উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৩৪

0
2620

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৩৪
(নূর নাফিসা)
.
.
৩৩.
মেঘ নাফিসাকে নিয়ে রিকশায় উঠালো। রাস্তা যত অতিক্রম করছে মনের ধুকপুকানি ততই বাড়ছে! নতুন পরিবেশে যাচ্ছে সে! শশুর বাড়ির লোকজন কেমন হয় সেটা ভাবতেও পারছে না! কিভাবে তাকে গ্রহণ করবে সেটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! মেঘের উপর ভরসা থাকলেও সে মনকে শান্ত করতে পারছে না। মাঝপথে আসতেই মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। মেঘ বুঝতে পারছে নাফিসা নার্ভাস ফিল করছে, সাধ্যমতো চেষ্টা করছে নাফিসাকে স্বাভাবিক করার! মেঘ তাকে নিয়ে একটা বাড়ির সামনে নামলো। দোতলা বাড়িটা লাইটিং করা! সন্ধ্যা হতেই লাইট জ্বালিয়ে ফেলেছে! মেঘ ভাড়া দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বললো,
– বাহ! তাড়া কতো, এর মাঝে লাইটিংও শেষ করে ফেলেছে! চলো।
– এটা কাদের বাড়ি?
– তোমার শশুরের বাড়ি।
– লাইটিং কেন?
– তোমার শশুরের আফসোস, ছেলের বিয়ের আয়োজন করতে পারলো না। তাই, বৌভাতের আয়োজন করেছে পরশু দিন। আর এজন্যই তোমাকে নিয়ে আসা।
– কিহ! এমন বিয়েতে বৌভাত! আমি তো আগে জানলে আসতামই না!
– এজন্যই তো তোমাকে আগে জানাইনি! কি হলো, দাড়িয়ে রইলে কেন?
– যাবো না আমি।
– হাতে ব্যাগ তো, কোলে নেই কিভাবে!
– আশ্চর্য! আমি বলেছি নাকি কোলে নিতে! বৌভাত প্রোগ্রাম হলে আমি বাসায় যাবো না।
– যেতে হবেই! বাবা মা মেনে নিয়েছে এটাই বেশি। বাবার একটা শখ হয়েছে এতে অন্তত আপত্তি করো না। বৃষ্টি…!
মেঘ এখানে থেকেই জোরে বৃষ্টিকে ডাকলো। সাথে সাথে বৃষ্টি দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে এলো।
– ভাবিইইইই! এতো দেড়ি হলো কেন তোমাদের! আমি সেই কখন থেকে বসে আছি! কেমন আছো তুমি?
– আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কেমন আছো?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। চলো চলো।
মেঘ বলে উঠলো,
– এই দাড়া! ব্যাগ নিয়ে যা, তোর ভাবি যেতে পারবে না, পায়ে ব্যাথা!
– এই মিথ্যে কথা, আমার পায়ে ব্যাথা নেই!
বৃষ্টি হিহি করে হেসে বললো,
– ভাইয়া, পায়ে ব্যাথা হলেও হেটে যেতে হবে। বাবা বাসায়!
– ওফ্ফ! বাবা আজ এসময় বাসায়!
– বাড়িতে বউ আসবে দেখবে না! ভাবি চলো।
– এই দাড়া!
মেঘ নাফিসার মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললো,
– এবার নিয়ে যা।
বৃষ্টি হেসে নাফিসাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছে আর মেঘ তাদের পিছু পিছু যাচ্ছে ব্যাগ নিয়ে।
দরজার সামনে এসে বৃষ্টি চেচিয়ে বললো,
– আম্মাজান, বরন ঢালা নিয়ে আসবে নাকি নতুন বউ এমনিতেই প্রবেশ করবে?
নাফিসার ভেতরে ধুকপুকানি বেরেই যাচ্ছে! বারবার ঘুরে ঘুরে মেঘের দিকে তাকাচ্ছে! মেঘের মা গম্ভীর মুখ নিয়ে ছেলের বউকে বরন করে ঘরে তুললো। মেঘ ও নাফিসা দুজনেই বাবা মাকে সালাম করলো। বাবা কিছু সম্মানী দিলো নাফিসার হাতে। বাবার মুখে তো হাসি লেগে আছে কিন্তু মায়ের মুখ এমন গম্ভীর কেন! মেঘ বুঝতে পারছে না সেটা! বৃষ্টিও লক্ষ্য করেছে বিষয়টা! মেঘ বৃষ্টিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, বৃষ্টিও ইশারায় উত্তর দিয়ে দিলো সে জানে না। বাবা রুমে যাওয়ার সম্মতি দিলে বৃষ্টি নাফিসাকে নিয়ে মেঘের রুমে গেলো। মেঘও ব্যাগ নিয়ে রুমে গেলো। বৃষ্টি কথার খই ফুটিয়ে যাচ্ছে। মেঘ তাকে থামিয়ে বললো,
– বাসায় আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেছে তোর বকবকানি! ফ্রেশ হওয়ার সময় তো দিবি!
– সেটা তো দিবোই! তুমি এমন করছো কেন! বিয়ে করে বউ পেয়েছো বলে দাপট দেখাও! তুমি বউ পেলে আমিও কিন্তু ভাবি পেয়েছি! সুতরাং বৃষ্টি হতে সাবধানে থেকো বলে দিলাম! ভাবি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
বৃষ্টি বেরিয়ে যেতেই মেঘ দরজা চাপিয়ে দিলো। শার্ট খুলে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– মেঘা তোয়াল নিয়ে আসো, গোসল করবো।
মেঘ বাথরুমে ঢুকে পড়লো। নাফিসা বিড়বিড় করে বললো,
– হুহ্! নিজের বাসায় ফিরে একেবারে শায়েন শাহ হয়ে গেছে!
ব্যাগ থেকে শার্ট প্যান্ট আর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে বললো,
– ধরুন আপনার জামাকাপড়।
– ভেতরে এসো।
– না, আপনি নিন।
মেঘ দরজা খুলে জামাকাপড় না ধরে হাতে টান দিয়ে নাফিসাকে ভেতরে এনে দরজা লাগিয়ে দিলো।
– এসব কি হচ্ছে!
– কিছুই হয়নি তবে এখন হবে!
মেঘ জামাকাপড় রেখে নাফিসাকে টেনে ঝর্ণার নিচে নিয়ে গেলো। নাফিসা বাধা দিতে বললো,
– মেঘ না!
– ওকে, আমাদের মেয়ের নাম রাখবো মেঘনা!
নাফিসার কথাকে প্যাচাতে পেরে মেঘ হাহা করে হেসে উঠলো! নাফিসার বাধা আর মানলো না, সে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে নিজের সাথে নাফিসাকেও ভিজিয়ে দিলো!
– এটা কি হলো! আমি এখন গোসল করতাম না!
– কিন্তু আমি করাতাম!
– সকালে গোসল করে এসেছি!
– আমিও তো করেছি! সারাদিন জার্নি করে শরীরে ধুলাবালি লেগে আছে না! গোসল করলে ফ্রেশ লাগবে!
– জামাকাপড়ও নিয়ে আসিনি!
– সমস্যা কি! আমার টা পড়ে বের হবে। তুমি দেখছি গোসল করতে এসেও শান্তি দিবে না! আসতে না আসতেই বৃষ্টির বাতাস পেয়ে গেছো! আর একটা কথাও না, এখন আমাদের মাঝে প্রেমালাপ হবে আর গোসল হবে। এর বাইরে কিছুই না!
গোসল শেষে নাফিসা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। এমনিতেই ঠান্ডার দিন, এর মাঝে আবার রাতে ঠান্ডা পানিতে এতোক্ষণ গোসল! শরীর কাপছে তার! মেঘ চেঞ্জ করে বেরিয়ে নাফিসার জামাকাপড় ব্যাগ থেকে বের করে দিয়ে এলো।
রাতে খাওয়ার সময় রায়হান চৌধুরী একটু আধটু কথা বলে নাফিসা সম্পর্কে জানলো। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো নেই। নেই বলতে বুঝে গেছেন দুনিয়াতে নেই। কিন্তু মোহিনী কিছুই বললো না। মেঘ বৃষ্টি কিছুই বুঝতে পারছে না! খাওয়া শেষ হতেই মোহিনী বললো,
– নাফিসা, কিচেনে ঘুরে এসো।
কেন এ কথা বললো, কেউই বুঝলো না! নাফিসা কথামতো কিচেনে ঘুরেফিরে সবটা দেখে নিলো। তারপর বেরিয়ে আসতেই মোহিনী আবার বললো,
– দেখেছো ঠিকমতো?
– জ্বি মা।
– এবার টেবিল থেকে সবকিছু নিয়ে যাও। ঠিকঠাক ভাবে রেখে এসো।
বৃষ্টি বললো,
– মা, ঘরে আসতে না আসতেই ভাবিকে কাজ করতে বলছো! ভাবি তোমার করতে হবে না, আমি করে দিচ্ছি।
মোহিনী চোখ রাঙিয়ে বৃষ্টিকে বললো,
– তোকে বলেছি আমি! বাড়ির বউ কাজে হাত লাগাবে। বাড়িতে আজ এসেছে তো কি হয়েছে! বিয়ে তো আর আজ হয়নি! যাও, রেখে এসো।
– মা..
মেঘ অবাক হয়ে কিছু বলতে নিলে মোহিনী থামিয়ে দিলো।
– একটা কথাও বলবি না কেউ! খুব কথা বলতে শিখে গেছিস মা বাবার উপর!
মেঘ আর কিছু বললো না। মুখটা মলিন করে বসে রইলো। বৃষ্টিও হতম্বর হয়ে তাকিয়ে আছে। আর এদিকে মোহিনী বলার সাথে সাথেই নাফিসা চুপচাপ প্লেট উঠাতে লাগলো। খাবার যা ছিলো সব ঠিকঠাক মতো রেখে বাকি থালাবাটি সব ধুয়ে গুছিয়ে রাখলো। মোহিনী দরজার সামনে দাড়িয়ে সবই দেখছে। নাফিসা কাজ শেষ হলে দরজার কাছে মোহিনীকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– মা এখন কি করবো?
– মেঘের বাবা একটু পর চা খাবে, পানি বসাও।
“মেঘের বাবা” বলাতে নাফিসার একটু খারাপ লাগলো। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। পাতিলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো কোনটা চায়ের পাত্র! সঠিক পাত্রটা নিয়েই পানি বসালো চুলায়। মোহিনীকে জিজ্ঞেস করে চিনির পরিমাণ জেনে নিলো। বাকিটা নিজের ইচ্ছেমতোই করলো। সাথে এলাচি দিয়েছে। মোহিনীকে ও রায়হান চৌধুরীকে চা দিলো। মোহিনী কিছু বললো না কিন্তু রায়হান চৌধুরী অনেক প্রশংসা করলেন। নাফিসা কিচেনে এসে চায়ের পাতিলও ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখলো। আবার ড্রয়িং রুমে আসতেই বৃষ্টি বললো,
– মা, তোমার কাজ শেষ হলে বলো ভাবিকে নিয়ে যাই।
– কোথায় নিয়ে যাবি?
– গল্প করবো।
– কোনো গল্প হবে না। ঘুমা গিয়ে।
নাফিসাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– বাড়ির বউদের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হয়। এটা কি জানা আছে তোমার?
মেঘ সোফায় বসে ছিলো। মায়ের এমন সব কথাবার্তা শুনে সেখান থেকে উঠে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো। বৃষ্টিও তার রুমের দিকে ছুটলো। নাফিসা এখানে দাড়িয়েই মেঘের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মোহিনী তাকে যেতে বললে সে ধীর পায়ে রুমে চলে গেলো। মেঘ জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে।
রাতের বেলা জানালার গ্লাস খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেঘ। নাফিসা দরজা চাপিয়ে পাশে এসে দাড়িয়ে বললো,
– কি দেখছো আকাশে?
মেঘ নাফিসাকে টেনে তার সামনে দাড় করিয়ে বললো,
– তাকাও বাইরে। এবার বলো কি দেখছো?
নাফিসা বাইরে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে বললো,
” দেখেছি নিশী, আর করেছি অনুভব তোমায় সেই নিশীথে!
ছড়িয়েছে কিরন, আর ভূবণ হয়েছে উজ্জ্বল সেই চন্দ্রপ্রদীপে!”
নাফিসার কথা শেষ হতেই মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নাফিসার সাথে আরও আবেশে মিশে বললো,
– মায়ের আচরণে রাগ করেছো?
– উহুম।
– মেঘা, মা মোটেও এমন না। কিন্তু হঠাৎ এমন আচরণ করছে কেন কিছুই বুঝতে পারছি না!
– মায়ের কাজে বাধা দেওয়া তোমার উচিত হয়নি! মা বলতেই পারে। ঘরের কাজ তো মেয়েরাই করে!
– আমি কাজ করতে নিষেধ করিনি। মায়ের কথা একটু অন্যরকম লাগছে তাই কিছু বলতে চেয়েছিলাম।
– মা কিন্তু ভুল বলেনি। মা বাবার উপর কথা না বলাই শ্রেয়। আমরা অনেক কিছু জানলেও মা বাবার চেয়ে বেশি জানি না। আমার মাথায় বিলি কেটে দিবে একটু?
– মাথা ব্যাথা করছে?
– একটু।
– কারণ কি?
– সারাদিন জার্নি করেছি আবার রাতে গোসল!
– খাটে যাও, আমি আসছি।
– কোথায় যাচ্ছো?
– বাসায়ই আছি।
মেঘ বেরিয়ে গেলো, কিন্তু নাফিসা সেই চন্দ্রপ্রদীপের দিকেই তাকিয়ে আছে! যার নিজের কোনো আলো নেই, সেও পৃথিবীকে আলোকিত করে রেখেছে! অন্ধকারেও সে পথিককে পথের সন্ধান দেয়! জ্যোছনা মাখিয়ে শীতল করে রাখে ত্রিভুবন! কার না ভালো লাগে জ্যোছনা? কে না ভালোবাসে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো! কে না চায় শশীর রুপালী আলোতে নিজের রূপের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে! সবই মহান আল্লাহ তায়ালার চমকপ্রদ! সবকিছুতেই সম্পূর্ণ ভিন্ন মাধুর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এই জগৎ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here