উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ৪২

0
2741

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৪২
(নূর নাফিসা)
.
.
এদিকে বৃষ্টি রিকশায় উঠে গেছে নাফিসার সাথে। বাইরে থেকে ঘুরে এসে দুজনেই একটু সতেজ হয়েছে! মনটা ফ্রেশ হয়ে গেছে! বৃষ্টির তো আকাশের মনোভাব দেখে আরও বেশি আনন্দ লাগছে! আকাশ তাহলে তাকে কল করেছিলো নিজ থেকে! তা না হলে তো জানতো না ফোন বন্ধ কি-না! এর আগেও নাকি তার বান্ধবী নিতুর কাছে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো আকাশ! আজ আবার তার সাথেই দেখা! ইগনোর করতে পেরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বৃষ্টি মনে মনে বললো, “ভালোবাসো তবুও অবহেলা করো! খুব তো জ্বালিয়েছো আমাকে, এবার নিজে ফল ভোগ করো মিস্টার আকাশ! আমিও ধরা দিচ্ছি না তোমার কাছে! ফলাফল যা হবার হবে। আমার প্রতি তোমার ফিলিংস থাকলে অবশ্যই তোমাকে পাবো আর না থাকলেও আফসোস করবো না! বরং ভাগ্যকে মেনে নিবো।”
.
গত দুদিন যাবত বাসায় ছিলো না, আজ সন্ধ্যায় ফিরেছে মেঘ। বৃষ্টির সাথে সারাদিন ঘুরে নাফিসার এখন মাথা ব্যথা করছে। মায়ের সাথে রান্নার কাজে হেল্প করেনি আজ সে। গিয়েছিলো কিন্তু মোহিনীই বলেছে বিশ্রাম নিতে। মেঘ রুমে এসে দেখলো নাফিসা চোখের পাতা বন্ধ করে খাটে বসে আছে। মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে মেঘ নাফিসার কাছে গেলো। কপালে উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে নাফিসা চোখ খুলে তাকালো আর মেঘের হাসিমাখা মুখটা দেখতে পেল। মেঘ পাশে বসে বললো,
– কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– তুমি থেকে আবার আপনি হয়ে গেলাম! এভাবে বসে আছো কেন! শরীর খারাপ?
– না।
– ঠান্ডা লাগছে না, শীতের জামা কোথায়!
নাফিসা কিছু বললো না। মেঘকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তাই সে উঠে মেঘের জামাকাপড় আর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে রেখে এলো। নাফিসা আবার খাটে এসে বসছিলো। মেঘ শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
– বেগম কি আমার উপর রেগে আছে?
নাফিসার কোনো উত্তর পেলো না। তাই আবার বললো,
– আর কয়েকটা দিন আমার উপর রাগ জমা করো। পড়ে সব রাগ ভেঙে দিবো।
মেঘ বাথরুমে চলে গেলো। নাফিসার খুব কান্না পাচ্ছে তবুও নিজেকে শক্ত করে রেখেছে! সবার কথাই রহস্যজনক! কেউ তার সাথে সহজভাবে কথা বলছে না! সব কিছুতে একটাই মানে পাচ্ছে, সে মেঘকে আর পাবে না! অন্যকেউ মেঘের ভাগীদার হয়ে গেছে! সে কি মেঘের অযোগ্য! হ্যাঁ, হয়তো! মেঘ তো সব দিক থেকেই তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন একটা ছেলে! তার পাশে নাফিসাকে মানায় না, তার পাশে সেই মারিশাকেই মানায়! মারিশার সচ্ছল পরিবার আছে, মারিশার সামাজিক মর্যাদা আছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে! কিন্তু তার কাছে তো এসব কিছুই নেই! সবকিছুতেই মারিশা থেকে পিছিয়ে সে! তাহলে কিভাবে মেঘের যোগ্য মনে করবে নিজেকে! এটাই নাফিসার ভাবনা!
আরও একটা কঠিন মুহুর্ত যে আজ তার সামনে দাড়িয়েছে! সেটার কি হবে, আর তার জীবনই বা কোন দিকে ধাবিত হবে মাথায় ধরছে না নাফিসার!
মেঘ গোসল করে বেরিয়ে এলে নাফিসা ওযু করার জন্য চলে গেলো। ইশার নামাজ পড়ে নিলো দুজনেই। খাওয়া শেষে নাফিসা নিজের রুমে না গিয়ে বৃষ্টির রুমে চলে এলো। বৃষ্টি ফেসবুকে ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। নাফিসাকে দেখে বললো,
– ভাবি, এসো।
– কি করছো?
– এইতো, ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা! বসো এখানে।
নাফিসা কম্বলের নিচে পা রেখে বসে পড়লো। বৃষ্টি বললো,
– ভাবি, আজকের ফুচকার কমপিটিশনটা কিন্তু খুব মজার ছিলো। আশা করি, খুব শীঘ্রই তোমার সাথে আবার এমন একটা কমপিটিশন হয়ে যাবে।
– আল্লাহ বাচিয়ে রাখুক।
– হুম, ইনশাআল্লাহ। তবে ভাইয়া থাকলে আরও বেশি মজা হতো! আগে ভাইয়ার সাথেও মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হতাম আর এমন কমপিটিশন চলতো। এখন তো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে!
– সবাই কি আর একরকম থাকে! সময়ের সাথে সাথে মানুষের মাঝে অনেক পরিবর্তন আসে বৃষ্টি। কখনো কারো কাছে আমরা খুব প্রিয় থাকি আবার হঠাৎ করেই অপ্রিয় হয়ে যাই! ছোট থাকতে এক অভ্যাস থাকে আমাদের বড় হলে সেটা ভিন্ন রূপ নেয়! সবাই পরিবর্তনশীল, তেমনি তোমার ভাইয়াও পরিবর্তন হয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে!
– হুম, ঠিক বলেছো! তবে আমার পরিবর্তন হতে ইচ্ছে করে না! সবসময় হাসিখুশি জীবনযাপন করতে ইচ্ছে করে তবুও কিভাবে যেনো বিষন্নতা চলে আসে!
– এটা নিয়তির খেলা!
নাফিসা রুমে যাচ্ছে না বিধায় মেঘ বেরিয়ে এলো তাকে খুজতে। প্রথমেই বৃষ্টির রুমে উঁকি দিয়েছে আর সেখানেই পেয়ে গেছে নাফিসাকে! রুমে এসে সে ও কম্বলের নিচে পা রেখে বসে পড়লো। কম্বলের নিচে কয়েকটা পা পেয়েছে তার ঠান্ডা পা সেই পা গুলোর সাথে লাগিয়ে রাখলো। বৃষ্টি ঝটপট নিজের পা সরিয়ে নিয়ে বললো,
– ওফ্ফ! ভাইয়া, আমার গরম পা ঠান্ডা করে দিচ্ছো কেন! এতো ঠান্ডা কেন তোমার পা!
– কোথায়, ঠান্ডা! মেঘা, ঠান্ডা লাগছে?
মেঘের দুষ্টুমিতে নাফিসা কিছু বললো না! বৃষ্টি পা সরিয়ে নিলেও তার পা দুটো সরায়নি নাফিসা। মেঘ কম্বলের নিচে নাফিসার পায়ে দুষ্টুমি চালাচ্ছে। কখনো পায়ে পা নাড়াচ্ছে আবার কখনো চেপে রেখে নিজের পায়ের ঠান্ডা নাফিসার গরম পায়ে দিয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টি বললো,
– ঠান্ডা হলেই বলবে নাকি! নিজের আগে তোমার চিন্তা করে ভাবি।
– আমার বউ। আমার চিন্তা করবে না তো, তোর চিন্তা করবে!
– হুহ্! বউ! কয়দিন বেড়াতে নিয়ে গেছো বউকে? আমার ভাবি, বলেই আজ বেড়াতে নিয়ে গেছি আমি!
বৃষ্টি ব্যঙ্গ করে বললো কথাটা। মেঘ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললো,
– নিয়ে যাবো রে! সময় পাচ্ছি না এখন। কেমন মজা করলি বেড়াতে গিয়ে?
– হুম, মোটামুটি। ইনশাল্লাহ, শীঘ্রই আবার যাবো অন্যকোথাও।
– বেশি দূর যাবি না। যাওয়ার হলে আশেপাশেই যাবি। সাড়ে দশটা বেজে গেছে! মেঘা ঘুমাবে না?
নাফিসা নেমে গেলো বৃষ্টির বিছানা থেকে। খোপা খুলে গিয়েছিলো, আবার খোপা করতে করতে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। মেঘও তার পিছু পিছু চলে গেলো। “বউ আগে তো বর পিছে” এই ভেবে বৃষ্টি মৃদু হাসলো!
নাফিসা রুমে এসে বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়লো। মেঘও কম্বল টেনে নাফিসার উপরসহ ছড়িয়ে দিয়ে নাফিসাকে ঝাপটে ধরে শুয়ে পড়লো। নাফিসাকে তার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
– কি গো? এতো রাগ করেছো! একটুও কথা বলবে না আমার সাথে?
– কি বলবো?
– যা ইচ্ছে বলো।
– মাথা একটু একটু ব্যথা করছে আমার। ঘুমানো দরকার।
– ভ্রমণ করতে পারো না তাহলে যাও কেন, অযথা অসুস্থ হওয়ার জন্য!
মেঘ খালি হাতে মাথায় বিলি কেটে মেসাজ করতে লাগলো। নাফিসা হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
– লাগবে না। এমনিতেই সেড়ে যাবে।
– আচ্ছা তাহলে ঘুমাও। আমারও ঘুম পাচ্ছে!
মেঘ নাফিসাকে আরও কাছে টেনে নাফিসার পায়ে পা লাগালো এবং পেটে হাত রেখে বললো,
– আগের মতো আরাম নেই!
কথাটা শুনে নাফিসার ভেতরে হৃদয় নামক কাচে ফাটল ধরলো! মনে মনে বললো, ” কি করে আরাম লাগবে মেঘ! আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি! তুমি তো নতুন কারো স্বাদ পেয়ে গেছো! আর আরাম পাবে না আমার কাছে! সেই মাধুর্য আমি হারিয়ে ফেলেছি! চিন্তা করো না, আর চেপে থাকবো না তোমার ঘাড়ে!” চোখের দুপাশ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো নাফিসার! মেঘের চোখ তো বন্ধ, দেখবে কিভাবে এই অশ্রু! আরাম যখন পাচ্ছে না এখনো বেধে রেখেছে কেন তাকে! এখনো আদর দিয়ে সুখের সমুদ্রে ভাসাতে চাইছে কেন তাকে! বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে নাফিসা চোখ বন্ধ করে রইলো।
হঠাৎ ভেজা অনুভব করতে পেরে মেঘ চোখ খুলে তাকালো নাফিসার দিকে। চোখে পানি দেখে বললো,
– মেঘা? কাদছো কেন তুমি? এই, কথা বলো! কাদছো কেন?
– সিলেট যাবো কবে?
– আম্মির কথা মনে পড়ছে?
নাফিসা ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। মেঘ চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে বললো,
– আর চারদিন পর আমরা সিলেট যাবো। কোনোমতে আর চারটা দিন এখানে কাটাও। আম্মির সাথে কথা হয়েছে আজ?
– হুম।
– কাদবে না একদম! তোমার চোখে পানি দেখলে আমার ভেতরটায় কষ্ট হয় জানো না তুমি! আর এক ফোটা অশ্রুও যেন না ঝড়ে! ঘুমাও এখানে!
মেঘ তার মাথাটা বুকে জড়িয়ে নিলো।
৪০.
সকালে নাস্তা শেষে প্রতিদিনের মতো মেঘ ও রায়হান চৌধুরী চলে গেলো অফিসে। বাসায় তারা মা মেয়েরা তিনজন। বৃষ্টি নাফিসাকে নিয়ে ছাদে গেলো। কয়েক প্রকার ফুল গাছ আছে এখানে। নাফিসার কাছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে শিউলি ফুল! তার খুব প্রিয়! বৃষ্টি গাছগুলোতে পানি দিলো আর নাফিসা ঘুরে ঘুরে গাছগুলো দেখলো, ফুলগুলো স্পর্শ করলো। অবশেষে দুজন ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে গল্প করলো। বেশ কিছুক্ষণ ছাদে কাটিয়ে তারা নিচে চলে এলো। আজ বিকেলে মেঘ বাসায় ফিরেছে। ছাদ থেকে আনা কাপড়চোপড় ভাজ করে গুছিয়ে রাখছিলো নাফিসা। এমন সময় তার রুমে প্রবেশ করলো মেঘ সাথে মারিশা! মেঘ ও মারিশা দুজনের মুখেই মুচকি হাসি! মারিশা নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছো?
নাফিসা কোন জবাব দিলো না শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো! মেঘ বললো,
– মেঘা, তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে মারিশা!
মেঘের কথা শুনে নাফিসা বললো,
– ভালো।
মারিশা কেমন যেন আহ্লাদী দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকালো আর মেঘ ইশারায় মাথা নাড়িয়ে কিছু নিষেধ করলো। মেঘের ইশারা নাফিসা ধরতে পেরেছে। কিন্তু এর মানে কিছুই বুঝতে পারেনি! তার কাছে এর মানে অনেক কিছুই হতে পারে! মারিশা আবার নাফিসার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। নাফিসাকে খুব মমতায় জড়িয়ে ধরে বললো,
– সবসময়ই এভাবে ভালো থেকো।
ছেড়ে দিয়ে বললো,
– আসি আমি। আসি মেঘ।
মেঘ জবাব দিলো,
– সে কি! আরও কিছুক্ষণ থাকো।
– না মেঘ! আজ আমি এমনিতেই অনেক খুশি, বেশিক্ষণ থাকলে আবার মনকে মানাতে পারবো না! আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।
মারিশা চলে গেলো। মেঘও ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে চলে গেলো। নাফিসা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে এক জায়গাতেই। মারিশার এমন আচরণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না সে! আজ এতো ভালো আচরণ করলো কেন তার সাথে! মেঘই বা তাকে ইশারা করে কি বললো! আজ হঠাৎ মারিশা এতো খুশি কেন! মেঘ কি তার ইচ্ছে পূরণ করে দিয়েছে! শেষ পর্যন্ত তাহলে মেঘকে হারিয়ে ফেললো! মারিশা তার ইচ্ছে পূরণ করেই ছাড়লো! ছিনিয়ে নিলো মেঘকে! না, একটা মেয়ের নিশ্চয়ই পুরুষের চেয়ে বেশি শক্তি নেই! মেঘেরও ইচ্ছে ছিলো! মেঘ চেয়েছিলো বিধায় মারিশা তার ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছে!
নাফিসার বুক ফেটে কান্না আসছে তবুও কাদছে না! নিজেকে নিয়ে নিজেই আশ্চর্য! সে কাদতে ভুলে গেছে! না আছে চোখে অশ্রু আর না আছে মুখে কান্নার আওয়াজ! অতি কষ্টে মানুষ কাদতে ভুলে যায়, আজ তারও সেটাই হয়েছে! কঠিন পাথরের মতো হয়ে গেছে সে!
বিকেল থেকে মেঘের সাথে কথা বলেনি নাফিসা। নিজেকে নানান কাজে ব্যস্ত রেখেছে মেঘ থেকে দূরে থাকার জন্য। মেঘও তেমন নাফিসাকে খুজেনি, কেননা সে নিজেও তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। বাসা থেকে বেরও হয়নি। বাকি সময়টুকু ল্যাপটপ নিয়ে ঘরেই বসে ছিলো। রায়হান চৌধুরী ফিরলে বাবা ছেলে বসে ব্যবসায়ের কাজে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলো।
রাতে ঘুমানোর সময় হলে নাফিসা আগেই শুয়ে পড়েছে। মেঘ তার ঠান্ডা দেহ নাফিসার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে আর বেশি নড়াচড়া করে বিরক্ত করেনি মেঘ। চুপচাপ সে ও ঘুমিয়ে পড়লো।
দু নয়নের পাতা লেগে আছে ঠিকই,
কিন্তু ঘুম যে নেই চোখে!
অবশেষে প্রিয়জন হারানোর বেদনাটা,
অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়লো যে, পাথর ফেটে!
এতো কাছে আছে প্রিয় মানব,
তবুও আজ বহু দূরে দূরে!
আজ আবারও কেটে গেলো পাহাড়ি কন্যার এক নির্ঘুম রাত! পারেনি, পারেনি সে ঘুম ডেকে আনতে নয়ন জোড়ায়! শুধু নিশি কেটে যাওয়ার অপেক্ষায়!
.
ঘুম থেকে উঠে নাফিসাকে রুমে পেলো না মেঘ। রাতে কাজ করে দেড়িতে ঘুমিয়েছে বিধায় দেড়িতে ঘুম ভাঙলো তার। জানালার পর্দা ভেদ করে আলো ছড়িয়ে পড়েছে রুমে। নাফিসা তাকে নামাজ পড়ার জন্যও ডাকলো না কেন! জানালার পর্দাও সরায় নি! আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মেঘ। বাথরুম হতে ফ্রেশ হয়ে এলো। টিশার্ট পড়ে রুম থেকে বের হতেই বৃষ্টির সাথে দেখা। বৃষ্টি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে “ভাবি” বলে ডাকছে। মেঘ বললো,
– রুমে নেই, কিচেনে দেখ।
– আমি তো কিচেন থেকেই এলাম! কিচেনে নেই।
– তাহলে তোর রুমে হতে পারে।
বৃষ্টি তার রুমের দিকে গেলো আর মেঘ কিচেনে এলো মায়ের কাছে।
– মা, বাবা কি বাইরে গেছে?
– হ্যাঁ। নাফিসা ঘুম থেকে উঠেছে?
– হ্যাঁ উঠেছে তো সেই কখনই।
– আজ ঘুম থেকে উঠে দেখলাম না যে, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
– দেখোনি মানে! সে তো বাইরেই ছিলো।
বৃষ্টি এসে বললো,
– কোথায় ভাবি? আমার রুমেও তো নেই!
মেঘ চিন্তিত হয়ে বললো,
– নেই মানে! ভালো করে দেখ।
– ভালো করেই দেখেছি আমি।
মেঘ বেরিয়ে আবার সব রুম গুলো ভালো ভাবে দেখলো। পেল না নাফিসাকে! আবার কিচেনে এসে বললো,
– মা, তুমি কি একবারও দেখোনি ঘুম থেকে উঠে?
– না। আমি তো ভেবেছি ঘুমাচ্ছে।
– কোথায় যাবে তাহলে!
– ছাদে দেখে আয় একবার। হাটতে গিয়েছে কি-না!
মেঘ দৌড়ে ছাদে চলে এলো। না, এখানেও নেই! চিন্তিত হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ খেয়াল হলো, হাতমুখ ধুয়ে চুল ঠিক করার সময় ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা ভাজ করা কাগজ দেখেছিলো! সে দ্রুত তার রুমে এলো। নাফিসার ফোনের নিচে রাখা আছে কাগজটা। হাতে নিয়ে দেখলো একটা চিঠি!
” মেঘ,
বলতে পারো অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমায়। জানো? ছোট থেকে অনেক কিছুতেই বুঝতে আমি প্রথমবার ভুল করে ফেলেছি দ্বিতীয়বার সেটা শুধরে নিয়েছি। ওই যে, ভুল থেকে শিক্ষা হয়! ভালোবাসাটাও প্রথম ছিলো, আজ এটাও বুঝতে ভুল করে ফেলেছি! বরাবরের মতো এটাও শুধরে নিবো। আমাদের অঞ্চলের অনেকেই বলতো, আমার চেহারা নাকি আম্মির মতো অনেকটা। আজ আমি নিজেই মিলিয়ে নিলাম, শুধু চেহারা নয় ভাগ্যও পুরোটাই আমার আম্মির মতো!
তুমি তো জানো সবটা, আম্মির জীবনটাও তো এমনই ছিলো! ভালোবেসেছে একজনকে তাকেই অন্যের জন্য বিসর্জন দিতে হয়েছে! আমাদের মা মেয়ের জীবনে ধোকা জিনিসটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে! বহুবছর আগে আম্মি ধোকার সম্মুখীন হয়েছে আর আজ আমি!
মারিশাকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে কিভাবে! মারিশা তো তোমার পূর্ব পরিচিত ছিলো, তাহলে তুমি আমাকে কেন টানলে তোমার জীবনে? কেন আমার সাদাকালো জীবন রাঙিয়ে দিয়ে আজ আবার পালিয়ে গেলে! কেন ভালোবাসার সাথে পরিচয় করালে আমায়? মারিশার বাবা আছে, সুসজ্জিত পরিবার আছে, সামাজিক মর্যাদা আছে, ধন সম্পদ আছে। সবদিক থেকেই তোমার জন্য উপযুক্ত সে। আমি তো তোমার যোগ্য নই, তাহলে আমাকে শুধু শুধু নিজের জীবনে জড়িয়ে রাখলে কেন! জানিনা, কি পাপ করেছি আমি যার ফলে এতো বড় শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি! আমি এজন্যই কোনো পুরুষলোককে বিশ্বাস করতাম না! চাইনি কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে! হারানোর ভয় হতো সবসময়! কিন্তু তোমাকে পেয়ে আমি সেই ভয়ের কথা ভুলে গিয়েছিলাম! মারিশাকে দেখার পর থেকে সেই ভয়টা আবার হানা দিয়েছে! আর আজ সেটাই ঘটলো! ভালোবাসতে বাধ্য করেছো তুমি। আজ অবহেলাও করলে তুমিই! আমরা পৃথিবীতে বেচে আছি কেন বলতে পারো? সব তো তোমাদের মতো শক্তিশালী মানুষের ইচ্ছাতেই হয়! তাহলে সৃষ্টিকর্তা আমাদের মনে ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন কেন, ভেবে পাই না আমি!
আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে হবে না মারিশার সাথে। আর গোপনে রাত কাটাতে হবে না মারিশার কাছে। অসংখ্য ধন্যবাদ যে, তুমি নিজেই বলে দিয়েছো আমার কাছে আর আগের মতো আরাম পাও না তুমি! কি করে পাবে, এক জিনিস কি আর সবসময় ভালো লাগে! আমি তো আমার মাধুর্য হারিয়ে ফেলেছি! আর পাবে না আগের মতো আরাম, আগের মতো সুখ আমার কাছে আর পাবে না। বাবা মায়েরও তো মারিশাকে খুব পছন্দ। বাসায় নিয়ে এলে সমস্যা কি! আমি থাকায় কি সমস্যা ছিলো? এবার তো আমিও সরে এলাম। তোমাদের পরিপূর্ণ জীবনের কাটা হয়ে থাকতে চাই না। স্বেচ্ছায় সরে এলাম তোমার জীবন থেকে। সুখে থাকো মারিশাকে নিয়ে।
কোনো কষ্ট নেই আমার, ভালো থেকো তুমি। অযথা আমার খোঁজ নিও না। অসহায় ভেবো না আমাকে। আল্লাহ আছে আমার সাথে। গুছিয়ে নিতে পারবো নিজেকে! শক্ত করে ফেলেছি নিজেকে, ধৈর্যশীল হয়ে গেছি, আর সেটা তোমার গুনেই! তোমার এই মোহনীয় গুনের জন্যই হয়তো না চাইতেও প্রেমে পড়ে গেছি! চিন্তা করো না, কাউকে কিছু জানাবো না আমি। কখনো কোনো অধিকার দাবি করবো না তোমার কাছে! সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকো। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি,
রোকসানার মেয়ে নূর নাফিসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here