“প্রিয় দিও বিরহ,১৫,১৬
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।
১৫.
ভাতের শেষ লোকমাটা নিশিতার মুখে তুলে দিয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। নিশিতা বাচ্চাদের মতো পানিটুকু পান করে বলে,
‘তুমি খুব ভালো, আর অনেক সুন্দরও। ‘
মেহতিশা কথা শুনে মৃদু হাসে। এ বাড়িতে আসার পর নিশিতা মেয়েটাকে ওর অস্বাভাবিক মনে হতো। প্রথম প্রথম এই ঘরের আশেপাশে আসতেও লাগতো প্রচুর ভয়। যতসম্ভব দূরেই থাকতো সে। তবে, কাল থেকে মেহতিশার বারবার মনে হচ্ছিল যদি কোনোভাবে নিশিতার সঙ্গে একটু কথা বলা যায় তাহলে হয়তো কিঞ্চিৎ পরিমাণ রহস্য ভেদ করতে সক্ষম হবে৷ তারপরই সকালে একবার এই ঘরে এসেছিলো। ওকে দেখে নিশিতা তেড়েফুঁড়ে এসেছিলো মারতে। যেই মেহতিশা হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিলো অমনি নিশিত হেঁসে উঠলো। চকলেটের প্যাকেটটা খুলে খাওয়া শুরু করলো। মেহতিশার মায়া লাগলো দেখে।
মেয়েটাকে দেখে ক্ষুধার্ত লাগছে। হয়তো কিছু খেতে দেয়া হয়নি তাকে। মেহতিশা খেয়াল করেছে লালিমা নিশিতাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। যেনো বাধ্য হয়ে মেয়েটাকে আঁটকে রাখছে। বাঁচল কী মরলো কিছুই যায় আসে না। মেহতিশা রান্না ঘরে ঢুকে একটা প্লেটে ভাত, সবজি, আর মাছ নিয়ে আসে। মেখে খানিকটা নিশিতার মুখের সামনে ধরতেই নিশিতা গপগপ করে খেয়ে নেয়। এক বসায় সম্পূর্ণ ভাতটাই খায় নিশিতা। মেহতিশা প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে নিশিতার পাশে বসে। নিশিতা আপনমনে পড়নের শাড়ির আঁচল টেনে খেলা করছে। মেহতিশা হাসিমুখে বলে,
‘আপু, আপনি অসুস্থ কতদিন ধরে? ‘
নিশিতা মুখটা অবুঝের মতো করে বলল,
‘আমি অসুস্থ না তো!
মেহতিশা মনে মনে নিজেকেই বকে। মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ কী কখনো নিজেকে অসুস্থ স্বীকার করে! সে কিনা বোকার মতো জিজ্ঞেস করছে।
মেহতিশার হাত ঝাকিয়ে নিশিতা ঠোঁট উল্টে বলে,
‘শোনো শোনো, আমি অসুস্থ না তো। আমি রাগ করেছি। ‘
মেহতিশা মাথা নাড়িয়ে তাল মেলায়। যেনো কোনো ছোট বাচ্চাকে প্রসন্ন করার প্রয়াস। নিশিতা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘বুঝেছো, আমি রাগ করেছি অনেক রাগ। তাই তো বারবার রেগে যাচ্ছি। ‘
‘আচ্ছা! ‘
‘হ্যা..তাইতো। ‘
‘কিন্তু, কীসের জন্য এতো রেগে আছো আপু?’
নিশিতা চুপ করে থাকে ৷ হাতটা কয়েকবার মোচড়ামুচড়ি করে টলটলে চোখে তাকায়। মেহতিশা ভড়কে গেলো। সে নিশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘কী হলো আপু?তুমি কাঁদছো কেনো?’
‘আমি তো রোজ কাঁদি, আরও কাঁদবো! খুব খুব কাঁদবো!’
‘কেনো কাঁদবে! ‘
নিশিতা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে দাঁড়ায়। ছন্নছাড়া পায়ে বালিশের নিচ থেকে ফটো ফ্রেমটা বের করে। মেহতিশা কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। নিশিতা ছবিটা এনে মেহতিশার সামনে ধরে। মেহতিশা ছবিটায় দৃষ্টিপাত করে। ছবিতে সুদর্শন যুবকটিকে দেখে বুঝতে পারে এটা বুঝি দর্পণের বড় ভাই অর্পণ। যে কিনা নিশিতার স্বামী। পাশ দিয়ে কম বয়সী একটা মায়াবী মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চমকায় মেহতিশা। ছবিটায় নিশিতাও আছে। কী অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে একসাথে! অথচ এখন নিশিতার দিকে তাকালে একসমুদ্র বিষাদ ঝলমল করে ওঠে। চোখের নিচটায় কালসিটে আস্তরণ। মুখটা শুকনো৷ দুই একটা ব্রণ। ছবিতে যেখানে কোমড় জড়িয়ে আছে দীর্ঘ কেশরাশি। সেখানে এখন কাঁধটাও পাড় করছে বহু টেনেটুনে। কী উষ্কখুষ্ক লাগছে। বহুদিন অবহেলার ছাপ শরীরে। অথচ, ঘরটা! কোনো এক সময় হয়তো একটা স্বপ্নপুরী ছিলো। দুজন ভালোবাসার মানুষের হাতে বোনা স্বপ্ন গুলো এখনো দেয়াল জুড়ে আছে। হাতে বানানো কালারিং প্রজাপতি, কাগজের নকশা,রোমাঞ্চকর ওয়াল পেইন্টিং সহ আরও অনেক কিছু। বারান্দার দিকে তাকালেও বোঝা যাবে সেখানেও অসংখ্য অমলিন স্মৃতিরা ঘুরে বেরায়।
মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিশিতা তখন ছবিটার দিকে তাকিয়ে অশ্রুপাত করছে। মেহতিশা কিছু বলার আগেই নিশিতা বললো,
‘তুমিই বলো, সবাই বলে ও আর নাকি আসবে না। কিন্তু ও আমার হাত ছুঁয়ে বলেছে ও আসবে। আমাকে কখনো ছাড়বেনা। ‘
মেহতিশা একবার বলে উঠছিলো, তুমি এতো ভালোবাসো যাকে সে আবার আসবে, তাঁকে তো তোমার টানে আসতেই হবে! কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো মৃতরা কখনো ফিরেনা। মিথ্যা আশ্বাস কীভাবে দেবে সে! মেহতিশা মলিন মুখে বলে,
‘সে আর আসবেনা আপু, আপনি অপেক্ষা করা ছেড়ে দিন৷ ‘
নিশিতা ফুঁসে ওঠে। মেহতিশার দিকে চিৎকার দিয়ে বলে,
‘বেরিয়ে যাও তুমি! এক্ষুনি বেরিয়ে যাও! আর কখনো আমার সামনে আসবেনা। তুমিও খারাপ! সবাই খারাপ। ‘
মেহতিশা চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নিশিতা দৌড়ে খট করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। দরজার পাশেই ধপ করে ছবিটা নিয়ে বুকে চেপে বসে।
সে পাগল হলেও ভালোবাসা বোঝে। সে সব বোঝে। শুধু প্রিয় মানুষের মৃত্যুই বুঝতে পারেনা। নাকি বুঝেও মানতে চায়না, কে জানে! নিশিতা আকাশের কালো মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে নির্নিমেষ অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,
‘আমি তোমার অপেক্ষা করবো প্রিয়, শেষ নিঃশ্বাস অব্দি অপেক্ষা করবো। তুমি এসো, তোমার না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। ‘
–
আকাশে তখন অবাধ্য মেঘের গর্জন। রাতের আকাশে থমকে থমকে গর্জে উঠছে। একে নাকি বলা হয় শীত নামানো বৃষ্টি।
তীব্র বৃষ্টির ছিটা এসে ঢুকে যাচ্ছে ঘরের জানালা ভেদ করে। অকর্মণ্যতায় ঝিমাচ্ছে মেহতিশা। নিশিতার কাছ থেকে আসার পর মন খারাপ করে কতক্ষণ এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করলো। সকাল থেকেই আজ রিনিঝিনি বৃষ্টি। দর্পণ অফিসের ফাইলপত্র ঘাঁটছে।
মেহতিশা সেদিকে খানিকক্ষণ তাকায়। মিনমিন করে বলে,
‘শুনছেন?’
‘……..’
‘এই শুনুন না!’
দর্পণ হাতের কলমটা সাইডে রেখে তাকায়। মেহতিশা দেখে দর্পণের চোখে কালো ফ্রেমের চশমাটা বড্ড মানিয়েছে। লোকটাকে সব কিছুতেই মানায়। এই যে এতক্ষণ গম্ভীর চোখমুখে ফাইলের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কীসব ভাবছিলো তখন তাকে মেহতিশার তুর্কী নায়ক বুরাক ডেনিযের মতো লাগছিলো। এখন আবার যেই মুখটা গম্ভীর থেকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো তৎক্ষনাৎ চোখমুখ ফিরে পেলো তার আসল সত্ত্বা। লোকটা সম্পূর্ণটাই রহস্যে ভরপুর। যাই হোক, মেহতিশা ভালোবাসে এখন এই লোকটাকে। আত্মা দিয়ে ভালোবাসে। এক পৃথিবী সমান ভালোবাসে। সরল স্বীকারোক্তি মনে মনে। বাহিরটা নিরুত্তাপ। মেহতিশাকে অন্য রকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে, দর্পণ কপালে ভাজ এনে বলল,
‘কী বউজান?তাকিয়ে থাকার জন্যই কী ডাকলেন?’
মেহতিশা ভড়কায়। তবে লজ্জা পায়না। কারণ ততোদিনে তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা কতখানি এগিয়েছে তা বলার বাকি রাখেনা। মেহতিশা সোফা থেকে উঠে এলো। দর্পণ খাটের পাশটায় আধশোয়া হয়েছিলো। তাকে চমকে দিয়ে মেহতিশা দর্পণের হাত থেকে ল্যাপটপ সহ বাকি কাগজপত্র সরিয়ে জগাখিচুরি বানিয়ে সেসবের জায়গা দখল করে আদুরে ভঙ্গিতে বসে দর্পণের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। অশান্ত মনের শান্তি প্রয়োজন। দর্পণ হাসলো। কিছু বললো না। মেহতিশা চোখ বুজে শুয়ে রইলো। বাহির থেকে বৃষ্টির ছিটা এসে গায়ে লাগছে। ঘরের বাতিগুলো সব নিভানো। বাহিরের থেকে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ ঘরকে স্বর্গের ন্যায় অনুভূত করাচ্ছে। দর্পণের মধ্যেকার সুপ্ত পুরুষ সত্ত্বা তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে। অতি নিকটে শায়িত সুদর্শনা নারীটি তাকে পোড়াচ্ছে।
রমনীটির পিঠ এলিয়ে থাকা রেশমী চুলগুলো আছড়ে আছে খাটে। বুকের উপর থেকে শাড়ি অনেকটাই সরে আছে। দৃশ্যমান হয়েছে ফর্সা কাঁধ, গলা। হাঁটুর কাছাকাছিতে এসে গেছে শাড়ির নিম্নাংশ। ফর্সা গোলাপি পা যুগল বেরিয়ে আছে। দর্পণ অভিমানী সুরে বলে,
‘বউজান, আমার হিংসে হচ্ছে। ‘
মেহতিশা চোখ খুলে বলে,
‘কাকে হিংসে হচ্ছে?’
‘বৃষ্টিকে। ‘
‘মানে?’
মেহতিশা ভ্রু কুচকে থাকে। দর্পণ মেহতিশার কপালে অঁধর ছোঁয়ায়। আদুরে কন্ঠে বলে,
‘এই যে, দেখুন বৃষ্টিগুলো আপনাকে কীভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে! আমার রাগ হচ্ছে বউজান। ভীষণ রাগ হচ্ছে। বৃষ্টিরা খুব দুষ্ট। ওরা যাচ্ছে না কেনো! ‘
দর্পণের বলার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেঁসে ফেলে মেহতিশা। আলতো হাতে ধাক্কা বসিয়ে দেয় দর্পণের কাঁধে। দর্পণের মোহাচ্ছন্নতা কাটে না। সে এগিয়ে আসে মেহতিশার মুখ বরাবর। দর্পণের উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাস এসে তার মুখ স্পর্শ করতেই শিউরে ওঠে মেহতিশা। দর্পণের অবাধ্য ঠোঁট মেহতিশার সারা মুখ, গলদেশ ছুঁয়ে দেয়। নাক ঘষে মেহতিশা কাঁধে। মেহতিশা খেয়াল করে এতো ঠান্ডা পরিবেশ থাকার পরও সে ঘামছে। দরদর করে ঘামছে। দর্পণকে সরিয়ে সে উঠে যেতে চাইলো। দর্পণ মুচকি হেসে তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলো। ঘোর লাগানো গলায় বলল,
‘বৃষ্টির মতো আমিও আপনাকে ছুঁয়ে দিতে চাই। ‘
মেহতিশা উপেক্ষা করে চলে যেতে পারেনা। সে নেশাগ্রস্তের মতো কাছে চলে আসে। কেঁপে কেঁপে সে দর্পণের পড়নের পাঞ্জাবিটা খামচে ধরে। দর্পণের পুরুষালি হাতজোড়া পেচিয়ে রাখে মেহতিশার সর্বাঙ্গ। মেহতিশাও মত্ত হয়ে পড়ে মুহুর্তেই। অথচ,এমনটা করার অনুমতি তার নেই। তাকে ধরে বেঁধে দেয়া হয়েছে কিছু কঠোর নিষেধাজ্ঞা। সে নিষেধাজ্ঞা ভাঙলেই ধেয়ে আসবে ঘোর বিপদ। তবুও, মেহতিশা ভুলে বসে সব কিছু। যদিও অনেকটা সময় পর মেহতিশার কানে বাজে বাবার কথাগুলো, দর্পণকে ভুলেও নিজের কাছে আসতে দেয়া যাবে না। ভালোবাসাও যাবেনা। করা যাবে না কোনো স্বীগারোক্তি। বাঁধ ভেঙে ফেলে মেহতিশা। হার মানে ভালোবাসার মানুষের কাছে। এমনকি একসময় আওড়েও ফেলে,
‘ভালোবাসি দর্পণ সাহেব। আপনার আরশীজালে আমি বাজে ভাবে ফেঁসে গেছি। ‘
কেটে যেতে থাকে একটা অন্যরকম রাত্রি। দর্পণের ঘুমন্ত মুখমণ্ডল তখন মেহতিশার গলায় মুখ গুঁজে রাখা। সে যেনো কতকাল নিদ্রাহীন থেকেছে। মেহতিশা তখন আধোঘুম আধোজাগ্রত। সময়টা তখন মাঝরাত। কোথায় যেন গান বাজছে। দূর থেকে ভেসে আসছে মনমোহিনী বিষাদমাখা সুর,
তারে আমি দূর হতে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব।
তারে আমি দূর হতে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব…
চলবে-
লেখিকা -নাঈমা হোসেন রোদসী।
“প্রিয় দিও বিরহ ”
১৬.
সুখময় প্রেমে অঢেল বর্ষণে মাখো মাখো সময় তখন।
সবটাই যেনো স্বপ্নের মতো সুন্দর। ভয়ঙ্কর সুন্দর। এ যেনো ছোটবেলার ফেইরিটেইলের রূপকথার গল্প। যেখানে রঙ বেরঙের লাল-নীল পরীরা জাদুর কাঠি দিয়ে দুঃখ কষ্ট মুছে দেয়। ছোঁয়া দিয়ে সুখের পরশ ছড়ায়।
দিনের শুরুটা হয় ভালোবাসার চুম্বনে ও শেষ প্রহরের
সমাপ্তি হয় অজস্র সুন্দর মুহুর্তে। কখনো বারান্দায় বসে তো আবার কখনো চন্দ্রবিলাস করে। সংসারের মধ্যমণি এখন মেহতিশা। দর্পণের বাবা,মা,নিশিতা তারা মেহতিশা বলতে পাগল। এমনকি দিয়াও এখন তেমন অপছন্দ করেনা তাকে। মেহতিশার সঙ্গে সময় পেলেই গল্পের আসর জমায়। মেহতিশার দিনগুলো হাসিখুশি ভাবেই কাটছে। যে বাড়িটা ও বাড়ির মানুষ গুলোকে সহ্য হতো না। লাগতো অসহ্যকর। এখন তাদেরই দিনদিন আপন মনে হয়। আগে যাদেরকে নিয়ে দুদন্ড মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেনি। এখন তাদের সঙ্গেই আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
কষ্টটা শুধু একজায়গায়ই। দর্পণের পা দুটো। সব সুখ গুলো ফিকে পড়ে যায় দর্পণের অসুস্থার নিকট। মেহতিশার বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে নিজের ভাগ্যল৷ কে দোষারোপ, হাহুতাশ করতো এই ভেবে যে একটা পঙ্গু লোকের সঙ্গে কীভাবে সারাজীবন কাটাবে সে! কিন্তু এখন সেই ভাবনা আর আসেনা। এখন মনে মনে কষ্ট হয় দর্পণের কষ্টে। প্রার্থনা করে, মানুষটা যেনো সুস্থ হয়ে ওঠে। সেই দিনটা হবে মেহতিশার কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। যখন আর পাঁচটা মানুষের মতো দর্পণও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। ইচ্ছে মতো চলাচল করতে পারবে। এইজন্য মেহতিশা চিন্তা করলো, সে নিজেই এর দায়িত্ব নিবে ৷ এসব ভেবে ঘরে বসে মেহতিশা মোবাইলটা হাতে নিলো। কল করলো নিজের মামাতো ভাই মহসিনকে। যে কিনা কয়েকদিন আগেই লন্ডন থেকে এমবিবিএস করে এসেছে। এখন বেশ ভালো একটা হসপিটালের ডক্টর। মেহতিশা কল করলো তাকে। রিসিভ হতেই ওপার থেকে ভেসে এলো –
‘হেলো, বল মেহতিশা। কেমন আছিস?’
মেহতিশা মুচকি হেসে বললো,
‘ভালো আছি ব্রো। তুমি কেমন আছো? ‘
‘এই তো বেশ। ভাইকে তো ভুলেই গেছিস। ‘
‘আমি ভুলে গেছি! তুমি তো ব্যস্ত মানুষ। তোমার সাথে কথা বলতে এখন টিকিট কাটতে হয়। মোটা অঙ্কের ফিস না দিলে তোমার দেখা পাওয়া মুশকিল! ‘
‘হাহাহা, তুই আগের মতোই রয়ে গেলি। কথায় কথায় বমের মতো রেগে যাস৷ এমনিই কী আর সৌজন্যে তোকে চকলেট বম নাম দিয়েছিলো! ‘
হাসতে নিয়েও থেমে গেলো মেহতিশা। ওপাশ থেকে মহসিনও বুঝতে পারলো। সে বললো,
‘হ্যারে মেহতিশা, তুই তো পারতি সৌজন্যেকে একটা সুযোগ দিতে! ‘
মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
‘তুমি এই কথা বলছো কীভাবে !’
‘দেখ, সৌজন্যে তোকে কতটা ভালোবাসতো তা আমাদের কারোই অজানা নয়। ছোট্ট বেলা থেকে ছেলেটা তোকে না দেখলে পাগলের মতো করতো। আর তোরও যে ওকে অপছন্দ ছিলো, বলতে পারবি কখনো? ‘
‘অস্বীকার করবো না, সৌজন্যকে প্রথমে আমি শুধু মাত্র ভাইয়ের নজরে দেখলেও, ও যখন বিদেশ থেকে এলো তখন আমারও কিছু একটা ফিল হয়েছিলো। কিন্তু সেসবে আমি পাত্তা দেইনি। প্রথমত সৌজন্যে আমার চেয়ে বয়সে ছোট। তারপর.. ‘
‘তুই এখনো নিজেকে অনাথ ভাবিস!’
মেহতিশার চোখ টলমল করে। সে হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে,
‘যতই হোক, আমি তো অনাথই। যদি নিঃসন্তান দম্পতি শামীউল্লাহ জামান আর আপন খালা ফেরদৌসি জামান আমাকে মা বাবা মারা যাওয়ার পর সেই বাড়ি না নিয়ে যেতেন তাহলে কী এই মেহতিশা বেঁচে থাকতো! ‘
গলা ভেঙে যায় মেহতিশার। নিজের আসল পরিচয় ভিন্ন। ফেরদৌসির বড় বোন শাওমির একমাত্র মেয়ে মেহতিশা। মেহতিশার জন্মদাতা পিতা মাঈনুল হোসেন বড় একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তখন মেহতিশার এক বছর, তিনি একদল সন্ত্রাসীকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তারই ক্ষোভে একরাতে মেহতিশার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসীগুলো। মেহতিশাকে সেখানে থেকে উদ্ধার করে বাড়ির দারোয়ান। ফেরদৌসি বন্ধ্যা। আর শামীউল্লাহ জামানেরও কিছু সমস্যা আছে তাই দুজনই পরবর্তীতে মেহতিশাকে নিজের সন্তানের পরিচয় দিয়ে বড় করে তোলেন।
পুরনো কথা মনে পড়ে মেহতিশার। সে তো ছোট ছিলো তাই কিছুই তার মনে নেই। সবটা কিশোরী বয়সে থাকতে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাদী আর বড় চাচীর আলাপ করার সময় সে জেনে যায়। পরে কান্না করার জন্য সবাই তাকে এসব মজা করে বলেছে বলে সান্ত্বনা দিলেও, সত্যিটা বোঝার ক্ষমতা ছিলো মেহতিশার।
ফোনের ওপাশ থেকে মহসিন উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
‘মেহতিশা, তুই কী পারতি না সৌজন্যেকে বলে একসাথে পালিয়ে আসতে। আমি নিজেই তোদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে রাখতাম। তুই তো কখনো নিজের উপর অন্য কারো মত মানিস না। তুই যদি রাজি না হতি, রাগ দেখিয়ে চলে যেতি তাহলে কী পারতো কেউ তোকে বিয়ে দিতে? ‘
মেহতিশা ভাঙা গলায় বললো,
‘আমি চাইলেই পারতাম বাবার মুখের সামনে না করে চলে যেতে। কিন্তু আমি ওই পরিবারটার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। ছোটবেলায় বাবা যদি আমাকে নিজের পরিচয় দিয়ে লালন পালন না করতেন আমি মরে যেতাম হয়তো। ‘
মহসিন কথা আর বাড়ালো না। সে নিরস গলায় বললো,
‘আচ্ছা। বাদ দে। আর বল হঠাৎ আজ কী মনে করে কল দিলি? ‘
‘ওহ হো! আমি ভুলেই গেছি। তুমি তো জানোই দর্পণের পায়ের অবস্থা কী। তুমি তো অনেক ভালো ডক্টর। কী ধরনের ট্রিটমেন্ট নিলে দ্রুত সেরে উঠবে তা বলো। ‘
‘হুম, আচ্ছা শোন। আমি আগে রিপোর্ট দেখবো। তুই কালকে আমার কাছে আসবি, রিপোর্ট দেখে আমি ঔষধ দেবো। ‘
‘ঠিক আছে ভাইয়া, রাখছি তাহলে। কালকে আসবো আমি। ‘
–
তারপর দিনই রিপোর্ট দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে আসে মেহতিশা। দর্পণকে নিজ হাতে ঔষধ খাওয়ায়। এবার সেও দেখবে কীভাবে দর্পণ সুস্থ না হয়!
দুপুরের খাবারটা রান্না করে মেহতিশা তখন টেবিলে সাজাচ্ছে। দিয়া বসে মোবাইল টিপছিলো। লালিমা শেখ ফল কাটছিলেন। আর দর্পণ অফিসের ম্যানেজারকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। সারাক্ষণ বাসায় থাকলেও দর্পণ কাজের দিকে সম্পূর্ণ নজর রাখে। পাই টু পাই হিসাব দিতে হয় প্রতিটি কর্মচারীকে।
অনলাইনে প্রেজেন্ট নেয় শিক্ষকের মতো সে। সিসি টিভি ক্যামেরায় নজর রাখে চারজন কর্মকর্তা। অতএব, কাজ থেকে অব্যাহতি নেই কারো। দর্পণ তখন গম্ভীর অভিব্যাক্তিতে কথা বলছে। চমকে উঠলো ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভেঙে যাওয়ার। সবাই বিস্মিত চোখে তাকালো সেদিকে। কাঁচের প্লেটটা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর পাশেই অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে মেহতিশা। দর্পণ নিজে উঠতে না পারায় লালিমা আর দিয়াকে বললো ওঠাতে। মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে তার চিন্তায়। তড়িঘড়ি করে ওঠানো হলো মেহতিশাকে। আধা ঘণ্টার ভেতরেই ডক্টর এসে হাজির হলো। কিছু টেস্ট করে উনি মুচকি হেসে দর্পণের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘শুভেচ্ছা! বাবা হচ্ছেন আপনি। প্রাথমিক টেস্টে তাই বোঝা যাচ্ছে। আপনারা আরেকবার হসপিটালে গিয়ে টেস্ট করিয়ে নিবেন। ‘
দর্পণের অভিব্যাক্তি বোঝা গেলো না৷ লালিমা খুশিতে অজ্ঞান মেহতিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দিয়াও খুশি হলো খুব। ওরা ভাবলো দর্পণ হয়তো মেহতিশাকে একা চাচ্ছে। তাই দরজা বন্ধ করে ওরা বেরিয়ে গেলো।
ওরা বের হওয়ার পর দর্পণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেহতিশার দিকে তাকালো। মুখে ফুটে উঠলো বক্র হাসি। সে নিজের হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। একটা লাথি মেরে হুইলচেয়ারটা সরালো। স্বাভাবিক পায়ে হেঁটে বিছানায় বসলো, মেহতিশার কপালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। পাশেই টেবিলের উপর রাখা ঔষধের পাতা গুলো ছুঁড়ে মারলো জানালা দিয়ে। মুচকি হেসে বললো,
‘বউজান, প্রসঙ্গ যখন আপনি তখন ভীষণ স্বার্থপর আমি।’
চলবে-