উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৩১

0
2519

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৩১
(নূর নাফিসা)
.
.
বিকেলে আম্মিও এসে পড়েছে। রাতের জন্য আম্মিই রান্না বসালো। আজ বিকেলে মেঘ বাজার করে এনেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাফিসা মেঘকে দেখতে পেল না! প্রতিদিন তো মেঘের বুকেই ঘুম ভাঙে আজ মেঘ তাকে না ডেকেই উঠে পড়লো কেন! নামাজ পড়তেও ডাকেনি, বেলা হয়ে গেছে! বিছানো ঠিকঠাক করে বাইরে এলো নাফিসা। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখলো আম্মিকে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে!
– কি হয়েছে আম্মি?
– কই?
– এভাবে আছো কেন? চুলায় আগুন নেই ভাত বসিয়েছো!
আম্মি নিজের কান্ডে মৃদু হেসে চুলায় আগুন ধরাতে ধরাতে বললো,
– বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো। এই তার প্রমাণ!
– হ্যাঁ, চুল পাকেনি অথচ বুড়ো হয়ে যাচ্ছো! এদিকে উঠে আসো, আমি রান্না করি।
আম্মি উঠে এলো নাফিসা রান্না করার জন্য বসলো। নাস্তা করার জন্য আম্মি ডাকলো।
– হ্যাঁ বলো।
– খাবি না?
– তুমি খাও, আমি পরে খাবো।
– মেঘের জন্য অপেক্ষা করছো? মেঘ আজ আমাদের সাথে নাস্তা করবে না।
মেঘের কথা শুনে চমকে উঠলো নাফিসা! সে তো মেঘের অপেক্ষাই করছিলো। কিন্তু আম্মির কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
– আমাদের সাথে নাস্তা করবে না কেন?
– আমার কাছে বলেছে, কি একটা কাজে বেরিয়েছে ফিরতে দেড়ি হবে। এসো আজ আমি খায়িয়ে দেই। কবে থেকে খায়িয়ে দেই না আমার আম্মিটাকে!
নাফিসার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো! মেঘ তাকে বলেও যেতে পারতো! যাক আম্মি বলছে সেজন্য আর না করলো না। আম্মির হাতে নাস্তা করলো। বাসায় একা একা ভালো লাগছে না তার উপর সকাল থেকে মেঘের দেখা নেই! তার মনে আবার ভয়ও হচ্ছে তাই ভয় দূর করতে আলমারি খুলে মেঘের জামাকাপড় চেক করলো। সব এখানেই আছে দেখে চিন্তামুক্ত হলো। দুপুরেও আসেনি মেঘ! আম্মির সাথে খেয়ে আম্মির ফোনটা হাতে নিলো। নিজের রুমে এসে মেঘের নম্বরে ডায়াল করলো। একবার কল হয়ে কেটে গেছে দ্বিতীয় বার ডায়াল করতেই রিসিভ হলো।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় আছো?
– ইম্পর্ট্যান্ট কাজে বেরিয়েছি।
– কখন আসবে?
– কাজটা শেষ করেই চলে আসবো।
– খুব বেশি ব্যস্ত এখন?
– না, বলো।
– আমাকে ঘুম থেকে ডেকে গেলে কি হতো?
– ইচ্ছে করেনি ঘুমটা ভেঙে দিতে!
– এতো সকালে যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো! নাস্তা করে বের হলে কি হতো?
– প্রয়োজন ছিলো বিধায় বেরিয়েছি। বাইরে নাস্তা করেছি তো আমি। লাঞ্চ করেছো?
– হুম।
– তাহলে এখন একটা ঘুম দাও, বিকেলে আবার পড়াতে যাবে।
– সাবধানে থেকো, কাজ শেষ করে দ্রুত বাসায় ফিরবে।
– ওকে, বেগম সাহেবা। আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।
নাফিসা ফোন রেখে কিছুক্ষণ ছোট জানালার পাশে বসে রইলো। টেবিলে মেঘের ল্যাপটপটা খুজলো কিন্তু পেল না! নিয়ে গেছে হয়তো সাথে!
মেঘের কথামতো দুপুরে ঘুমিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাদের পড়াতে গেছে। মেঘ এখনো বাসায় ফিরেনি! খুব মিস করছে মেঘকে! রাতে আবার কল করলো। প্রথম বার কল কেটে দিয়েছে। দুমিনিট পর মেসেজ এসেছে, ” মেঘা, আমি আজ ফিরবো না। কাজের চাপ একটু বেশি। আজ আম্মির সাথে ঘুমাতে যাও।”
নাফিসা কল করেই যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না! একটু পর মেঘের নম্বর বন্ধ দেখছে!
ভয় তো বেড়েই যাচ্ছে! কান্না আসছে খুব! আম্মি একবারও জিজ্ঞেস করেনি মেঘের কথা। তার মানে আম্মি জানে! দৌড়ে আম্মির কাছে এসে বললো,
– আম্মি, মেঘ কোথায় গেছে?
– কাজে বেরিয়েছে। রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে। চলো খাবার খেয়ে নেই।
– কি কাজে বেরিয়েছে?
– জরুরি কাজ আছে নাকি!
আম্মি কথা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে তাই নাফিসা রেগে বললো,
– সেটাই তো জানতে চাচ্ছি কি কাজে গেছে, কোথায় গেছে? তুমি সবটা জানো আমার কাছে লুকানোর চেষ্টা করছো কেন? বলো না মেঘের কি হয়েছে?
রোকসানা মেয়ের চিন্তা ও কান্না দেখে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না! বলেই দিলেন,
– মেঘের কিছু হয়নি। মেঘ ঢাকা ফিরে গেছে বাবামায়ের সাথে কথা বলতে। অতি শীঘ্রই ফিরে আসবে।
নাফিসা স্তব্ধ হয়ে গেছে! তাহলে কি মেঘ তাকে ধোকা দিয়ে চলেই গেলো! ঢাকা গেলেই তো মেঘকে বিয়ে করতে হবে! ওর তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে! এজন্য সে তার মেঘাকে না জানিয়ে পালিয়ে গেছে! যেই ভয়টা মনে গেথে ছিলো আজ সেটাই ঘটতে চলেছে! খুব ঠান্ডা স্বরে আম্মিকে জিজ্ঞেস করলো,
– কখন বলেছে তোমাকে?
– কাল রাতেই বলেছিলো। ভোরে যাওয়ার সময় আবার বলে গেছে। সকালের ট্রেনেই উঠেছে। তুমি চিন্তা করবে তাই তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছে। কালকেই ফিরে আসবে দেখো।
নাফিসা আর কিছু শোনার জন্য এখানে অপেক্ষা করলো না। দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে কান্না করেই যাচ্ছে! আম্মি এসে দরজা খুলতে বললো কিন্তু নাফিসা খুলছে না! দুই রুমে মা মেয়ের কেটে যাচ্ছে নির্ঘুম রাত! নাফিসার চোখে ঘুম নেই মেঘের জন্য আর রোকসানার চোখে ঘুম নেই মেয়ের অবস্থা দেখে!
৩১.
দুপুরের দিকে কলিং বেলেরে শব্দ শুনে দরজা খুললো বৃষ্টি। দরজার ওপাশে মেঘকে দেখে অবাক হয়ে আছে!
– ভাইয়া তুমি!
মেঘকে সরিয়ে এপাশে ওপাশে বাইরে উঁকি দিয়ে কাউকে খুজতে লাগলো বৃষ্টি। কিন্তু আর কেউ তো নেই! মেঘ বুঝতে পেরে বললো,
– এদিকে কাকে খুজছ? আমি তোর সামনেই দাড়িয়ে!
– তোমাকে তো দেখছি ই। তুমি একা এসেছো? ভাবি কোথায়?
মেঘ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
– আমি আমার বাড়ি ভাবি ভাবির বাড়ি। আমার মা জননী কোথায়?
– হিহিহি, ওই যে তোমার মা আর জননী।
মোহিনী ছেলেকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
– মেঘ!
মেঘ মা কে সালাম করে বললো,
– কেমন আছো তুমি?
– আলহামদুলিল্লাহ। বলা নেই কিছু না হুট করেই চলে যাওয়া আবার হুট করেই চলে আসা! চেহারার কি অবস্থা করেছে! এখন একটা লাগাতে মন চায়!
মেঘ মুচকি হেসে মায়ের সামনে গাল পেতে দিয়ে বললো,
– লাগাও।
মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– লাগিয়েছি! ফাজিল ছেলে একটা! এই ক’দিনেই শুকিয়ে গেছে।
মায়ের কথা শুনে বৃষ্টি বললো,
– মা, তুমি ডাক্তার দেখাও। তোমার চোখে প্রব্লেম হয়েছে। ভাইয়া কোনদিন মোটা ছিলো বলো তো আমাকে একটু ?
– চুপ থাক তুই! নিজে আরেক শুটকি, আবার কথা বলতে আসে! কি যে অবস্থা, মনে হয় অভাবের সংসার আর তোদের না খায়িয়ে রাখি!
– যদি ফুলে বেলুন হয়ে আকাশে উড়েও যাই না তবু্ও বলবা শুটকি আছি। এটা তোমাদের মতো মায়েদের স্বভাব! বাবা কি বলে শুনো না? সুস্থ আছি এটাই আলহামদুলিল্লাহ।
– হইছে তোর জ্ঞান তোর মাথায়ই রাখ। মেঘ হাতমুখ ধুয়ে আয়, চোখ কেমন গর্তে চলে গেছে। রাতে ঘুম ও হয়না বুঝি!
মেঘ মনে মনে বললো, “ঠিকই ধরেছো মা। কাল রাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি।
এদিকে বৃষ্টি বিড়বিড় করে বললো,
– শুকিয়ে গেছে হুহ্! আমি তো দেখছি জামাই আদর পেয়ে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে!
মেঘ বুঝতে পেরে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই বৃষ্টি হাসতে হাসতে ছো মেরে দৌড় দিলো তার রুমে। মেঘ তার রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো। নাফিসা কল করেছিলো তার সাথে কথা বলে নিলো। দুপুরের খাবার খেতে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
– মা, বাবা কোথায়?
– কোথায় আর থাকবে! রাত কাটে বাড়িতে আর ভোর হতেই ছুটে ব্যবসায়ের কাজে।
মেঘ খেয়ে কিছুক্ষণ ছাদে হাটলো। অনেক দিন হলো বাগানের যত্ন ছেড়ে দূরে আছে, তবে বাগান ভালোই আছে। বৃষ্টি যত্নে রেখেছে হয়তো। নানান ফুলের বাহার দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো কিন্তু চিন্তা টা মাথা থেকে যাচ্ছে না। আবার রুমে চলে এলো। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু চোখে ঘুম আসে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না বলছে ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্তি নেই! বিকেলে বাইরে একটু ঘুরেছিলো। সন্ধ্যায় বাবা বাসায় ফিরেছে। খেতে যাবে এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আম্মির নম্বর থেকে কল এসেছে। নাফিসা কল করেছে মেঘ নিশ্চিত। তাই একটা মেসেজ পাঠিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলো। রাতে একসাথে খাওয়ার সময় বাবা বললো,
– মেঘ, মারিশার আর তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছি আমরা অভিভাবকরা। তোমার মায়ের খুব শখ হয়েছে বাসায় ছেলের বউ আনার। মারিশাকে তো আগে থেকেই পছন্দ। তোমাদের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও ভালো। মারিশার মতামত আছে, তোমার নিশ্চয়ই অমত নেই?
বৃষ্টি খাওয়া রেখে বাবামায়ের মুখে একবার তাকালো আবার মেঘের মুখে তাকালো। মেঘ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। বাবার কথায় প্লেটের দিকে তাকিয়েই বললো,
– বাবা, খাওয়া শেষে তোমাকে কিছু বলবো।
ছেলের এমন ভঙ্গি দেখে বাবা মা দুজনেই তাকালো তার দিকে। মেঘকে নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে দেখে তারা একে অপরের দিকে তাকালো। সিরিয়াস কিছু হবে তারা সেটা বুঝতে পেরেছে। অত:পর খাওয়া শেষ করে নিলো।
ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। মেঘ একটা কাগজ এগিয়ে দিলো বাবার দিকে। বহুবছর পর ছেলের এই অভ্যাস টা আবার দেখলো তারা। ছোট বেলায় কোনো অপরাধ করলে সরাসরি মুখে বলতে পারতো না মেঘ। চিরকুটে লিখে বাবামায়ের কাছে প্রেরণ করতো। এতো বছর পর আজ সে আবার এমন করছে! কি অপরাধ করেছে সে!
বাবা মা সামনের সোফায় বসা আর মেঘ তাদের বিপরীতে বসে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান চৌধুরী কাগজটা হাতে নিয়ে না খুলেই জোর গলায় বৃষ্টিকে ডাকলো। বাবার ডাক শুনে বৃষ্টি দ্রুত ড্রয়িং রুমে এলো। পরিবেশটা খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে! কি হবে বৃষ্টি আন্দাজ করতে পারছে না! রায়হান চৌধুরী বৃষ্টির দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– অনেক দিন হলো তোমার রিডিং ধরি না। পড়ে শুনাও দেখি আগের মতো স্ট্রংভাবে পড়তে পারো কি-না!
বৃষ্টি বাবার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলো,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here