয়ে উঠছে আনহিতা। আমি এসব সহ্য করব না। ওর ভালো চেয়ে এসেছি আমি সবসময়, খারাপ হয়েছে এতে কি আমার হাত ছিল? ওই মেয়েটা খারাপ ছিল তাতে কি আমার দোষ?
আনহিতা চুপ করে থাকলো। শায়খ চৌধুরী চিল্লিয়ে বাড়ি এক করলেন। শায়লা বেগম লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। সোফায় বসলেন। শান্ত গলায় বললেন
‘ ওকে ওর মত করে থাকতে দে। ওর উপর আর কোনোকিছু চাপিয়ে দিস না। ভুলে ও বিয়েশাদির কথা তুলিস না। রাগের মাথায় কি না কি করে বসে।
আনহিতা এসে বলল
‘ মা ও একটা পরিচিত মুখ এই জেলার। ওর সবকিছু পার্ফেক্ট থাকা দরকার। নাহলে জনতা প্রশ্ন তুলবে। আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না। অনুরাগকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। কুহেলী খারাপ ছিল তার মানে এই নয় সব মেয়েরাই এমন।
শায়লা বেগম বললেন
‘ ওর যাকে মনে ধরবে, ও তাকেই বিয়ে করুক। চাও না?
আনহিতা শায়খ চৌধুরীর দিকে তাকালেন। মৃদুস্বরে বললেন
‘ চাই।
‘ তাহলে চুপ করে থাকো। সময়টা একদিন আসবে। তখন কিছু হলেও তোমাদের দোষ থাকবে না।
আনহিতা বলল
‘ কিন্তু মা, আমি চাইছি ওর একটা সংসার হয়ে যাক। আমি বেঁচে থাকতে ওর একটা গোছানো সংসার হয়ে যাক। সেসব কবে হবে? দেড়টা বছর তো চলেই গেল এমনি এমনি।
শায়লা বেগম আর কিছু বললেন না। বলতে চাইলেন না।
________
থানা থেকে বেরিয়ে আসলো অনুরাগ। আয়নার বাড়ির ফোনে ফোন লাগালো তারপর পরই। আয়না রান্না বসিয়েছিল রান্নাঘরে। রূপা এসে ফোন হাতে নিল। কানে নিতেই অনুরাগের গলা শুনে দৌড়ে গেল। আয়নাকে বলতেই আয়না দূরে দাঁড়িয়ে বলল
‘ তুই কথা বল। আমি বলব না।
রূপা সালাম দিল।
‘ অনুরাগ সালাম নিয়ে বলল তোমার আপাকে দাও ফুলটুসি।
রূপা ভয়ে ভয়ে বলল
‘ আপা কথা বলবেনা বলছে। শরম পায়।
আয়না চোখ লাল করে তাকালো।
অনুরাগ বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার আপাকে বলো সায়ানের খোঁজ পেয়ে গেছি।
রূপা বলল
‘ সায়ানের খোঁজ?
আয়না ফোন কেড়ে নিল। বলল
‘ কোথায় পেয়েছেন? তাড়াতাড়ি বলেন। আমি এক্ষুণি যাব।
অনুরাগ থামলো। খানিক্ষন পরে বলল
‘ বাহ কথা তো বলতে জানো। ভেবেছি কথা বলতে ভুলে গেছ।
আয়না ফোনটা রূপাকে দিয়ে দূরে সরে পড়লো। ফিসফিস করে বলল
‘ সায়ান কোথায় সেটা বলতে বল।
রূপা হেসে ফেলল। অনুরাগকে বলল
‘ সায়ানের খোঁজ দিতে বলতেছে। নইলে ফোন রাখতে বলতেছে।
অনুরাগ বলল
‘ শহরের ওই বাড়িটাতে উঠেছে সন্ধ্যায়। ওই বাড়ির কর্তার সাথে আমি কথা বলেছি। তোমার আপাকে জিজ্ঞেস করো কখন যেতে চায় ও।
রূপা জিজ্ঞেস করলো। আয়না বলল
‘ কাল সকাল সকাল৷ এখন তো আম্মার জ্বর। শহর তো অনেকদূর।
অনুরাগ বলল
‘ ঠিক আছে।
__________
এক বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল অর্কর৷ এপাশ ওপাশ করতে করতে সে উঠে গেল শেষমেশ। দরজা খুলে বের হয়ে এল রুম থেকে। কান্নার আওয়াজ অনুসরণ করে হাঁটতেই দেখতে পেল হীরার পাশের রুমটা থেকেই শব্দটা আসছে। হেঁটে গেল অর্ক। দরজাটা ঠেলে ঢুকলো রুমটাতে। ছেলেকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ানো মেয়েটির চোখ বন্ধ। দরজাটা লাগিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো অর্ক৷ বাচ্চাটার কান্না থামলো৷ হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে৷ মা শুইয়ে দিল বাচ্চাকে৷ নিজের ভেজা গাল মুছে শোয়ার আগেই চোখ গেল দরজার কাছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তার না?
দ্রুতপায়ে হেঁটে গেল নামিরা৷ একদম মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো৷ হাত তুলে ছুঁলো মুখ,গলা,বুক। তারপর ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মিনমিন করে বলল
‘ আমাকে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া রঙিন দিনগুলো ফিরিয়ে দাও। আমার সন্তানের কাছে তার আব্বাকে ফিরিয়ে দাও। আমাকে আমার মানুষটাকে ফিরিয়ে দাও৷ আমাকে একটু ভালোবাসো। আমি কতদিন তোমাকে ছুঁই না, তোমার বুকে মাথা রাখিনা৷ তোমার ভালোবাসার অভাবে আমি রোজ রোজ মরছি আয়ান। আমার কাছে ফিরে আসো। আমার তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন আয়ান । আমাকে খুব করে বুঝার আর ভালোবাসার মানুষটাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন।
অর্ক নড়লো না, সরলো না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো শক্ত হয়ে।
নামিরা তার বুকের কাছে শার্ট ভিজিয়ে দিল৷
চলবে,