প্রিয় দিও বিরহ,পর্ব-১
নাঈম হোসেন রোদসী
বধূবরণ শেষে একরাশ বিরক্তি জমিয়ে শেখ বাড়িতে পা রাখে মেহতিশা। এইসব আদিক্ষ্যেতা তার কোনোকালেই পছন্দ ছিলো না। তবুও, বাবার কথা অমান্য করতে না পেরেই বিয়েটা করতে হলো। বিয়ে নিয়ে তেমন একটা আগ্রহও ছিলো না। আর এখনও নেই। বাবার রাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত হতে কখনোই চায়নি মেহতিশা। মারামারি, দঙ্গল, তর্ক বির্তক, সমালোচনা এসব থেকে দশ মাইল দূরে থাকতে পারলে বাঁচে। কিন্তু চাপে পড়ে সেসবেই জড়িয়ে পড়তে হলো ওকে। এমনকি বাবার আদেশে বিয়েটাও করতে হলো। মেহতিশার একবার ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে বলতে, ‘একটা পঙ্গু, প্রতিবন্ধী লোককে আমি মরে গেলেও বিয়ে করবো না, একদমই না! ‘ কিন্তু ঐ যে বাবার কড়া চোখের দিকে তাকিয়ে মেহতিশা প্রতিবারের মতোই ভেজা বেড়াল হয়ে যায়। তবে, মায়ের কাছে বেশ কয়েক বার আহ্লাদী সুরে নাইনুকুর গেয়েছিলো। এর ফলে মা কিছু করতে না পারলেও বাবার সুরক্ষাকর্মীরা নজরদারি আরও বাড়িয়ে ফেলেছিলো। জানালায় রশি বেঁধে একবার গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেও ওর বাবা শামীউল্লাহ জামানের পোষা কুকুরটা গলা খেঁকিয়ে মেহতিশার পথের কাটা হয়ে দাঁড়ালো। পালানো আর হয়নি। তিক্ত মেজাজে তিন কবুলে বিয়ে করে নেয়। কিন্তু মনে মনে দূরছাই করেই যাচ্ছে বিয়েটাকে। মেহতিশা এটাই ভেবে কুলাতে পারছেনা, ওর মতো পাড়া কাঁপানো সুন্দরী, যোগ্যতা সম্পূর্ণ, উচ্চশিক্ষিতা মেয়েকে কেনো বাবা একটা পঙ্গু লোকের সঙ্গে বিয়ে দিলো। বাবার কী টাকার এতোই অভাব ছিলো! তাহলে বললেই পারতো। মেহতিশার চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়ে এক তুড়িতে শত শত যোগ্য পাত্র এসে হাজির হতো। তবুও কেনো! এই কথাটা মনে উঠতেই রাগে খিটমিট করে উঠলো মনমেজাজ। বড়লোক ঘরের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় কিছুটা ইগো নিয়েই বড় হয়েছে মেহতিশা। বড়লোক ঘরের মেয়েরা নাকি সুন্দরী হয়, কিন্তু মেহতিশার মতো সুন্দরী গোটা বংশেও জন্মায়নি।
এই কারণে সব জায়গাতেই একটা আলাদা সম্মান পেয়ে গেছে। কোনো সেমিনারে অংশগ্রহণ করে হেরে গেলে সেই হারও যেনো সুন্দর। পাকা ধানের মতো গায়ের রং আর লং বব করে রাখা কাঁধের একটু নিচ পর্যন্ত মেজেন্ডা কালার করা চুলগুলো কাট কাট মুখের সঙ্গে একশোতে একশো মিলে যায়। এই রূপকে কাচ কলা দেখিয়ে যখন বাবা একটা পঙ্গু লোকের সঙ্গে তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে দিয়ে দিলো, তখন মেহতিশা এটা মেনে নিতে পারলো না। বিয়ের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে সাজানো হয়েছে শেখ মহলকে। মেহতিশার শাশুড়ী লালিমা শেখ হাস্যজ্জ্বল মুখে হাতের গয়না নিয়ে মেহতিশাকে পড়িয়ে দিলো। মেহতিশা গোমড়া মুখে একবার মহিলাটিকে দেখে নেয়। মেদভরা শরীর, গায়ের রং টা কালো। সঙ্গে মুখের আদলটাও মোটামুটি। সব মিলিয়ে সুন্দর বলা যায় না। মেহতিশা মনে মনে ভাবে, ছেলেটাও নিশ্চয়ই নিজের মায়ের মতোনই হবে। ভেবে নিজের কপালকে আরও একবার গালমন্দ করে সে। আহারে! মেহতিশা যখন স্বামীকে নিজের বন্ধু বান্ধবের সামনে দাঁড় করাবে তারা তো ঠাট্টা করে বলবে,
‘এতকাল শত শত ছেলে রিজেক্ট করে শেষে কিনা এই পেটমোটা কালো লোককে বিয়ে করলি! ‘ আর ভাবতে পারেনা মেহতিশা। মাথা ঘুরিয়ে উঠলো ওর। মেহতিশা হাত দিয়ে সোফার হাতলটা ধরে দাঁড়ালো। ব্যাপারটা লালিমা শেখ খেয়াল করতেই অস্থির হয়ে মেহতিশাকে ধরে বললেন,
‘ইশ! দেখেছো মেয়েটা দুর্বল হয়ে গেছে। চলো মা, তোমাকে ঘরে দিয়ে আসি। দর্পণ মনে হয় এতক্ষণে খেয়ে নিয়েছে। এসো এসো। ‘
মেহতিশা বুঝতে পারে তার স্বামীর নাম দর্পণ । নামটা শুনেই গা খিটমিট করলো সে৷ লালিমা শেখ স্নেহশীল দৃষ্টির সহিত কথা বলতে বলতে পেঁচানো সিঁড়িটা বেয়ে একটা অদ্ভুত ঘরের সামনে তাঁকে নিয়ে আসলো। মেহতিশা ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকালো। রুমের বাহিরে একটা বিশাল আয়না লাগানো। কী অদ্ভুত! এমন ঘর জীবনেও দেখেনি সে। দরজার উপরের দিকে একটা আর্ট করা। সম্ভবত আয়নার মতো ডিজাইন । সেখানে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,
‘আরশিজগতে স্বাগতম। আরশির রহস্য ভেদ করতে এসো না, নিজেই রহস্যে তলিয়ে যাবে। ‘
চলবে-